গাজী তানজিয়ার গল্প: একগুচ্ছ রেইনট্রি ফুল

পাভেল হিমিকার কম্পনটা ঠিক বুঝতে পেরেছে। ওর হাতে ফুলটা দিতে ও যেন একটু চমকে উঠল। ফুলটা নেয়ার সময় আঙ্গুলগুলো কি একটু কাঁপছিল না!
কি হয়েছে হিমিকা?
কই, কিছু না-তো!
আমাকে বললেই হলো, না! কিছু একটা তো হয়েছে।
আচ্ছা তুমি এই ফুল কোথায় পেলে?
ওহ্ এই কথা, কাল রাতে ঝড় বৃষ্টি হলো খুব তখন একটা ছোট্ট ডাল সমেত ফুলটা আমার জানালায় এসে পড়ল। তখন ভাবছিলাম তুমি এটা দেখলে খুশি হবে। কিন্তু তুমি এরকম চমকে উঠলে কেন?
ও কিছু না।
হিমিকা ’কিছু না’ বললেও পাভেল বুঝতে পারছিল ওর কিছু একটা হয়েছে। কেমন যেন অন্য মনস্ক হয়ে আছে। সেই কখন থেকে একটা সুগার কিউব কফি মগে দিয়ে নাড়ছে তো নাড়ছেই।
কি ভাবছ?
উম্।
ভাবছ কি হিমি?
আচ্ছা, মৃত্যুর পর আসলে কি হয়?
কেন, কি হয়েছে? হঠাৎ এই প্রশ্ন?
আহা বলোই না!
কিভাবে ব্যাখ্যা করব, ধর্মীয় ব্যাখ্যা-নাকি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা?
বিজ্ঞান না ধুর! বিজ্ঞান বড় আনরোম্যান্টিক, বলবে মৃত্যুতেই জীবনের অবসান। ওখানেই সব শেষ। বরং ধর্ম দারুণ ব্যাখ্যা দেয়। আত্মা, পরকাল, পূনর্জন্ম।
তুমি এতে রোমাঞ্চিত হও হিমিকা! ধর্ম যে খুব ভয় দেখায় মানুষকে। পরকালে শাস্তি, পাপ-পূণ্যের বিচার, মার-ধোর কোনোটাই তো বাদ দেয় না।
না দিক তারপরও আমার ধর্মের ব্যাখ্যাই ভালো লাগে। মরার পরও বেঁচে থাকার একটু সম্ভাবনা!
তাই যদি মানো তাহলে তো মৃত্যুর পর আত্মাদের ঘুর ঘুর করে বেড়ানোর কথা, কখনো কি কোনো আত্মার দেখা পেয়েছ তুমি!
সে জন্যই তো বলছি। সত্যি বলতে কি জানো পাভেল, আমিও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এবার উইন্টারে তুমি যখন চলে গেলে ট্যুরে ওই সময়টাতে একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনাটাই আমার আগের সব ধারণা ওলট-পালট করে দিল।
কি, ভুত এসেছিল?
ভুত কি-না জানি না। আমি ঠিক এর ব্যাখ্যা দিতে পারব না কোনো। তবে এসেছিল জানো!
কে?
ওই ছেলেটা।
কোন ছেলেটা?
ওই যে..। ওহ্ ! তুমি তো জানোই না ঘটনাটা। তখন তো তুমি এখানে ছিলে না জানবে কি করে? ওই যে আমাদের সামনের একতলা বাড়িটা, ওখানে তো সারা বছরই কোনো মানুষ থাকে না। ভাড়াটে ওঠে আর চলে যায়। তো এবার একদল ভাড়াটে এলো। একদিন দেখলাম ওবাড়ির জানালা-দরজা খোলা, বুঝলাম কেউ এসেছে। ওরা বোধ হয় তিনজন ছিল। বাবা-মা আর একটা টিনএজার ছেলে। ছেলেটা বোধহয় কলেজে পড়ত। কলেজটা এখান থেকে খুব কাছাকাছি তাই হয়ত ওরা এখানে শিফট করেছিল। কিন্তু ছেলেটা জানো ঠিক ওই কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের মতো প্রাণবন্ত ছিল না। তুমি তো জানো বিকেলের দিকে আমার কোনো ক্লাস থাকে না। আমি প্রায়ই বিকেলবেলা যখন বারান্দায় বসে চা খেতাম তখন দেখতাম ছেলেটা ছাদে হাঁটছে। এই দূর থেকেও আমি ওর বিষন্ন মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেতাম। জানো, ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। ও হাঁটা-হাটির এক পর্যায়ে কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমার এক ধরণের অস্বস্তি হতো। আমি কখনো উঠে চলে যেতাম আবার কখনো ভাবতাম আমার ছাত্র হয়ত কলেজে দেখেছে। কিন্তু ওর তাকানোর মধ্যে সেরকম ভাব ছিল না। কেমন যেন আমাকেও না ঠিক, আমার ভেতরে অন্য কাউকে খুঁজত সে। আমি ভাবতাম অন্য কথা, ওর কি কোনো বন্ধু নেই! এ বয়সের একটা ছেলে প্রতিদিন বিকেলবেলা এরকম একা একা থাকে! ও কি কোনো কারণে ডিপ্রেশনে ভুগছে!
ভাবছিলাম একদিন ওদের বাড়িতে যাবো, ওর মায়ের সাথে কথা বলব। কিন্তু সে আর হয়ে উঠল না।
কেন?
একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি ওবাড়ির সামনে অনেক লোকের ভীড়। ভাবলাম, এতো সকালে আবার কি হলো ওবাড়িতে! একজনকে ডেকে জানতে চাইলম- বলল, এ বাড়ির ছেলেটা আত্মহত্যা করেছে। শুনে আমি থমকে গেলাম জানো। আমার পা যেন আর চলছিল না।
সত্যিই, এরকম আকস্মিক খবরের জন্য তো কেউ প্রস্তুত থাকে না ।
না, সেজন্য না। এর ভেতরে অন্য একটা ব্যাপার আছে। যার কোনো ব্যাখ্যা আমি এখনো খুঁজে পাচ্ছি না।
কী ঘটল আবার এর মধ্যে?
সত্যিই অলৌকিক, অশরিরী একটা ব্যাপার।
সেটা কি রকম?
তুমি জানোতো ওবাড়িতে একটা বড় রেইনট্রি আছে।
হ্যঁ, ফেব্রুয়ারি মার্চের দিকে গোলাপি ফুলে ভরে যায়। তুমি একবার দেখিয়েছিলে আমাকে।
হ্যাঁ, ওই গাছটাই।
ওই গাছটা কি?
ওই গাছটা নাকি একশো- দেড়শো বছরের পুরোনো। এই এরিয়ার সবচেয়ে পুরোনো গাছ। সন্ধ্যাবেলায় রাজ্যের পাখি এসে ভীড় করে ওখানে। কিচির-মিচির শব্দে এক স্বর্গীয় আবহ তৈরি হয় যেন। অথচ সেদিন আমি শুনলাম, একদম ক্লিয়ার শুনলাম একটা মেয়ে কাঁদছে। ওই গাছটা থেকেই ভেসে আসছে কান্নার শব্দটা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল কান্নার শব্দটা যেন থেকে থেকে বাড়ছে। থেমে থেমে কিছুক্ষণ পর ভেসে আসছে শব্দটা। এভাবে তিন দিন। আর তার পরই ওই ছেলেটা সুইসাইড করল।
কিন্তু এই এলাকার বাড়িগুলোর দূরত্ব এতো বেশি সে ক্ষেত্রে কি নিশ্চিত হওয়া যায় যে কান্নার শব্দটা ওই গাছটা থেকেই আসছিল!
এজন্যই তো নিশ্চিত হওয়া যায় পাভেল। আমি ভুল শুনিনি।
তারপর কি হলো?
ছেলেটা মরে যাওয়ার পর থেকে আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল ছেলেটা এবাড়িতে আসবে। ওর যে কৌতুহল ছিল, যে কারণে ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকত, অন্তত সেই কৌতুহল পূরণ করার জন্য হলেও এ বাড়িতে আসবে। আর যতবার এটা ভাবছিলাম ততবার ভয়ে আমার বুকের রক্ত হীম হয়ে আসছিল। সন্ধ্য হলেই আমি ঘরের দরজা জানালা শক্ত করে বন্ধ করে দিচ্ছিলাম। বিকেল বেলা আর খোলা বারান্দাতেও বসি না। এভাবে তিনদিন কেটে গেল। ভয়টা অনেকটা শিথীল হয়ে এসেছে। এরপর এলো সেই রাত।
তার মানে ছেলেটা এসেছিল?

সেই রাতটাতে খুব শীত পড়েছিল। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সঙ্গে টিপ টিপ বৃষ্টি। আমি রুমহিটারের পাওয়ারটা বাড়িয়ে দিলাম। পশমী কম্বলটা ভালো করে জড়িয়ে নিলাম গায়ে। হঠাৎ টের পেলাম, স্পষ্ট টের পেলাম আমার জানালা ঘেসে খোলা বারান্দায় কেউ হাঁটছে। পা টেনে টেনে হাঁটছে। সঙ্গে যেন একটু গোঙ্গানির শব্দ। আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। তারপরও আমি জানালার পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম বারান্দায় কে হাঁটছে।
প্রচণ্ড ভয়াবহ কোনো ঘটনার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালে মানুষের ভয় থাকে না।
ঠিক তাই। আমি ভয়ে ককুড়ে যেতে যেতে হঠাৎ অনুভব করলাম আমার একটুও ভয় করছে না। হঠাৎ এক প্রচণ্ড বিদ্যুৎ চমকানির সাথে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। কাউকে দেখতে পেলাম না। আবারও কিছুক্ষণ পর সেই পা টেনে হাঁটার শব্দ। আমি আবারও পর্দা সরালাম। আবারও বিদ্যুৎ চমকালো। আমার চোখ চলে গেল ওবাড়ির ছাদে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। বিদ্যুৎ চমক স্থায়ী হচ্ছে না। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকের আলোয় দেখা গেল ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে, ঠিক যেন পনের বছর আগের আমি। মেয়েটা রেগে রেগে ছেলেটাকে কী যেন বলছিল। তারপর হঠাৎ ছাদ থেকে ঝাপ দিল নিচে। শুধু দেখলাম রক্তে চাতালটা ভিজে যাচ্ছে। আবারো সব অন্ধকার। আমি আর কিছু দেখতে পেলাম না।
তারপর?

আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না আমি কি দেখছি। ইন্দ্রিয়ের অতীত কোনো একটা দৃশ্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে ধরা পড়ছিল। বুঝতে পারছিলাম ওখানে যা ঘটছে তা কোনো বাস্তব দৃশ্য নয়। অন্য জগতে অন্য কোনো সময়ে হয়ত এটা ঘটেছে। আমি ছুটে গিয়ে ওয়াচম্যানকে ডেকে তুললাম। তাকে বললাম, ওবাড়ির ছাদে দেখেছ কি ঘটছে?
সে বলল, ম্যাডাম আমি তো..! বুঝতে পারলাম সে ঘুমাচ্ছিল। আমার কথা মতো সে ওবাড়ির ছাদে টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল। বলল, কই কিছুই তো দেখতে পাইতেছি না ম্যাডাম।
সে রাতটা কিভাবে যে কাটল কাউকে বোঝাতে পারব না। আমি হয়ত এর পেছনে অনেক যুক্তি দিতে পারতাম পরে। হতে পারে আমার অবচেতনে আমি এমন কোনো সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলাম, আর তা-ই আমি দেখেছি। কিন্তু পরেরদিনের ঘটনাটা আমার সব যুক্তি ভণ্ডুল করে দিল।
কোন ঘটনা?
পরদির ভোরে দেখলাম, আমার খোলা বারান্দায় পড়ে আছে একগুচ্ছ রেইনট্রি ফুল। অথচ জানো, তখন এই ফুলের সিজন ছিল না। অন্তত এই মহাদেশের কোথাও এই ফুল পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

সেই থেকে জানো আমি একদিন রাতেও ঠিক মতো ঘুমাতে পারি না। আর আজ কেন তুমিও সেই একই ফুল হাতে..! হিমিকা তখন কাঁপছে। চোখ ভিজে উঠেছে জলে।
পাভেল আস্তে করে হাত ধরল হিমিকার। কেঁদ না হিমি, কিচ্ছু হয়নি তোমার। এই পৃথিবীতে কতকিছুই তো হয় যার কোনো ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারি না।

 

গাজী তানজিয়া

জন্ম: ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭। পিরোজপুর, বাংলাদেশ। পেশ: লেখক
উপন্যাস: ১. জাতিস্বর;২. পৃথিবীলোক
গল্প:১. সবুজ ঘাসে মুক্ত বেশে
রাজনৈতিক নিবন্ধ: অরক্ষিত দেশে অবরুদ্ধ সময়ে
পুরস্কার: আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১০

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top