কোলাহল
কোলাহল করেছ আর চুপ করে বসে রয়েছ
চারপাশে নিঃশব্দতার ছায়া
আমি প্রতিবিম্বের ভিতরে এবং ওপারে
কবেযে আয়না ভেঙে ভয়াবহ হবে অন্ধকার
আমি বেরিয়ে পড়ব কবরস্থান থেকে
যেখানে আমার পিতামহ
বর্ণনা করছন অন্তিম
বিভ্রমে ভেঙ্গে আমি কি কোলাহল করেছি
বুঝাতে পেরেছি যে ঘুমিয়ে পড়েছি !
সন্দেহ
এতদিনে ফিরে এসেছ,মৃত প্রেমিক
আশ্চর্য হইনি, শুধু প্রাণপনে মুখস্থ করেছি তোমার মৃত্যু
অস্বাচ্ছন্দের সান্নিধ্য থেকে সরে
চেষ্টা করেছি আকাঙ্ক্ষার কিছু পরিবর্তন সত্যি হোক
সদ্যোজাত নখে নুন-ছাল লুকিয়ে কুষ্ঠ অভিজ্ঞ মেয়েটির মত
বহু সময় খরচ হয়ে গেছে প্রাপ্তমনস্কতায় পৌঁছতে
আমার বর্তমান চুলের ভঙ্গিতে সেই ভাব !
কাটগ্লাসের মতন সন্ধ্যা
এটা একটি সমস্যা হিসেবে নাও
ভাবো, হঠাৎ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরা তোমার পছন্দের হলেও
দেখছি তো জুতো খুলে মুছছো বারবার
কাট গেলাসের আভার মতন সন্ধ্যা
কবে যেন বাদাম কিনে খেতে খেতে তোমার কাঁধ জড়িয়ে
নিতাম সন্ধীপ নুনের ঝাঁজ
তখন হাওয়ায়
বোতাম খুললে বুকটাও ফুলতো
সন্ধ্যে পর্যন্ত খোলা থাকতো দোকান ক্যাফে
রাত দুপুর হয়ে যেত বাসায় ফিরতে
তুমুল ঝগড়া শুনতো পাড়া প্রতিবেশি
তুমিও, আমিও
এখন আমি লিফটের বোতামে চাপ দিয়ে
টিস্যু পেপারে মুছে নিচ্ছি আঙুল!
দ্বিতীয় সম্বোধন
যে পাখি উড়ে যাচ্ছে হয়তো সেটাই শেষ পাখি নয়
পৃথিবী আর একটু ঝুঁকে বাঁকা হয়ে আছে সূর্যাস্তের দিকে
সমাধি অনুসরন করা বাদামি গানগুলোর
বদলে যাচ্ছে চোখের পৃষ্ঠা
সেই থেকে খাঁ খাঁ করে আমার হাড়ের খাঁচা
জানি জুতো খুঁজতে খুঁজতে
কাঁদছে ফুরানো বিকেল
তার ছিঁড়ে ডুবে গেল চোখ
আর কি কখনও তাকে ডাকা যাবে দ্বিতীয় সম্বোধনে?
পরাজয়
আমি পরাজয় জমাচ্ছি—কথাটা উচ্চারণ করি ক্ষোভে নয়, শ্লাঘায়। শ্লাঘাও ঠিক না, ময়ূরের গায়ের বিবিধ রঙের মত এই পরাজয় বাক্য হয়ত বাকি জীবনেও আমার উধৃতি!দেশ ভাঙ্গা নিয়ে আমার নিজের অনুভূতি শূন্য। কিন্তু আমার মায়ের দুঃখ মিশ্রিত কিছু বাক্য তো ভুলে যেতে পারিনা! “তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে ভাঙলো কাচের আয়না” না, আমার মাকে কখনও চুল বাঁধতে দেখিনি। সাদাসিধে একটা কালো টাসেল জড়াতো শুধু। তাই দিয়েই খোঁপা। হ্যাঁ চুল ছিল নাইলে আমার এত চুল হল কিভাবে! মা বলতো তার আয়নার কথা। আহা নতুন আয়না ফেলে আসতে হয়েছে! আর কি কি কত কিছুর স্মৃতি, নতুন বিয়ের ঘোরা ঘুরি। কোথায় কোন বিখ্যাত দোকানে জুতো, প্রথম রুমালি রুটি খাওয়া। এক পয়সায় এত্তগুলো ছোলা মাখা—মায়ের চোখ প্রত্যাশায় জ্বলে উঠেই নিভে যেত। আর হবেনা। কি দেশে যে আসলাম।বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই হোস পাইপে ধুয়ে দেয়া কোলকাতার রাস্তা—নাহ!” এবার অবাক না আমি। হ্যা, মা রাস্তা আবার ধোয় নাকি?
আমার চোখে আমার গোপালগঞ্জ সেরা শহর। গোপালগঞ্জের রাস্তা সেরা রাস্তা। রাস্তার পাশে টুকরো কাগজ, ঠোঙা, দরজি দোকানের কাপড়, বাদামের খোসা এসব তো পড়ে থাকবেই। আমিতো ওখান থেকেই কাপড় টুকাই পুতুলের জন্য! কিছুই দেখলিনা তোরা। কিছুই না। মা ক্ষান্ত দেয়। তাছাড়া অবসর কোথায়! আমার বাবা একজন নাটক করা পাগল মানুষ! গান্ধির আদর্শে সেই যে খদ্দর ধরেছে তার আর নড় চড় নাই। কোলকাতা থেকে ফিরেছে কিন্তু আমার দাদুর ব্যবসার ধারে কাছে যায়না। বেশ বড়ো ব্যবসা দেখে বাবার দুই ভাই। তার তো ক্ষেপে লাল! কারণ ততদিনে আমরা ভাই বোন হয়েছি। সংসারে তো বাবার কোনো সহযোগিতা নেই। নাটকের মহড়া শেষে সেই রাত গভীর হলে বাড়ি ফেরা। সেই অভশপ্ত রাত এলো। বাবা বাড়ি ফিরলে মা বলল, বাবা তো আর পারছে না। সংসার বেড়ে গেছে। তুমি কিছু করোনা এটা কেউ কতদিন সহ্য করবে? কেউ কিছু বলেছে? বাবা তোমাকে ত্যাজ্য করেছে। বলতে মায়ের চোখ ভরে গেলেও মা ই বা আর কত পারে? শ্বশুর তার খুব প্রিয় কিন্তু বাবা সংসার দেখছেনা! ভোরবেলাতেই, দুজন ঘুমায়নি।মাকে নিয়ে দু ভাইবোন নিয়ে বাবা বাড়ি ছাড়লো। একজন নাটক পাগল মানুষ, একজন কবি একজন ওপন্যাসিক, একজন আবৃত্তিকার, একজন লিটল ম্যাগ প্রকাশক এভাবেই বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য বেরিয়ে গেল।বাবা কি পরাজিত হয়েছিল? সারাজীবন পরাজিত? হয়তো তাই। আমার রক্তেও সেই পরাজয়। পরাজয়ের নেশায় আমি আরো পরাজয় জমাই।
কচি রেজা
জন্মশহর গোপালগঞ্জ, ডিসি রোড। মা- রাবেয়া রেজা, বাবা- কাশেম রেজা। প্রকাশিত বই এর কয়েকটি: অবিশ্বাস বেড়ালের নূপুর; ভুলের এমন দেবতা স্বভাব; মমি ও কাচের গুঞ্জন মনে করো ও নির্বাচিত কবিতা।
কবি কচি রেজার ভাষায়- খুব প্রস্তুতি নিয়ে লিখতে তো আসিনি। তবে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে অনেক। এখনও নিচ্ছি। তৈরি হচ্ছি এখনও। সমস্তকবিতাকালই প্রস্তুতিকাল, আমি মনে করি। জীবন ভালো কি মন্দ জানি না। আঘাতের অভিঘাতই আমি লিখতে চেয়েছি কেবল!