জর্জিয়া-২
জকির জন্মদিন পালনের জন্য সন্ধ্যায় পাকঘর থেকে আনা বড় টেবিলে তার উপর খাবার সাজিয়েছে তারা। টেবিলের এক দিকে এক বাঁটি গোসত। অন্যপাশে সেদ্ধ আলুর খোঁসা ছাড়াচ্ছে ফ্লোরেন্স। বড় কড়াইয়ে টগবগ ফুটছে সবজির স্যুপ। কালো পাত্রে ধূসর ধোঁয়া উড়ছে। তাপে গরম পানির সাথে বিট আর কফি একবার উপরে উঠছে, আবার চলে যাচ্ছে নিচে। ছোট চেস্টার হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে মোটরদানা নেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু এলিস তাকে ডালের হাতা দিয়ে সরিয়ে দিল।
“আর কিছু নেই, কোরা?” এলিস জিজ্ঞেস করে।
“বয় না, এত ব্যস্ত ক্যান?” কোরার জবাব।
এলিস একটু হতাশ হল। তারপর খেতে শুরু করল।
গত বছর জকির জন্মদিনে কোরা একজোড়া পাতাকফি দিয়েছিল। সেও সেটা নিয়েছিল যথাযথ কৃতজ্ঞতার সাথে। পাকঘর থেকে কোরা দেখল, এলিস তার থলেয় কি যেন একটা দেখছে। তারপর বাইরে গিয়ে আলোয় আরও ভাল করে দেখতে লাগল। তবে কি সে ভাবছে আমি তাকে পচা খাবার দিয়েছি? গত পাঁচ বছরে তাকে যা দিয়েছি তার কিছুই মূল্য নেই? জমি থেকে টাটকা সবজি তুলে তাকে দিয়েছি। শুধু আমি কেন? নানী, মা তারাও তো এলিসকে এসব দিত। এসব নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেই বা কি লাভ?
এক সময় র্যান্ডেলদের সাথে এলিসের ভাল সম্পর্ক ছিল। তাদের বাড়িতেই সে দাসীগিরি করেছে। কিন্তু এখন জেমস র্যান্ডেল তার নিন্দায় মুখর। তার কারণ, ছোটবেলা থেকেই জেমস তার কাছে বঞ্চনার শিকার। শরীফা ফল কেটে এলিস তাকে ছোট টুকরোটা দিত। সে শুধু ঘ্যানঘ্যান করত। কিন্তু নিজের ভাগ বুঝে নেবার জন্য জোর করতে পারত না। জেমস যা বলত, এলিস তার উল্টোটা করত। ছোটভাই টেরেন্স ঠিক তার বিপরীত। সে তার ভাগ ঠিকই বুঝে নিত। স্যুপ নেবার সময় তার ভাগ ঠিকই সে আদায় করে নেয়। দশ বছর বয়স থেকেই টেরেন্স এগুলো ঠিকঠাক আদায় করতে শিখেছে। বড় হয়ে দায়িত্ব পালনে তার ব্যক্তিত্বে এসব গুণ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জেমস যেখানে শামুকের মত গুটিয়ে থাকে, টেরেন্স সেখানে তার ক্ষমতা জাহিরে ওস্তাদ। কিছুতেই সে তার হিস্যা হারাতে রাজি নয়।
খামারের দক্ষিণ ভাগ থেকে কেনা গোলামদের জন্য কিছুই করা হয় না। কয়েক বছর আগে র্যান্ডেলরা একটা টস করে সিদ্ধান্ত নেন কোন ভাগে উৎসব আয়োজন করা হবে। সেভাবেই উত্তরভাগে এসবের আয়োজন করা হয়। কিন্তু টেরেন্সের অংশে এসব চলে না। গোলামদের আমোদপ্রমোদে টেরেন্সের ভীষণ আপত্তি। নিজেদের মত করে দুই ভাই নিজ নিজ অংশ পরিচালনা করে। জেমস হাঙ্গামা এড়িয়ে ব্যবসা করতে চায়। এমন ফসলে তার আগ্রহ যাতে লাভ-লোকসানের ঝুঁকি কম। কম, কিন্তু নিশ্চিত মুনাফায় তার আগ্রহ। জমি এবং নিগার গোলামদের দেখিয়ে সে ব্যাংক থেকে টাকা নেয়। টেরেন্স অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে নিউ অরলিয়েন্স পর্যন্ত ব্যবসা প্রসারিত করতে উদ্যোগী। টাকা কামানোর জন্য তিনি যে কোন কিছু করতে রাজি। দাস ব্যবসায় বেশি মুনাফা, তাই সেটাই তার বেশি পছন্দ।
চেস্টার ও তার বন্ধুরা কোরাকে ঘিরে ধরেছে। কোরা বেশ অপ্রস্তুত। বাচ্চাদের খেলা। এবার দৌঁড় হবে। দৌঁড় শুরুর আগে শিশু ও কিশোরদের কোরা দু’ভাগে ভাগ করে নেয়। বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী। একটু বড়দের জন্য দরকার হলে আলাদা ব্যবস্থা। বি গ্রুপ। এ বছর চেস্টারকে কোরা বি-গ্রুপে রেখেছে। ছেলেটার কপাল মন্দ। তার যখন খুব অল্প বয়স তখন তার মা-বাবা বিক্রি হয়ে যায়। তারা কোথায় চলে গেছে কে জানে! কোরাই তাকে দেখাশোনা করে। খাড়া-খাড়া চুল আর লাল লাল চোখের ছেলেটা হঠাৎ করে গত ছ’মাসেই অনেক লম্বা হয়ে গেছে। একেবারে তালপাতার সেপাই। কনেলি একটা বিরল মন্তব্য করল যে, সে সেরাটা খুঁজছে।
“তুই কিন্তু পেরতম হবি,” কোরা বলে।হাতটা মাটিতে ছুঁয়ে সে প্রস্তুত। মনে মনে বলল, আমাকে কিছু বলতে হবে না। চেস্টার এখন প্রায় কিশোর। এসব শিখে ফেলেছে। আগামি বছর হয়ত সে বি-গ্রুপেও খেলতে পারবে না, তাকে সাইড লাইনে বসে দেখতে হবে।আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই মাঠের চারপাশে জড়ো হয়েছে খেলা দেখতে। সন্তানহারা মায়েরা একবুক হতাশা নিয়ে খেলা দেখছে। খেলায় অংশ নেবে এমন কেউ নেই তাদের। লোকগুলো একটা মদের ভাঁড়ে একে একে চুমুক দিচ্ছে। হব থেকে এখানে মেয়েরা খুব কম আসে। তবে নানা কাজে সহায়তা করতে ন্যাগ যে এসেছে সেটা কারো চোখ এড়ায় নি।
দৌঁড়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিচারক হিসেবে আছে লভি। সবাই জানে, সুযোগ পেলেই লভি তার পছন্দের বাচ্চাদের প্রতি পক্ষপাত করে। সেখানে ম্যাপেল কাঠের একটা হালকা চেয়ারে বসে আছেন রকি। এ চেয়ারটায় বসে তিনি রাতে আকাশের তারা গোণেন। তিনিই আজ সভাপতি। তার জন্মদিনের এ আয়োজনে চেয়ারটা তিনি নিজেই নিয়ে এসে বসেন। সব দিকে খেয়াল রাখেন যেন সবাই আমোদ করার সুযোগ পায়। তার নামেই এ খেলাধুলোর আয়োজন। খেলা শেষে সবাই তার কাছে জড়ো হয়। আর রকি তাদের সবার হাতেই আদার চকলেট উপহার দেন। খেলায় কে জিতেছে, কে হেরেছে তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই তার। সবাইকেই উপহার দিয়ে সবাইকে খুশি করেন।
চেস্টার সবার শেষে হাত দুটো হাঁটুতে রেখে বেশ একটা খেলোয়াড়ি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে।
“খুব ভাল করিচিস। আরেকটু ভাল করতি হবে কিন্তুক,” কোরা তাকে বলে।
“হুম, আরেকটু,” এ কথা বলে সে আদার চকলেট নিতে এগিয়ে যায়।কোরা রকির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, বয়স কত হল আপনার? গত বছর রকি নিজের বয়স এক শ’ এক বছর বলেছিলেন। আসলে হয়ত এর অর্ধেক বয়স তার। তবে র্যান্ডেল প্লান্টেশনের দুই অংশের কোথাও তার চেয়ে বয়েসী আর কেউ নেই। যখনই কেউ তার বয়স জিজ্ঞেস করে, তিনি সোজা বলেন, এই তো পাঁচ কুড়ি হলো হলো; কিংবা পাঁচ কুড়ি আট। এখানকার নিষ্ঠুরতার জীবন্ত সাক্ষী তিনি।
ষোলো বা সতের বছর। নিজের বয়স কোরা এ রকমই ভাবে। সে শুধু মনে রাখে, এক বছর আগে কনেলি একজনকে বিয়ে করতে চাপ দিয়েছিল। দু’ বছর আগে পট আর বন্ধুরা তার উপর পাশবিক নির্যাতন করে। এরপর অবশ্য আর কেউ তাকে ঘাঁটায় নি। কোরা তার সেই কুঁড়েতেই থাকে। সবাই তাকে পাগলী ভাবে। মা নিখোঁজ হবার পর ছ’বছর কেটে গেছে।
কোরার মনে হয়েছিল, এবার রোববারে জকি জবরদস্ত আয়োজনে জন্মদিন পালন করবেন। জকি তেমন ঘোষণাই দিয়েছিলেন। সে মোতাবেক এই আমোদ-ফূর্তির আয়োজন। কোনোবার এই অনুষ্ঠান হয় বসন্তের কোন বাদলাদিনে। কোনোবার বা শরতের বাদলায়, আবার কোনোবার হয়ত ফসল তোলার পর। কোনোবার হয়ত কোন অনুষ্ঠানই করেন না। হয়ত ভুলে যান। কিংবা নিজের কোন ঝামেলার কথা বলে এড়িয়ে যান। তিনি যা করেন সবাই তা মেনে নেয়। এখানে কালোদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে প্রবীণ। তার সিদ্ধান্ত সবাই মানে। সাদাদের সকল ষড়যন্ত্র তিনিই মোকাবেলা করেন, নির্যাতনের শিকার হন। চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে গেছে। নির্যাতনে নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে গেছে একটা পা, হাত দুটো চিরদিনের মত কুঁকড়ে মাকড়সার ভাঙা পায়ের মত হয়ে গেছে। তবু আজও বেঁচে আছেন রকি।
শ্বেতাঙ্গরা তাকে একলা রেখে চলে গেছে। তার জন্মদিনে বুড়ো র্যান্ডেলও কিছুই বললেন না। দায়িত্ব নেবার পর থেকে জেমসও কিছু বলেন না। ওভারসিয়ার কনেলি রোববার প্রায়ই গরহাজির থাকে। খোঁজ নিলে জানা হয়ত যাবে, সে কোন বান্দিকে বউ পাতিয়ে কাটিয়েছে। শ্বেতাঙ্গরা এসব জানলেও তাকে কিছু বলে না। তারা ভাবে, এতে অন্যদের যেমন শাস্তি দেওয়া হল, আবার এমন কষ্টকর জীবনে কাউকে কাউকে এটুকু স্বাধীনতা দিলে বরং সুবিধাই আদায় করা যায়। তার প্রকৃত জন্ম তারিখ জানা কঠিন। সাদা দুনিয়ায় কালোদের জন্ম তারিখে কী যায় আসে? এটা জানার চেয়ে ভুলে যাওয়াই বরং ভাল।
“কোরা।”
সবাই খাওয়ার জন্য চলে গেছে। একা সিজার যায় নি। সে অপেক্ষা করছে। সিজারের সাথে কথা বলার কোন সুযোগ হয় নি কোরার। প্লান্টেশেনে নতুন যারা আসে তাদের মেয়েদের সাথে না মিশতে হুকুম দেয়া থাকে।
“এটটু কতা ক’তাম,” কোরাকে সিজার বলল।
জেমস র্যান্ডেল বছর দেড়েক আগে আরও তিনজনের সাথে তাকে কিনেছিলেন। মেয়ে দুটোকে লন্ড্রিতে আর সিজার ও প্রিন্সকে খামারে মাস্তানদের সাথে কাজে লাগাবেন। কোরা তাকে পাইন কাঠের খাপে বাঁকানো ধারালো কৃপাণ মাজায় ঝুলিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। সে কখনও অন্যদের তেমন আমলে নেয় না। মাঝে মাঝে তাকে ফ্রান্সেসের সাথে ছুকড়ি নিয়ে ঘুরতে দেখেছে। এখনও তারা কি একসাথেই থাকে? লভি হয়ত জানতে পারে। মেয়েমানুষ হলেও লভি ছোড়াছুড়িরা কে কোথায় কি করে তার খোঁজ খবর রাখে।
কোরা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “কি বলবি, সিজা?”
আশেপাশে কেউ আছে কি নেই, বা কেউ শুনছে কি না তার তোয়াক্কাই করল না সিজার। তার অবশ্য দরকারও নেই। কেননা, পুরোটাই পরিকল্পিত। “শিগগির উত্তরে চলে যাব, তুইও যাতি পারিস।” কোরা মহা মুস্কিলে পড়ে গেল। এ আবার কোন আপদ? কী মতলব কে জানে? “উত্তরে যাবি যা, আমি একন খাতি যাব,” নিষ্পৃহভাবে কোরা জবাব দেয়।
আলতোভাবে কোরার হাত ধরে সিজার। হালকা কিন্তু সুঠাম ও শক্তসামর্থ্য সিজার কোরার হাত ধরে তেমন কোন জোরাজোরি করল না। গোলগাল মুখে চ্যাপ্টা ফানেলের মত নাক সিজারের। হাসলে তার চলে টোল পড়ে। কবে একদিন কোরার নজরে পড়েছিল সেটা। কোরা তা ভোলে নি। কিন্তু কেন?
“একুনি বলতি হবে না; পরে বললিও হবেনে। তবে আমি যাবই। তুইও চল; ভাল হবেনে।”
এতক্ষণে কোরার মনে হল কোন বদ মতলব হয়ত ওর নেই। বিশ্বাস করা চলে। বেশ সোজা সরল বলেই মনে হয়। তার মুখ থেকে গোশতের গন্ধ বেরোচ্ছে। কোরা হাত ছাড়িয়ে নিল। “কনেলি বা চৌকিদারের হাতে মার খেয়ে মরা বা সাপে কেটে মরার চেয়ে হয়ত এটা ভাল,” ভাবছে কোরা।
স্যুপে চুমুক দিতে দিতে নিজের বোকামোর জন্য হাসি পেল কোরার। সাদারা রোজ একটু একটু করে খুন করে। কখনও কখনও চটজলদিও খুন করে। তাহলে আর “না” বলা কেন?
লভিকে দেখল পাশেই দাঁড়িয়ে। কিন্তু সিজার বা ফ্রান্সিসের সাথে কী কথা হল তা নিয়ে কিছু জানতে চাইল না।
হবে আসার পর এই প্রথম কোন যুবক তার সাথে আলাপ করল।
কুস্তি শুরুর বাতি জ্বালানো হল। দর্শকরা আনন্দে মেতে উঠল। এর মাঝে অন্য খামারের অনেক পুরুষ এসেছে কুস্তি উপভোগ করতে। বেশ দূর থেকে এসেছে তারা। অন্য কারো সাথে ফস্টিনস্টি না করে স্বামীরা খেলা দেখতে গেছে এজন্য বউরা খুশি।
“আমি ওর সাথে কুস্তি খেলব”, মেজরকে দেখিয়ে এ কথা বলেই হেসে গড়াগাড়ি লভি।
মেজর মাথা নাড়ল যেন সে শুনেছে কথাটা।
লভিকে ভাল লাগে তার। কঠোর পরিশ্রমী সে। মালিকের চাবুক তেমন খেতে হয় না তাকে। কনেলি যদি তাদের একটা সম্বন্ধ করে দিত!
কুস্তিগীররা ঘাসের উপর বসে আছে। ছোটরা একেক জনের উপর বাজি ধরছে। পছন্দের লোক যেন জেতে। বড় হয়ে তারাও একদিন এমন কুস্তি লড়ার স্বপ্ন দেখে।
খেলা, নাচ-গান হল। সবাই রকির প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনিই এমন চমৎকার আয়োজন করেছেন। দিনটাও ভাল বেছে নিয়েছেন তিনি। সবাই খুব খুশি। তবে জকি শংকায় আছেন। কখন সাদা-কালোয় কী উটকো ঝামেলা বাঁধে কে জানে? ভয়ে ভয়ে প্রথম কয়েক ঘন্টা কেটে গেল। এবার তো কাটল। আগামি বার কী হবে? এবারের ঘাটতি কী আগামি বছর পূরণ হবে? এসব নিয়ে ভাবছেন রকি। যাই হোক না কেন, অন্তত খারাপ কিছু যেন না হয়।
নোবেল হাতে একটা খঞ্জনি নিয়ে বাজাতে শুরু করল। দ্রুত বাজাতে বাজতে অন্যদেরও তার সাথে তাল দিতে উৎসাহিত করছে সে। এসব কাজে তার অসাধারণ নৈপুন্য আছে। হাতে তালি বাজিয়ে, পাছা দুলিয়ে, কনুই বাঁকিয়ে সে নানা রঙ্গ করতে ওস্তাদ। খোলোয়াড়ি নর্দনকুর্দন যাই হোক, নাচগানের সাথে ড্রামের গগনবিদারী আওয়াজ আর অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের যুগলবন্দি না ঘটা পর্যন্ত কিছুই জমে না। তাই জর্জ আর ওয়েসলি হাতে বেহালা আর ব্যাঞ্জো তুলে নিলে শুরু হল হল্লা। জকি তার ম্যাপেল কাঠের সেই চেয়ারে বসে আছেন। সবাই মিলে উদ্দাম নাচছে আর হল্লা করছে।
কোরা একটুও নড়ে নি। এবার শুরু গানের খেলা। কেউ একজন কোন গানের দুয়েক লাইন গেয়ে ছেড়ে দেবে। তার সাথে সুর মিলিয়ে আরেকজন গাইবে আরেকটা গানের খানিকটা। সে যেখানে ছাড়বে, সেখান থেকে আরেকজন। পরেরটা কে গাইবে সেটা আগের জনই ঠিক করে দেবে। কোরার ভয়টা এখানেই। কী জানি কে এসে কখন ঘাঁড়ে সওয়ার হবে? না পারলে সবাই হাসাহাসি করবে। আরও একটা ভয় আছে তার। বলা নেই, কওয়া নেই, কেউ একজন হঠাৎ এসে একজনকে টেনে হয়ত কারো গায়ের পরেই ফেলে দেবে। আর সবাই হৈ হৈ করে উঠবে। যে যেমন খুশি খেমটা নাচছে। নাচের অবাধ লাইসেন্স। কোরার এসব পছন্দ না। বদ মতলব ছাড়াই, শ্রেফ মজা করার জন্য, কেউ হয়ত এসে দুহাতে জড়িয়ে ধরে হন হন করে টেনে নেবে হৈ-হুল্লোড়ের মাঝখানে। তারপর অশ্লীল কথা আর অঙ্গভঙ্গি। একবার রকির জন্মদিনের উৎসবে ওয়েসলি এমন একটা গান গাইল যার সুর কারো জানা নেই, কোনদিন শোনেও নি কেউ। সে উত্তরে কোথাও এই সুর শিখেছিল। কোরা সাহস করে এগিয়ে যায় সে গানের সুরে কিছু একটা গাইতে। যা আছে কপালে! চোখ বন্ধ করে কোরা গাইতে শুরু করে। সেদিন কোরা গান শুরু করার সাথে সাথে জর্জ বেহালায় সুরের এমন মূর্ছনা তৈরি করেছিল যা আজও কেউ ভোলে নি। চোখ খুলে কোরা দেখে তার সামনেই এডওয়ার্ড। দু’চোখে কামনার আগুন, যেন তাকে একখুনি গিলে খাবে। এডওয়ার্ড, পট কেউ অবশ্য এখন আর বেঁচে নেই। কয়েক বছর আগে অতিষ্ঠ লোকজন এডওয়ার্ডকে বস্তায় পুরে পাথরের হন্দর দিয়ে থেঁতিয়ে থেঁতিয়ে মেরে ফেলে। আর পটকে তারা মাটিতে অর্ধেক জ্যান্ত পুতে একপাল ইঁদুর দিয়ে খাবলে খাবলে খাওয়ায়। সারা শরীর রক্তজবার মত দগদগ করছিল। তাতেই রোগাক্রান্ত হয়ে অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করে সে মরে। কিন্তু তারা মরে গেলে কী হবে? এডওয়ার্ডের চোখের সেই কামনার আগুন আজও কোরা ভুলতে পারে নি। এখনও কোরা হলুসিনেশনে ভোগে। আজ অবশ্য কেউ তাকে টানাটানি করে নি।
গান শেষ হল। গোল জমায়েতও নেই। কখনও কখনও এমন জমায়েতের সুযোগে দুয়েক জন হারিয়ে যায়। মুক্তির স্বপ্ন তাদের হাতছানি দেয়। বেশির ভাগ সময়ই যা শেষ হয় দুঃস্বপ্নে। সেবার এমনি এক রোববারে নাচগান চলছিল। তখনই ওভারশিয়ার লোক গুনতি শুরু করল। এখনই কাজে যেতে হবে। মনিবদের হাতের পুতুল সে। আর গোলামদের জীবন হল এমনই কষ্টে মোড়ানো।
প্রাসাদোপম বাড়ি থেকে র্যান্ডেল ভ্রাতৃদ্বয় একযোগে সেখানে এসে হাজির। গোলামরা সবাই সরে দাঁড়ালো, যতটা দূরে দাঁড়ায়ে কুর্নিশ করা দস্তুর, ততটা দূরে। তাদের যাবার পথ করে দিল তারা। জেমসের মশালদার গডফ্রে আগে আগে চলেছে লণ্ঠন হাতে। বুড়ো আব্রহাম বলে, জেমস যেন তার মায়ের মতই বিশাল বপুর মস্ত এক পিঁপে; মুখ তার কঠিন ও রুক্ষ। অন্যদিকে টেরেন্স বাবার মত দীর্ঘদেহী, লক্ষ্মীপেঁচার মত হুমড়োমুখো। মনে হয়, এই বুঝি কোন শিকারের উপর হামলে পড়বে। জমিজিরেতের সাথে তারা এক দর্জিরও ওয়ারিশ। মাসে একবার হালকা একটা গাড়িতে করে সে আসে অতি সাধারণ লিলেন আর সুতির পোশাক পরে। ছোটবেলায় দুই ভাই এ রকম পোশাক পরত। সাদা ধবধবে ট্রাউজার আর শার্ট। ধোপানীর পক্ষে যতটা সাদা করা সম্ভব তা ছিল ততটাই ধবধবে। সে পোশাকে কমলামুখি বালক দু’জনকে মনে হত যেন আকাশ থেকে নেমে আসা দেবদূত!
চেয়ারের হাতলে আলতো চাপ দিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গি করে জকি একে একে তাদের সালাম জানান, “মাস্টার জেমস, মাস্টার টেরেন্স।” একটু দাঁড়ানোর ভঙ্গি করেও জকি চেয়ারেই বসে থাকলেন।
“আ-মা-দের বি-রক্ত ক-র না; খুউব জ-জরু-রি আ-লা-প করতে ক-কর-তে তোমা-দের গা-ন শুন-ছিলাম, হুহ্! আ-মি ওকে ব-বল-ছিলাম এ-মন মা-তাল করা গা-ন না, আ-গে ক-ক-খ-নও শুনি নি, হুহ্!”
দু’ভাই মদে চুর। হয়ত কয়েক বোতল সাবাড় করেছে। কোরা ভিড়ের মধ্যে সিজারকে খুঁজছে। কোথাও নেই! গতবারের উৎসবেও সিজার হাজির হয় নি। উত্তরভাগের সে অনুষ্ঠানেও দু’ভাই যোগ দিয়েছিলেন। এসব থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। র্যান্ডেলরা যখন কোন অনুষ্ঠানে আসে তখন এমন কিছু ঘটে যা আগে থেকে অনুমান করা কঠিন। আরও কঠিন যতক্ষণ না তা নিজের জীবনে ঘটে।
জেমস কনেলিকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান। তিনি হয়ত কোন দর্শনপ্রার্থীর সাক্ষাৎ দেবেন বা দূরের কোন খামার থেকে আসা কোন উৎসাহী মালিকের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠবেন। টেরেন্স নিগারদের সাথে কদাচিৎ কথা বলেন। চাবুক না মেরে ওদের দিয়ে কাজ করানো যায় না বলেই তার বিশ্বাস। ভাইয়ের খামারে এসে টেরেন্সের কাজই হল এখানে সবচেয়ে করিৎকর্মা দাস আর ভোগের মত সেক্সি ছুঁকড়ি কে কোথায় আছে তার খোঁজখবর নেয়া। ছুঁকড়িদের শুধু আঁড়চোখে দেখেই তৃিপ্ত হয় না তার, যতক্ষণ না ভোগ করতে পারেন। সে ফন্দি আঁটতেই তিনি বস্তিগুলা ঘুরে ঘুরে দেখেন। কোন নিয়ম নীতির ধার ধারেন না। নব দম্পতির বাসর রাতে মিলন দৃশ্য দেখার মত কুৎসিত মতলবে এমন কি তাদের কুঁড়েয় উঁকি মারতেও তার রুচিতে বাঁধে না। এ এক চরম রুচি বিকৃতি।
জেমস একটু আলাদা প্রকৃতির। সবাই তা মানে। বাবা বা ভাইয়ের মত তিনি খামারের সব কিছুই নিজের ভোগের জন্য বলে মনে করেন না। কখনও সখনও তিনি কাউন্টি থেকে কিছু মেয়েকে দাওয়াত করে নৈশভোজে আপ্যায়ন করেন। এলিস তার মত করে মজাদার খাবার তৈরি করে অতিথিদের খাওয়ায়। মিসেস র্যান্ডেল অনেক বছর আগে গত হয়েছেন। এলিস মনে করে, খামারের মান-ইজ্জৎ টিকিয়ে রাখে মেয়েরাই। কাঁদাপানিতে জানপরাণ খেটেখুঁটে, গাড়ি ঠেলে ঠেলে যারা এই প্রাসাদোপম বাড়িতে সব কিছু পৌঁছে দেয় তাদের জন্য এ অতি সামান্য আয়োজন বলেই মনে করেন জেমস।
হেঁশেলে মেয়েরা মুখ টিপে হাসাহাসি করে। ইন্দ্রিয় সুখভোগের জন্য জেমসেরও গোপন ব্যবস্থা আছে; কিন্তু সেটা বহু দূরে, নিউ অরলিয়ান্সে। প্রাইড সে সব গল্প রসিয়ে রসিয়ে বলে বেড়ায়। ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছে এমন এক বন্ধুর কাছ থেকেই সে নাকি সে সব কেচ্ছা শুনেছে।
জেমসের কাছেই টেরেন্স শুনেছেন একটা নিগার নাকি ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মুখস্থ বলে যেতে পারে।
“আমি তাকে দেখতে চাই; আজ রাতেই।”
“তল্লাটে এখন কেউ নেই। যারা আছে তারাও হুল্লোড়ে ব্যস্ত।”
“কেউ জানবে না। আজই আমরা এর হেনস্থা করতে পারি।”
তারা নিচের ঝুঁপড়িতে নেমে আসেন।
“মাইকেল, কোথায়?”
চারিদিক নিস্তব্ধ। মুখে কিছু না বলে গডফ্রে আলোটা তুলে ধরল। পরপরই চাবুকের শপাং শপাং আওয়াজ। র্যান্ডেলদের কাছে স্বয়ং ভগবানও তখন অসহায়। বাকি কাজটুকু গডফ্রের। গলায় ছুরি চালিয়ে মুণ্ডু থেকে দেহ বিচ্ছিন্ন করে ফেলল সে। তারপর বলল, “মাইকেল খতম, মাস্টার…।”
পুরোনো চাবুকটা টেরেন্স ভাগাড়ে ছুড়ে ফেললেন। তার পিতা এটা ব্যবহার করতেন। চাবুকের হাতলটা রুপোর। সেটা বানানো ভালুকের মাথার আদলে। কত নিগারের পিঠে এই চাবুকের নিষ্ঠুর আঘাতের ঘা দগদগ করছে, তার নিকাশ নেই। চাবুকের আঘাতের অসহ্য যন্ত্রণা তারা কখনই ভুলবে না।
মাইকেল ছিল খুবই স্মৃতিধর। অনেক গল্প সে মুখস্থ বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। পিতা র্যান্ডেলের অদ্ভূত বিশ্বাস ছিল। তিনি মনে করতেন, যদি দক্ষিণ আমেরিকার একটা সাধারণ কাকাতুয়া শুনে শুনে লিমেরিক মুখস্থ রাখতে পারে, তাহলে একটা গোলাম তো এসব পারবেই। একটা কাকাতুয়ার চেয়ে একটা নিগারের মাথা তো অনেক অনেক বড়!
মাইকেলের বাবা ছিল জেমসের পিতার কোচম্যান। মাইকেল ব্রিটিশ ছড়াও শিখেছিল। ধীরে ধীরে উচ্চারণ করত। যদিও সেসবের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝত না; কিন্তু মুখস্থ বলতে পারত। খুব বুদ্ধিমান কিছু প্রাণীর মতই মাইকেল শ্রুতিধর। তালিম পেলে, যা শোনে মাইকেল সব মুখস্থ করে গড় গড় করে বলে যেতে পারত। এটাই কাল হয় মাইকেলের। মালিকের হিংসার বলি হয় সে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে লেখা “বারংবার আক্রমণ ও উচ্ছেদের ইতিহাস”-এর মতই এ এক নিষ্ঠুর সত্য।
জটিল আলোচনার আগে মেহমানদের মনোরঞ্জনে মাইকেলকে ভাঁড় হিসেবে ব্যবহার করা হত। ইদানিং তার ভুল হচ্ছিল। জেমস তাতে অখুশি। নিগারদের পটুত্ব নষ্ট হচ্ছে বলে রসিকতাও চলত। আগের মালিক তাকে দক্ষিণে বিক্রি করে দেন। এভাবে সে র্যান্ডেল খামারে আসে। এখানে তার উপর অত্যাচার চলত হরহামেশাই। তাতে তার বুদ্ধিসুদ্ধিও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল। কাজেকম্মেও সে খুব দড় না। তার ধারণা, চেঁচামেচি আর যাদুটোনায় তার স্মরণশক্তি কমে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছে করত না আর। তাকে মেওে টেরেন্স যেন তাকে মুক্তিই দিলেন!
টেরেন্স ভাইকে একটু নাচাতে চাইলেন। “জেমস, বিষয়-সম্পত্তির দিকে আরেকটু নজর দাও।”
“ওসব নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।”
“নিগারগুলোর নিয়ে এত হৈ-হুল্লোড় করা, এত আস্কারা দেয়া ঠিক না। আমি তো ওসব করি নে। খারাপ আছি?”
“তারা তোমাকে নিয়ে কী বলে তা তো জানো না,” বলেই মদের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে জেমস যাবার জন্য পা বাড়ালেন।
“আরেকটা গান, জেমস।”
জর্জ আর ওয়েসলির তেমন কদর নেই। খঞ্জনি হাতে নোবলকেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। হড়কাতে হড়কাতে বসে মুখ টিপে ইঁশারা করতেই আবার খেলা শুরু হল।
বেতটা শক্ত করে ধরে টেরেন্স বলে উঠলেন, “শুধুই নর্দন-কুর্দন? নাচ, নাচ। আমি বলছি, নাচ।”
তার কথায় কোন তোয়াক্কা না করেই তারা নিজেদের মত খেলতে শুরু করল। উত্তর ভাগ থেকে আসা লোকেরা একটু থেমে চোখ ইশারা করার সাথে সাথে শুরু করল আগের ছন্দের সেই নর্দনকুর্দন।
কোরাকে নাজেহাল করার পর থেকে চতুর আভা অন্যদের বোকা বানাবার তালে আছে। ছদ্মবেশ ধারণ করে সে এলো লম্বা লম্বা পা ফেলে। চিৎকার করতে করতে সে একটা হৈচৈ বাঁধিয়ে দিল। ভাবখানা এমন যে, বড়দিনে এমন হৈচৈ না হলে মাস্তিই জমে না। সবাই মুখোশ পরা। কোন ভয়ডর নেই। ছোট ছোট বাচ্চারা কেউ লাফাচ্ছে, কেউ দিচ্ছে ডিগবাজি। কেউ বা এক পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দোড়াচ্ছে। বাদ্যের তালে তালে গোল হয়ে কালোদের প্রিয় উদ্দাম নাচগান চলছে সমানে। সত্যিকারেই জমে উঠল উৎসব। এমন উচ্ছলতায় কালোরা আগে কখনও মাস্তি করে নি। কোরা নিজেই চলে এলো তার মাঝখানে। প্রতি ঘূর্ণিপাকে সে র্যান্ডেল ভাইদের প্রতিক্রিয়া বুঝতে চেষ্টা করছে। রকি হাতে তাল দিয়ে সময় গুণছে। কোরার চোখ পড়ল সিজারের উপর। হেঁশেলের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে সে। মুখটা গম্ভীর। হঠাৎ সে সরে গেল।
“তুমি!”
টেরেন্স। সিজারের সামনে তিনি শার্টের হাতাটা মেলে ধরলেন টেরেন্স। একটা দাগ। কোরার নজরে পড়ল দৃশ্যটা। তার প্রিয় শার্টের হাতায় লেগে আছে এক ফোঁটা মদের দাগ।
চেস্টার লাফিয়ে উঠল।
শ্বেতাঙ্গ প্রভূর সামনে গিয়ে মাথা হেট করে সে বলল, “মাফ করেন, হুজুর, দয়া করেন আমারে।” ততক্ষণে চাবুকটা শপাং শপাং আওয়াজ তুলে বেদম তার ঘাঁড়ে, মাথায় গিয়ে পড়তে শুরু করেছে। বেদম মারের চোটে হাউমাউ করে চিৎকার করতে করতে চেস্টার পাশের নোংরা জঞ্জালের উপর গিয়ে পড়ল। কিন্তু চাবুক থামল না। টেরেন্সের হাত উঠছে আর চাবুকটা গিয়ে পড়ছে চেস্টারের পিঠে, মুখে। শপাং, শপাং! জেমসকে অসহায় দেখাচ্ছে।
মাত্র এক ফোঁটা। কোরার বুকটা হিম পাথর হয়ে গেল। এমন নির্দয় পিটুনি সে বহু কাল দেখে নি।
কোরার মনে পড়ে অতীতের কথা। গাছে গাছে কালোদের জ্যান্ত বা লাশ ঝুলিয়ে রাখতে সে দেখেছে। আরও দেখেছে বাজপাখি আর কাকেদের দল বেঁধে এসে খাবলে খাবলে সে সব মৃতদেহ সাবাড় করতে। কী নারকীয় দৃশ্য! কুকুরের নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখেছে সোমত্ত মেয়ের শরীর। আগুনে পোড়াতে দেখেছে জ্যান্ত কিংবা মরা লাশ। দৌঁড়ে যাতে পালাতে না পারে সে জন্য কেটে দিতে দেখেছে পা দুটোই; চুরি ঠেকানোর নামে কেটে দিয়েছে দু’হাতের পাঞ্জা দুটোই! চেস্টারের চেয়ে কম বয়েসী ছেলেমেয়েদের উপর এর চেয়ে বীভৎস, নারকীয় অত্যাচার করতে সে চোখের সামনে দেখেছে; কিন্তু কিছুই করে নি।
আজ সে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। কিছু একটা করতেই হবে। পরাভূত গোলামী জীবনের জড়তা ভেঙে তার মধ্যে জেগে উঠল এক মানবিক সত্তা। পড়ে থাকা ছেলেটার গায়ের উপর গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল কোরা এক দুর্ভেদ্য বর্ম হয়ে। তারপর সাপুড়ে যেমন ক্ষিপ্র গতিতে সাপের গলা মুঠো করে ধরে, তেমনি ক্ষিপ্রতায় ধরে ফেলল টেরেন্সের হাতের চাবুকটা। চাবুকের রুপোর হাতলে আঁকা ভালুকের মাথায় চোখ আটকে গেল তার। সেখানে আঁকা একটা ক্ষুধার্ত ভালুক হিংস্র দাঁত বের করে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে কোন শিকার! কিন্তু পরক্ষণেই কোরার হাত থেকে চাবুক কেড়ে নিয়ে সাদা সাহেব এবার কোরা মাথায়ই আঘাত করল সজোরে। আরও একবার, আরও, আরও…। এবার দেঁতো ভালুকের নক্শা করা রুপো হাতলটা ভেঙে তারই একটা টুকরো ছুটে এসে ফুটল কোরার চোখে। দরদর করে ঝরতে লাগল রক্ত। সে রক্তে লাল হল জঞ্জালখানা। (চলবে)
আমিরুল আলম খান
জন্ম যশোর জেলার ভারতীয় সীমান্তলগ্ন শিববাস গ্রামে ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ১৫ই অগ্রহায়ণ।
পড়েছেন এবং পড়িয়েছেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য। এরপর মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে যুক্ত থেকেছেন। যশোর শিক্ষা বোর্ডে প্রথমে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরে চেয়ারম্যান ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি অপেশাদার সাংবাদিকতায় যুক্ত গত পাঁচ দশক ধরে। ইংরেজি দৈনিকে নিউ নেশান-এ প্রায় এক দশক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলো, সমকাল, বণিক বার্তায় কলাম লেখেন।
গ্রামীণ পাঠাগার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশে গ্রামোন্নয়নের নতুন মডেল ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম গণপাঠাগার যশোর পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
শিক্ষা, ভাষা, প্রকৃতি, কৃষি, বাস্তুসংস্থানবিদ্যায় আগ্রহী। এসব নিয়েই তার বই: বাঙলার ফল, অরণ্যের পদাবলী, পারুলের সন্ধানে, কপোতাক্ষ-মধুমতীর তীর থেকে, বিপর্যস্ত ভৈরব অববাহিকা, পারুল বিতর্ক, বাংলাদেশের শিক্ষার স্বরূপ সন্ধান এবং বিদ্যাবাণিজ্যের রাজনৈতিক-অর্থনীতি।
তাঁর অনুবাদগ্রন্থ: আফ্রিকান-আমেরিকান উপন্যাস দি স্লেভ গার্ল। হ্যারিয়েট অ্যান জেকব রচিত এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসটি বোস্টন থেকে প্রকাশিত হয় ইনসিডেন্টস ইন দ্য লাইফ অব এ স্লেভ গার্ল শিরোনামে, ১৮৬১ সালে।