আমার শহর নয়কো তেমন বুড়ো
অতীতকালের অস্থি মুদ্রা চৈত্য বিহার কিছু
পাবে না তার কোথাও মাটি খুঁড়ে,
হঠাৎ কখন নদীর ধারে ব্যাপারীদের নায়ে
আমার শহর নেমেছিল কাদামাখা পায়ে।
এই তো সেদিন নারকেল আর খেজুর গাছের ঝোপে
অনেক ধুলোয় মলিন পা তার
অনেক ধোঁয়ার ঝাপসা দুটি চোখ,
আমার শহর ভুলে গেছে তার জীবনের আদি পরম শ্লোক
[শহর/ প্রেমেন্দ্র মিত্র]
এখন কেবলই বাংলা সাহিত্যের ‘শহর’ নামের কবিতাগুলো আমাকে ধাওয়া করে ফিরছে। আমি তাদের ভেতর দিয়ে দেখে ফেলি আমার ফেলে আসা শহরের মুখচ্ছবি। চারশো বছরেরও বেশি বয়েসি ঢাকা শহর, যেখানে একদিন কেটেছে জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিনগুলো, যেখানে আমি কাটিয়ে এসেছি বেঁচে থাকার সবচেয়ে দীর্ঘ সময়টুকু। দেখছি সেই শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ কী ভীষণ অসুখ। আকাশের দিকে তাকালে আকাশ কেঁদে ফেলে। মাটির দিকে তাকালে মাটিও গুমরে ওঠে। ওরা বলে, দেখো দেখো তোমার শহর আজ কী অসহনীয় বেদনায় ঝুঁকে আছে। বারবার করে বলে যাচ্ছে, যেখানে তুমি জন্মেছ, বড়ো হয়েছ, যে শহরের পথে পথে ঘুরে জেনেছ- কবিতা কী করে বেড়ে ওঠে, কী করে আবহমান বয়ে যায় চিরন্তনের দিকে। সেই শহর আজ দমবন্ধ পরিবেশে কোনো রকমের বেঁচে থাকছে, ধুঁকে ধুঁকে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সে এখন ভুলে গেছে তার পরিচয়ের অহংকার। ঢাকা শহর, তুমি তোমার এই উলঙ্গতাকে ঢেকে রাখতে কী ভীষণ অসহায় চোখে তাকিয়ে আছ। তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে ফিরে এসেছি বহুদূরে দূরদেশের এক সাজানো শহরে। যেখানে খানিকটা হলেও নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকার, মানবিকতা আছে, তবু শান্তি পাই না। আমার মন পড়ে থাকে তোমাতে। আমার হৃদয় আচ্ছন্ন থাকে তোমার ভালো থাকায়, মন্দ থাকায়! শিকড়, তুমি ছিঁড়ে যাও না কেন! নাকি নিজেই প্রতিদিন জল ঢেকে বাঁচিয়ে রাখি তোমাকে? এ কেমন টান, টান টান টেনে রাখে, কিন্তু ধরে রাখতে পারে না!
বেশ কয়েক বছর পর মাত্র কয়েকদিনের জন্য ঢাকায় গিয়েছিলাম, গ্রীষ্মকালে। অনুভব করলাম, চারদিক টগবগ করে ফুটছে। প্রকৃতি, জীবন, বাজার, রাজনীতি সব। এয়ারপোর্ট থেকে শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বুঝে যাই যানজট কত প্রকার ও কী কী এবং তা কতটা ভয়াবহ রূপে গ্রাস করছে ঢাকা শহরের সবকিছু! আগেও বুঝেছি, এবার আবারও নতুন করে বুঝলাম। হাজার হাজার মানুষ থই থই করছে চারদিকে। তার সাথে অগুনতি যানবাহন। পথ আটকে পথেই বসে আছে সব কিছু। প্রতিবার একটি বিষয় চোখে এসে ধাক্কা দেয়, তা হল- গতবারের তুলনায় মানুষ ও যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে ভিড়ের মাঝে ধাক্কা-ধাক্কি করে বেঁচে থাকা জীবন। সকলেই ঢাকামুখী, যেন রাজধানী আলো জ্বালিয়ে অপেক্ষা করে আছে প্রত্যেকের জন্য। কাজেই, চলো চলো ঢাকায় চলো! অথচ, আর কত ধারণ করবে সে। তার মাথার উপরে দাঁড়িয়ে আছে পৌনে দুইকোটি মানুষ। ভিড়ে গিজ গিজ করছে পুরো শহর। ষোলকোটি জনসংখ্যার দেশের প্রায় দুইকোটি মানুষ বসবাস করে ঢাকায়। এত ছোট্ট একটি ভূখণ্ডে এত মানুষের বসবাস! ঢাকায় যখন দম ফেলতে কষ্ট হয়, তখন ঢাকার বাইরের বাংলাদেশ পড়ে আছে অবহেলায়, অনাদরে। এভাবেই আমার প্রতিটি দেশে ফেরা চমকে দেয়, প্রশ্নগুলো বারবার মনে করিয়ে দেয়, আর কত বাকি এই রাজনীতি আর মানুষের নাভিশ্বাস খেলা! কেন ঢাকাই হয়ে ওঠে সব কিছুর কেন্দ্র। ঢাকার বাইরের সব কেন পড়ে থাকে অযত্ন অবহেলায়! এই অন্যায় বিভাজনের শেষ কবে, কোথায়? আমার মাথায় আসে না, এদেশে একটি বিশাল সংসদ রয়েছে, তারা নাকি পুরো বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাহলে পুরো বাংলাদেশ কেন ঢাকায় এসে ঠেকেছে?
এই যে এতসব বিশাল দালান-কোঠা, শপিং কমপ্লেক্স, বাণিজ্য ভবন গড়ে উঠছে। তৈরি হচ্ছে অসংখ্য ফ্লাই-ওভার। প্রতিটি রাস্তায় হাজার হাজার প্রাইভেট কার। এসব কি প্রমাণ দেয় ঢাকা শহর দারুণ আধুনিক ও দৃষ্টি নন্দন রূপে-লাবণ্যে ঢলে ঢলে পড়ছে! জানি, তার এই সাজানো রূপ ভেতরের মর্মমূলে আঘাত দিয়ে ফিরে ফিরে যায়। জীবন এখানে ফেরি করছে জীবনের নিগূঢ় বেদনা। বঞ্চনা আর অসম ব্যবধান জানিয়ে দিয়ে যায়- এখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কত মূল্যহীন, কত অপূর্ণ। যারা বেঁচে থাকার জন্য এ শহরে এসেছে, একদিন তারা নিজেরাই পণ্য হয়ে অনিশ্চয়তার হাতে ঘুরতে থাকে। খুঁজে নেয় এটা সেটা কত না পেশা। যে পেশা তাকে না দেয় সম্মান, না দেয় নিরাপত্তা, না দেয় সুস্থভাবে বেঁচে থাকার নূন্যতম অধিকার। রাজধানীতে পৌঁছে বেঁচে থাকার জন্য সামান্যতম উপায় খুঁজে নিতে নিতে একদিন উধাও হয়ে যায় সবগুলো স্বপ্নের পাখি। জীবনের সামান্যতম প্রাপ্তিটুকুও না পেয়ে মিলিয়ে যায় সে, কিংবা নিজেই মিশে যায় খর-কোলাহলে। ঢাকা শহরে এরকম অগুনতি মানুষকে আমি দেখেছি, ভাসমান, অনির্দিষ্ট, ফুটপাতচারী জীবন বহন করে বেড়াচ্ছে বছরের পর বছর। তারা জেনে গেছে এভাবেই বেঁচে থাকতে হয়। যদি বেঁচে থাকাটা স্রেফ বেঁচে থাকা হয়। সেই রংহীন, বর্ণহীন জীবনে কোথায় যে কতটুকু আনন্দ আছে তার সন্ধান এরা কবে পেয়েছে? বেঁচে থাকা খুঁজতে খুঁজতে হয়তো একদিন সে নিজেই হারিয়ে গেছে নেশা, বা তার চেয়েও ভয়ংকর কোনো পাঁকে। যেখানে নিজেকেই লগ্নি করতে হয় বেঁচে থাকার কারণে। কত নিষ্ঠুর ছিনিমিনি নির্মম অন্যায়ের তাপে ধুলি হয়ে গেছে কত না স্বপ্ন দেখা জীবন।
এবারও এসেও দেখলাম সেরকমের ছিন্নমূল মানুষের হার বহু গুণ বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে পথ-ভিখিরি এবং হকারের সংখ্যা। সেই সাথে নতুন ধনবানদের গাড়ির বহর, যা বেড়ে বেড়ে অগুনতি হয়ে গেছে। যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দীনহীন দরিদ্র, পঙ্গু, অন্ধ-অচল ভিখিরির দল। সিগনালে সিগনালে ওরা সেঁটে থাকে দামি দামি গাড়ির জানালায়। সেসব গাড়ির মালিকদের পকেট ভর্তি কাঁচা টাকার স্তূপ নির্লজ্জতাকেও লজ্জা দিয়ে যায়। খেয়াল-খুশির ফুর্তিতে যারা উড়িয়ে দেয় হাজার হাজার ডলার। হোটেল বা রেস্টুরেন্টে এদের উন্মুক্ত খরচ দেখে মনেই হয় না যে, এখান থেকে বেরুলে কোনো অভুক্ত মানুষের মুখোমুখি হতে পারে তারা! এতটা অন্যায় বৈষম্যে আমার মতো অতি সাধারণ এক অনাবাসী মানুষও মনে মনে অপরাধ বোধ করতে থাকে! যে তার জন্ম-মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষে মানুষে এই ব্যবধান দেখে হাঁসফাঁস করতে থাকে। চিৎকার করতে পারে না। সকলে তার মুখ চেপে ধরে, বলে- চুপ! বলিস না কিছু! আর তখন ভেতরে ভেতরে প্রলাপ বকতে থাকে।
হৃদয়, অনেক বড়ো-বড়ো শহর দেখেছো তুমি;
সেই সব শহরের ইটপাথর,
কথা, কাজ, আশা, নিরাশার ভয়াবহ হৃত চক্ষু
আমার মনের বিস্বাদের ভিতর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
কিন্তু তবুও শহরের বিপুল মেঘের কিনারে সূর্য উঠতে দেখেছি;
বন্দরের ওপারে সূর্যকে দেখেছি
মেঘের কমলারঙের ক্ষেতের ভিতর প্রণয়ী চাষার মতো বোঝা রয়েছে তার;
শহরের গ্যাসের আলো ও উঁচু-উঁচু মিনারের ওপরেও দেখেছি- নক্ষত্রেরা-
অজস্র বুনো হাঁসের মতো কোন দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে উড়ে চলেছে। [শহর/ জীবনানন্দ দাশ]
রাজনীতির দাবা খেলায় বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় বা কেমন তা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা না হয় নাই যাই। এটুকু তো বুঝতে পারি- আইন শৃঙ্খলা প্রশাসন সব যেন ব্যর্থতার লেবাস গোপন করে নির্লজ্জ হাসি হাসছে। কিছুতেই যেন কিছু যায় আসে না। পাঁচ বছর পর পর প্রহসনের পালা বদলে আমজনতার কোনো লাভ কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে হ্যাঁ এসবের ভিতর দিয়ে লাভ তো কারো না কারো হয়, হয়েছে এবং হচ্ছেও বটে। তা না হলে কেন সংসদ নামের অসার বিচরণ ক্ষেত্র, কেন পাহাড় সমান কালো টাকার ঝনঝানানি কাঁপিয়ে দিয়ে যায় সব কিছু! এত অসুর শক্তির দামামা শুনি কী করে? রাজনীতির সুতোয় বাঁধা জনগণ, পুতুল নাচের পুতুল তারা, কথা বলতে পারে না, স্বপ্ন দেখতে পারে না, ঠিক মতো বাঁচতে পারে না। তাদের কোনো অধিকার নেই নাগরিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার। ক্ষমতায় থাকে যারা থাকে, তারা যেন এক একটি অক্টোপাস হয়ে চেপে ধরে জনতার টুঁটি। কেউ তাদের কথা ভাবে না। হত্যা, ছিনতাই, ধর্ষণ, রাহাজানি, হয়রানি সবকিছু নিয়ে সন্ত্রাসী সময়ের ঘোলাজলে ডুবে যাচ্ছে তারা।
এই হতভাগ্য শহরটির ভেতর দিয়েই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় সম্পূর্ণ দেশটার চিত্র। বলা নেই কওয়া নেই অতর্কিত পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে মরে-পুড়ে কয়লা যাচ্ছে অসংখ্য নিরীহ বাসযাত্রী! কী তাদের দোষ তারা জানে না। প্রায় দিনই নানা রকমের যানবাহনসহ ঘরে-বাইরে ধর্ষণে ধর্ষণে একাকার নারী। পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণে বৈশাখী মেলার আনন্দ এখন নারীর উপরে যৌন নির্যাতন। মুক্তচিন্তা প্রকাশের শাস্তি চাপাতির আঘাতে কুপিয়ে হত্যা করা। শিক্ষাঙ্গনের ছাত্র-রাজনীতির নামে শিক্ষক ও নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর নেমে আসছে লাঞ্ছনা ও অপমানের খড়গ হস্ত। ধর্ম তো চিরকালই এদেশে ছিল, কিন্তু এখন ধর্মের নামে জন্ম নিচ্ছে নব্য সৌদি-আফগানিস্তান-পাকিস্তানীরা। এই সবকিছু মিলিয়ে আমার জন্মভূমি আমার কাছে ক্রমশ অজানা অচেনা হয়ে উঠছে, ক্রমশ দূর থেকে দূরের লাগছে। আমি পুরোপুরি চিনতে পারি না তাকে।
ভীষণ এক অন্ধকার পৃথিবীর প্রতিধ্বনি অবিরাম শুনতে পাই চারদিকে। বারবার অনুভব করি কালোরঙের আলখেল্লা গায়ে, উদ্ধত হাতে শানিত চাপাতি নিয়ে অশ্বখুরের শব্দে ধেয়ে আসছে অসংখ্য যমদূত, ধেয়ে আসছে দিক্বিদিক একাকার করে ঝড়ের গতিতে। যে কোনো সময়, যে কোনো দিন, যে কারো উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তারা। বেছে বেছে মুক্তচিন্তার মানুষগুলোর মাথা এখন তাদের বড্ড প্রিয়। আর এর পাশাপাশি নারী নামের এক সম্প্রদায় তো রয়েছেই। যার নাম শুনলে লক লক করে ওঠে লোভের হিংস্র জিভ। নারী, সে যে কোনো বয়সের হলেই হল, তিন বছর থেকে তেহাত্তর, কোনো অসুবিধা নাই। সময় অসময়ে তাকে তাক করো, যে কোনোখানে বাসে-মিনিবাসে, গাড়িতে-মাইক্রো বাসে, ট্রাকে-নৌকায়, পথে-ঘাটে-মাঠে-স্কুলে, বাজারে-বাড়িতে যেখানে যেভাবে খুশি, একা বা গণ ধর্ষণে মাতো। এসবের বিচার হবে না, প্রতিরোধের চেষ্টা হবে না। কাজেই একদল খাও-দাও-ফুর্তি করো, ধর্ষণ ও হত্যার উৎসবে মজে থাকো, আর সেই সাথে আরেকদল চাপাতিতে শান দিতে থাক প্রাণ ভরে। এই শহরের অন্ধ করে দেয়া চোখ দিয়ে অবিরাম দেখতে পাই ছটফট করতে থাকা মুখগুলো। ভেসে যাচ্ছে শোভন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো, ক্ষয়ে যাচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতির উদাত্ত প্রতিশ্রুতি, চাপা পড়ছে সৎ মহৎ মানবিক শব্দগুলো।
তবু হঠাৎ আসে যখন পাতা ঝরার দিন,
দমকা হাওয়া থেকে থেকে
ছাদ-ছাড়ানো গাছের মাথায় লাগে,
আমার শহর খানিক বুঝি
ঝিমিয়ে পড়া তন্দ্রা থেকে জাগে।
জন্ম-শহরের এসে সত্যি সত্যি বারবার মনে হতে থাকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতার লাইনগুলো, ঘুমন্ত চৌকাঠে বারবার ঠোকর দেয়- জাগবে! জাগবে!! এভাবে চিরকাল চলতে পারে না। তাই হয়তো ফিরে ফিরে আসি এ শহরের টানে। যেখানে এ দেশের প্রতিটি প্রতিবাদ, বিপ্লব এবং রক্তপাতের শুরু। বাহান্নের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতার ডাক, নব্বইয়ের স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এ শহর, এত সহজে হার মানবে না, মানতে পারে না। জানি, এ শহর উঠে দাঁড়ালেই জেগে উঠবে বাংলাদেশ।
ফিরে আসার সময় উড়োজাহাজের জানালা দিয়ে ঝুঁকে থাকি ঢাকার দিকে। চোখ ভিজে ওঠে। ওই তো ওখানে ঘুমিয়ে আছেন বাবা-মা, বিচরণ করছে আমার আপন ও প্রিয়জনেরা। রয়েছে আমার জীবনের গড়াপেটা। তার উপর দিয়ে এই আকাশে উড়ে উড়ে যত দূর দেশেই যাই না কেন, আমার আত্মা, আমার পরিচয় সব পড়ে রয় ওই মাটিতে। ঢাকা, তোমাকে ঢেকে রাখি প্রাণের গভীরে। যেখানে শত বিরুদ্ধতাতেও বয়ে চলে বুড়িগঙ্গা, প্রগাঢ় আলিঙ্গনে আজো আমাকে জড়িয়ে থাক অনন্ত ভালোবাসায়। ঢাকা, আমার প্রিয় শহর, তোমার কাছ থেকে ফিরে এসে তোমাতেই ফিরে যাই বারবার। তুমি আমার স্বদেশের মুখ, তুমি আমার প্রতিটি বেড়ে ওঠার প্রথম ফাগুন। যেখানে আমার আমি হয়ে ওঠার সকল অভিষেক দাঁড়িয়ে আছে মহীরুহ হয়ে। যেখানে একদিন আমি জীবন-তৃষ্ণায় ছটফট করে মরেছি। রোদ্দুর হতে চেয়েছি। গানে, প্রেমে, কবিতায়, বন্ধুত্বে, ভালোবাসায়, মায়ায় জড়িয়ে থাকা আমার অন্তহীন প্রণয়ের ঢাকা, এত উঁচু থেকে তোমাকে দেখার দৃশ্যটা ভাঁজ করে নিয়ে আসি। ফিরে যেতে যেতে উচ্চারণ করি প্রার্থনার মতো কিছু স্বগতোক্তি, কিছু দূরবাসী প্রত্যাশা-
আমাদের বাতিঘরে দুর্মর পেঁচিয়ে আছে হিংস্র রাজনীতির গোখরা নাগ।
হোমরা বাইদ্যা আয়, হোমরা বাইদ্যা ভাই বাজাও তোমার বীণ রঙিন
সুরেলা পাখা, বেহদ্দ দুলুনিমাখা- বিষ আঁকাবাঁকা। তাহার তরাস নিয়া
এই বিষ হোক সারা, শ্বাস ফেলি একান্ত বহতায়আমরা তো বহুকাল দেখি নাই কোনো সুখ, কতকাল জেগে আছি নিভানো
আলোঘরে প্রলয়ের প্রান্তঝড়ে। বিকিকিনি মন্ত্র শিখে কতবার বাতিঘরে জ্বলে
পুড়ে মরে একাকার। রাজনীতি ঘোরঘুমে মরশুমে মরশুমে হাই তুলে
পাশ ফিরে জগৎ ঘুমায়। হয়তো তাহার মতো সুখে নাই কেউহোমরা ভাই এবার নামাও বিষ, নাগপাশ সরুক শেষে
[বিষ আগুন থেকে/ ফেরদৌস নাহার]
ফেরদৌস নাহার
ফেরদৌস নাহারের জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে। নেশা, দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো ও বইপড়া।
ফেরদৌস নাহার বাংলা ভাষার একজন শক্তিমান কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগীত রচয়িতা। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা: ১৫টি কবিতা ও ৩টি প্রবন্ধের বই। তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে একটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে অসংখ্য যৌথ কবিতা সংকলন। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের দল ‘মাইলস’-এর অনেকগুলো জনপ্রিয় গানের রচয়িতা তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও কানাডা থেকে কম্পিউটার ট্রেনিং প্রোগ্রাম কোর্স করেছেন তিনি। কবিতার পাশাপাশি ছবি আঁকেন, গান লেখেন, ব্লগিং করেন, কফিশপে ধোঁয়া আর ঘ্রাণে আড্ডার ঝড় তোলেন। কিন্তু সবকিছুর উপরে এক বিশ্ব বোহেময়ান কবি আর চির তারুণ্যের নাম ফেরদৌস নাহার। মন চাইলে বেরিয়ে যান। ঘুরে বেড়ান খেয়াল-খুশি মতো, যাকে তিনি ‘ঘুরণ’ বলেন। ভালোবাসেন প্রকৃতি ও মানুষ। পথের নেশা তাকে করেছে ঘরছাড়া, ঘুরতে ঘুরতে এখন আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে, কানাডায়। সেখানে জীবন যাপনের পাশাপাশি জীবন উৎযাপন করেন কবিতা এবং লেখালিখির খরস্রোতা নদীতে বৈঠা বেয়ে। ইমেইল : [email protected]
নস্টালজিক মায়ায় মাখামাখি হতে হতে হতাশা, বেদনাবোধ ছুঁয়ে যাচ্ছে গভীর বোধের জায়গাগুলো, যে বেদনা ঢাকাকে ধারণ করা সকলেরই।
পরমা ছবিতে প্রথম শুনি প্রেমেন্দ্র মিত্রের আমার শহর কবিতাটি। চোখ ভিজে ওঠে। যতবার পাঠ। বার বার। এই ঢাকা শহর কী এমন প্রেমে আমায় মজালো! তোমার অনুভব অভিমান বুঝতে পারছি যেন, দিদা। মন ভার হলো। তুমি থেকো, ভালোবাসার শহর, ঢাকা!
দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও বেদনার এক মিশ্র অনুভূতি। আমাদের অভিবাসী মনের বলা না-বলা কথাগুলোর স্পষ্ট প্রকাশ। যতবার যাই উদ্বেলিত হই মাটি ও মানুষের ছোঁয়ায়, কিন্তু বিভাজন, বৈষম্য ও হিংস্র রাজনীতির দূষণ মনকে বিষণ্ণ করে। এইসব দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা ভাঁজ করে নিয়ে ফিরে আসি। আগামীর উজ্জ্বল দিনের জন্য প্রার্থনা করি।