কিডন্যাপ
জংলা ফলের শাঁস তুমি বোবা মন
গাঁয়ের কিশোরী যেমন বহু হাত ঘুরে
পৌঁছোয় অচেনা উপকূলে
হাওয়ার টানা গর্জনে জেগে থাকে ভয়ে
আলো নিবে গেলে গোঙায়
লোহালক্কড়ের অন্ধকারে ঘুম-ঘুম বন্দরের হাঁটাচলা
পরস্পরবিরোধী বিশ্বাসের ফাঁকে তার চোখ
ঝুলে থাকে ভীত
ছবি
আজ ফের সব কিছু নতুন হয়ে উঠছে
কী ভাবে আঁকা হবে এই দৃশ্য, যার ভেতরের
রেখাগুলি নির্দেশ হয়ে এগোয় আর
যে-তারাটি ঘুমিয়ে পড়েছে তার নিদ্রাটুকু চায়
আলোর দিকে ছোটে মন, অন্ধকারের
দিকে নক্ষত্র সরে-সরে যায়
আমিও পিছলে গেছি অসুখের দিকে
যেখানে বর্ণিল জীবাণুরা দল বেঁধে
আঁকাবাঁকা সুরে
গাইছে নতুন মড়কের গান
হুমকি
এই যে মথ ওড়ে, ওরা মৃত শিশুদের পুরোনো মনখারাপ
এই যে ছায়া তোমার একলা গানে লম্বা হতে থাকে
তুমি গাইছ একা, নীচে থেবড়ে বসে
মেঝে থেকে ভাপ ওঠে— পূর্বপুরুষদের আশ্বাস
আর চেয়ার রয়েছে পাশে, যে তোমার সম্ভাব্য শ্রোতা
কান খাড়া করে দেয়ালেরা শুনছে
বের করে দিচ্ছে ওপারে
নীচে রাস্তায় খটখট কুচকাওয়াজ
ড্রপ খেতে খেতে আজই হুমকির গর্জন গলিতে ঢুকে পড়েছে
আজই আমরা বের করে দেখলাম কী কী সঞ্চয় আমাদের
মাটিতে গাঁথা কাঁসার থালার পুরোনো গর্ত
যার ঊপর সাজানো থাকত আমাদের সংকল্পগুলি
যার চারপাশে বসে আমরা রূপকথা শুনতাম
নিখোঁজ
এখন কোন দেশে, ঠিক জানি না
বলতেও পারি না— কত যে অপরূপ গাছপালা
শেষ আলোর ঝিলিক-দেওয়া নদী
সবেমাত্র পেরিয়ে এলাম
একেবারেই হারিয়ে যেতাম যদি
হয়তো খুঁজে পেতাম নিজেদের
ঘন সন্ধ্যা এখন কালো-কালো পাখি হয়ে চারপাশে উড়ছে
খুঁটিয়ে জানতে চাইছে আমাদের পরিচয়
চোখের তারার রংও চিনে নিতে চায়
শিশির পড়তে শুরু করেছে
অচেনা ঘাসের ডগায় টলটলে মাতৃবিন্দু
ওই অশ্রুগুলিই কি আমাদের হেঁটে যাওয়ার চিহ্ন?
রাত্রি
ভারী পাটাতন সরে গেল
শব্দ হল না
রাতের গোটা জনপদ আতঙ্কে হতচকিত
শুধু গুটিকয় মেয়ে অতীতের সন্ধ্যেগুলো ভুলে
যেখানে কেউ কোনোদিন মরেনি, সেই প্রান্তরে
গাইতে বেরিয়ে গেল
তাদের গান নিসুন্দি লতায় পাক খেতে খেতে
ডাঙায় লুটোয়
আকাশ অন্যত্র ফের খুলে গেল
তারা খসে পড়ল একটা দুটো তিনটে
তাদের ধিকিধিকি আগুনে
কেউ-বা নির্বাক, আলোর আড়ালে
একা-একা পুড়ছে
প্রত্নবস্তু
ঘিঞ্জি শহরে, হুল্লোড়ের ভেতর
শুনেছিলাম যুদ্ধের ঘোষণা
দেখেছিলাম প্রাচীন দিঘির ঘাটে
অপরূপ কাঁসায় ঝলমল করছে জলতল
স্ববিরোধ বলতে এইটুকুই
এবং যা-কিছু দৃশ্যমান, সবই নষ্ট হয়ে গেছে
আজ মাটি খুঁড়ে দেখি হারানো পেয়ালা
কানায় চিড়, বহুদিনের বহু আঙুলের ঘষটানিতে রং-চটা
তোমার নয়, তুমি তো হেঁটে যাচ্ছ হারিয়ে যাওয়ার পথে
গাইছ যদিও, পুরুষ না নারীকণ্ঠ– বোঝার উপায় নেই
একরাম আলি
জন্ম ১ জুলাই ১৯৫০, বীরভূম জেলার তেঘরিয়া গ্রামে। বর্তমানে কলকাতাবাসী। স্কুলেই কবিতা লেখার শুরু। সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র যখন, সম্পাদনা করেন ‘অনিয়ম’ পত্রিকা, যাতে কলেজপড়ুয়াদের সঙ্গে লিখেছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বিনয় মজুমদার, ভাস্কর চক্রবর্তী।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন।
প্রথম বই ‘অতিজীবিত’ বেরোয় ১৯৮২-তে। দ্বিতীয় বই ‘ঘনকৃষ্ণ আলো’র জন্যে পান বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার পান ১৯৯০-এ। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতাবই ৯টি। ভারত সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রক দ্বারা দু-বছরের জন্যে (২০০৯-২০১০) সিনিয়র ফেলো নির্বাচিত হন।
কিশোরদের জন্যে লিখেছেন জীবনীগ্রন্থ ‘অতীশ দীপংকর’।
এ ছাড়া রয়েছে গদ্যগ্রন্থ ‘মুসলমান বাঙালির লোকাচার’, ‘অ্যাপোলোর পাখি’। সদ্য বেরিয়েছে স্মৃতিকথা ‘ধুলোপায়ে’। এই গ্রন্থের জন্য তিনি একাডেমি পুরষ্কার পেয়েছেন। ৬৫ বছর বয়সে পৌঁছে লিখেছেন প্রথম উপন্যাস ‘দিগন্তের একটু আগে’, যেটি প্রকাশের পথে।
যুক্ত রয়েছেন ‘আজকাল’ সংবাদপত্রের সঙ্গে।