ফেরদৌস নাহার
রোদের রাংতায় মোড়া স্পর্শগুলো
মদের প্রবল আলাপনে
সারারাত কবিতা, সারারাত বাতাসে ওড়ে কিছু নেশারু মাতাল
গেলাস উলটে পড়ে অথবা পড়ে না। কোনদিকে যে চলে যায়
রুদ্ধশ্বাস বোতলের ঘটনা, কেউ জানে না সাট সাট খুলে যায়
মদপাখি ডাকাডাকি জলজ জানালা
কেন যে আমার এই সময়টাতেই সে আসে, যে সময়
তাকিয়ে তাকিয়ে কেবল রোদ্দুর দেখার কথা! তা-ই দেখছিলাম
স্কুলবাড়ির বারান্দায় টানা রোদ্দুরে বাঁক ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম
ধুলোমাখা পায়ের ছায়া। আর কত অবহেলা, আর কত আঘাত!
সময় হলে তাদের হয়তো ডেকে নিলে নিতেও পারি
মদের প্রবল আলাপনে টলছে টুকরো চোখ। মানুষ
তাকেই মনে রাখে, যে তারে এলেবেলে অবজ্ঞা করে
চোখের ধারাপাত
মনে করে নেমে এসো
জংশনে দাঁড়ানো মালগাড়ি তোমাকে ডেকে নিয়ে গেল
সবগুলো জানালায় উৎসাহী মুখোশ তোমাকে খুঁজতে
স্টেশনে ঝড় তুলে দিলো। যাও বনদেবী যাও, এই অরণ্যবাস
চোখ ও চোখের ধারাপাত অসংখ্য সন্দেহ কাঁপা হাতে
ভূর্জপত্রে লিখে গেল- সর্বনাশের চেয়েও বেশি চেয়েছিল যা
তার মুখ ঝিমঝিম রৌদ্রস্নাত। এবার শুনছি শতাব্দীর
সঘন সংবাদ, জলে নেমে খেলা হবে তোমার আমার
পুনর্জন্মের পৃথিবী
আজ আমার জন্মদিন, মুখাগ্নি করো না ভুলে
তিনহাজার বছরের প্রেম নিয়ে এসেছি এবার
তিনশো বছরের প্রাচীন শহরে
কেউ কি চিঠি লিখেছিল, অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে
কেউ হয়তো গান গেয়েছিল! জন্মদিনে পাঠানো কার্ড ও
চিঠি ফিরে গেছে প্রেরকের কাছে, সে তো অবাক!
তাহলে কি বেনামে লিখলেই পেয়ে যেতাম অথবা
ভুল ঠিকানায়। তিন হাজার বছর ধরে ভুলভাল চলছে
তবু প্রেম বয়ে আনি তিনশো বছরের প্রাচীন শহরে, জন্মদিনে
দিয়ে যাও সেই হারানো চিঠি, তুমি যার শব্দে বসে
হৃৎপিণ্ডের ধ্বনি গুনে যাও। দাও একটু ছলনা চাহন,
খানিক অন্যরকম। সেসব চিঠির দিন কাটুক র্যালির সাথে
দলবেঁধে। ঠিক নামের ঠিকানা লেখা আটচল্লিশটি খামে
অন্ধকার ডুকরে উঠুক অন্দরমহলে
ভ্যান গঘের জ্বর
ভ্যান গঘ বসেছিলেন এইখানে, জলের দরজা খুলে
সৈকতে পোশাক রেখে নেমেছিলেন জলে, সেই থেকে
জলের ছবিগুলো বড় বেশি নীল মনে হয়। তারপরও
সূর্যমুখীর মুখ কেন এত হলুদ লাগছে বলো তো!
ভিনসেন্ট পুড়েছে জ্বরে, তার চোখে সূর্যের আলো
কপালে জলপট্টি দিয়ে সারারাত বসে আছি পাশে
আহারে কেন তার এত জ্বর এলো! কেন বোঝে না
সূর্যমুখী সে যে ব্যথার গহন তাপে কেঁপে কেঁপে ওঠে
ঝরে পড়ে আল্পসের বনে
সারারাত ভুল বকে ভোরবেলা ঘুমিয়েছে সে, ডেকো না
তাকে। রঙের স্বপ্নমাখা কোনো স্বপ্ন দেখছে হয়তো, ঘুমঘোরে
জ্বর এঁকে যাচ্ছে। তার নিশ্বাসের শব্দ খুব অন্যরকমের
অচেনা লাগছে
এবার থিউকে লিখে দিতেই হলো একবার আসতে
যে শহরে স্টেশন নেই
যে শহরে কোনো স্টেশন নেই, সে শহরে নির্বাসনে যাব না আমি
তুমি ফুল লতাপাতা এঁকে আমাকে প্রলোভন দেখাতে পার, তবু আমি
যাব না, যেখানে ট্রেনের হুইসিল সিটি মেরে টেনে নিয়ে যায় না
কোনো অঝোর স্টেশনে। হে হৃদয় আমাকে ভুলে যেও। সেই ভুলে
যাওয়া মনে পড়ার আগে লীলাময় ক্লান্ত হাত, মাঝপথের আগুন
নদীর আদিবাস, কিছুই পারবে না গলাতে
গলা থেকে মালা খুলে পরাব না, কঠিন পথের বাঁকে আয়ু ভুলে
যতই টেনে ধরো, আমি যাব না মনে রেখো। তুমি ভুলে যাও অথবা
মনে রাখো, এ নিতান্ত সংসারে যা-ই সত্য হোক, আমি কিন্তু যাচ্ছি না
ভীষণ জরুরি কোনো উত্তরের সন্ধানেও স্টেশন বিহীন শহরে
ফেরদৌস নাহার
ফেরদৌস নাহারের জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে। নেশা, দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো ও বইপড়া।
ফেরদৌস নাহার বাংলা ভাষার একজন শক্তিমান কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগীত রচয়িতা। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা: ১৫টি কবিতা ও ৩টি প্রবন্ধের বই। তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে একটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে অসংখ্য যৌথ কবিতা সংকলন। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের দল ‘মাইলস’-এর অনেকগুলো জনপ্রিয় গানের রচয়িতা তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও কানাডা থেকে কম্পিউটার ট্রেনিং প্রোগ্রাম কোর্স করেছেন তিনি। কবিতার পাশাপাশি ছবি আঁকেন, গান লেখেন, ব্লগিং করেন, কফিশপে ধোঁয়া আর ঘ্রাণে আড্ডার ঝড় তোলেন। কিন্তু সবকিছুর উপরে এক বিশ্ব বোহেময়ান কবি আর চির তারুণ্যের নাম ফেরদৌস নাহার। মন চাইলে বেরিয়ে যান। ঘুরে বেড়ান খেয়াল-খুশি মতো, যাকে তিনি ‘ঘুরণ’ বলেন। ভালোবাসেন প্রকৃতি ও মানুষ। পথের নেশা তাকে করেছে ঘরছাড়া, ঘুরতে ঘুরতে এখন আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে, কানাডায়। সেখানে জীবন যাপনের পাশাপাশি জীবন উৎযাপন করেন কবিতা এবং লেখালিখির খরস্রোতা নদীতে বৈঠা বেয়ে। ইমেইল : [email protected]