মিঠু আর দুগ্গামাঈ
১
দুগ্গামাঈ দেখো ওই হ্যাঁ-পদ্ম না-পদ্ম ভাসে
জলে আর জলের দক্ষিণে
বালিটিকুরির ধোঁয়া যেদিকে উড়েছে সেই
অগ্নি না বায়ু না কোন ঈশানে নৈঋতে
ভাঙা ঘর আলো করা অদ্ভুত চাঁদের গ্রাম
চাদরে পানের নকশাকাটা
বুড়োবুড়ি গল্পে বসে সন্ধের রোয়াকে আর
চিলেকোঠা থেকে কার কোমল গান্ধার ভেসে যায়
দুগ্গামাঈ তুমি ওই ঠাকুরদালানে আছ
ক’বছর! কত পাল্কি ডুবে গেছে জলে!
হ্যাঁ-গঙ্গা না-গঙ্গা নাকি ইছামতী বিদ্যেধরী
কে তোমায় ছেড়ে গেল আমাদের অবরেসবরে?
২
বনবেড়ালের ছায়া রাঙাদিকে খেয়ে গেছে
হাড়গোড় উঠোনে ছড়ানো
দিদা হাসছে দিদা কেন হাসছে ওই
ওরা জানে, যারা জব্দ লাথে আর ভাতে
ওদের ঝগড়ার শব্দে ঘুমোতে পারি না আমি
হাতে ঝাঁটা মুখে বাপ-মা তুলে গালাগাল
আর নিতে পারছি না দুগ্গামা দ্যাখো মেঘ করে
এল আর শিউলিও ফুটেছে
বিনা বাক্যব্যয়ে যদি সব মেনে নিই ওই
সিঁড়িভাঙা অঙ্ক নিয়ে মুখে মুখে তর্ক নাও করি
রাঙাদি কি ফিরে আসবে, বনবেড়ালের ছায়া
যাকে খায়, সে কি ফেরে? সংসার গোছায়?
৩
অধিকন্তু নামে এক ভদ্রলোক তার বউ উপর্যুপরির
সঙ্গে এ বাড়িতে এল, তাদের ছানারা
নাক খুঁটে গুলি করে লেপে দিল ঠাকুরগলিতে
এটুকুই কথা, আর দুগ্গামাঈ, আমারও কপাল
পায়রাকে খাওয়াতে যাব, কী যে ঝটকা
কে যেন জামার খুঁটে বেঁধে দিল পাঁচ দশ নয়া
এদিকে উপর্যুপরি আর তার অধিকন্তু বর
ভালোমানুষের মতো ভাজামাছ সোজাপিঠে খেয়ে
চোরের মায়ের গপ্পো আমাকে শুনিয়ে চলে গেল
৪
ওদিকে বুবুদি আর কড়িমাসি ঘরে দোর দিয়ে
কী যে করে কী যে খায় গন্ধ আসে আখের গুড়ের
ঘেন্নাপিত্তি কিছু নেই বড়মা গোপাল খাটে তুলে
মশারি টাঙায় আজও দশ কুড়ি বছর পেরিয়ে
বুদবুদের আলো নাকি আলোর বুদবুদ
খিড়কি পুকুরের ঘাটে ফর্সা গা-গতর নেমে আসে
সাবানের এত নেশা, দুগ্গামাঈ, আর জনমেও
ওই ঘাটে ফেলে যেও, ধুলোময়লা তুলব ঘষে ঘষে
বুবুদি না কড়িমাসি নাকি ওই বড়মা যেখানে
‘শুকসারি’ লিখে রাখে, রেখো সেই উতল কাঁথায়
৫
গিরিবালা নাকি কষামাংস নিয়ে ধুন্ধুমার
ইল্লতে ছেলেরা আর রাগে অন্ধ ঠাকুরমশাই
কলতলায় শ্যাওলা আমি পড়ি কি না-পড়ি হাতে
দুব্বোঘাস, আমের পল্লব
বিচিসুদ্ধু গিলে খাবে বাপের জন্মেও যেন
কাঁঠাল দ্যাখেনি ওরা যত্তসব নিখাগির দল
ছোটুমামা বিবিমামা কবেই মরেছে তুমি
আমাকে নিও না আমি যমেরও অরুচি
এবাড়ি আমাকে খায় প্রতিদিন মাঝরাতে
সকালে ওগড়ায় আর রোজ রোজ পাল্টে যাই আমি
দুশো ছাপ্পান্নটা হাড় সাতাশে নেমেছে আমি
মাছেরও অধম তুমি আমাকে খেও না দুগ্গামাঈ
নিজেই নিজেকে গিলে বেঁচে আছি দু’দশক তিনদশক তিনছয়নয়
৬
মিঠু জানে, একদিন ম্যাজিক হবে। জ্বরের ঘোরের মতো মেঘ করে আসবে আর নাকে-কানে গয়নার ঝামর তুলে নেমে আসবে মুখ। জলে জল চতুর্দিক এ কেমন পুজো বাপু আমাদের কালে কত আলো ছিল কী সরল রাস্তা ছিল এপাড়া ওপাড়া। পান সাজতে সাজতে দিদা ভুলে যেত রান্নাঘর। মিঠু জানে, সেই থেকে অবেলায় নাওয়ার অভ্যেস। উঠোনে আলতার ছোপ, ফিরে এল, জলে ডোবা মেয়ে? শাড়ি ভেসে চলে গেছে তিনকুড়ি বয়েসের পার।
দুগ্গামাঈ কিছু কিছু জানে তার। মিঠু যা জানে না
মিতুল দত্ত
জন্ম : ১২ অগাস্ট, ১৯৭২
পেশা : লেখালিখি, গানবাজনা
প্রকাশিত কবিতার বই : জানলা জুড়ে মেঘ (প্রথম আলো, ২০০০); মরণ! (পদ্যচর্চা, ২০০১); বিদূষক ও সৌদামিনী (আনন্দ, ২০০৩); মায়াবী লিবিডো (সপ্তর্ষি প্রকাশন, ২০০৮); যে মেয়েটি গোপনে গিটার (শুদ্ধস্বর, ২০১০); এম টু এম (ওরা, ২০১৪);আমাদের কালো সাম্যগান (কলিকাতা লেটারপ্রেস, ২০১৫); বেড়াবিনুনি (ভাষালিপি, ২০১৬); উইকএন্ড ( গুরুচণ্ডা৯, ২০১৭); প্রকাশিত কবিতা ও গল্পের সংকলন : রঙ্গিলাজন্ম (ছোঁয়া, ২০১৩); প্রকাশিত গল্পের মিনিবুক: কচ্ছপের ডিম (কবিকথা, ২০০৬);
প্রকাশিত গদ্যের বই : পেইনকিলার (ইতিকথা, ২০২০)
প্রাপ্ত সম্মান : ট্রাভেল গ্রান্ট, সাহিত্য একাডেমি (২০০৪); সংস্কৃতি অ্যাওয়ার্ড (২০০৬)
যুব পুরস্কার, ভারতীয় ভাষা পরিষদ (২০১২); কৃত্তিবাস পুরস্কার (২০১৪); বাংলা সাহিত্যে মিনিস্ট্রি অব কালচার-এর জুনিয়র ফেলোশিপ (বিষয়: ১৫০ বছরের বাঙালি মহিলাদের আত্মজীবনী, ২০১২-১৩)।