ছোটকার জেলবাস
একদিন ভোরবেলায় উঠে দেখি আম্মা অঝোরে কাঁদছে। অতিরিক্ত কান্নার ফলে আমার অতিরিক্ত গৌরবর্ণা আম্মার নাকমুখ একেবারে রক্তজবা ফুলের মতো টুকটুকে লাল হয়ে উঠেছে। আব্বারও চোখ দুটো ফুলে ঢোল— অনুমিত হয়, বিস্তর-কান্নাকাটির পরে আব্বা সদ্য কিছুটা হয়তো ধাতস্থ হয়েছে। আমাদের সমস্ত বাসা রাতভর টর্নেডো বয়ে যাবার মতো করে লণ্ডভণ্ড। প্রতিটা রুমের বিছানা-বালিশ উলটপালট করে রাখা। আম্মার কারণে আমাদের ছোট্ট বাসাটা এমনিতেই খুব গোছানো আর পরিস্কার-পরিছন্ন থাকত। সদ্য ঘুম-ভাঙা-চোখে বাসার এইরকম হাল হওয়ার রহস্য কী বা কেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না! কিন্তু ছোটকাকে কোথাও দেখছিলাম না। ছোটকার রুমের বিছানাপত্র সব উলটে রাখা। টেবিলের বইপত্র ছড়ানো। এমনকী ছোটকার তোরঙ্গখানির পাল্লাও হাট করে খোলা। সবই আছে শুধু ছোটকা নাই। ছোটকাকে কোথাও দেখছি না! আব্বা-আম্মার মুড দেখে আমাদের কথা বলার মতো সাহস নাই। ছোটকা কই তা-ও জিজ্ঞেস করা যাচ্ছে না। আমরা ভাই-বোন পড়ে গিয়েছি মহাফ্যাসাদে। গতরাতেই যে আমাদের পড়া দেখিয়ে দিল, এই সকালের মাঝেই সে গেল কই?
আমাদের সে ‘ছোটকা’ হলেও তার বয়স ষোল-সতেরর বেশি নয় কিছুতেই। আর আমাদেরই বা বয়স কত? প্রদীপের চার কি পাঁচ আর আমার নয় বা দশ চলছে। ছোটকা পড়ে নবম বা দশম শ্রেণিতে। কিন্তু বয়স কম হলেও সে সম্পর্কে চাচা বলে তার শাসন আমাদের মেনে চলতে হতো। ছোটকাও তখন কিশোর। আমি ভয়ে ভয়ে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম—
আম্মা ছোটকাকা কই?
এই প্রশ্নে আম্মা একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। আমি বিব্রত মুখে অদূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আম্মা ঝাপসা গলায় বলল—
মিন্টু রে তো গতরাতে ধইরা নিয়া গেসে!
‘ধইরা নিয়া গেসে’ মানে কী?
আম্মার কান্নাকাটি কিছুটা থামলে যা বলল, তা শুনে আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
গতরাতে আমাদের বাসায় পুলিশ রেইড হয়। এবং পুলিশ এসে এই টর্নেডো ঘটিয়ে গিয়েছে। ছোটকার বিছানা-বালিশ-বইপত্র ঘেঁটে কিছুই পাওয়া যায় নাই। যা পাওয়া গিয়েছে তা একখানি ছোট্ট পুস্তিকা, যাকে কিনা লিফলেটেও বলা চলে। ওই লিফলেটটা নাকি কোন এক রাজনৈতিক দলের!
আমাদের বাসায় আব্বার কড়া-শাসনের খাঁচার মাঝে ছোটকার রাজনীতি করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার! তাছাড়া ছোটকা একদমই বাসার বাইরে বের হয় না। আড্ডাবাজির প্রশ্নই আসে না। আমাদের মতোই তাকে সান্ধ্য-আইনের আওতায় থাকতে হয়। ইশকুল থেকে ফিরে ভাত খেয়ে বই খুলে বসতে হয়। প্রাইভেট পড়া থাকলে নিয়ম করে পড়তে গিয়ে সময় মতো বাসায় ফিরে আসতে হয়। বড় হওয়ার পরে আমি অনুমান করেছিলাম, কলোনীর কেউ হয়তো তাকে ওই ছোট্ট পুস্তিকাখানি পড়তে দিয়েছিল। আব্বার ভয়ে ছোটকা তা তোরঙ্গ-বন্দী করেই রেখেছিল। সিলেটে আগমন করার মাত্র বছরখানেকের মাথায় ছোটকার তেমন কারো সঙ্গেই নিবিড়-বন্ধুত্ব গড়ে উঠবার কথা নয়! কোনো নওলকিশোর হয়তো পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে ভয়-ডরে ছোটকার নাম বলে তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল।
পুলিশ ছোটকাকে মানে একজন নির্দোষ-কিশোরকে রাজবন্দী হিসেবে ধরে নিয়ে গিয়েছে— আব্বার পক্ষে এটা মানা দূরে থাকুক, চিন্তাতে আনাও অসম্ভব ছিল। কারণ আব্বা তার ভাইবোনদের অত্যধিক ভালোবাসত, অনেক সময় সে ভালবাসা তার নিজের সন্তানদের চাইতেও বেশিই ছিল।
আব্বা একেবারে মুষড়ে পড়ল! বরাবরই আব্বা ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী ও প্রখর বুদ্ধিমান। যে কোনো সিদ্ধান্তে মাথা ঠাণ্ডা রাখার মানুষ! আর ছিল করিৎকর্মা। কিন্তু আমার বুদ্ধিমান আব্বা ছোটকার বেলের বন্দবস্ত করাতে ব্যর্থ হলো। এইধরনের রাজবন্দীদের তখন জামিন দেয়া হবে না। তবে আমার বুদ্ধিমান আব্বা ঠিকই ছোটকাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতির জন্য জেলারকে অ্যাপ্লিকেশন করে ফেলল! আমার স্পষ্ট মনে আছে, ফুলস্কেপ কাগজের উপর অপূর্ব সুন্দর হস্তাক্ষরে আব্বার গড়গড়িয়ে ইংরেজিতে অ্যাপ্লিকেশন লিখে যাওয়া। ফলত ছোটকাকে দেখতে যাওয়ার দিন-তারিখও স্থির হয়ে গেল। আম্মা পোলাও-কোর্মা-কাবাব-সেমাই-পায়েস রান্না করে টিফিন-ক্যারিয়ার ভরতি করে চোখের জল আঁচলে মুছতে মুছতে চলল ছোটকাকে দেখতে!
ওই প্রথম আমাদের পরিবারের সদস্যদের জেলখানার ভেতরে যাওয়া! আমাদের একটা ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রেখে এক কনস্টেবল গেল ছোটকাকে ডাকতে। খানিক বাদে ছোটকা এসে একটা ফুলবাগানের ধার ঘেঁসে দাঁড়াল। তখন আমাদের ডাক পড়ল ছোটকার সংগে দেখা করার। আমার অত্যন্ত আবেগপ্রবণ আব্বাকে দেখলাম বাম হাতের তালুতে চোখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করেছে। আম্মা তো স্কুটারে যেতে যেতেই কাঁদছিল । দেখার করার নির্ধারিত সময় পার হলে আমরা জেলগেট দিয়ে বের হয়ে এলাম।
আব্বা অত্যন্ত কঠিন একটা সময়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছিল। আচানক দেশে তখন দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। লবণের সের ষাটটাকা। একটা ৫৭০সাবানের মূল্য দশটাকা। আর চাউলের মণ চারশ’ টাকা। ছোটকাকে বাইরে থেকে কোনোকিছুই পাঠানোর অনুমতি ছিলনা। আব্বা তবুও কীভাবে যেন কাকে কাকে বলেকয়ে ছোটকার জন্য দুইটা ৫৭০ সাবান পাঠিয়ে দিত। মাত্র দুইটা সাবান পাঠানোর জন্য একশ’ টাকার একটা নোট তাদের হাতে গুঁজে দিতে হতো। পরার জন্য লুঙ্গি-শার্টও পাঠিয়ে দিত। কিন্তু যা কিছুই যাকে দিয়েই ছোটকাকে পাঠানো হতো, সেজন্য আব্বাকে বাড়তি টাকা দিতেই হতো। তার মানে ব্রাইবিং এর ব্যাপারটা আগাগোড়াই ছিল এই বঙ্গদেশে। প্রতিমাসে শুধু একবার আমরা ছোটকাকে দেখার জন্য অনুমতি পেতাম।
একদিন হঠাৎ আব্বার কাছে খবর এল যে ছোটকাকে রাতের সুরমা মেইল ট্রেনে করে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে। ছোটকা এ্যারেস্ট হওয়ার পরপরই আব্বা দিদিকে সিলেটে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু নানান হ্যাপার জন্য দিদিকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয় নাই। এইবার একটা সুযোগ পাওয়া গেল— কোনো বাহনে না চেপেও দিদি ছোটকাকে দেখে আসতে পারবে।
মাগরিবের আজান হতে না হতেই আমাদের মাঝে সামান্য উত্তেজনা— আজ ছোটকার সাথে আমাদের দেখা হবে। নামাজ অন্তে দিদিও প্রস্তুত। দিদির পরনে অত্যন্ত মিহি-জমিনের কালো-সরু পাড়ের ধূতি। গায়ে শাদা ভয়েল কাপড়ের ব্লাউজ। আর পায়ে বাটা কোম্পানীর লেদারের চটি স্যাণ্ডেল। দিদি শাড়ি পরেছে এক-প্যাঁচ দিয়ে। শাড়ির আঁচল ঘুরিয়ে মাথার ঘোমটা হয়েছে। দিদি কখনই কুচি দিয়ে [ আম্মা-চাচিমারা শাড়ি পরত সামনে কুচি দিয়ে, এভাবে শাড়ি পরার কায়দাকে আম্মা বলত ‘ড্রেস দিয়ে শাড়ি পরা’] শাড়ি পরত না।
আমাদের বাসার সবাই দল বেঁধে চললাম ছোটকাকে দেখতে। রেলস্টশনে গিয়ে দেখি ছোটকাকে ইতোমধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। এনে তাকে ফার্স্টক্লাস ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে। হাতে হ্যাণ্ডকাফ লাগানো। হ্যাণ্ডকাফের সাথে বাধা দড়ি ধরে বসে আছে এক কনস্টেবল।
ছোটকাকে দেখলাম সামান্য ওজন বেড়েছে তার। ওয়েটিং রুমের উজ্জ্বল আলোতে তার ফর্সা মুখমণ্ডল জ্বলজ্বল করছে। ছোটকাকে দেখাচ্ছে অপরিচিত কোনো রাজকুমারের মতো, যে কীনা সদ্যই তার তেজী ঘোড়া থেকে অবতরণ করেছে! যে রাজকুমারকে আমরা এর আগে কোনোদিন দেখি নাই। চিনি নাই। যেন এই অচেনা কিশোর কোনোদিন আমাদের মাঝে ছিল না!
ছোটকাকে দেখেটেখে আমরা বাসা-মুখো হচ্ছি— দিদি হঠাৎ রেললাইনের স্লিপারের ঠিক মাঝখানে বসে পড়ল। আমরা ভাবলাম পায়ে কোনো ব্যথাট্যাথা পেল কি না? না, দিদি বসে পড়ে তৎক্ষণাতই ফের উঠে দাঁড়ালো। আমরা তখন দেখলাম দিদির হাতে কয়েকটা ছোট ছোট পাথর। আমাদের অবাক করে দিয়ে দিদি সেসব চারদিকে ছুঁড়তে শুরু করল। আমরা বাচ্চারা প্রথমে ফান ভেবে জোরে হেসে উঠলাম। কিন্তু আব্বা আমাদের ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল।
বাসায় চলে আসার পর দিদি ক্রমাগত প্রলাপ বকতে শুরু করল—
মিন্টুরে সোনার চূড়ি কে পিন্দাইছে? দেখছস আমার রাজপুত্তররে ক্যামন লাগতেছে দেখতে? আমার রাজপুত্তররে ওরা কই নিয়া গেল গা?
দিদির প্রলাপ-বকা আর কিছুতেই থামে না। আম্মা জবাকুসুমতেল সামান্য জলে ফেটে নিয়ে দিদির মাথায় মালিশ করে দিলো, কিন্তু দিদি নির্বিকার। সে কাউকেই চিনতে পারছে না। ফলত সে অনর্গল প্রলাপ বকেই যাচ্ছিল।
ছোটকাকে হ্যাণ্ডকাফ পরা অবস্থায় পুলিশ পাহারায় দেখে দিদির সরল ও কোমল মন যে অত্যন্ত আহত হয়েছে, আমরা তা বুঝতে পারছিলাম। ছোটকা ছিল দিদির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান।
প্রলাপ বকে বকে দিদি আমাদের সারারাত জাগিয়ে রাখল। আব্বাকে দেখলাম ঘন ঘন চোখ মুছে চলেছে। আর আম্মার শাড়ির আঁচল আম্মার চোখের উপরই শক্ত করে ধরা রইল। ভোর ফুটলে আব্বা ডিসপ্যানসারিতে গিয়ে ডাক্তারকে বলে ওষুধ নিয়ে এল। ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে… এই গান গাইতে গাইতে দিদি ঘুমিয়ে পড়ল। আব্বা আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলল—
ঘুমের ওষুধ দিয়ে মা কে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। পোলাপান তুমরা কিন্তু একদম শব্দ করবে না!
পাপড়ি রহমান
নব্বই দশকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন কথাশিল্পী। এ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। কথাসাহিত্যে কাজের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনাও। বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা গ্রন্থ ‘ ভাষা শহিদ আবুল বরকত’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর ভিন্নধারার উপন্যাসগুলি প্রকাশ মাত্রই বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) প্রকাশিত হয় মাওলা ব্রাদার্স থেকে। পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আট বছর বিরতির পর বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ (২০১৯)
২০২০ সালে উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ রি-প্রিন্ট হয় কলকাতার বনেদী প্রকাশনা সংস্থা ‘অভিযান’ থেকে।
তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন ২০১০ সালে। কলকাতার ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘সাদ’ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।