ধুসর গোধূলি
চানাচুর-ফুকল-আইসক্রীম-সিংগারা-তেঁতুল-অড়বড়ই-আমলকী নিত্য কিনে খেয়ে, বন্ধুদের খাইয়েও আমার হাতে প্রতি হপ্তাতেই কিছু পয়সা উদ্বৃত্ত থেকে যেত।
দুই-তিন-হপ্তা বাদেই দেখতাম হাতে পাঁচ-দশটাকা জমে গেছে! এত টাকা কই বা কীভাবে খরচ করব তাল পেতাম না। রিক্সা ও নৌকাভাড়া দেয়া ছাড়া আমার নিজের কোনো খরচই ছিলনা। আমার বই-খাতা-কলম-পেন্সিল-শার্পনার— যা কিছুই লাগত, আব্বাই কিনে এনে দিত। ইশকুলে বই নেওয়ার ব্যাগ, টিফিন বক্স। ইশকুল শুরুর প্রথম দিকে আমার ব্যাগ আর টিফিনবক্স আব্বা ঢাকা থেকে কাকে দিয়ে যেন আনিয়ে দিয়েছিল। আব্বা-আম্মার ধারনা ছিল, সিলেটে অত উন্নত-মানের ইশকুল ব্যাগ-টিফিন বক্স পাওয়া যাবে না। আমার আজও স্পষ্ট মনে পড়ে—সেই সিনথেটিক-লেদারের ঘিয়ে-রঙা ব্যাগ, তার লালচে-খয়েরী ঝোলানো বেল্ট। আর রুপালী রঙের স্টেইনলেস-স্টিলের টিফিনবক্স। যার ঢাকনা একদিক আটকানো আর একদিন খোলা। যে টিফিন বক্সে আম্মা ডিম-পরোটা বা চিঁড়ার পোলাও দিয়ে দিত। কোনো কোনোদিন ময়দার-রুটি আর সুজির হালুয়া, কিংবা রুটি-ডিমভাজা। পাউরুটি-মাখন-কলা। সিনথেটিক লেদারের ব্যাগটা বইখাতার ভারে আমার কাঁধ থেকে বার বার নেমে যেতে চাইতো। কারণ আমার তো ক্লাসের জন্য রুটিন দেখে সব বই ও আলাদা আলাদা খাতা নেয়া চাই-ই চাই। এত বই-খাতার ভার সহ্য হতোনা ব্যাগের। ফলে আমার ইশকুল ব্যাগের বেল্ট ঘন ঘনই ছিঁড়ে যেত আর আব্বাকে নতুন করে ব্যাগ কিনতে হতো।
ফুকলওয়ালা, অড়বড়ইওয়ালা, তেঁতুলওয়ালাদের পাশেই ছিল সারি দেয়া তিন-চারটা বইয়ের দোকান। একেবারে আমাদের ইশকুল লাগোয়া। রাস্তা পারাপারের কোনো ঝামেলা পোহাতে হতো না। ফলে গাড়ির নিচে চাপা-পড়ার সম্ভাবনাও ছিল না। অবশ্য ইশকুলের রাস্তার ওইপারে ছিল জালালাবাদমার্কেট। রুনা-স্টোর নামে একটা কসমেটিকের দোকান। ওই দোকানে ব্র্যান্ডের সব ধরনের কসমেটিক পাওয়া যেত। বিদেশী লাক্স থেকে শুরু করে লিপগ্লস, ওড়নার ব্রুচপিন থেকে চার্লি-পারফিউম পর্যন্ত। পরবর্তীতে আমি এই দোকানের বান্ধা-কাস্টমার হয়ে গিয়েছিলাম। আমার হাতে টাকা জমলেই রুনা-স্টোর থেকে পাঁচটাকা দিয়ে একটা হেয়ারব্রাশ আর পাঁচটাকায় একটা নেইলপলিশ কিনে আনতাম। আমার ছিল নানা রঙের নেইলপলিশের সখ। আমি চাইতাম আমার কালেকশনে যেন সব রঙই থাকে। আর হেয়ারব্রাশ আমাকে কিনতেই হতো। প্রচণ্ড-ঘন ও কার্লি হেয়ারের জন্য আমার মাথায় চিরুনি-বুলানো প্রায় অসম্ভব ছিল। তাছাড়া আমি চুলের টান একদম সহ্য করতে পারতাম না। ছোট্ট-হাতল লাগানো নরম-ব্রাশ দিয়ে চুল আঁচড়াতে হতো। আজও তাই করি। আমার চুল আমি নানা রকম হেয়ারব্রাশ দিয়েই আঁচড়াই ।
রুনা-স্টোরের অপজিটে ছিল ‘শাড়িঘর’ নামে একটা বেশ ভালো মানের শাড়ির বিতান। আরও যেন কী কী সব দোকান ছিল অই ছোট্ট দোতলা-মার্কেটে! এই মার্কেটের সামনে রোমিওরা ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকত। আমি তাদের দেখেও না-দেখার ভান করতাম। কিন্তু আমি না-দেখলে কী হবে? রোমিওরা ঠিকই আমার পিছু নিত। পিছু নিয়ে নিয়ে বাসা পর্যন্তও এসে যেত। এইগুলি অবশ্য আরও পরে, আমি যখন ক্লাস সিক্স-সেভেনে উঠেছি তখন থেকেই শুরু হয়েছিল।
নেইলপলিশ আর হেয়ারব্রাশের কাস্টমার হওয়ার আগে আমি একেবারে পয়লাপরথম যা কিনেছিলাম— তা ছিল একটা বই। এই বইকে আম্মারা বলত ‘নভেল’। আর আমি বলতাম ‘গল্পের-বই’। আমি তখন উপন্যাস আর গল্পের ফারাক বুঝতাম না।
আমি ভীরু-পায়ে ফুকলওয়ালা আর তেঁতুলওয়ালার ঝাকা পেরিয়ে, রাস্তার ওইপারের রোমিওদের কুনজর বাঁচিয়ে একদিন ছুটির পরে বুকস্টোরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রচণ্ড ভয়ে আমার বুক ঢিপঢিপ করছে। আমি তো জানিনা আমি কী বই কিনব? তবে যে সাহসে ভর করে দোকানে ঢুকেছি— তা ছিল আমার হাতে জমানো পাঁচটাকার একটা নোট। আব্বা কোনোদিন আমাকে দেয়া টাকা-পয়সার হিসেব চাইতো না। ভুলেও জানতে চাইতো না বাড়তি টাকা দিয়ে আমি কী করি? আমার ভয় লাগছিল দুইটা কারণে— এক. আমি এই প্রথম কোনো বুকস্টোরে ঢুকেছি! দুই. আমি একটা নিষিদ্ধ বই কিনতে এসেছি!
[আজ এই ভেবে আশ্চর্য লাগছে, এক বালিকার কতোটা সাহস থাকলে সে একা একা কোনো বুকস্টোরে আউটবই কিনতে যেতে পারে?]
দোকানের সামনে আমি ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছি। সেলসম্যান জানতে চাইলো—-
খুকী তুমি কী নিতে চাও?
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম— গল্পের বই।
তাইলে দোকানের ভিতরে এসে খুঁজে নাও।
আমি দ্বিধা নিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখি ফ্লোরের উপর উঁচু করে সারি সারি বই রাখা।
কী বই কিনব আমি?
ঠাকুরমার ঝুলি, রাশিয়ার রূপকথা, সোনার ডালে রুপার পাতা, চীনদেশের রাজকুমারি, ছোটদের রবীন্দ্রনাথ নাকি চম্পাবতী?
ওসব বই তো আমার পড়া হয়ে গিয়েছে। আমি বড়দের বইয়ের র্যাকে খুঁজতে লাগলাম। খুঁজতে খুঁজতে অত্যন্ত সঙ্কোচ নিয়ে একটা বই টেনে নিলাম—
‘ধূসর গোধূলি‘— নীহারঞ্জন গুপ্ত।
এই বইটা আমি নিলাম কারণ এই লেখকের নামটা আমার অতি পরিচিত। এই লেখকের বহু বই আম্মা-চাচিমাদের আমি পড়তে দেখেছি। হয়তো এই বইটাও। বইয়ের মলাটের রঙ বটল-গ্রিন। আমি ভয়ে ভয়ে পাতা উলটে দেখলাম—
মূল্যঃ- ৪.৩০ টাকা।
আমি আমার পাঁচটাকার নোটটা এগিয়ে দিতেই সেলসম্যান আমাকে বইয়ের গায়ের দাম রেখে আটআনা মানে ৫০ পয়সা ফেরত দিল।
বইয়ের দোকান থেকেই বেরিয়েই বইটা আমি যত্ন করে ব্যাগের ভেতর অন্য বইয়ের মাঝে লুকিয়ে রাখলাম। আব্বা-আম্মা বা ছোটকা যে কেউ দেখলেই আমার আর রক্ষে নাই। মার খেতে খেতে জান বরবাদ হয়ে যাবে। আব্বা-আম্মা যদি না-ও দেখে, ছোটকা দেখবেই। ছোটকার কাজ হলো আমার আর প্রদীপের দোষ্ত্রুটি খুজে খুজে বের করা। আর সেইসব নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে আব্বার কাছে নালিশ জানানো। আমার আব্বা যতোনা পুলিশ, ছোটকা তার চাইতেই ডবল-পুলিশ ছিল! সুর্যের চাইতে বালি গরম— বিষয়টা অনেকটাই তেমনই আর কি!
আমার নীহারঞ্জন গুপ্তের এই ‘ধুসর গোধূলি’ কেনার কারণও ছিল— বড়দের বইয়ে আমাদের হাত দেয়া একেবারেই বারণ ছিল। কিন্তু বড়দের মুখ থেকে আমি সমস্ত আউটবইয়ের কাহিনীই জেনে যেতাম। আম্মা-চাচিমারা তাদের পড়া বই নিয়ে এন্তার আলাপ-সালাপ চালাতো। তাদের বিকেলের আড্ডা জমে উঠতো নিজেদের পড়া বই নিয়ে।
ফলে আমি ছোটদের বই পড়ার পাশাপাশি বড়দের বই পড়ার জন্যও সকলের অলক্ষ্যে মুখিয়ে থাকতাম। কিন্তু তা থাকলে কী হবে? নিজের দেহের হাড়গোড় ভেঙে যাওয়ার ভয় সকলেরই থাকে—আমারও ছিল। আর আমি তখন বালিকা বলে হয়তো সে ভয় একটু বেশি মাত্রায়ই ছিল।
বাসায় এসে লুকিয়েচুরিয়ে শুরু হলো আমার নভেল পড়া। [নিজের ইঁচড়ে পাকামি মনে হলে নিজেই বিস্মিত হই, সেইসংগে কিছুটা লজ্জিতও]। নভেল পড়ার জন্য আমি এক অভিনব কায়দা বের করলাম— পাঠ্য বইয়ের উপরে নভেল বিছিয়ে রেখে পড়া। কেউ দেখে ফেললে বইটা উলটে দিলেই পাঠ্য বইয়ের নাম ভেসে উঠতো। আর দেখে ফেলার পর সে চলে গেলে আরামসে ফের নভেলটা পড়া যেত। অবশ্য আমার এই চুরিবিদ্যায় আউটবই পড়া আব্বার কাছে গোপন রাখা যায় নাই। আব্বা ঠিকই দেখে ফেলতো আর রাগের জ্বালায় ছিঁড়ে ফেলতো সেসব বই। কিংবা উঠানে ছুঁড়ে ফেলতো। আব্বা গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে এই কাজগুলি করতো সে। আর আমার বইপড়া তখন চাঙ্গে উঠতো। বইগুলি ছিঁড়ে ফাতরাফাতরা হওয়ার দুঃখে আমি রাতভর কাঁদতাম। কিন্তু আব্বা ছিল নির্বিকার। বই ছিঁড়ে ফেলার জন্য আব্বার কোনো অনুশোচনা আমি দেখি নাই। আব্বা অত্যধিক রেগে গেলে আমার ইশকুলের বই-খাতাও ছুঁড়ে ফেলে দিত। আর রাগে অন্ধ হয়ে বলতো— কালকে থেকে তোর ইশকুলে যাওয়া বন্ধ! আর তুই ইশকুলে যাবি না…!
আমি সব মানতে পারতাম, কিন্তু ইশকুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে, কিছুতেই এটা মানতে পারতাম না। কারণ ইশকুলই ছিল আমার মুক্তির জায়গা। আমার সমস্ত আনন্দের- আকর! বাসার দমবদ্ধকর পরিবেশ থেকে ইশকুল-ই ছিল আমার উদ্ধার! ফলত আমার সহপাঠীদের লোভনীয় সাহচর্য্যের জন্য আমি মুখিয়ে থাকতাম!
পাপড়ি রহমান
নব্বই দশকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন কথাশিল্পী। এ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। কথাসাহিত্যে কাজের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনাও। বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা গ্রন্থ ‘ ভাষা শহিদ আবুল বরকত’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর ভিন্নধারার উপন্যাসগুলি প্রকাশ মাত্রই বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) প্রকাশিত হয় মাওলা ব্রাদার্স থেকে। পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আট বছর বিরতির পর বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ (২০১৯)
২০২০ সালে উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ রি-প্রিন্ট হয় কলকাতার বনেদী প্রকাশনা সংস্থা ‘অভিযান’ থেকে।
তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন ২০১০ সালে। কলকাতার ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘সাদ’ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।