শাহমান মৈশান
তেমাথার দেহতত্ত্ব-দোয়া
মেঘবেলা দেহের গভীর আকাশ পাতাল কবির নাভির বলয় মাতাল। কথার ওপিঠে কথাদের খেলা দৃশ্যরসে শ্রুত লাল মেঘবেলা।।
সন্ধ্যাফণা অধিগল্প আগুনের বনে সুনয়ন তোমাদের মনে। শ্রবণেরা সুবচন খনা ভাষাঘন-সাপ সন্ধ্যাফণা।।
নিশিমন শিশুর ডানায় রাতের ইশারা তোমাদের মন আজ খাঁচাহারা পাখির সুরত দেহে দরশন লীলার আভাসে খোঁড়ো নিশিমন।।
ঘাসফুলের মতো ঘরবাড়িতে ফুটে থাকে গ্রাম। গ্রামের নাম আঁখিতারা। খোলাচোখ তোমাদের দেহের ভিতরে নকশাকাটা গ্রামের পাতালপ্রেত আর হিজলফুলের বাতাস। হাওয়ার ভিতরে দুলে ওঠে গ্রামবর্গ। সভ্যতার বিভাজিত বর্গ শুধু এ নয়। গ্রাম তোমাদের প্রকৃতির এক কুটিল কুসুম। দৃশ্যের আঘাতে আঘাতে কুসুমিত গল্পের কালাকাল হয়ে ওঠে তোমাদের গ্রাম– গ্রামের মনন, জনন, সুরাক। তোমাদের মতো হে দৃশ্যপাপ, খোলো! খুলে যায় দেহগ্রাম– গ্রামের পশ্চিম এখন প্রান্তরের সবুজ। গৃহস্থ আর চাষীদের পোষাপালিত গরু, ভেড়া আর ছাগলের চারণভূমির দক্ষিণে শাপলা গাং। এই গাং কি গঙ্গার পুত্র! পুত্রের বুকে একটা ছেঁড়াপাল-নৌকা স্থির হয়ে থাকে। নৌকার বুক ঘেঁষে থাকে জাল শতাইন্যা। শতাইন্যার মাথার ওপর উত্তীর্ণ-তিরিশ সাবিলক । বাতাসের আঘাতে গাং আর জালের শরীরে স্পন্দন। মাথার ভিতরে চিলিকমারা রৌদ্র আর এই দুপুর আ…আ…ব্…ব্…ব্বা… … …। ফেরেশতার শিঙার মতো এই সুনিপুণ ধ্বংসোন্মুখ আওয়াজে মতি নাশ হয় সাবিলকের। শাপলা গাঙে ভারসাম্যহারা ফেলে দেওয়া পাথরের ওজন এখন পানির সাথে মিশে গিয়ে এক কোটি ভুরভুরি ফুল। জালবাঁশের নকশার উরুসন্ধির কাছে এসে দাঁড়ায় সাবিলকের শিশুপুত্র হরকত। হরকত তুমি কি পুত্র!
হরকত: আব্বা, আব্বা, আব্বা, আম্মার প্যাড ব্যদনা উঠছে। তুমারে দাদী কইছে তাগদা অই দাইমা আলিমনের মারে লইয়া যাইতা।
ভেজা আর বেবশ শরীরে ধ্রুপদী পিতার বাসনার মতো জলস শব্দে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসে সাবিলক ।
সাবিলক: ই্-ই্-ই্-য়া... ...আ্-আ্-লী। হরকত ই্-ই্-ই্-য়া... ...আ্-আ্-লী। সাবিলক: পুতরে তুই তাইলে লুঙ্গিডা দে।
হরকত শিং মাছের মতো ঘাই দেয় চিলের মতো ছোঁ আর নিজের শরীর থেকে পিতারই বেঢপ লুঙ্গি খসে ফেলে। পুত্রের দুইপা-ফাঁক করা ভূমিপদের কাছে মুহূর্তের মতো লুঙ্গিটি পড়ে থাকে। কালো তাগা দেওয়া পুত্রের ঘুনসিময় উরুসন্ধি আর উলঙ্গ শরীর দেখতে দেখতে ডেকে ওঠে আকাশের মেঘ । মেঘের সাথে বিদ্যুতের চমক আর শিস।
হরকত: আব্বা তাগদা কর।
পুত্রের লুঙ্গিটি তুলে পরে নেয়। পিতা এবার সহাস্য কিন্তু বিচলিত। হরকত নিজের কাঁধে তুলে নেয় ভেজা কাপড়। স্কন্ধিত বস্ত্রের দেহ বেয়ে বেয়ে যায় পানিফোঁটা। শিশুটি কি জানে সে কার ফোঁটা! মানুষ তবে কি শিশু নয়?
সাবিলক: তুই দৌইরা বাড়িত যা। দিনের অবস্থা খরাপ। হরকত: আম্মার অবস্থাও খরাপ। সাবিলক: আমি দাইরে আনতাম যাইতাছি।
পিতা-পুত্র পরস্পর সমকোণে এক অভিন্ন তাড়নায় দৌড়ায়। পিতা গ্রামের ছিন্নসূত্র প্রান্তরের এক প্রান্তে একটি একা টিনের ঘরের দিকে ধাবমান হাম্বা। আর পুত্র গ্রামের ঘরবাড়ির কোলাহল বিদীর্ণ করে ছুটছে এক বকনা বাছুর। একদল কাদায় লেপ্টে থাকা শিশুর ভেতরে হুমড়ি খায় হরকত। বাজে শিশুদের ঘুঙুর আর উরুশ্রেণি।
অলা মেঘ, ধলা মেঘ–ধলা আমরা যামু মেঘের হউরবাড়ি অলা মেঘ, ধলা মেঘ–অলা আমরা যামু আসমান ছাড়ি।। অলা মেঘ,ধলা মেঘ–ধলা অলা মেঘ, ধলা মেঘ–অলা ধলা মেঘ, অলা মেঘ, ধলা মেঘ, অলা মেঘ... ধলা মেঘ, অলা মেঘ, ধলা মেঘ, অলা মেঘ... ধলা মেঘ, অলা মেঘ, ধলা মেঘ, অলা মেঘ অলা মেঘ, ধলা মেঘ, অলা মেঘ, ধলা মেঘ... ...
আল্লার আসমানের নিচে শিশু আর কাদাদের এই নাচ আর প্রলয়ের ভেতরে মানুষ কি ভুলে যায় জন্মের বেদনা। শিশুরা যেন বাংলাদেশের শিবের পিতাসকল। ওদের দেহভঙ্গিমার মধ্যে রচিত হয় ভূমিজীবনের নকশা আর তুফানের মতন সশব্দ জীবনের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা ধুলার রূপে সাবিলকের পায়ে পায়ে মিলায়।
কচু আর ঢেড়সের মাচা এই ঘর-লাগোয়া। শনের বেড়ার ফোকড় দিয়ে গরীবির আত্মা আর প্রাচীন হস্তশৈলী রমণীয় স্মারক– সিকায় তাক তাক মাটির হাঁড়ি। আলিমনের মার এলাহি কাঁদনের ভিতরে একটা নিস্তব্ধ কাকতাড়ুয়া মাতৃবৎসল হাতের পীড়াপীড়িতে কাঁপছে। আলিমনের মা কোথায়? এই বেটির হাউমাউ কান্নার মুহুর্মুহু বজ্রপাতের ভিতরে আরো একটি বজ্র হয়ে এক চিলতে কালো উঠানে নিনাদিত হতে থাকে সাবিলক। বজ্র আর বুকের নিনাদ-ধ্বনি শ্রবণ-প্রভুময়ীর কাছে পৌঁছে না। মানুষ তবু মানুষের মুখোমুখি হয়ে ইচ্ছাময় আত্মাকে করে উদাম। উদাম নগ্নতা নয়, শুধু কথা।
সাবিলক: অ বেডি তুমি কই, তোমার মাথা বাইর কর। নীরবতা তোমার মাথা বাইর কর। আমার ডর করতাছে।
ক্রমাগত নীরবতা গলা ভেঙে দেয়। কণ্ঠের ভেতরে ভাষার স্রোত দলা পাকায়। কথার দলা যেন কাদার দলার মতো পানিমিশ্রণে ঘোলা হয়ে আসে। সাবিলকের কণ্ঠ এখন শিরার মতো সরু হয়ে আসে। কথাময় গলার ভেতরে আধমরা ইদুঁরের শেষ চিৎকার। মগজের ভেতরে আগুনপোড়া তেলাপোকার ডানা। ভাজা সজনেপাতা। হ-অ-হ-চ্-চ্-অ-এ-এ-ই-ই।
সাবিলক: এই বেডি আমার বউ মইরা যাইতাছে। প্যাড ব্যাদনা উঠছে। মাইয় গো তুমি কই? তাগদা বাইরইয়া আইয়! সাবিলকের আর্তি উড়ে যায় পৃথিবীর প্রাচীন ভাষায়। তোমরা তো হে ভাষাবিরোধী বুদবুদ...
আলিমনের মা: সিনালের পুত, তর বউরে গিয়ে মা ডাক, তর জিরে মা ডাক। সাবিলক: আমার কুনো জি নাই গো, একটাই পুত। আলিমনের মা: তর বউরে গিয়া ক জি বিয়াইতো। যা গাইডারে গিয়া ক। সাবিলক: বুবু, বুবু তুমি তাগদা কর। আমার বউডা আর নাইলে মারা যাইবো। বুবু... নীরবতা বুবু...বুবু... নীরবতা বুবু...বুবু... ... আলিমনের মা: হে-ই-স্ সিনালের পুত...
নারীর এই অদ্ভুত রগড় আর ভূমণ্ডলকে হেঁচকা মেরে ঘুরিয়ে দেওয়া এই আকাশধ্বস আওয়াজে সাবিলক ঘম করে হাঁটু ভেঙ্গে কালো মাটির পাজরে লেপ্টে সটাং হয়ে যায়। ভীষণ দুই জলাশয় এখন পুরুষের চোখ– চোখ বরাবর ঢেড়স আর কচুর পাতার ফাঁক আর বাঁশের ঠ্যাং। গ্রামের ঝিঁঝিদল ডাকছে, গর্জনশীল মেঘেদের ঝারিঝুরি শেষ। আর মাচার ভেতরে আলিমনের মার আইল্যা। এই মাটির পাতিলে আগুনজ্বলা শিখা। মহিলার উরুর পাশে হুকাটি হেলে আছে যেন তার শিশুপুত্র। পদ্মার আসনে অধিষ্ঠিত আলিমনের মা ধ্যানমগ্ন ঋষিময় মুখে এখন কিছুই দেখছে না। শাদা ধুতির পাড় এখন সে খুলছে। একটা কালো ঘুনসি। সে হাত ঢুকিয়ে দেয় আগুন ভেদ করে, ভেতরে আগুন। দহনলাগা পাতিলের ভেতর থেকে উঠে আসে আঙুল, ঘুঙুর লাগা আঙুল। ঘুঙুরবাঁধা ঘুনসি এখন কাকতাড়ুয়াটির কোমরবৃত্ত। ক্ষিপ্র সাপের ফণা ধরে বেরিয়ে আসে আলিমনের মা। সাবিলকের বুকের ভেতরে কেয়ামত ঘটে। এ কিসের ইশারা অ-অ-খো-দা-আ…
আলিমনের মা: আলিমন, আলিমন, আলিমন, আলিমন, আলিমন, আলিমন, আলিমন... ইল বাবা আলিমন, মায়ের দোয়া মা মন, মায়ের দয়া মা মন, ইল বাবা আলিমন... ...
ধ্যানমগ্ন জপভরা মায়ের নাচের ভিতরে সাবিলক চিৎকার করে। তোমাদেরও এইসব মুহূর্ত আছে– মানুষের চিৎকার আদতে ভাষা হয়ে ওঠেনা। তোমাদের মুহুর্মুহু নিঃশ্বাস ভাষাকে নাকচ করে জীবন হয়ে ওঠে। জীবন তবু ভগ্ন ভগ্ন ধ্বনির প্রশ্ন ও বিবৃতি–
সাবিলক: আলিমন কেডা,কেডা ? তুমার কুনো জি নাই... তুমার কুনো পুত নাই... তুমি রাঢ়ি, বেওয়া ... তুমার কুনো লাঙ নাই, বেডা নাই... তুমার কিতা অইছে? কুস্তা অইছে না ... গেরামের সবাই জানে। তুমার বাড়ি কই ? এই ঘরটা কেডা দিছে ? এই চুতমারানির বেডি... খানকি... চুদানি...
আলিমনের মা একটা ঘূর্ণি, একটা বাত্যা– নাচের নেশায় দশা লাগে। নারীটি জ্ঞান হারায়। এখানে মধ্যাহ্ন, আঁখিতারা গ্রাম, স্ত্রীর প্রসব বেদনা, শিশুপুত্রের তাড়া সব এসে– আকাশের নিরঞ্জন মেঘ, তাপহীন সুরুজ, এইসব যুক্তি আর বেঁচে থাকার শৃঙ্খলা– সব এসে বরফ হয়ে যায়। তুমি কি একটা বরফকল? বরফের শিশ্নে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সাবিলক। সে বোকা হয়ে যায়। এই গ্রামে কে আসলে বোকা নয়! ঠিল্লাভর্তি জল এনে ঢালে সাবিলক। পানিস্রোতে নড়ে উঠে আলিমনের মা। সে ওঠে। ভেসে থাকা পানির আওয়াজ ছাড়া এই গ্রাম আর ওরা দুজন নীরব। ওরা হাসে। হাসির কী আছে!
আলিমনের মা: নীরবতা সাবিলক: নীরবতা আলিমনের মা: হাস কেন গো ? সাবিলক: আমার বউয়ের বাইচ্চা অইব, ব্যাদনা উঠছে। আলিমনের মা: ইডা আগে কইবানা গো... যাও আমি আইতাছি।
সূর্যের রেখা ধরে দূরে মিলিয়ে যায় সাবিলক। বাংলাসাবান নিয়ে অদূর গাঙের ঘাটে সিনানে যায় আলিমনের মা। পানির গন্ধে তার ত্রাস কেটে গেছে। ত্রাসে তার এ কি হয়! দূর দিয়ে নৌকা চলে যায়। পাশে কলমীর দাম পাতিহাঁসের ঢেউয়ে কাঁপছে। সাবান হাতে কোমরজলে দাঁড়িয়ে থাকে আলিমনের মা। হু হু করছে কেন বুক? নারীর বুকে মাংসের কবর কেন লেগে থাকে? একি সিদ্ধার্থ ইচ্ছার ফুলে ওঠা শূন্যতা!
আলিমনের মা: কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে। কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকূলে।।
গাং ভর করে আলিমনের মার দুই নয়নে। চোখের আকাশ ভরা অভ্র। সে কাঁদে। কান্না বুঝি গান হয়ে আসে। এইসব মুহূর্তে মেয়েদের গানকে মনে হয় কাঁপতে থাকা কার্তিকের মঙ্গা। শীতের ঘাসের শিশির ফুল। ভাসানীর আগুনের ফলা–
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে। কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকূলে ।।
আলিমনের মা: চল্লিশ বছর আমারে খামচা মারে, ঘুষি মারে, গুতা মারে, গণ্ডগুল করে… … গণ্ডগুলের বছর… মুক্তির বছর, মুক্তি আয়ে, মুক্তি আয়ে… মুক্তি… ভারত যা, ভারত যা… মুক্তি… মুক্তির মার হেডা মারি…
আলিমন, মন… …
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে। কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকূলে ।।
আসমান ভেঙে মেঘ আসে, মেঘ ভেঙে বৃষ্টি আসে। এই অঘোর বর্ষণ ভেঙে তোমাদের লাল চোখ আসে। সে কাঁদে হা হা হা। নিসর্গের বৃষ্টি, শাপলার জল আর মানবীর অশ্রুর কৌতুক এখন সমস্ত গ্রামের আকাশ আর পাতাল দিয়ে আবহমান।
আলিমনের মা: গাঙে জিভ ডুবাইলে মাইনষের কান্দনের নুন পাওয়া যাইব। পোয়াতি বেডিরা তেতুঁল খাইলে এই গাঙ্গে আইয়া জিলবা ডুবাই দে, নুন পাইবি। এই নদী নিমুকহারাম না। অ লো সিনাল–সিনালের আডারো কল!
বৃষ্টি যেন আত্মবেহালার মতো বাজছে। এই বর্ষণ আর বাজনার ভেতরে আখিঁতারা গ্রামকে মনে হয় কুয়াশার নকশা আঁকা কুলা। কর্তব্য তাকে ক্ষিপ্র করে তোলে। সপাৎ সপাৎ শব্দে আলিমনের মা ঘরে ঢোকে। ঘর কি তাহার ও তোমাদের মন? ঘরকে পর ভেবে বানায়েছো তুমি ঘর! ঘরের শাদা ধুতিতে সে এখন ধ্রুপদী, পাক– সাফ। ধাত্রী তুমি তাড়াতাড়ি কর।
সন্ধ্যাফণা
(দোয়া) অধিগল্প আগুনের বনে সুনয়ন তোমাদের মনে। শ্রবণেরা সুবচন খনা ভাষাঘন-সাপ সন্ধ্যাফণা ।।
লজ্জাবতীর ঝাড়, গুচ্ছ গুচ্ছ বিষকাঁটালি আর শ্যাওড়ামুখা পথের বাঁক শেষে নিকারি পাড়া। পথের পাশে জুম্মাঘর। দুই বান টিনের নতুন চালার ভিতরে জৈষ্ঠ মাসের বিকেল গুমোট হয়ে আছে। এই গুমড়া বিকাল আটকুড়া নারীর অন্ধকার যোনীর দুঃখের মতো মনে হয়। কালো জোব্বায় ঢাকা বোরখাপরা দীঘল মেয়ের ঢাকাশরীরের মতো মসজিদের মিনার। মিনারের বুকভাঙা আওয়াজে ধপাস করে ওঠে বুক। আলিমনের মা বুকে ছেপ দেয়। মাথার ঘোমটা কপালে ঝুমকালতার মতো আরো ঘন হয়ে বৃদ্ধি করে ভার।
আলিমনের মা: সোনা মা বিবি, আযান দিল যে, তোমার পুতের বউ কিতা পুত বিয়াইছে? সোনামা হেউ দুপ্পুর থিকা চিল্লাইতাছে, মাইয় তুমারেই ডাকতাম যাইতাছি। এই নিদান কাল! আলিমনের মা: তুমার তো মরার সময় অইছে, আর কত সংসার সংসার করবা। এই সংসারে মা সার নাই, জগতসংসারে সার পাইবা না!
মায়ের নামে একটা বিষময় আর্তচিৎকার তোমাদের মতো বার্ধক্যের দার্শনিকতাকে তুলার মতো উড়ায়। বামপন্থে মসজিদ। ডানপন্থে ছাবিলকের ছাপড়া। ছাপড়ায় ঢুকে পড়ে দুই নারী।
আলিমনের মা: আরে কুলক্ষিণী বুড়া বেডি, দুয়ার লেপা দে। তর পুতরে ক বেতকাটা কাইট্যা আনত। গরম পানি কর। সোনা-রূপার পানি দে। খেজুইর কাডা আর বেলেড আনা।
ছাপড়ার দুয়ার দিয়ে সরু ফাঁক। আর স্ত্রীর প্রসব বেদনা গ্রামের ভিতরে ক্রমাগত ঘন্টা বাজিয়ে চলছে। গরু ডাকছে হাম্বা-ম্-বা-আ। আযানের নিস্তব্ধতার পর এখন কুত্তার চিৎকার। তোমরা হে বলো, পশুরাও অপরের বেদনায় কেঁপে ওঠে কী দুঃখে? নতুবা দুঃখ এখন পশুদের তামশায় পরিণত হয়।
ক্ষিপ্র অপেক্ষার ভেঙে যাওয়া বাঁধের ঘোলাস্রোতে সব কাজ আয়োজিত হতে থাকে। ঘর ঘিরে নিকারিপাড়ার নারীদের গুঞ্জন, পশুডাক, দুয়ার লেপা, নিমপাতার পানির ঝটাক ছিটা, বেড়ার ফাঁকে ঝুলছে বেতের পাতা । আর তীব্র কণ্ঠে সূরা ইয়াসিন–ইয়াসিন ওয়াল কুরআন ইন্নাকা লামিনাল মুরসালিন, ইয়াসিন ওয়াল কুরআন ইন্নাকা লামিনাল মুরসালিন– ইয়া রাহমানু, ইয়া জব্বারু, ইয়া আজিজু- ইয়া গাফ্ফারু, ইয়া আল্লা, আল্লাহু শাফি, আল্লাহু মাফি, আল্লাহু কাফি–একটা অদ্ভূত ধ্বনি সমস্ত পবিত্রতা আর পাঠের সুর ভেঙে দেয়। সুর কেটে গেলে গলা থেকে যায়। আর যে কোনো প্রকার গলা তখন অনুচ্চারিত নদীর অস্তিত্ব, সুর আর শোকের সজল কবর।
বন্ধ দুয়ার খুলে যায়। সরু ফাঁক দিয়ে একটা পাতাল-প্রশস্ত আওয়াজে উঠানে-উঠানে অপেক্ষায় নিহত মেঘের ডিমের মতো পৃথিবী আর তার ফিরে আসে হারানো শ্রুতি। শ্রুতি হলো গুচ্ছ গুচ্ছ সংবাদ। কবুতর পাখির ঠোঁট, শূককীটের মিহিময়তা, পতনের উল্কা, নাভিমূলে ঘাম, তোমাদের বনবিলাই বহন করে বিবিধ সংবাদ। হে অমানবমণ্ডলী তোমরা তো কিছুই নও, শুধু এক প্রকার সংবাদ। দেখো, দর্শাও– সে আসে, সংবাদ–অতিক্রান্ত সংবাদ আসে! সংবাদ কি কেবল অক্ষরের কিতাব–শ্রবণ হে, এ হলো অক্ষর-পূর্ব জৈবিকতা, কথা, কথার বিরোধিতা। হে মুখ শোনো!
আলিমনের মা: অগো সোনামা বিবি, তোমার পুতের বউ নাতিন বিয়াইছে। যাও! মা ফাতেমার জামাই খুঁজ গিয়া।
হাসতে হাসতে লজ্জাবতী লতার মতো মিলিয়ে যায় ঘরের ভেতরে ধাত্রী আলিমনের মা। আর মিলায় দরজার এক চিলতে ফাঁক। মুহূর্ত এখন আল্লার ডাকে ভরে যায়। মাগরিবের আযান– আল্লাহু আকবর, তুমি শিশুর ঘাতক। আজানের রমণীয় সুর এখন গ্রামের আবছা অন্ধকারকে সূরা আল-বাকারার মতো সুন্দর করে তুলছে।
সাবিলক: ও আল্লা তুমি তামাও। আমার জিয়ের জন্মের সময় এই আজান কিলিগ্যা। অ হজুর! বদ্ধ কর–আমার জি অইছে, এই পাপ বাপরেও ছাড়তো না।
উঠানের ভিতরে সাবিলকের অদ্ভূত শোকার্ত বিলাপের সাথে তার বৃদ্ধা আম্মা সোনামা বিবির অস্ফুট গোঙানি যুক্ত হয়ে বাজিয়ে তুলছে একটা মিশ্রগান । শিশু হরকত প্রতিক্রিয়াহীন প্রতিক্রিয়ায় বেহুশ। আযানের নিঠুর স্নিগ্ধতার পর মুহূর্ত মুহূর্ত নিস্তব্ধ হয়ে থাকে গ্রামময় উঠান। ছাপড়ায় শুধু ফিসফিস আর জননীর প্রসবোত্তর কাতরতার মৃদু গন্ধ। গন্ধের বণিক! হে ক্রেতাগণ! তোমরা তো গঞ্জবাসী! নির্জন সুরাকে আনুনাসিক হও– সেখানে গন্ধের বিলাই।
সোনামা: অ-খদা আমার পুত কি পাপ করছিল! এই অলক্ষী বদমাইশ একটা ব্যাঙ্গের বাইচ্চা বিয়াইছে– অ খদা গো...।
এই তীব্র বিলাপে বৃদ্ধার গলায় দুই হাত যুক্ত করে বিলাপকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে সাবিলক। তোমরা দেখো বিলাপযুগল!
আলিমনের মা: হেই মা-পুত! তুমরা নাফরমানি কইর না। তুমরার ঘর মা ফাতেমা আইছে। সাবিলক: চুতমারানির জি, আমি তরেও আজকা কাডুম...
আচমকা হযরত আলীর শক্তিতে মত্ত হয়ে ওঠে সাবিলক। উঠান জুড়ে খুঁজতে খুঁজতে আনে দা। হরকত শুধু চিৎকার করে। চিৎকার হলো জিব্বার জল। হরকত খুলে যায়! হরকত খসে যায়! আদমজল তো রক্ত নয়। রক্ত কি খুব ঘন হয়? কী হয়–
সোনামা: এই পুলা কান্দিস কিলিগ্যা? তর মা তো ফুলপুর থিক্কা তরে আইয়া লইয়া যাইবগা। তরে ত লইয়া যাইবগা... গুলামের পুতরে...অ পুতরে... পরের পুতরে লাইল্যা, পাইল্যা... অ-খদা গো...
একটা অদ্ভুত সুরে পুর্নবার চতুর্গুণ, অষ্টগুণ… বেগে বেগে বিলাপ জোড়ে। পুত্র এখন হিতাহিত জ্ঞানহারা। মায়ের বিলাপে আবার জড়িয়ে যায় জননছেঁড়া ধন। ধনের আগায় মরিচ বাটা– বাটা,বাটা,বাটা। বিলাপ বাটা। বিলাপ এখন বহমান সংস্কার। সংস্কারের নদীতে বৃদ্ধা আর পুত্র এখন ডুবছে, ভাসছে, উড়ছে, সান্দাইছে আর ডুবছে, উড়ছে…প্রহরের পর পহর… ….
গভীর নিশি লেগে আছে গ্রামে। উঠানভরা পৃথিবীতে মাতা-পুত্র আর শিশু হরকত ঘুমগ্রস্থ। দুয়ার খুলে দাঁড়ায় আলিমনের মা। ধাত্রীর কোলে সদ্যোজাত কন্যা। প্রসবিনী যন্ত্রণাগ্রস্থ হয়ে এখন নেশার মধ্যে বেহুশ। একহাতে কুপি দপ দপ করছে। আর হাতে কোলে ধরা শিশু মা ফাতেমা।
আলিমনের মা: পাপিষ্টের দল আমি মারে লইয়া যাইতাছি, আর মারে বাচাই যাইতাছি..... তরা ঘুমা, আমি যাইতাছি... ...
একটা চিকন ঝিলিমিলি হাসিতে আঁখিখিতারা গ্রামের মেঘময় আকাশ, আকাশের তারার ফাঁক ভরে যায়। পথের ভিতরে আলিমনের মার পা এখন ধাবমান–হিংসা ও ভালোবাসা এখন ধাবমান– লক্ষীপেঁচার ডাক, বাঁদুরের ডানা ঝাড়ার শব্দ, অন্ধকার গাবগাছ, নিশিভূতের প্রান্তর পার হয়ে সে এখন নিজের এক চিলতে আলো-অন্ধকার উঠান। উঠান যেন এক কদম। সিকায় ঝুলন্ত হাঁড়ি খুলে যায়– একটা ঘুঙুর এখন শিশুর কোমরের অভিজ্ঞতা। বেরিয়ে পড়ে আলিমনের মা– ঘুঙুরের নৃশংসতা ভেঙে নীরব প্রান্তর, গ্রামের আত্মা আর থেমে থাকা গাঙের জলস শব্দ। শব্দে মাতরম। মা গঙ্গা, মা গঙ্গা, গঙ্গা…
মা ফাতেমা, মা ফাতেমা… অয়ি জগজ্জননী… অন্ধকার যোনী ভেঙে ডাক আসে আটকুড়া জননীর। জননী কি শুধু জননী? জননতৃপ্ত রমণ কার– কে পুরুষ, পুরুষ! সে এক শীৎকার, তোমারও শীৎকার প্যাঁক, প্যাঁক, প্যাঁক! ও ইন্দ্রিয় ও জীবন!
আলিমনের মা এখন গ্রাম কালিকচ্ছের দিকে ধাবন্ত। সম্মুখে গাং আর জি্বনের বাদশাহি ঝলমল শরৎ বাবুর বটগাছ…হলুদগুড়ার মতো হেসে ওঠে, পেঁয়াজপোড়ার মতো কেঁদে ওঠে কোলে মা ফাতেমা। অন্ধকারে দাঁড়ায় আলিমনের মা। নদীর ঢেউ ভেঙে ভেঙে দূরে চলে যায় বৃক্ষের জলদ ছায়া।
আলিমনের মা: অ গাছ হুজুর তুমি আমারে বাচাও, এই দুধের শিশুডা আমার কইলজার টুকরারে বাঁচাও!
হলুদগুড়ার মতো শিশু হাসে। এ কী হাসি? এ কি হাসি! পেঁয়াজপোড়ার মতো শিশু কাঁদে। এ কী কান্না? এ কি কান্না!
আলিমনের মা: অ আম্মা হুজুর, তুমি এমুন কইর না, ডর করতাছে। মা ফাতেমা আমারে বাচাও...
তার চুলের ভিতরে ধুলার ঘূর্ণি। ভয়ে দেহের আরশ কাঁপছে। সে আত্মরক্ষার প্রশ্নে কৌশল ভুলে যায়। তোমরা তাই কুশলী হয়ো না। কুশীলব হও। হলুদগুড়ার মতো শিশু হাসে। পেঁয়াজপোড়ার মতো শিশু কাঁদে। হায় মরীচিকা, জীবনচিকা, চিকার দাম পাঁচসিকা…
নিশিমন
(দোয়া) শিশুর ডানায় রাতের ইশারা তোমাদের মন আজ খাঁচাহারা পাখির সুরত দেহে দরশন লীলার আভাসে খোঁড়ো নিশিমন।।
আলিমনের মা: দুদ খা, দুদ খা, মা ফাতেমা! আমি হুকাইয়া গেলাম গা... ইয়া আশেকে রসূল, বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী... দুদ খা।
চিৎকার করে আলিমনের মা। একটা তামশায় খিলখিল হাসিতে খেজুরকাঁটায় দরদর করে কাটে বুক ।
আলিমনের মা: দুদ খা, দুদ খা, মা ফাতেমা...
স্তনের অন্ধকারে মুখ ডুবিয়ে নিজেই শিশুর জিভে পরিণত হয়।
আমিই মা ফাতেমা।
একটা ঝিলমিল হাসি রাতের আকাশে আতসবাজির মতো ফোটে।
আলিমনের মা: কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে
দূরের হারিকেন আর তিনটি মানব-অবয়ব ক্রমাগত নিকটবর্তী হয়। সাবিলকের হাতে দা। বৃদ্ধার আর্তিভরা মুখ ও হাত। ন্যাংটা হরকতের হাতে হারিকেন। ওরা বৃক্ষ আর বৃক্ষাতুর রমণীর ছায়ার নিকটবর্তী হয়। ঝিলিমিলি হাসিসহ ওঠে দাঁড়ায় আলিমনের মা কিংবা ছায়া। ঝিলিমিলি হাসি আর মা ফাতেমাসহ সে অথবা তাহাদের ছায়ারা ক্ষিপ্ত হয়। আসন্ন সম্মুখগামী মানুষেরা কাঁদতে কাঁদতে পশ্চাতে দৌড়ায়।
ঝিলিমিলি হাসিসহ সাবিলক, সোনামা আর হরকত ক্ষিপ্ত হয়। আলিমনের মা এবং শিশুর অনিবার্য ছায়াগণ কাঁদতে কাঁদতে পশ্চাতে দৌড়ায়। পারস্পরিক হাসি আর কান্নার বিনিময়। হাসি আর কান্নার বিনিময় হতে থাকে…… হাসি আর কান্নার বিনিময় হতে থাকে… কান্না আর হাসির বিনিময় হতে থাকে… কান্না আর হাসির বিনিময় হতে থাকে…
মা এ কি প্রলয়। এ কি পিপাসা। এ কি প্রহসন। হায় মরীচিকা, জীবনচিকা, চিকার দাম পাঁচসিকা…
আমিন। সুম্মা আমিন। হি হি হি হি… … …