[মানুষের কাজই তাঁকে আলাদা করে চিনতে শেখায়। জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) ও পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ (২০১১) লিখে পাপড়ি রহমান নব্বই দশকের সেরকম একজন ব্যতিক্রমী এবং উল্লেখযোগ্য কথাশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। আমরা আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, সাহিত্য ক্যাফে পাপড়ি রহমানের স্মৃতিগদ্য ‘সুরমাসায়র’ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করবে । আমরা পাঠকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি স্মৃতিগদ্যটি নিয়মিত পড়ার জন্য। – সাহিত্য ক্যাফে]
মোমবাতি, তারাবাতির আলোয় ভরা সৌভাগ্য রজনী
রেললাইনের ধারঘেষে বহু বছর ধরে গড়ে ওঠা কলোনীতে পাশাপাশি দুটো করে বাসা–যারা একটার গায়ে আরেকটা একেবারে বিশ্রীভাবে গা এলিয়ে পড়া। এইরকম দুটো জোড় বাসা পরে পরে কিছুটা জায়গা গ্যাপ দিয়ে আরও দুটো করে বাসা। তবে এই নিয়ম ভেঙে কিছু কিছু বাসা একেবারে দলছুট হয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতো। আমাদের বাসাটাও দলছুট হয়ে অন্যদের সাথে খানিকটা ব্যবধান গড়ে নিয়েছিল।আমাদের বাসা লাগোয়া ছিল শুধুমাত্র একটা বাসা।এই দুই বাসার অতি সন্নিকটে অন্য কোনো বাসা ছিলনা। অবশ্য থাকলেও কিছু আসতো যেতো না।কারণ আমার আম্মা সবার সাথে মেলামেশা করতো না। অর্থাৎ আমাদের গ্রামের বাড়ি রেওয়াজ মানে করটিয়ার বাছবিচার এখানেও বহাল ছিল। করটিয়াতে যেমন চৌধুরী,মুন্সী আর কাজিবাড়ি ছাড়া চাচিমা-আম্মারা অন্য কোনো বাড়িতে যেত না।তাও ওইসব বাড়িতেও যাওয়া-আসা ছিল আত্মীয়তার সূত্র ধরে।সিলেটে আসার পর একই অবস্থা জারি রইলো। বড়চাচিমা যা-ও দুই-চারটা পরিবারের সাথে মেলামেশা করতো, আম্মা তা-ও করতো না। আম্মা বরাবরই উন্নাসিক প্রকৃতির। আমার নানা ছিলেন জিপিওর পোস্টমাস্টার ও নানারা ছিলেন উচ্চ বংশীয় মীর। ফলে আম্মা কখনই সবার সঙ্গে মেলামেশা করতো না।আম্মা তার মনপছন্দ কলোনীর দুইটা পরিবার ছাড়া কারো সাথেই তেমন মিশতো না। কিন্তু না মিশলেও সবার সঙ্গেই আমাদের সদ্ভাব ছিল।এবং এই সদ্ভাব টের পাওয়া যেত শব-ই-বরাত, রোজা, ঈদ বা পূজা এলে। আমার বেলায় আম্মার নাক উঁচা ভাব বা বংশগরিমার বাছবিচার তেমন কার্যকরী ছিলনা। প্রায় সবার বাসাতেই যাওয়ার এখতিয়ার আমার ছিল। আমার সমবয়সী বা বয়সে সামান্য বড় মেয়েরা যেসব বাসায় ছিল, আমি তাদের প্রায় সকলের বাসায়ই যেতাম খেলাধুলা করার জন্য। দড়িলাফানো থেকে শুরু করে ইচিংবিচিং,পুতুলের বিয়ে,বউচি খেলার বউ হতে হতে আমার বিকেল ঢুকে পড়তো সন্ধ্যার আলোআঁধারির সীমা রেখায়। আর যাদের বাসায় বইয়ের স্তূপ ছিল তাদের বাসায় আমি অবধারিতভাবেই যেতাম, বই পড়ার তীব্র নেশায়। দিব্যি নাওয়া-খাওয়া ভুলে বই পড়েই সেইসব বাসায় আমি সারাদিন কাটিয়ে দিতাম। এ নিয়ে ওইসব বাসার কেউ আমায় কিছু বলতো না। তবে অবশ্যই আমার এই আকছার বড়দের বই পড়া আব্বা-আম্মার অগোচরেই হতো।
আব্বা জানলে কী পরিমাণ মারধর আমাকে খেতে হবে বিবেচনা করে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হতো।আব্বা আমাকে বরাবরই জন্তু জ্ঞান করে পিটাতো। শুধু আমাকে নয়, আমার একমাত্র ছোটভাইটিরও এ থেকে নিস্তার ছিলনা। পান থেকে চুন খসে কি খসে নাই আব্বা প্রচণ্ড আক্রোশে বন্য ষাঁড়ের মতো আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। হাতের কাছে যা পেত তা দিয়েই প্রচণ্ড প্রহার করতো। আমার দুইবাহু, পিঠ, আর উরু থেকে পা পর্যন্ত নীল নীল জখমে ছেয়ে থাকতো। একটা আঘাতের উপর অবলীলায় আরেকটা আঘাত এসে পড়তো। আমি অনেক সময় আমার গায়ের রঙ নিয়ে দোটানায় পড়তাম। আমার গায়ের রঙ আদতে কেমন? তা হলদেটে না ধপধপে শাদা না নীল নাকি কালসিটে? অথচ আমরা দুইভাইবোন তেমন কোনো দোষে দোষী ছিলাম না। আমাদের অপরাধ বলতে ছিল, বাসার বাইরে যাওয়া। হয়তো দুপুরে আব্বা-আম্মার রেস্টের সুযোগ নিয়ে আমরা দুই-ভাইবোন বাসার বাইরে টইটই করতে যেতাম। আমার ছোট ভাইটি যেত ঘুড়ি ওড়াতে।বা অন্য বালকদের সাথে খেলতে। আমিও তাই, বাইরে যেতাম খেলার জন্য বা কারো ব্যক্তিগত বইয়ের লাইব্রেরীতে মুখ গুঁজে দেয়ার জন্য। বেশিরভাগ সময়ই ঘর থেকে বাইরে বের হওয়ার জন্যই আমাদের গরুপেটা করা হতো। আব্বা কিছুতেই চাইতো না আমরা কলোনীর অন্যদের সাথে মেলামেশা করি। আম্মাও তাই। দুইজনেই হয়তো ভাবতো অন্যদের সাথে মিশলে আমরা খারাপ হয়ে যাবো। কিন্তু আমাদের মন ছুটে যেত খেলাধুলা করার জন্য। বাইরের জগত আমাদের হরহামেশাই হাতছানি দিয়ে ডাকতো। আব্বা আমাকেই বেশি মারধর করতো। কোনোদিন প্রহার অতিরিক্ত হয়ে গেলে নিজেই অঝোরে কাঁদত। আমার নামে আব্বা্র কাছে নালিশ দেবার জন্য লোকের অভাব ছিল না। আম্মা তো ছিলই, আম্মার সঙ্গে ছোটকাও ছিল। এদের কাজই ছিল আমাদের ভাইবোনের পিছু লেগে থাকা। শাসনের নামে প্রহার আর গালিগালাজ খাওয়ানো। আমি অবশ্য মাঝেসাঝেই বিদ্রোহ করে বসতাম।
আমাদের পরিবারে আরেকটা বিষয় ছিল, সবাই সব বিষয়েই ছিল অতি জ্ঞানী। সবাই সব বিষয়েই উপদেষ্টা। এবং চান্স পেলেই তাদের অধিত জ্ঞানে আমাদের জ্ঞানী করে তোলা। ওইসব বিষয় আজ অব্দিও বহাল রয়ে গেছে। কথায় বলে না স্বভাব যায় না মইলে! ফলে বয়সের গাছপাথর তাদের চাপা দিতে চাইলেও কারো কারো স্বভাব ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে। জ্ঞান ঝাড়তে পারলেই তারা যেন বাঁচে। যদিও আমাদের বয়স হয়েছে ঢের আর আমরাও জ্ঞান-অজ্ঞানের নৌকায় বহুকাল ধরেই ভেসে চলেছি। কিন্তু উপদেষ্টার পদ থেকে তাদের অবসর মেলেনি। মেলেনি নয়, আদতে তারা কেউই অবসর নিতে চায়নি। বড়দের নানান অত্যাচার, শাসন, ভালোবাসা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের মাঝেও আমাদের পরবগুলি ঠিকঠাক এসে যেতো।
শব-ই-বরাত ঘনিয়ে এলেই আমরা উৎসবে মেতে উঠতাম। বড়চাচিমা দশ থেকে বারো সের আতপ চাউল ভিজিয়ে দিত। আর মর্জিনার মা বা মনিরার মা এসে গাইল-ছিয়া দিয়ে ধাপ্পুরধুপ্পুর করে আটা করতে লেগে যেত। গাইল-ছিয়ায় আটা কুটার অদ্ভুত সুন্দর ভঙ্গিমা ছিল। নাচের ভংগিতে দুটো হাত ছিয়া ধরে উপরে উঠে যেত, পরক্ষণেই নেমে আসতো গাইলের ভিতরে। এতে ভেজানো চাউল ধীরে ধীরে আটায় রূপান্তরিত হতো। সে আটায় রুটি বানানো হতো। সঙ্গে গরুর মাংশ। তখন শব-ই-বরাত এলেই এদিকসেদিক দুই-চারটা গরু কাটা হতো। কাটা গরুর মাংশ ভাগা হিসেবে বিক্রি হতো। আমরা বলতাম– ‘ভাগের মাংশ’। ওই ভাগের মাংশের স্বাদ ছিল অতুলনীয়। বানানো হতো বুটের হালুয়া আর সুজির ফিরনী। বড়চাচিমা বা আম্মা হাফপ্লেটে করে ট্রের উপর সাজিয়ে দিত হালুয়া-রূটি। আম্মা বাঁশের বড় জালি দিয়ে ঢেকে দিত ট্রে। সেই জালির উপর বিছিয়ে দিত ‘খানপোষ’(খাঞ্চার উপরে দেয়া ঢাকনি বিশেষ)। ক্রুশকাঁটাতে নানান বর্নিল সুতা দিয়ে আম্মা বছর জুড়েই নানা কিছু বুনে যেতো। লেস, টেবিলক্লথ, জামার হাতা, তেপায়ায় ঢাকনার সঙ্গে আম্মা এই জালির ঢাকনাও বুনতো। আমি আমার সুন্দর ফ্রকটি পরে সেই নান্দনিক ঢাকনা দেয়া ট্রের রুটি-হালুয়া পৌছে দিতাম কলোনীর প্রায় সব বাসায়। অন্য বাসা থেকেও দেদার আসতো এই হালুয়া-রুটি। বছরের এই একটা দিনে আমরা অন্য বাড়ির রান্নার স্বাদ চেখে দেখার সুযোগ পেতাম।
বাসায় বাসায় এই হালুয়া-রুটি বিলানো ছিল আমাদের কাছে মহা আনন্দের কাজ। কিন্তু শব-ই-বরাতের আসল আনন্দ তখনো বাকি থেকে যেতো। আমি আর আমার ছোটভাই মোমবাতির জন্য আব্বার কাছে বায়না ধরতাম। মোমবাতি এলে তারাবাতি আসবে না তাই কি হয় নাকি? আব্বা মাত্র দুই প্যাকেট তারবাতি এনে দিত। আমরা দুইভাইবোন সেটাই ভাগ করে নিতাম। এক প্যাকেট থেকে ভাইকে দিতাম চারটা আমি নিতাম তিনটা। কিন্তু সব তারাবাতি ভাই-ই জ্বালাতো। আমি ভয় পেয়ে দূরে সরে থাকতাম। তারাবাতিতে অদ্ভুত সুন্দর আলোর খেলা ছিল। মাথায় আগুন ধরালেই ঝিরিঝিরি তারার মতো আলোর ঝর্না বেরুতে শুরু করতো। তারাবাতির সৌন্দর্য দেখার জন্য অন্ধকারের দরকার হতো। আমরা তাই আমাদের বাগানের গাঢ় অন্ধকারে তারাবাতি জ্বালাতাম।
তারাবাতি মাত্র দুই প্যাকেট এলেও মোমাবতি আসতো কিন্তু তিন-চার প্যাকেট। বাসার সামনের এক চিলতে বারান্দার আমরা সেই মোম সারিবদ্ধভাবে জ্বালিয়ে দিতাম। এখন যেমন দেয়ালির রাতগুলোতে আলো জ্বালানো হয়, ঠিক তেমনি করে আলো জ্বালাতাম। শুধু আমরা নয়, কলোনীর অন্য বাচ্চারাও আমাদের মতো একইভাবে মোমবাতির আলো জ্বেলে দিত। আমরা শুধু বাইরের বারান্দায় নয়, ভেতরের বারান্দাতেও মোমের আলো জ্বালিয়ে দিতাম। আব্বা একটা পটে চাউল রেখে তাতে একগোছা আগরবাতি জ্বালিয়ে দিত। পরিবারের প্রায় সবাই রাতভর নামাজ পড়তাম। মোমের আলো গায়ে মেখে আগর পুড়ে যাওয়ার সুগন্ধে মাতোয়ার হতে হতে আমরা প্রার্থনা করতাম।
নামাজ অন্তে শীতলপাটিতে বসে সবাই একসাথে রাতের খাবার খেতাম। হালুয়ায় গা থেকে উড়ে আসা গরুর খাঁটি ঘৃতের ম-ম সুঘ্রাণে আমাদের মনোবেদনা দূরীভুত হয়ে যেত। বছর জুড়ে মার খাওয়ার কষ্ট আমরা ভাইবোন নিমিষেই ভুলে যেতাম।মোমের নরম আলো ফুরিয়ে যেতে যেতে সৌভাগ্য রজনীও ক্রমে গহীন থেকে গহীনতর হয়ে উঠতো। ঘুমে ঢলে পড়বার আগে শুনতাম, আব্বা খুব সুরেলা ও বিশুদ্ধ উচ্চারণে কোরান তেলওয়াত করে চলেছে…। (চলবে)
পাপড়ি রহমান
নব্বই দশকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন কথাশিল্পী। এ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। কথাসাহিত্যে কাজের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনাও। বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা গ্রন্থ ‘ ভাষা শহিদ আবুল বরকত’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর ভিন্নধারার উপন্যাসগুলি প্রকাশ মাত্রই বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) প্রকাশিত হয় মাওলা ব্রাদার্স থেকে। পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আট বছর বিরতির পর বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ (২০১৯)
২০২০ সালে উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ রি-প্রিন্ট হয় কলকাতার বনেদী প্রকাশনা সংস্থা ‘অভিযান’ থেকে।
তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন ২০১০ সালে। কলকাতার ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘সাদ’ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।