জাফর তালুকদার
এখন একটা কিছু না করলে আর নয়। কিন্তু সেটা যে কি তা ঠিক বুঝতে পারছি না। এমনিতে বাদাইম্যা মানুষ। তারে নারে করে জীবনটা পার করছি। এর লেজুড়, ওর লেজুড় ধরে চলছে ঠেলেগুঁতিয়ে। গ্রামে নানা রকম আওয়াজ দিয়ে চললেও বউ ছেলেমেয়ে ঢাকায় আনার সাহস হয়নি এখনো। সেই যে নব্বইতে এসে সিপাইবাগে রুস্তুমের মেসে সিপাই হয়ে ঢুকেছি, আর সুযোগ হয়নি সিপাহসালার হবার। টিনের ছাপরা ঘরের একটা খুপরিতে তিনখানা খাটের একটি দখল নিয়েছি মৌরসি পাট্টার মতো। বাকি দুখানায় আসা যাওয়া চলে অবিরত। বর্তমানে যে দুই মহাত্মা সেখানে অধিষ্ঠিত, এর একজন ইঁদুর চিকার মহামান্য ক্যানভাসার। তার মাইকের উৎপাতে মেরাদিয়া, ভূইয়াপাড়া, গোরান আর মৌলভীরটেকের তাবৎ তেলাপোকা, ছারপোকা, ইঁদুর মন খারাপ করে চলে গেছে নিরাপদ জোনে। দ্বিতীয় মহাত্মাটি শেক্সপিয়ারের ভাষায় উচ্চশিক্ষা নেবার পর কিছুদিন কলম পিষেছেন একটা কোমল পানীয়ের কোম্পানিতে। একসময় মনে হলো এটা তার উত্তম জায়গা নয়। কিছুদিন ধানাইপানাই করার পর বয়সটার বারোটা বাজিয়ে এখন নেইলকাটার বিক্রি করছেন দোকানে দোকানে। এই দুই চিজের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কম। ঘোর নিশীথে তিন নিশাচর আধমরা শরীরখানা টেনে টেনে নিয়ে এসে আমখাটের ক্যাচরম্যাচরে ফেলে দেন আলুর বস্তার মতো। ফেলতে বাকি, মুহূর্তের মধ্যে নাক ডাকার বিউগল শুরু হয় উৎসবের আমেজে। দুঃখিত, আমার মহৎ পেশাটি সম্পর্কে বিশদ কোন আলোচনায় না যাওয়াই ভালো। ভদ্র ভাষায় একে যেখানে রাত, সেখানে কাত বলাই যুক্তিযুক্ত। কাজকর্মের বাজার তো ফক্কা। তালতলায় তাল কুড়ানো তো কম হলো না! ফুটপাথে দশ,বিশ টাকার ফুটাফাটা কাপড় বেচে যে দুটো পয়সা হতো, করোনায় সে-পথও বন্ধ । এখন আর এসব মানাচ্ছে না। বয়স হয়ে গেছে। এই যে চোখের সামনে তালতলাটা বেইলি রোড হয়ে গেল, সে তো ওই খানাখাদ্যের সুবাদে। এরকম একটা ঝকমকে খাদ্যের দোকান খুললে কেমন হয়? কোন দিকে তাকাবো? ডানে বামে আগুন ধরে আছে। কত কি সব নামের বাহার! পুরো চলন্তিকা অভিধানখানা ঝেড়েমুছে লাগিয়ে দিয়েছে সাইনবোর্ডে। আহা,ম্যাংগো ট্রিও আছে দেখছি! আমি বরং আরও একটু বেশি দেশজ করে গাব নয়তো ডেউয়া বেছে নিতে পারি। একটু দ্বন্দে পড়ে গেলাম। গাব না ডেউয়া। ডেউয়া না গাব। দ্যত শালা, ঘোড়ার আগে গাড়ি? আগে শুরু হোক ব্যবসা। তখন কচু, ঘেটু একটা দিলেই হবে। বাঙালি আনকমন ভালোই খায়। আচ্ছা, সামনের নতুন বালাখানাটা একটু ঢুকে দেখি তো। আহা, কি নামের ছিরি! ‘ব্যাম্বু।’, হ্যাঁ, ব্যাম্বুই বটে। সিঁড়ি থেকেই শুরু হয়েছে তাদের কারুকাজ। বাঁশ, চাটাই,চট,মাদুর, পাটি, শিকা, হোগলা, রিক্সার হুড– যত হাবিজাবি আছে, সব গাল্লুগুল্লু করে একখানা আজব চিড়িয়াখানা বানিয়েছে ছোকরা মালিক। এমবিএ বিদ্যাটা পুরোপুরি বিনিয়োগ করেছে উর্বর মস্তিষ্কে। ঠান্ডা বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে এলো। পায়ে পা তুলে সহসা বেড়ে গেল প্লাস্টিক স্যান্ডেলের নাচন। আরে বাবা, এতো নাচানাচির কি হলো!বাম জুতার ফিতাটা ছিঁড়ল কখন! প্যান্টের তলায় কাদা লাগলো কোত্থেকে? ঢাকাটা ডাস্টবিন হয়ে গেল দেখছি! ভদ্রলোকের নিরাপদে হাঁটাচলার জো নেই। এবার একটা গাড়ি না হলে আর চলছে না। ‘ব্যাম্বুর’ ছেলেটা মেনু হাতে ব্যাম্বু দেবার জন্য প্রস্তুত। সারা সন্ধ্যায় এই জিনিস দেবার সুযোগ ঘটেনি এখনো। একজন যা পাওয়া গেল, সে যত লেজ নাড়ে, আসল কাজ তো কিছুই না। মেনুটা এমন ভাবে পড়ছেন, যেন কাল সকালে ওটা নিয়ে পরীক্ষায় বসবেন। এভাবে মাগনা ঠান্ডা বাতাস খাবার আর সুযোগ না দিয়ে ছেলেটি এবার অর্ডার লেখার জন্য ঝুঁকে পড়ল–”স্যর, প্লিজ।” স্যারের আসন এতক্ষণে গরম হয়ে উঠলো। হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে কাউন্টারের এমবিএর কাছে গিয়ে তারিফের ভঙ্গিতে হাসলেন একটু–”বাহ, দারুনতো সাজিয়েছেন ভেতরটা! নতুন আইডিয়া আপনাদের। মনে হচ্ছে, গ্রামের কোন বাড়িতে ঢুকেছি। হবে, হবে, আপনাদের হবে।” ছেলেটি খুশি হলো।কিন্তু একেবারে ব্যাম্বু না নিয়ে খালি যাচ্ছি দেখে কিছুটা হতাশও– “স্যার, কিছু খেলেন না?” উত্তরে দুহাতের একটা ভঙ্গি করে ঠোঁট বেঁকিয়ে বললাম,”নিশ্চয়,নিশ্চয়,খেতেই তো এসেছিলাম। কিন্তু আমার ফেইভারিট চপচুই রাইসের আইটেমটা দেখলাম এখানে নেই।হাওয়েভার, আর একদিন ফ্যামিলি নিয়ে আসব। আজ একটু মিটিংয়ের তাড়া আছে। আচ্ছা চলি, বাই।” সিঁড়িতে লাফিয়ে নামতে নামতে একটু মধুর বাক্য উড়ে এলো কানে– “শালার বাদাইম্যা।” পাত্তা দিলাম না। সোজা চলে এলাম ফুটপাতের হাবুইল্যার চায়ের দোকানে। দশ টাকার মলিন নোটখানা আর একবার স্পর্শ করে একটু সাহসী হলাম। গলায় বিপুল তেজ নিয়ে বললাম, “এই পিচ্চি, লিকার মাইরা হাফ চা দেতো। আর শোন, ছোট দেখে বনরুটি দে একটা। এখন আর ডিনারে যাব না। সময় নেই।”
জাফর তালুকদার
জন্ম: ৯ অগ্রহায়ণ ১৩৪৯, মল্লিকেরবেড় বাগেরহাট।
স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
কর্মসূত্রে যুক্ত ছিলেন দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংস্থায়।
সম্পাদনা করেন বেশ কয়েকটি লিটিল ম্যাগাজিন।
বর্তমান ‘গল্প’ পত্রিকার সম্পাদক।
লেখকের গ্রন্থসংখ্যা ৩০
তাঁর অপুর অভিযান বইটি এম নুরুল কাদের সাহিত্য পুরাস্কারে ভূষিত হয়েছে।