কত বিনিদ্র রাতের খসড়া এক করে তৈরি হয় একজন লেখক জীবন। পৃথিবী নীরব হলে জেগে উঠে একাকীত্ব। কালের দহন, ক্ষরণ, বৈভব, বিড়ম্বনাসহ সমাচার বহন করা মন নিয়ে যে কোন কাজে গভীরভাবে নিমগ্ন হতে গেলে প্রশান্তি ও নীরবতা অপরিহার্য। ভাবনার করিডোর ধরে হেঁটে যায় হাজার বছরের মানুষের আর্তনাদ ও ঐতিহ্যের আবহ। যুদ্ধ, ধ্বংস, মহামারী ও প্রাণ বিয়োগ ব্যথা। বেঁচে থাকার আনন্দ। প্রিয় কণ্ঠের অনুরণন। প্রতারণার প্রদাহ। নারীর প্রতি সীমাহীন প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য। নির্যাতিতের ক্রন্দন। পাওয়া না পাওয়া বুকের কোথাও হিমের প্রহর কাঁপিয়ে দিয়ে যায় অথবা আনন্দের বাগানে ফুল ফোটায়। কখনো হৃদয়ের আকাশ ভরে তারায় তারায়। চায়ের চুমুক, সিগারেটের ধোয়া, পানীয়ের শীথিল নহর, খাতা, বই, কলম ও কাটাকাটি। কত রাতে ভেস্তে যায় সব আয়োজন। কত দিন রাতে আয়োজনহীন পাতার পর পাতা সাজতে থাকে বাজতে থাকে বিরহের সেতার। অলক্ষ্যে সুর ও স্বরের সম্মিলিত ধ্বনি প্রতিধ্বনি কাব্যদেবী জেগে উঠে কোন অসতর্ক-সতর্ক মুহূর্তে। জেগে উঠে গদ্যের প্রতিমা। দার্শনিক মতামত। বিজ্ঞানী আবিষ্কারের খুশিতে বলে উঠেন ইউরেকা। রাতের নাভিতে কত কালের মধুচন্দ্রিমা, শোলক বলা তিথি, প্রেমের অক্ষয় অনুরাগ, প্রিয় চুমুর চুম্বক, স্পর্শের বাহারি রঙধনু, সহবাসের প্রবাহমান সুখানুভূতি, আহরিত শব্দের পরিপাটি সংগম। মননের গভীর তন্ত্রীতে আলোড়িত হয় ছন্দের দোলা, বাক্য বিভা, করুণ কোন বার্তা। কখনো অনুভূতির রসাস্বাদনে অধরা কোন অনুভূতি লট্কে ঝটকে থাকে; ধরেও ধরা যায় না। এমনি পেষণে তৈরি হতে থাকে সৃষ্টির জগৎ। কত দীর্ঘ ও নাতিদীর্ঘ বলয় হেঁটে আসা পৃথিবী, বিলীন হয়ে যাওয়া ফসিল, বৃক্ষের প্রেম কথা, অগ্নি ও প্রলয়ের গীতিকাব্য। ধূলিতে উড়ে আসে প্রতাপী-বিলুপ্ত জাতির অশ্ব-খুরধ্বনি। হৃদয় তন্ত্রীতে বেজে উঠে নিষ্পেষিত জনের ব্যথা ও বিড়ম্বনার শত বাধা ও বেদনার হাড়ের ইতিহাস।
পৃথিবীতে সেই টিকে থাকে যে নিজেকে বেশি মূল্যবান মনে করে। নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে মুখোমুখি হতে হয় সংগ্রাম ও সমজোতার। যদি না শিল্প হয়ে উঠে কালোত্তীর্ণ। কালের প্রবাহে তা একসময় নিজ বিভা বলে দাঁড়িয়ে যায়। এখানে ক্ষুন্ন হয় নৈতিকতা, করতে হয় দমন পীড়ন। সংগ্রাম দু’ধরনের এক নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি স্থায়ী করণের জন্য নিষ্ঠুরতম আয়োজন আরেকটি দমন পীড়ন থেকে মুক্তি লাভের পথ কর্ম-পরিক্রমা। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ যে সর্বদা অন্যের কথা ভাবে; সে নিজেকে পীড়িতদের পক্ষের জন মনে করে। সে নিষ্ঠুরতার হাত থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম নয় মানুষকে মানবিক হতে উৎসাহিত করে। মানব মনের অন্তর্গত সু ভাবনাগুলোর উদ্ভাসিতকরণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। কেননা যে কোন সংগ্রামের সাথে জড়ির থাকে হত্যা, মৃত্যু ও ধ্বংস। লেখক নিজকে উজাড় করে অন্যের নিমিত্তে প্রাণে বহন করেন নিবিড় মমতা ও ক্রন্দন। তার মন মানবিকতার পদদলনে আর্তনাদ করে। একজন লেখকের প্রাণও শামিল হয় নির্যাতিতের বেদনা ও রক্ত-ক্ষরণের সাথে। তিনি সকল ধর্মের, সকল গোত্রের, দেশ ও কালের উর্ধ্বে অবস্থান করেন। শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেন এক আলোকিত রূপময় শব্দ সম্ভার ও অনুভূতির আলোকে। আলোয় আলোয় মুগ্ধ শব্দাবলী মুক্ত হয়ে পাঠকের অন্তঃকরণে সুপ্ত ও মগ্নতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। ভাষা ও বোধকে তৈরী করতে হয় একদিকে নির্যাতিতের ধারক বাহকরূপে অন্যদিকে স্বাধীনতার আলোকোজ্জ্বল স্তরের সোপান ধরে তোরণে পৌঁছার সংকল্পে। যা মিথ্যে তা ঝরে পড়ুক, যা আদি ও আসল তাই মূর্ত হোক। তবে কুসংস্কার ও অজ্ঞতা বা অত্যাচারের নিষ্ঠুর হাত দমনে যে মনোসংগ্রাম ও আধুনিকতাকে স্বাগত জানাতেও দ্বিধা থাকে না একজন সৃষ্টিশীল মানুষের মনন ও চিন্তনে।
যদিও মানব জীবনও সংগ্রাম ও কৌশলে টিকে থাকার ইতিহাস। হাজার হাজার শতাব্দী ধরে নিজের অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখতে মানুষ পরিবর্তিত করে এসেছে এক কোষ থেকে বহুকোষী পর্বের স্তর। এ পর্বের কিছু মানুষ মন ও মননে পশুত্ব স্তর থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মানবিকতার স্তরে পৌঁছেছে। এটা ধ্যান ও সাধনার নিরন্তর শৈল্পিক মনোবৃত্তি। এখানেই মানুষ শুধু ভোগী নয় লালন করে স্রষ্টা-সত্তা। হয়তো বিবর্তনের হাত ধরে সৃষ্টিশীল মানুষ আরও নতুন কোন অবয়বে নতুন কোনো স্তরে পৌঁছে যাবে; এটা কল্পনা, আশা বা স্বপ্ন যাই হোক স্রষ্টা-মানুষ ক্রিয়াশীল থাকে ভবীষ্যৎ পরিভ্রমণে। শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক অনুধ্যান করেন সৌন্দর্য সৃষ্টির। মনের গভীর অতলে নাড়া দেন। পৃথিবীর রুক্ষ-আবিলতা ঢেকে প্রকৃতির রূপ মাধুরী ধারণ করেন আপন প্রতিভার স্ফূরণ ঘটান । সে সৌন্দর্যে ডুবে পাঠক অর্জন করে সৌন্দর্য পিয়াসী অন্তঃকরণ ও শৈল্পিক চেতনা। যা যুগে যুগে মনের পশুত্ব বিসর্জন দিতে সহায়তা করে। এ চর্চা মনকে করে শাণিত, মননকে করে উজ্জীবিত। প্রকৃতির রূপ বৈচিত্র আত্মিক জগতে প্রবেশ করে শিল্প স্ফূরণ ঘটায় শিল্পীর। যা সমাজকে, দেশকে জগৎকে আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত করে।
খাতুনে জান্নাত
খাতুনে জান্নাতের জন্ম সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ থানায় ১২ জুলাই ১৯৬৯।
পেশাগতভাবে শিক্ষকতা ও সমাজকল্যান মূলক সংগঠনের প্রধান হিসাবে বাংলাদেশের ৪টি জেলায় কর্মকান্ড চালান দীর্ঘদিন। ২০০৭-২০১৪ সাল পর্যন্ত বিলেতে বসবাস করার পর বর্তমানে বাংলাদেশে বাস করছেন।
১৯৮৯ সালে একটা জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় তাঁর লেখা ছড়া , গল্প প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৭ সাল থেকে বিলেতে অবস্থানকালে আবার সাহিত্যচর্চা শুরু করেন নতুনভাবে। তাঁর কবিতা নস্টালজিক অনুভূতি, নারী মুক্তি, প্রকৃতি, বোধ ও বিভেদ আবহ, ও উজ্জীবনমূলক।
কবিতাগ্রন্থ: দিনান্তে দেখা হলে (২০০৯) জীবনের কাছে ফিরে (২০১০), নিরন্তর রোদের মিছিলে (২০১২), মুঠো খুলে দেখি(২০১৬)। নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ‘ দ্য রে অফ লাইফ এন্ড নেচার‘ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। এছাড়া বাংলাদেশ, ভারত, জার্মান, স্পেন ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের পত্রিকায় বাংলা কবিতা ও তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে। উপন্যাস :শিউলির কথা (২০১৯)।
পুরস্কার: লক্ষীপুর সাহিত্য সংসদ পুরস্কার ২০১৬, কবিবরণ সম্মাননা ২০১৬ , বিশ্বশান্তি পদক ২০১৮ এবং কৃত্তিবাস স্মারক সম্মান।
কাব্যিক শৈলীতে লেখা অনবদ্য গদ্য ।
সব সময় শুভকামনা ➰🌼