এখানে দিন বেশ দীর্ঘ এখন—ফলে সন্ধ্যে সাতটার সময়েও ঘরে থাবা মেরে পড়ে থাকে রোদ। তাই প্রায় প্রতিদিনই বাড়ী ফিরে আহারান্তে চায়ের পেয়ালাটি নিয়ে বারান্দায় যাই। পূর্বী নদীর সামনের বারান্দাটিতে কাঁচ-ঢাকা টেবিলটির একদিকের সবুজ চেয়ারটিতে বসি। টেবিলটির কাঁচে পেঁজা তুলোর মত মেঘের ছবি, মুখোমুখি নীলচে শূন্য চেয়ারটিতে চুপ করে থাকে ছায়া—
যেন ‘এলায়ে পড়েছে ছবি’।
পূর্বী নদীর দিকে তাকাই—ভাঁটার স্রোত বয়ে যাচ্ছে জোরে। নদীতে আকাশের নীল ছায়া। কত নৌকো জলে—কোনটা বড়, কোনটা ছোট; কোনটা যন্ত্রচালিত, কোনটা পাল-তোলা; কোনটায় লোক দেখা যায়, কোনটায় কাউকে দেখি না। নদীর জল চিরে চলে তারা সবাই—কখনও ঢিমেতালে, কখনও দ্রুত লয়ে।
নদীর এ পাড়ে আমাদের দ্বীপে নদীর ধারে বেঞ্চগুলোতে বসে থাকে কতজন— কিশোর-কিশোরীরা, যুবক-যুবকীরা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। বোঝা যায়, কথা হচ্ছে, গল্পে মেতেছে অনেকে, উচ্চকিত হাসির আওয়াজ আসে কখনো-সখনো।
ছ’ তলায় আমাদের বারান্দার সামনের মাঠের ফালির প্রান্তসীমায় দুটো ম্যাপেল গাছ বড় হয়ে নদীকে ঢেকে দিয়েছে কিছুটা। সেই গাছের মগডালে পাখির বাসা চোখে পড়ে। শনৈ শনৈ বেড়ে উঠেছে গাছ দু’টো। তাকালে মনে হয়, যেন বলছে, ‘কি ভালো আছো তো’?
নদীর পাড়ের পথ দিয়ে কত লোক হেঁটে যায়— একা, দু’জন, বহুজন। নবীন মা-বাবারা শিশু-বাহন ঠেলে নিয়ে যান এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বাহনটি শিশুশূন্য, শিশুটি নেমে পড়েছে বহু আগে। শিশুদের কল-কাকলি কানে ভেসে আসে। চিনি অনেককেই। ২৫ বছর আগে যাঁদের শিশু-কিশোর হিসেবে দেখেছিলাম, তাঁরাও মা-বাবা হয়েছেন। ওপরের দিকে তাকিয়ে অনেকেই হাত নাড়েন, হাসেন— আমিও হাত নাড়ি, হাসি ফিরিয়ে দেই।
নদীর ওপাড়ে ম্যানহ্যাটেনের সুউচ্চ হর্ম্যরাজির ফাঁক দিয়ে ‘কনে দেখা রোদ’ এসে পড়ে বারান্দায়, শার্সিতে, টেবিলটার ওপরে। ডিমের হাল্কা কুসুমের মত নরম হলদেটে রোদ–তার মৃদু উত্তাপ পাই। ভালো লাগে। ওপারের দালানগুলোর কাঁচে বিকেলের পড়ন্ত রোদ জ্বলতে থাকে অন্ধকারে বেড়ালের চোখের মতো।
আকাশের দিকে তাকাই। মনে হয় সারা আকাশে আগুন লেগে গেছে— ‘নামে সন্ধ্যা তন্দ্রালসা, সোনার আঁচল খসা’। মেঘের রঙের সঙ্গে রোদ গুলে কতরকম যে রং ধরে
মেঘমালা—কোনটা আগুন রঙা, কোনটা গোলাপি, কোনটা হলদেটে, কোনটা ধূসর–লালে মাখামাখি। কখনও কখনও মেঘমালারা কাছে এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ভালবাসায়, কখনো কখনো তারা অভিমানে দূরে সরে যায়। কখনো কখনো দেখি, মেঘমালার মাঝ দিয়ে একটা জানালা তৈরী হয়েছে–তার ফাঁক দিয়ে তাকাই, কিছু একটা দেখার চেষ্টা করি। কি, তা নিজেও জানি না।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামে। মেঘের অতো রং কে যেন রবার ঘষে তুলে ফেলে নরম হাতে। ম্যানহ্যাটেনের বাতি জ্বলতে শুরু করে। জ্বলে ওঠে আমাদের নদী–পাড়ের সোজা দাঁড়িয়ে থাকা বাতিস্তম্ভের আলোগুলোও। টের পাই লোকজন ফিরতে শুরু করেছে গৃহপানে। মনে পড়ে যায় সেই চরণটি—
‘যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্হরে’।
কালো বেড়ালের মতো ছায়া ছায়া আঁধার নেমে আসতে থাকে অতি ধীরে। সেই ধূসর আবছায়ায় তৈরী হয় কোন এক অজানা রহস্য। ঠিক সে সময়েই এক ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে’। সেই আধো-আঁধারে টের পাই ছায়া ছায়া কে একজন হাল্কা পায়ে বারান্দায় আসলো। বসল আমার মুখোমুখি টেবিলের উল্টো দিকের নীলচে চেয়ারটাতে— ওটাই তার জায়গা ছিল। তাকাল আমার দিকে, মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার কমনীয় মুখে। তারপর অভ্রান্তভাবে টেবিল পেরিয়ে তার হাত এসে ধরল আমার হাত।
মনে পড়ল পরস্পর একে অন্যের হাত তো ধরে রেখেছি চার দশকেরও ওপরে— ছাড়িনি কখনো, কোন অবস্হাতেই। এ হাত ধরাধরিতো কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিল। এমন কি পিতৃপ্রতিম অধ্যাপক কবীর চৌধুরীও ঠাট্টা করে বলতেন, পাণিগ্রহণের এমন আক্ষরিক দৃষ্টান্ত তিনি আর কোথাও দেখেন নি। লজ্জা আমাদের কারোই ভূষণ ছিল না— সুতরাং তাঁকেও পাল্টা ঠাট্টা হজম করতে হয়েছে।
কানে নয়, মনে শুনতে পাই, ‘কেমন কাটলো তোমার দিন?’ মুখে নয়, মনে বলতে শুরু করি ঐ প্রশ্নের উত্তর। শুনতে পাই হৃদয়ে সেই অতি পরিচিত অসহিষ্ণুতা, ‘আসল কথা বলো’। মনে মনে হাসি, এ অসহিষ্ণুতা সে রেখে গেছে আমাদের কনিষ্ঠা কন্যার মাঝে। জৈষ্ঠ্যা যেখানে চায় গল্পের বিস্তার— ‘তারপর কি হল’, কনিষ্ঠা সেখানে চায় শুধু গল্পের নির্যাসটুকু— ‘আসল কথা বল’।
অন্ধকার আস্তে আস্তে ঘন হয়ে আসে চারদিকে, বারান্দার ধূসর চাদরের মত আবছায়া কালো হয়ে আসে। অতি ধীরে নরম ছোঁয়ায় সে হাত ছাড়িয়ে নেয়, নীলচে চেয়ার ছেড়ে ওঠে। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে আমার সবুজ চেয়ারের দিকে। তার ছায়া পড়ে টেবিলের কাঁচে। আমার চেয়ারের পেছনে একহাত রেখে অন্যহাত রাখে আমার মাথায়। আমি চোখ বুঁজে সেই আবেশটুকু নেই। জিজ্ঞেস করি, ‘যাচ্ছো?’ মৃদু কণ্ঠের জবাব পাই মনের ভেতরে, ‘যেতে তো হবেই’।
আমি চোখ মেলি, তাকাই এদিক— ওদিক। সেই দুলে ওঠা মায়াবী পর্দাটি কেটে গেছে। কেউ কোথাও নেই। হু হু করে হাওয়া আসে যেন কোন দিক থেকে। গাছের পাতার হুটোপুটি শোনা যায়। আমিও শূন্য চায়ের পেয়ালাটি তুলে উঠে পড়ি— তৈরী হতে হবে আগামীকালের জন্য।
আমি পা বাড়াই অন্ধকারে ঢাকা শূন্য ঘরের দিকে। শেষবারের মতো বারান্দার দিকে তাকাই -‘কিছু কি ফেলে গেলাম’? হৃদয়ের এক গহীন কোণ থেকে শুনতে পাই, ‘দু:খ তা সে আমারই থাক, পাতার নীচে ছাতার মতন, পরম ব্যাপ্তিতে’।
সেলিম জাহান
ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.
মনোজাগতিক অনুভূতির দারুণ প্রকাশ। গদ্যটা সহজ-সাবলিল— যেনো মৃদু শ্রোতের এক শান্ত নদী! চমৎকার এক এলিজি। সুখপাঠ্য লেখা। শুভকামনা সতত…