পিয়া ট্যাফড্রাপ ডেনমার্কের শীর্ষস্থানীয় কবি। জন্ম ২১ মে ১৯৫২।
২০০৮-০৯ এর শীতকালে আমি ”তুষারে একাকী ঋক্ষ” নামে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কবিতার একটি বাংলা অ্যান্থোলজি সম্পাদনার কাজে রত ছিলাম। তখন তাঁর সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ। সদ্য নতুন দিল্লির এক কবিতা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ফিরেছেন তিনি– ভারতবর্ষ সম্পর্কে গভীর উৎসাহ। তিনি ভারতবর্ষে গিয়েছিলেন মুম্বাই এর নৃশংস সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের হপ্তা দুয়েক পরে এবং সেই বিভ্রান্ত সময়েও মুগ্ধ হয়েছিলেন সাধারণ মানুষের আতিথেয়তায়।
কুড়িটিরও বেশি কাব্যগ্রন্থ তাঁর; গদ্যগ্রন্থও বেশ কয়েকটি; ইংরেজি অনুবাদে নির্বাচিত কবিতার দুটি বিশদ সংকলন।
আলোচ্য কবিতাটি দীর্ঘ– আমি তার অংশবিশেষের অনুবাদের কাজ হাতে নিয়েছিলাম। কিন্তু ডেনমার্কের বর্ষার এই প্রায়-রাবীন্দ্রিক কবিতাটির ভিতরে ঢুকে মুগ্ধতার বশে আপ্লুত হয়ে পুরোটাই অনুবাদ করে ফেলি। যে অপরূপ সংবেদনশীলতা তাঁর কবি জীবনের পরতে পরতে, তার খানিকটা আশা করি ফুটে উঠেছে এই কবিতায়। এই কবির সম্পর্কে আরও বিশদ জানতে হলে আন্তর্জালে দেখুন– http://www.tafdrup.com
অংকুর সাহা
[আগস্ট ২০১১]
ডেনমার্কের বর্ষা: সরেজমিনে দেখা
অনুবাদ: অংকুর সাহা
অন্ধকার ছায় হঠাৎ
আর হাওয়া
খোলা জানলা দিয়ে ঢুকে দখল নেয় ঘরের।
বিদ্যুৎ ঝলকের সঙ্গে সঙ্গেই
পাখিহীন আকাশ, দমকা ঝোড়ো বাতাসে
পালিয়ে বাঁচে তারা।
বজ্রপাতে আকাশ চিরে দু ফাঁক,
দেমাকে ফোলে নিম্নগামী মেঘ
আর হাঁ করে কালো মুখ দেখায়।
আবার বিদ্যুৎ চমকে
ছিন্নভিন্ন, আলুথালু মেঘ; বৃষ্টি পড়ে
সশব্দ, কঠোর, উল্লম্ব।
বিদ্যুৎ–
মুষলধারায় বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে
মাথা নুইয়ে ধরিত্রীকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে বৃক্ষ।
বিদ্যুৎ–
ঝোপে, ঝাড়ে, গাছের ডালে পাখির গান থামে,
বৃষ্টি: টিপ টিপ, রিমঝিম, ঝম ঝম।
বিদ্যুৎ–
হাজার হাজার উদ্দাম ঘিলুর গুনগুন শব্দে– বৃষ্টি,
আছড়ে পড়ে বাজ, তারপর অদৃশ্য।
বিদ্যুৎ–
বৃষ্টি ধুয়ে দেয় পাতার, ঝোপের গায়ে ধুলো,
‘ছিঃ ছিঃ এত্তা জঞ্জাল’ গেয়ে নাচে শহরের ছাদে ছাদে।
বিদ্যুৎ–
ধূসর, পাঁশুটে, প্রায়-অন্ধ আকাশে,
রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে কখন।
বিদ্যুৎ–
শহরের কেন্দ্রস্থলেই সমুদ্রতলের আঁধার,
হাতের বইটা খুলে পড়াও সম্ভব না।
বিদ্যুৎ–
এবং দূর থেকে বর্ষাতির ছপ ছপ শব্দ,
খোলা ছাতার গায়ে বৃষ্টির স্তোত্রপাঠ।
বিদ্যুৎ–
ভুলে যাওয়া অন্তহীন বয়ামগুলোতে বৃষ্টির জল ভরে,
শিশুনিকেতনের বালিয়াড়িতে হাতে গড়া প্রাসাদগুলো ভাঙে।
বিদ্যুৎ–
সঙ্গে বজ্রপাত, জলজমা রাস্তায় লাঙল চালায় গাড়ির চাকা,
বৃষ্টির গর্জন, তার ছাঁটে অপ্রতিরোধ্য কুয়াশা।
বিদ্যুৎ–
পার্ক করা গাড়ির গায়ে বৃষ্টিধারার ফাঁকে
আঙুল চালায় বালক, হাত বোলায় আদরে।
বিদ্যুৎ–
ভাঙা ড্রেন পাইপ থেকে নির্গত ফেনিল জলধারায়
নির্বাধ জলকেলি বালিকার।
দূর থেকে গুরু গুরু ধ্বনি, অশনি চমকে উজ্জ্বল আকাশ,
তার পর উচ্চনাদে ঘন্টাধ্বনির পর ঘন্টাধ্বনি,
মৃতপ্রায় মানুষকেও কিছুক্ষণ জাগিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট।
আর এইসব আদিম শক্তির মাপকাঠিতে
নগরীর ক্রোধ এক স্ফুলিঙ্গ, বৃষ্টিতে যার অপনোদন,
উদ্দাম পাগলামিকে নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমাসুন্দর বরাভয়।
আরো তির, বিদ্যুতের ফলা–
আকাশ বিদীর্ণ করে ছোটে
আলোকে ঝলমল করে হাড়গোড়।
আবার বিস্ফোরণ
জানলার শার্সি কাঁপে, আলোর ঝলকানি–
যার দাপটে দুফাঁক হতে পারে প্রাচীন বৃক্ষ।
আরো মুষলধারায় বৃষ্টি, আরো বজ্রপাত–
আকাশ ভাঙে, জলপ্রপাত হয়ে ছড়ায় তার মণিমুক্তো,
প্রতিটি জলকপাটে ঢল, প্রতিটি ফাঁকফোকর টইটুম্বুর।
বৃষ্টি থামে,
বাজ পড়তে থাকে, তবে
কামানের বদলে পিস্তলের গর্জন তাতে।
গুরুগম্ভীর গর্জন আবার, আরো বিদ্যুৎ–
ঝিরঝিরে বৃষ্টির তেজ বাড়তে বাড়তে
পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গে উঠে যাওয়ার রজ্জু।
দূরে যায় বজ্রপাত, গড়িয়ে গড়িয়ে
অনেক অনেক দূরে, তার স্থান নেয় নতুন
বিস্ফোরণ, ঘরের খুব কাছে, আবার বিদ্যুৎ–
বর্ষাকালে, বজ্রপাত মানে প্রলয়–
আর মেঠো, বন্য, উথলে ওঠা অন্ধকার, দ্বিপ্রহরে
রাত্রির উদয়, এক পলকের নীরবতা, আরো বিদ্যুৎ–
দূরে আবার ঘন্টধ্বনি, ফিরে আসে বারিধারা,
ঘন ঘন বিদু্যৎ চমক– বৃষ্টিতে
সব পুরুষকেই দেখতে আমার প্রাক্তন প্রেমিকদের মতন।
ঘন ঘন গুরু গুরু, উচ্চনাদের শিঙাধ্বনি,
প্রলয় ধারাজলে, বেঁচে থাকার ফুরসত,
দূরে এক বারান্দায় ভেজে ভুলে যাওয়া জামাকাপড়।
অন্তহীন বাদ্যযন্ত্র ঘরের ছাদে,
পাতাল থেকে গলগল আওয়াজ,
ইঁদুরেরা সেখান থেকে উঠে আসে গর্ত খুঁড়ে।
বিদ্যুতের চকিত চমক, করতালির মতন মৃদু শব্দ,
ঘন্টাধ্বনির শব্দে বৃষ্টির গতি বাড়ে,
অনন্ত উজ্জ্বল জ্যোতি আকাশে।
বৃষ্টি ঝরে যায় অনেক, দীর্ঘক্ষণ
থামে, আবার শুরু হয়, বাতাস ধুয়ে মুছে সাফ,
সাম্প্রতিক কদিনের ভুলভাল চিন্তাভাবনার সমাপ্তি।
ছাদ থেকে ফোঁটা ফোঁটা, গাছ থেকে ফোঁটা ফোঁটা,
ভেজা কুয়াশা, কাদামাখা, সপসপে পশুপ্রাণী,
জলে পায়ের শব্দ আর অভিসিঞ্চিত গন্ধ।
দূরে যায় বজ্রবিদু্যৎ, সমুদ্রের দিকে.
পরিষ্কার হয়ে আসে রঙিন আকাশ
পাখির কলকাকলি শুনতে শুনতে।
(Summer in Denmark. On Location)
মূল ডেন ভাষার থেকে কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ডেভিড ম্যাকডাফ। কবিতাটি নেয়া হয়েছে “রানীর ফটক” কাব্যগ্রন্থ থেকে।
i like it
Kobi Tafdrup ar kobi Ankur Saha-r ek onno rokom jugolbondi…raag Jalod-bijli…