আয়না
সবুজ কুঠার দিয়ে কেটেছি কালো গাছ
সবুজ বর্শা দিয়ে গেঁথেছি কালো মাছ
সে-কুঠার ঐতিহাসিক, সে-বর্শা চিহ্নের মতো
বিস্ময়! তাদের গল্পে দম ফেটে ফেটে অনুনাসিক।
পৃথিবীর জাদুঘরে সময়ের কঙ্কাল রাখা আছে
তার পাশে সবুজ কুঠার, বর্শার ধার। তাদের
চোখ ঘষে ঘষে দেখতে আসে মহাকাল!
কুঠারের গতি, বর্শার ভেদ
সময়ের পাতা উল্টে এনেছে যে অনুচ্ছেদ:
সেখানে গাছ নাই, পাখি নাই। ক্ষতি কি!
সবুজ কুঠারে কেটেছি কালো গাছ, চেতনা
তাকেই বলেছে প্রগতি!
১৭.০৭.২০২০
দুপুর ২.১৬
আয়না বিবি
বয়সীরা উপুড় করে রাখে আয়নার বুক
সাজ শেষে। বাসন কোসনের পরিচর্যা সেরে
গুছিয়েছে নিজেদের মুখ।
নবীনারা উপুর করে রাখে আয়নার দেহ
বেণিতে জড়িয়ে ঐতিহ্যের স্নেহ আর
জননীর ঘোর সন্দেহ।
আয়নাগুলো উপুড় উপুড় হয়ে থাকে। সকাল
দুপুর, রাত। গৃহস্থের ভালো মেয়েরা, সংস্কার
পুষে রাখে।
আয়না এনেছে গঞ্জের বেপারী, সাত ঘাটে
জল খাওয়া কুটিল বেসাতিতে। পিতা সংকোচ
ঢেকেছিল কেশে, কন্যাকে দিতে দিতে।
সে-এক যুগ, তখন খ্রিষ্টাব্দ খুঁজিতেছে
টাকার বিস্ফোরণ: কিশোরীর মুখে সবে
ছোট ছোট ব্রণ! নিমের কষের সাথে যুদ্ধে
নেমেছে নবীন বিজ্ঞানের ফলিত দ্রবণ।
গঞ্জের শরীরে আছে নিষিদ্ধ বাক। সেই
বাড়িটার পরে আর পৃথিবীই নাই! পঞ্চায়েত
নিষেধ করে দিয়েছিল। আবার বলেছিল:
আচ্ছা থাক।
জোয়ানেরা নিতেছে নতুন অভ্যাস
বয়সের তামাশায়। ভাবা যায়!
বউঝিরা শুনেছে স্বামীদের কাছে:
আয়না বিবি এক আছে, পৃথিবীর শেষে যে ঘর
তার লাগোয়া আমাদের গঞ্জের শহর। ইস্কাপনের
বিবির শরীর তার, আসরে চিত হয়ে শোয়। তার
দেহে আয়নার আছর। কাছে গেলেই তুলে নেয়
বুকের উপর।
গৃহস্থের ভালো মেয়ের আয়নাতে ডর।
১৭.০৭.২০২০
সোলায়মান
সোলায়মান ওহ্ সোলায়মান
আগুনের বুকে ছুড়ে দিল
ক্রোধের কামান, আগুনে ফুটিল
ফুল। তোমার জীবন কবুল
করে নিয়েছিল আল্লাহ রসুল।
এখানে জাদু ছাড়া বেঁচে আছি
তোমাকে ছাড়া, আল্লাহ ছাড়া
একা একা সত্যের কাঙাল।
আজ ভাইয়ের জন্য শোক করি
নিজের জন্য রখেছি আগামীকাল
আমরা জানাজায় দাঁড়িয়েছি, বুক
ঠেসে ভরা: ক্রোধ আর শোক
তাকবির দিয়ে বলে উঠলাম:
কোকর কোকর কোক!
সোলায়মান ওহ্ সোলায়মান
ওদের হয়ে চাই নির্মোহ ক্ষমা
আমাদের কণ্ঠ তুমি কর তর্জমা!
ছেলেগুলো কাঁদছে না, শোন!
তাদের মা, বলেছিল ধর্ষিতা মেয়েটি
তার সন্তান, বোনও। সংবাদ তাকেই
ডেকেছে বেশ্যা। ছেলেগুলো কাঁদছে না
শোন। এক দঙ্গল ছেলে এই লোহার
জঙ্গলে, মায়ের মঙ্গলে, কাঁধের ঝোলা
ফেলে ফোলা ফোলা স্বরে চেঁচিয়ে
উঠল: চিঁহি চিঁহি হ্রেষা।
সোলায়মান ওহ্ সোলায়মান
তাদের তুমি করে দাও ক্ষমা।
ছেলেদের কণ্ঠগুলো কর তর্জমা।
তাদের বহর ভেসে চলে ডাঙায়। ঘোড়ায়
চড়িয়া মরদ পিছে পিছে হাঁটিয়া যায়। খুব
প্রবল গোল মুদ্রা ছিটায় আমাদের দিকে।
ছোঁব না। অমাদের কণ্ঠে: বুনো শূকরের
ঘোঁৎ ঘোঁৎ।
সোলায়মান ওহ্ সোলায়মান
বেলাও ফুরায়। ফেরেস্তারা আমাকেও চাইছে
ফেরত। তোমার কাছেই প্রার্থনা জমা:
আমাদের কণ্ঠগুলো করে দিও তর্জমা।
১৬.০৭.২০২০
হত বাক
মাস খরচের কিছু টাকা আর কিছু ভাষা আমার হাতে আছে। আমি
হিসেব মতো খরচ করে সংসার চালাই। মুদির দোকানে সদাইপত্রের
জন্য কিছু টাকা আর কিছু কথা খরচ করি। ট্রাফিক পুলিশকে কিছু
ঘুস দিতে হয়, তার সাথে প্রতিশোধ স্পৃহায় কিছু বাড়তি শব্দ খরচ
করে ফেলে অনুশোচনা করি। কাস্টমার কেয়ারে কিছু কথা না খরচ
করলে, বিলের হদিস পাওয়া যায় না। সন্তানদের উপদেশ দিতে হয়
বন্ধুর বিবাহ বার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে বেশ কিছু শব্দ খরচ
হয়ে যায়। রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার মতো আমার কাছে
মাসের উদ্বৃত্ত কোনো শব্দই অবশিষ্ট থাকে না।
১৪.০৭.২০২০
রাত ১০.২৬
গাছটি
আমাদের স্বার্থগুলো সব দৃশ্যমান। যেমন গাছে সম্ভাব্য হয়ে আছে—শয়নের খাট।
তার দেহ শেয়ার বাজারের গ্রাফ, সবসময় ঊর্ধ্বমুখী: ভাবে ব্যবসায়ী। সে নারীর চেয়ে
গাছের শরীর, আলিঙ্গনে বেশি ভালোবাসে। বাহু-ডোর সর্বদাই ভালোবাসার পরিমাপ।
শিকড়ের দিকে নিচু হয়ে নেমে গেছে পৃথিবীর তল। অর্থনীতি, সে আরো বিরাট!
সভ্যতার নির্বাহী বল: গাছটিকে গচ্ছিত রেখেছে করপোরেশনের হিসাবের খাতায়।
সে বসিয়েছে বাজার, হাজার হাজার ক্রেতার প্রতিযোগিতার পর, তাকে ডেকে নেবে
বিজ্ঞানের বিভাজন-ঘর। তাকে চিরে, ছিঁড়ে, গেঁথে বানানো হবে যে খাট, তারও
বাজার বিরাট! হাজার হাজার ক্রেতার প্রতিযোগিতার পর তাকে নিয়ে রচিত হবে
তোমাদের বাসর। ভোর হবে, হয়, এই খাট ধারণ করেছে তোমাদের ঘুম আর প্রণয়।
তোমরা যখন প্রেমে নিঃস্বার্থ যুগল, অর্থনীতি তখনো পূর্ণ, প্রবল। তোমাদের চুম্বন
তাকে শূন্য করে নাই। প্রতিদিনের ক্ষয়—তোমাদের ও শয্যার, সমন্বয় করে নেয়
তার মূল্য তালিকায়। তোমরাও প্রতিদিন সেই দাম ধরে নিজেদের কর ক্রয়-বিক্রয়।
১৩.০৭.২০২০
দুপুর ১২.৫০
জেনিস মাহমুন
জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৬৯; ঢাকা।
ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।
প্রকাশিত বই : ১২টি কাব্যগ্রন্থ।
গত বছর ‘অসমগ্র’ নামে ৭টি কাব্যগ্রন্থ একসাথে প্রকাশিত হয়েছে।
ই-মেইল : [email protected]