দুনিয়া যখন কোয়ারেনটিনে
রঙিন শপিংমল বন্ধ, রাস্তাগুলো
নিজেরাই একা একা হেঁটে যাচ্ছে
লৌকিক গলির দিকে—
এই সঙ্গ নিরোধকালে কোনো ক্যাফে নেই
সব ক্যাফে বেড়াতে গিয়েছে
সুন্দরবনের চৌপদী জঙ্গলে
দুনিয়ার সব ভয়ংকর রোগ
ঢুকে পড়ছে মানুষের মনোলোকে
তরুণ-তরুণী মেঘ উড়ে যাচ্ছে
প্রেমহীন শূন্যতার দিকে—
এই তালাবদ্ধ দুনিয়ায় এক চাবিঅলা
জাদুর চাবির বাক্স নিয়ে উঠে আসবেন উপকূলে
সমুদ্রের পাতাল নগর থেকে
স্বয়ং সূর্যদেব তারই উত্থানের
ক্ষণগণনায় মগ্ন রয়েছেন…
আরেক বৈশাখে
নদী ভাঙনের রাতে শিকস্তি যেমন
নির্ঘুম কাটিয়ে দেয় ভয় জড়সড় রাত
সেভাবেই কেটে যাচ্ছে কোভিড-সন্ত্রাসকাল
দিনরাত মুহূর্ত সমূহ, আশ্রয়ে থেকেও
এ রকম আশ্রয়হীনতা… এ রকম উদ্বাস্তু বোধ
দুনিয়া দেখেনি।
চলে গেলো বাঙালির সবচে’ উৎসবময়
আপন আনন্দ দিন, ধর্ম-বর্ণ মিলন মেলায়
দেখা নয়। চারুকলা রমনায় এ রকম নিঃশব্দ বৈশাখ
বহুদিন কখনো দেখেনি কেউ, দুনিয়ার
রিফ্রেশ বাটনে চাপ দিয়েছে কোভিড-১৯
গানে নয়… তরুণ-তরুণীর অনুভূতি বিনিময়ে নয়
দুনিয়া রিফ্রেশ হচ্ছে অজানা নিয়মে
তবে এটাই শেষ নয়- শেষ বৈশাখ নয়
আবার হবে তো দেখা প্রাণে প্রাণে
গানে গানে আরেক বৈশাখে
দুনিয়া হোঁচট খেলে
হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমধ্যে দুনিয়াও হোঁচট খায়
আর ঠিক তখনি পা চেপে বসে পড়ে
গ্যালাক্সি বলয়, যেনো এটাই নিয়ম
এটা মেনে নিতে হবে—
পিঁপড়ের দল ঢুকে পড়ে নিজের গুহায়
সাপ তার গর্ত থেকে মাথা তুলে ফের
নিজেকে গুটিয়ে নেয় নিজের শরীরে
গাছ তার প্রেমিককে বলে দুনিয়া অসুখে
আপাতত প্রেমপ্রীতি বাদ— বেশি বেশি
অক্সিজেন ছাড়ো হে… বেশি বেশি
সবুজ ছোড়ে দাও
দুনিয়া হোঁচট খেলে প্রকৃতি আরো ঢেলে দেয়
আরো বরফ জমে উত্তর মেরুতে
আর মানুষের অসুস্থ জানালায়
উঁকি মারে সবুজ বাতাস
যেনো শাদা কবুতর সবুজ সবুজ
সমুদ্র প্রহরে
অদ্ভুত বৈশ্বিক মহামারি যেনো সৌর দুর্ঘটনা
ফ্ল্যাট বাড়ি ভাসিয়ে নিয়েছে গভীর সমুদ্রে
ফ্ল্যাটগুলো ছড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রে সমুদ্রে
যেনো এক একটা দূর-বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাড়ি
দূরে দূরে সমুদ্র প্রহরে ভেসেই চলেছে…
নাগরিক পথ, গ্রীষ্মপীড়িত গাছ
সামুদ্রিক ঢেউ হয়ে দুলেই চলেছে
নুলো অন্ধ ভিখিরিরা ঢেউয়ের ফণা হয়ে
একটানা গেয়েই চলেছে বিবিক্ত সঙ্গীত
এমন কোভিডকালে কখনো হঠাৎ
ফ্ল্যাটের সাথে ফ্ল্যাটের দেখা হয়ে গেলে
সুকৌশলে পালিয়ে যাবার দিন এসে গেছে
আফ্রিকার পঙ্গপাল ধেয়ে আসছে এশিয়ায়
অন্য কোনো প্যানডেমিক বার্তা চিহ্ন হয়ে
কোনো এক গান, কবিতা, চিত্রকর্ম
জুড়ে দেবে দুনিয়ার নিষণ্ন সংসার
সেই আশায় জেগে আছেন সহস্র
বিজ্ঞান জাদুকর
জীবন বেঁচে থাক
বৃষ্টির প্রতীক্ষা নয়, গৃহবন্দি, উদ্বাস্তু সময়
দৈব কিছুর আশায় সবুজ আকাশমুখী
সমস্যা মানুষের কিন্তু পশুপাখি গাছপালা
এমনকি পোকার প্রার্থনা সভায়
জীবাণুর বিনাশ চেয়ে প্রার্থনা চলছে
এই ইকো সিস্টেমে দুনিয়া তো সকলের
এমনকি মানুষেরও
এটা মানুষ না বুঝলেও অন্যপ্রাণী বোঝে
তাইতো সকলে চায় মৃত্যু মরে যাক
জীবন বেঁচে থাক জীবনে জীবনে…
পরিণামের দিকে
গলায় পরেছো ভয় দাগ, জন্মদোষ
পরিয়ে দিয়েছে এই মৃত্যু দাগ
সুতরাং মৃত্যু হবে এবং হবেই
প্যানডেমিক থেকে বেঁচে যেতে পারো
কিন্তু দাগ থেকে কখনোই নয়
বালিশে যতোই মাখো শ্রমশ্বাস
শরীরে যতোই মাখো রোদ রস
ওই দাগ কিছুতে যাবে না
দিন আসছে, কবিতা লিখবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
মেধা নিয়ন্ত্রণ করবে গুগল
তোমার বাদামি স্বপ্ন চলনবলন
সব হ্যাকড হয়ে গেছে হে
দাগ দোষে ভেঙে গেছে পুলগুলো
ওই পথে হাঁটবে এখন রোবট মানুষ
পেছনে থাকবে এক এনালগ দুনিয়া
আর কিছু ক্ষীণ সুতো…
জীবন
করোনারকাল এসে লিখে দিল নতুন সময়
জীবন ভয়ের নয় জীবন তো চির বরাভয়
ঝাউ পাতার মর্মগান
আর কোনো দাঙ্গাস্ত্র নেই সুতরাং সন্ধি
এখন শুধুই ঝাউপাতার ধর্ম গান
স্যানিটাইজার ছিটানো ব্লাউজে
যতোটা সুরক্ষিত ভাবছো নিজেকে
ততোটা সুরক্ষিত নয় ওই ঝাউপাতা
জীবাণুমুক্ত চুম্বন বলে কিছু নেই
সেফটি পিনের নিখুঁত ধার নিয়ে যেতে পারে
গভীর কবরে। তখন আর কোনো পরিত্রাণ নেই
বিমূর্ত বাতাসে। শুধু
ঝাউপাতার মর্মগান ছাড়া
কবরবাসীর প্রতি
মোটেই মিশুক নয় ওই কবর নিবাসী
মূর্খ এবং অসামাজিক… ও তো নিজেই
কোয়ারেনটিনে থাকে সারাটা বছর
ওর হাতে হাত নয়- বুকে বুক নয়
স্প্যানিশ ফিভার প্লেগ অথবা কোভিড-১৯
ঢুকে পড়বে তোমার শরীরে—
সুতরাং ওই অস্পৃশ্য থেকে দূরে থাকো
ওকে আর ডেকো না লোকালয়ে উৎসবে পার্টিতে
বেচারা একাকী আছে থাক নিজের নিয়মে
চুপচাপ কবর চত্বরে ধ্যানে মগ্নতায়…
নিষণ্ন সময় জুড়ে…
লকডাউনের পরে
সূর্য কতো বড় আর কোভিড-১৯ কত্তো ছোট
এতো ছোট যে দেখাই যায় না। অথচ সেই
ক্ষুদ্র জীবাণু সূর্যকে গ্রাস করেছিল- গ্রাসিত সূর্যটা
এতোদিন- এতোটা সময় আকাশে উড়েছে
অবশেষে জীবাণুর খেলা শেষ হলো
দুনিয়াজুড়ে ফের মানুষের খেলা শুরু হলো
গ্রহণকাল শেষ- আকাশে নতুন সূর্য উড়েছে
নতুন সময় এসে গেল জীবনানন্দের শঙ্খচিল হয়ে
ড্রোন চোখে দুনিয়ার আনন্দযজ্ঞ দেখার
আবার কফি হাউসে ৩০ সেকেন্ড
পার্ক রোডে চা গুমটিতে আবার হাতে হাত
জীবনের উষ্ণতা ওয়েভ টিউনে ছড়ানোর দিন ফিরে এলো
আবার শ্রমে ঘামে কামে জীবন চালিয়ে দেয়া
আরো উজ্জ্বল দিন আরও অন্ধকার রহস্য রাত
ফিরে এলো…
দারা মাহমুদ
দারা মাহমুদ কবিতার এক সহজ অথচ দুর্বোধ্য রহস্যঘেরা পথের অভিযাত্রী। সরল সড়ক ধরে ক্রমশ কঠিন সূক্ষ্মতার দিকে তার চলা। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে হেঁটেই চলেছেন কবিতার ক্রমশ প্রাতিস্বিকতার পথে। জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮। ৫/৭ বার পেশা বদল করে এখন সাংবাদিকতায় স্থিত। দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখা ও বার্তা বিভাগের সম্পাদনার কাজে যুক্ত। মোট গ্রন্থ ১১টা। তবে মৌলিক একক কাব্যগ্রন্থ মাত্র ৫টা। এত কম লেখার কারণও ওই প্রাতিস্বিকতার কঠিন পথ অনুসরণ।