আনোয়ার শাহাদাত
ভূমিকা
বাপ-চাচাদের দেখেছি, বরিশাল-গামী বরগুনার লঞ্চ ঝালকাঠি ছাড়বার পর জামা, পাজামা বা শার্ট পরবার জন্য বিচলিত হয়ে উঠেছেন। লঞ্চ দপদপিয়া কীর্তনখোলার নদীর মোড় ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে কি পরে পোশাকে জেলা শহর উপযোগী পরিবর্তন আনা হতো। গ্রাম হতে বয়ে আনা পরিধানের লুঙি কাপড়খানা বদলে নিতেন। তখন কারো বুঝবার সাধ্য থাকবে না যে এদের পায়ে এইতো, এখনো বিল ভেঙ্গে আসা কাদার কিছুটা শুকিয়ে থেকে থাকতে পারে। আমিও ওদেরই একজন। ‘লুঙ্গি-কৌশল’ কি গামছা নিগ্রায়ে বিল, খাল, সাঁকো পেরিয়ে আসা। সে পায়ে-হেঁটে কি নৌকায় নদী ঘাটে এলে পা ধুয়ে লঞ্চে উঠে বরিশাল সদর হয়ে আবার দোতালা লঞ্চে ঢাকা’র সদরঘাটে নামলে সারে দশ সাইজের লম্বা পা’দুখানিতে আমাদের গ্রামের বিলের কাদা ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়না। মুই বলে কথা, সেই লোক আমি, কথিত ‘খ্যাতি’র কুমত-লোভে (সেই ধারনাটাই ভুল হয় বলে বোধ করি) শাহাবাগে গেলে ‘শহর্সাহিত্যরসৃষ্ট’ ঢেলা নাকেরা শুনেছি বিলের কাদা ইতিহাসে যতটা সর্বাআগ্রহী তার চেয়ে কম সাহিত্যে! এ গল্পটায়ও উপর্যপুরি বেশুমার কাদা আছে, বরিশালের দক্ষিণের বিলের কাদা। সে সবই ‘কর্দমাক্ত’ (নগর লেখকের উপমায় নয়) জনপদের উপাদেয় হয়তো একধরনের ফেরী করতে চাওয়া, অনেকটা নতুন পিদিম, পুরনো বদলায়ে ধরনের! এর আগে ছাপাও হয়েছে। লেখালেখি সমকালীন বিরতি বিধেয় এই অস্ত্রোপচার পদ্ধতি অনুসরণ পূর্বক একটি ব্যবস্থা! গল্পটি লিখবার সময় মাথায় ছিল না চলচ্চিত্রায়ন হতে পারে কোনোদিন। যদিও আমি ফিকশনের প্রতিটি শব্দ লিখবার সময় ভিজুয়ালি দেখতে পাই (ফ্রাঁন্সোয়া ট্রুফো সূত্রে সেটাই চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধানতম ভূমি)। যদিও ব্যক্তিগত মতে- অধিকাংশ চলচ্চিত্রকাররা লেখকদের কাছে পরধন-পোদ্দারি ক্ষেত্রে বড় অসহায়, ব্যতিক্রম বাদে (জাজমেন্টাল নই, বিস্তারিত আলোচনা আছে)। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই চলচ্চিত্রকার আবার আমি নিজেই, ‘নিজের বিরুদ্ধে!’ কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের পরামর্শে ছবির নামকরণ হয়েছে ‘কারিগর’ (ইংরেজি নাম- The Circum ciser), এতে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন – জয়ন্ত চ্যাটার্জী, রোকেয়া প্রাচী, সুষমা সরকার, রানি সরকার প্রমুখ। আর এর স্ক্রিপ্ট, সিনেম্যাটোগ্রাফি, এডিটিং, মিউজিকের অধিকাংশ সহ অনেক কিছু এবং ‘পরিচালনা’ সে আমারই। আমার প্রডিউসার জানিয়েছেন, ডিসেম্বরে ঢাকায় ছবিটির শো’ এর জন্য রেডি, সম্ভাবনা হচ্ছে তখন দেখা যাবে ওই অন্তর্গত বাকেরগঞ্জ, পাদ্রি-শিবপুর, রঘুনাথ গ্রামের লোকটি আমি পায়ে কাদা নিয়ে দাঁড়ায়ে এক ফেরিওয়ালা। দুর্মুখেদের মতে তার কিছু কাদা হয়তো ছড়াতে চাওয়া হবে আজিজ’এর চারধারে; এই দুরাশায় যে উচ্ছিষ্ট রূপে পরে থাকা খুব সামান্য খ্যাতি যদি জোটে কপালে! –আ.শা.
__________________
সত্তুর বছরের শিক্ষিত নয় এমন বুড়োর সঙ্গে দেখা করতে যেতে পঁচিশ বছরের উচ্চ শিক্ষিত নূপুরের কেন যে প্রেমিকার সাজ সাজতে ইচ্ছে হলো তা সে জানে না। যেমন মানুষ অনেক কিছুই জানে না যে কেন সে যাবতীয় সব কিছু করে থাকে। আজ সে বড় যত্ন করে সেজেছে, যেন সে সত্যি প্রেমিকা, তা প্রকৃতপক্ষে কেউ প্রেমিক পরিচয়ে থাকুক আর নাই থাকুক। তিনটে বনফুল গুঁজেছে মাথায়। কানের নিচের দিকে পেছনে, গলার দুদিকে, বুকের উপরের অংশে গলার ঠিক নিচে, এমনকি একটু চুলেও আলতো করে মেখেছে জুঁই সুগন্ধি। পায়ের পাতায় আলতা মেখেছে, আঙ্গুল দিয়ে দুটো লাইন এঁকেছে দু’পায়ের সবটা ঘুরিয়ে, পা-পাতা মধ্যখানটায় বাঙালি তরুণীর কপালের টিপ সমান দু’পায়ে দুটো ফোটা এঁকেছে। ঢাকা থেকে আসার সময় আনা নতুন সালোয়ার কামিজটি পরেছে।
এই গ্রামের পথে বের হবার আগে আরও একবার দু’পায়ের উপরে বসেছে, দু’হাত বদলিয়ে দু’পায়ে হাত বুলি
য়েছে, অর্থাৎ নিজের আলতা মাখা পায়ে নিজেই আদর করেছে। তারপরই বেরিয়ে পথের ধারের ঝোপের ফুল তুলে মাথায় গুঁজেছে। পায়ে স্যান্ডেল পরেনি, কেন পায়ে স্যান্ডেল পরেনি তাও সে জানে না যেমন সে জানে না কেন বুড়ো মোতালেব কারিগরের সঙ্গে কথা বলতে যেতে প্রেমিকার সাজ সাজলো। হয়তো আলতা মাখা পায়ে স্যান্ডেল বেমানান মনে করেই পরলো না। কাঁচা মাটির পথে হাঁটতে তার প্রথমে অদ্ভুত অনুভূতি হয়, সে অনুভূতি কিসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে তাও সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। পায়ে মাটির ছোয়াই যেন প্রেমিকের ভালবাসাময় হাতের স্পর্শ। নূপুর মনে করতে পারে না কবে সে খালি পায়ে হেঁটেছে নগ্ন মাটির উপর। প্রথম ক’কদম খুবই অস্বস্তি লাগে, এক অন্তর্নিহিত অজ্ঞাত লজ্জার মতো, কোথাও সে বোধটুকুও হয় যেন-বা স্ব-সমর্পণ।
সেই-এই প্রেমিকার সাজ আর প্রেমানুভুতিপূর্ণ ওয়াসিমা পারভিন নূপুর মোতালেব কারিগরের বাড়িতে ঢোকে। মোতালেব কারিগর তার ঘরের বর্ধিত নাড়ায় ছাওয়া খোলা বারান্দায় জলচৌকির উপর ধূসর বাদামি রঙের জামা গায়ে বসা। বয়স ও সময় অতিক্রান্তের ছাপ তার মাথার পাতলা চুল যা ছুপছুপ করা তেলে ডোবা, মাথার চারদিক গড়িয়ে সেই তেল নামছে ধীরে গাছের কষের গতিতে। নূপুর এর আগেও কয়েকবার মোতালেব কারিগরের কাছে গেছে, কখনো এমন পরিপাটি বুড়োকে সে দেখেনি, বরং ভীষণ মলিন, অযত্নে পড়ে থাকা বুড়োদের মতই। মোতালেব বুড়ো অপেক্ষা করছিল নূপুরের জন্যে। বুড়োর বাড়িতে ঢুকতে ছোট খালের উপর এক কাফিলা গাছের সাঁকো পার হতে তার কষ্ট হয়, দু’তিনবার পার হতে গিয়েও পারেনা। এপার থেকে বুড়ো কারিগরকে ডাকে, ও কারিগর হাতটা ধরেন পার হতে পারছি না। কারিগর উঠে এসে হাত ধরে, নূপুর বুড়োর হাত ধরে সাঁকো পার হয়।
নূপুরকে পার করাবার পর বুড়ো আবার তার জলচৌকিতে ফিরে যায়। বিমর্ষ বসে থাকে চৌকির উপর, নূপুর বোঝে তার হাত ধরে পার করাবার পর বুড়োর অতীত-পীড়ন হয়েছে। নূপুরই জিজ্ঞেস করে কই কারিগর আমার হাত ধরে সাঁকো পার করানোর পর কী বিবি সাহেবের কথা মনে পড়েছে ? একে শিক্ষিত লোকজনরা বলে থাকে নস্টালজিয়া। ততক্ষণে বুড়ো চোখ ডলে বলে জে হা বোন সাব তিনি কইতেন ও কারিগর মোর সাঁকো পার করাবার লাইগ্যা তোমার মরণ নাই। বুড়ো মোতালেব কারিগর এবারে মাথা নিচে দেয়, মনে করা যেতে পারে বুড়ো হয়তো কাঁদছে আবার নাও হতে পারে। নূপুর আগে কখনো কোন বর্ষীয়ান লোককে কাঁদতে দেখেনি, সে বিব্রত বোধ করে। মোতালেব কারিগর ডান হাতে মুখ ঢাকে আর বাম হাতে জলচৌকি ধরে। নূপুর কাছে গিয়ে বুড়োর হাত ধরে, তার ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে বুড়োর চোখ মুছে আবার হাত ধরে, হাতে হাত বুলায়, বলে, কারিগর মনে করেন আপনার বিবি সাহেব ফিরে এসেছেন এবং আপনি তার হাত ধরে সাঁকো পার করালেন। নূপুর একথা বলে মুখ টিপে সেরকম হাসে যেরকম হাসিকে পুরুষ দার্শনিকদের কাছে হাজার বছর ধরে মনে হয়েছে ‘নারীর রহস্যময় হাসি’। বুড়ো তার উত্তরেই যেন ওয়াসিমা পারভিন নূপুরের কথায় মুচকি হাসে ভ্রূ কষিয়ে সদ্য চোখ ফোটা আহ্লাদি কুকুরছানার মতো। সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, যেন সত্যি তার বিবি সাহেব ফিরে এসে এমন করে হাত ধরে সাঁকো পার করাতেন, এমন করে কাঁদতেন, এমন করে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। কী মনে করে কেন তা জানার উপায় থাকে না কিন্তু সে রকম কাজ এ সময় নূপুর করে, বারান্দা ছেড়ে উঠানে নামে, পাজামা উপরে পায়ের নলা পর্যন্ত তুলে পা নাচের তাল-মুদ্রার মতো করে। বুড়ো কারিগর নূপুরের আলতা-মাখা পায়ের তাল দেখতে থাকে, নূপুর এবারে উঠান ঘুরে বাউল নাচের মতো পা এবং হাত খুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গ্রামীণ নাচ নাচতে থাকে এবং আব্দুল আলীমের গাওয়া গান গায়-
ওরে যৌবনও জোয়ারের পানি
গেলে আর তো ফেরে না
হারে ননদী, ও ননদী
আমার প্রেম-যমুনায় বইছে উজান
প্রেম-যমুনায় বইছে উজান
আমার প্রাণে ধৈর্য মানে না,
বন্ধু এলো না,
ও বনের ননদ লো
ও সাধের ননদ লো
আমার মনের কথা কই লা
যৌবন ফুরাইয়া গেল বন্ধু এলো না
নূপুর এই গানটার সবটাই গায় এবং সারা উঠান ঘুরে গানটির সঙ্গে নাচে।
নাচের শেষে নূপুর উপলব্ধি করে সে এসব স্বাভাবিক আচরণ করছে না, সকাল থেকে তার কী হয়েছে ? মোতালেব কারিগরের সঙ্গে তার কথা বলা তার চাকরিরই অংশ। গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পেরই এটি নতুন শাখা প্রকল্প, তার অংশ হিসাবে মোতালেব কারিগরের সঙ্গে কথা বলে একটি বিস্তারিত স্পর্শকাতর প্রতিবেদন লিখে ঢাকা হেড অফিসে পাঠাতে হবে। তাদের এনজিওর প্রধান নির্বাহী সরাসরি নিজে এ প্রকল্পের দেখাশুনা করছে। এই এলাকায় এ প্রকল্পে এর আগে আর একটি ছেলে কাজ করেছে, সেই ছেলেটিই নূপুরকে বলে গেছে মোতালেব কারিগরের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলতে পারলে ভাল, একটা সত্য নির্ভর স্পর্শকাতর প্রতিবেদন লেখা যেতে পারে। সে একাধিক বার কারিগরের সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করেছে কিন্তু কারিগর আগাগোড়া তার ছেলেবেলার পর্ব থেকে গল্প শুরু করে এবং পর্যায়ক্রমে সে গল্প তার ব্যক্তিগত অতীত গল্পের ঘোরে পরিণত করায়, পরিশেষে গিয়ে দাঁড়ায় যে, বুড়ো কারিগরের কথাবার্তা তাদের প্রকল্পের মূল গাইড লাইনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। অতএব হতাশ হতে হয়।
‘নির্ধারিত ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা এবং ওই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবদান বর্ণনা’ই হচ্ছে প্রকল্পের মূল গাইড লাইন। সুতরাং মোতালেব কারিগরের সংশ্লিষ্টতা ও অবদানের প্রসঙ্গে কারিগর এক ধরনের অসম্পর্কিত কথাবার্তা বলে, প্রকল্পের আগের ছেলেটির অভিমত কারিগর সম্পর্কে এ রকমেরই। ছেলেটি নূপুরকে এও বলে তাছাড়া মোতালেব কারিগর আরো আশা করে এই সাক্ষাতকারের মাধ্যমে তার কোনো লাভ হবে কিনা, সে কোনো রিলিফ সামগ্রী পাবে কিনা, সরকারি কোনো সুবিধাদিও তার হবে কিনা, মরচে পড়ে ক্ষয়ে যাওয়া যা কিনা পেশাবে ক্ষয়ে যাওয়ার মতো দেখতে, সেই ঘরের চালের টিনের পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা, ইত্যাদি সব।
ওয়াসিমা পারভিন নূপুর কেবল সমাজবিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছে। ভবিষ্যতে তার আরো পড়বার ইচ্ছা, এমফিল, পিএইচডি সবই তো আশা, যেমন ভয়জা রদ্দি মার্কা ছাত্ররাও সব সময় বলে থাকে ‘তাহারও পিএইচডি করিবার রহিয়াছে ইচ্ছা’ জাতীয় কথা-বার্তা, যদি সম্ভব হয়। ‘জনসেবায়’ বা ‘দেশসেবায়’ ব্রতী হয়ে ভাঁওতাবাজির মতো করে নয়, নিজের প্রয়োজনে এই চাকরি নিয়েছে। চাকরি নেয়ার আগে স্বাক্ষর করতে হয়েছে এই মর্মে যে, বাংলাদেশের যে কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে কোনো ধরনের এসাইনমেন্টের জন্য প্রার্থী যেতে ও কাজ করতে প্রস্তুত কিনা। অতঃপর বরিশালের দক্ষিণে বাকেরগঞ্জের পাদ্রি শিবপুরের শ্রীমন্ত গাঙ সংলগ্ন ঝাউবন গ্রামের প্রকল্প অফিসে তার পোস্টিং হয়। ওয়াসিমা পারভিন নূপুরের ধারণা এই প্রকল্পের এই প্রতিবেদন ঠিকমত শেষ করতে পারলে তার বিশেষ লাভ হবে কেননা প্রকল্পটিতে সরাসরি প্রধান নির্বাহীর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে । ঠিকমত কাজটি করতে পারলে প্রধান নির্বাহী তাকে সরাসরি চিনবে এবং কোনো এক সুযোগে প্রধানকে অনুরোধ করতে পারবে তাকে কখনো ঢাকা হেড অফিসে পোস্টিং দিতে যাতে পাশাপাশি তার উচ্চশিক্ষা ও জীবনের যাবতীয় ধান্ধাবাজির সুযোগটি ঘটে। অতএব চাকরির শর্ত স্বাক্ষরের সময় প্রার্থীর দাসখত ধরনের সম্মতিমূলক স্বাক্ষরের সময় মাথায় একটা প্রতিবাদী চিন্তা এলেও তা প্রকাশ করার সুযোগ ছিল না ধান্ধাবাজির প্রাথমিক অংশ হিসেবে। স্বাক্ষরের সময় তার একবার মনে হয়েছিল গিয়ে জিজ্ঞেস করে কর্তৃপক্ষকে, এ কেমন কথা, যেকোনো এসাইনমেন্ট করতে বাধ্য থাকতে হবে? তবে যদি আপনারা কাল তিরিশ টনি ট্রাক ড্রাইভার ডেকে এনে বলেন এই পুরুষ প্রাণীটির সঙ্গে মহিলা হিসাবে শু’তে হবে, তাও কী করতে হবে ? নূপুরের এও মনে হয় ও কথা বলবার পর কর্তৃপক্ষের মানুষটি যদি হারামি গোছের হয় তাহলে সে যদি আবার তার উত্তরে ফিরিয়ে বলে যে তিরিশ টনি ট্রাক ড্রাইভার না হয়ে অন্য কিসিমের চিজ বা খইদ্দার হলে কী শোবেন নিকি? নূপুর এর কিছুই বলেনি, সবই তার কল্পনা, চাকরিটি তার দরকার।
নূপুর মনে মনে স্থির করে কারিগর যে ভাবেই বলুক, যাই বলুক সে সবই শুনবে সবই নোট নেবে। অতএব মোতালেব কারিগরের বর্ণনা মতোই তাকে সব কাহিনী শুনতে হয়। যা বলে তা খণ্ড খণ্ড এরকম
যদি রোদ থাকে, সকালের রোদ, কি বিকেলের, সে রোদ হাঁটা-পথিকের ডুবা তেল দেয়া মাথায় ঝলকে ঝলকায়। মাথা ছুপছুপ করা তেল, খাঁটি, ভেজালহীন সরিষার তেল, মাথার জন্যই সে তেল কেনা হয় চুল ও মাথা ঠাণ্ডা রাখা ধরনের আশা প্রধান, যদিও মাথার পাতলা চুল ভিজে ডুবে যায় সেই তেলে। তখন সোনালী রঙের সরিষার তেল চামড়া-আবৃত স্কাল গড়িয়ে ঘাড়ে নামে, এক লাইনের রসালো তরল ফোঁটা গড়ানোর ধারার মতো। প্রধানত দু’কানের ধার দিয়ে গালের দিকে। খুব ধীরে ওই তেল গড়ানো অনুভব করলেও মোছা হয় না সে পথিকের, এ যেন-বা সে তেল না মোছাই তার পারিবারিক পেশাগত বংশপরম্পরার ঐতিহ্য। এ সময় পরনের পুরনো পাঞ্জাবির যা কিনা পিরান নামে পরিচিত তার গলার প্রান্ত রক্ষার জন্যে ঘাড়ের উপর বিছানো হয় একটি ডুমা বা রুমাল। অতএব পিরানের গলার-ধার তেলে না ভিজে কি চটচটে না হয়ে কম ক্ষয় হয়। নিজ ঝাড়ের বেত থেকে বানানো বেতের লাঠিখানা হাতে পেন্ডুলামি ছন্দে সামনা-সামনিই দোলে, বগলে কারিগরি বাক্স। কারিগরের মনে উৎসব-উৎসব ভাব, পৌষ-মাঘের শীতে কাঁধ বদলায় যথাসম্ভব তার সামর্থ্য মতো সুন্দর চাদর। যদিও সেই কাপড় খানার ‘চাদর’ সম্বোধন পেতে যে গুণাবলি থাকা দরকার তা ওর থাকে না। ফলে তার চাদর নামকরণ হয়না, তার নাম ‘গায়ের-কাপড়’, কিন্তু কারিগর তার সেই গায়ের কাপড় চাদর মর্যাদায়ই হাঁটতে পথে এ-কাঁধ ও-কাঁধ বদলায়, যেমন শুনেছে কৈশোর কালে তাদের জমিদার শশী বাবু বদলাতেন।
এই যে-ওই যে, তার ‘ইতিহাসের’ মত হেঁটে যাওয়ার মধ্যেই যে কারিগরের সুখ-সুখ লাগা মনে হয় তার জীবনে আর তেমন, তেমন আর কিই-বা থাকতে পারে সুখের ও গর্বের কারিগর মর্যাদায় এই হাঁটতে যাওয়ার চেয়ে। (নূপুর কারিগরের এই ‘ইতিহাসের মতো হেঁটে যাওয়ার’ উপমাটিতে ভাব প্রকাশে ঠিক কি অভিঘাত সৃষ্টি করে বা কারিগর ঠিক কি বোঝাতে চায় তা বুঝে উঠতে পারে না কখনোই) গায়ের গিরাস্ত, ঝি-বউ, কী জোয়ান মরদ ক’মুহূর্তের জন্য কাজ থামিয়ে ডেকে জিজ্ঞেস করে, ও কারিগর আইজগোর কোন গায়ের দিক রওয়ানা, কাম কাইজ কেমন পরচে এই বচ্ছর, কতগুলা কাম এই যোবায়, কারিগর এ সব কথা শুনতে অভ্যস্ত, সে তার হাঁটার গতি ধীরে থেকে ধীরে করে এবং তারপর থামে, শারীরিক কারণে নয় সুখের অংশ হিসেবে কারিগর হাতের লাঠিখানায় ভর দিয়ে গা-ছাড়া আলস্য ভঙ্গীতে দাঁড়ায়, বগলের বাক্সখানি নামায়, চাদরখানি আর একবার অবশ্যকরণীয় ভঙ্গীতে কাঁধ বদলায়, বলে, কাম পেরতেক বচ্ছরের মতোই। তয় দেনা পাওনাডা অইলো যাইয়া তোমার নির্ভর করে ধান ফলনের উফর,’ কথাটা বলবার পরে সে তার দৃষ্টি আকাশের দিকে কোথাও ঝাপসা করে দেয়। কার্তিকের শেষে ভাল ফলিত ধানের ভারে নুয়ে পড়া ফসল সে আকাশের মধ্যে দেখছে।
হয়তো গিরাস্তও তখন প্রতিশ্রুতি করে কারিগরকে, ও কারিগর মোগেরও কাম আচে আল্লায় চাইলে ফিরতি বচ্ছর সামনের মাঘে, হেকালে সাত চলবে, এই বচ্চরই করাইতাম কিন্তুক হুনছি জোর বচ্ছর বয়সে সুন্নত কাম করানো ভালো না।
মোতালেব কারিগরের এই হেঁটে যাওয়ার সময় গ্রামগুলোর ভেতরে একটা নীরব তোলপাড় হয়ে যায় ছেলে শিশুদের মধ্যে। ছেলে শিশু-কিশোরেরা ভীত সন্ত্রস্ত দৌড়ে পালাতে থাকে অজ্ঞাত কোনো নিরাপদে। মোতালেব কারিগর জানে যতই পালাতে চায় না কেন কিশোর, তার উপায় নাই কারিগরের সামনে হাজির না হওয়া ছাড়া। প্রতিটি ছেলে কিশোরের পরিবার নিশ্চিত করে তাদের ছেলেকে মোতালেব কারিগরের সামনে হাজির করে কাজটুকু সেরে ফেলতে। এই যে মোতালেব কারিগরের উপস্থিতি দেখে গ্রাম জুড়ে এক তোলপাড় তা তার জীবনের বিনোদন ও উপভোগেরই অংশ যেমনটি মক্তবের মিয়া সাবের, মসজিদের ইমাম সাবের কী গ্রামের মাতব্বরের। অতএব মোতালেব কারিগরের পরিতৃপ্তি কাজে বা কাজের প্রতিক্রিয়ায়, যেমনটি চারণ কবিয়াল কি জারি বয়াতি কী পূজার মূর্তি বানানো কারিগরের মতো। কারিগর সে কথাই তার স্ত্রীকে বুঝায়, মোরা অইলাম যাইয়া তোমার শিল্পীর জাত। কারিগরের সেই ‘শিল্পীর জাত’ কথা শুনে স্ত্রী গুলবাহার পান ভরা মুখের নিচের পাটির দাঁতের বাম দিকে ডান হাতের নির্দেশক আঙ্গুল দিয়ে আর একটু চুন লটকায় এবং দু’চোখে মুগ্ধ দুষ্টের হাসি হেসে খেজুর পাতার মিহি পাটিতে গড়ায়, কুল কুল হাসে আর বলে “শিল্পীর জাত?” কারিগর তখন নাকি গুলবাহারের পিরিতে আর একবার ঘোষণা করে যে সে এই মুহূর্তে আর একবার মৃত্যুকে বরণ করে নিতে পারে, বলে, আমার ‘উম্মে কুলসুম’ আপনের জইন্যে এই প্রাণখানি কোরবান কইর্যাত দিতে পারি, আপনি বিশ্বাস করেন আর না করেন। কারিগরের ‘উম্মে কুলসুম’ পাটি থেকে কারিগরের দু’ঠোঁটের উপর আড়াআড়ি আঙ্গুল রেখে মাথা দোলায়, না এরম কতা কইবেন না যে, আমি বিশ্বাস করি কী করি না।
ওয়াসিমা পারভিন নূপুর দ্যাখে কারিগরের ভালোবাসার চোখ, আর সম্ভবত অজান্তেই নিজের সঙ্গে হয়তো কারণহীন রসিকতা করে ‘পিরিতি কাহাকে বলে!’
প্রথম রাতে মোতালেব কারিগর স্ত্রী গুলবাহারকে ‘আপনি’ সম্বোধন করলে গুলবাহার বলে, না পুরুষ মানষের ‘পরিবার জাত’কে আপনে জে কইর্যাক কইতে নাই। কারিগর নাকি তখন গুলবাহারকে অবাক করে দিয়ে বলে, আমি তো আহ্মনার পুরুষই না, পেরেম-পিরিতি ভালোবাসা, স্নেহক্ততার কোনো লিঙ্গ নাই, তা মোন-হৃদয় থেকে আসে লিঙ্গ থেইকা না, সেই নরের টান পুরুষেরও যা নারীরও তা, আমার উম্মে কুলসুম এই কথা-খান আপনে বুঝবেন তা জেনেই আমার এই সম্বোধন হইয়াছে ‘উম্মে কুলসুম’। মোতালেব কারিগর একথা বলে হাসে। গুলবাহার কারিগরের বাহুতে ঘষা আদরের হাতখানি থামায়, নিজেই একটু দূরে সরে গিয়ে কারিগরকে দেখতে থাকে, এ কী পুরুষ, কী মানুষ, নাকি অন্য কিছু? নাকি কোনো হিংস্র প্রাণী-ট্রানী হবে যার মানুষের তথা ‘পুরুষের’ গুণাবলি নাই। গুলবাহার শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় বালিশ তুলে মুখে চেপে ধরে কেঁদে ফেলে। সে কী, পুরুষ কিনা প্রথম রাতের প্রথম দর্শনে তাড়াতাড়ি কাপড় খুলে সতীচ্ছেদ নিশ্চিত করে কঠিন ফরমান জারি করতে থাকে, স্ত্রী হিসেবে স্বামীর নির্দেশাবলী অমান্য করলে কী কী বিচিত্র পদ্ধতিতে মারধর করা হবে এবং তার পরও অমান্য করলে জানে-প্রাণে কী কী ভাবে খতম করা হবে সেই সব জাতীয় হুমকি। কারিগর সে সব না করে কিনা প্রথম রাতে সব কিছুর আগে অর্থাৎ সঙ্গমেরও আগে স্ত্রীকে কোন এক আরব-ই মহিলার নামে সম্বোধন করেছে “আপনে আমার উম্মে কুলসুম।” গুলবাহার জানতে চায় কার নাম এই উম্মে কুলসুম, সে কী জিনিস যার নামে এই অবলাকে ডাকন হইতেছে। কারিগর খুব সংক্ষিপ্ত গুলবাহারকে জানায় মিশরীয় এই সঙ্গীতশিল্পী সম্পর্কে যতটুকু সে জানে। এর পর কারিগর গুলবাহারকে আরো জানায় যে সে ছোট সময়ে বাড়ি পালিয়ে কলিকাতায় গিয়ে একটি যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিল, সেই যাত্রাদলে থাকা কালে মধ্যরাতের পর মূল যাত্রা পালা শুরু হওয়ার আগে সে মেয়ে সেজে উম্মে কুলসুমের গান করত।
গুলবাহারের বাসরের সে রাত ছিল স্বপ্নের রাত, যেন কল্পনা করা যায় না এমন একটি মানুষ দেখার স্বপ্ন-রাত। কারিগর সে রাতে আরো অদ্ভুত কাজ করে, পরনের পিরান খোলে, দেহে থাকে শুধু গেঞ্জি, পাজামা খোলে, হাফ প্যান্টের মতো পাতলা কাপড়ের অন্তর্বাস, খাট-চৌঁকি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে গুলবাহারকে বলে, পেরথমে মনে করেন আমি একজন নারী, মায়ের জাত, এটুকু বলে সে দেহে একটা বাঁকা দোলা দেয় যা নারী ভঙ্গিমার সনাতনী শৈল্পিক কলার অংশ; তারপর বলে, ধরেন নাম উম্মে কুলসুম, পরনে পুরো হাতার বেলাউজ, হাতার পেরান্তে ও বেলাউজের শেষ পেরান্তে মোটা পাকানো সূতার ঝালর এবং ওই ঝুলমী সূতার নিচে ঝুনঝুনির মতো বোটলা, দেহ-ঘূর্ণি চক্কর দিলে ঝুনঝুনির মতো যা লম্বা পাকানো সূতার মাথায় সেই বোটলা তহন দিঘিতে ছুঁড়ে দেয়া ঝাঁকি জালের মতো খুলে যায়। এরপর কারিগর ডান হাত কোমরে রেখে বাম হাতের তর্জনী কপালের বামে ঠুকে আঙ্গুলগুলো মুকুটের পালকের মতো করে মাথার উপরে খুলে দেয়। এবং ঘুরে ঘুরে নেচে দেহ এবং কোমর দুলিয়ে উম্মে কুলসুমের গান করে।
আহ্ ইয়াহ্ না সিনি,
উইন্ তা আলাহ্ বা আলী উখাইয়াহ্ লাখ্ মাহ্ ইফায়ারোখ,
আইনিহ্,
আই্ ইয়াহ্ না সিনিহ্,
আহ্ ইয়াহ্ না সিনি,
উইন্ তা আলহ্ বা আলী উখাইয়াহ্ লাখ্ মাহ্ ইফায়ারোখ,
আইনিহ্,
আহ্ ইয়াহ্ না সিনিহ্,
বাহ্ ইয়াহ্ হানিহ্,
ওয়াহ্ আতেহব আলা হালিহ্
ওয়ার হামসিহ্
উইন্ তা আলাহ্ বাহ্ …
কারিগর এরই মাঝে তার নাচের তাল ঠিক রেখে গুলাবাহারের বুঝার মতো করে যা অনুবাদ করে-
তুমি আমায় ভুলে থাকলে কী হবে, কেনই-বা ভুলে থাকা, আমার ভালবাসার প্রতি আস্থা হারিয়ো না, তোমারও অনুভূতি প্রকাশ করো, …
কারিগর সেই গানের ঘরের বেড়া থেকে মন্দিরা এনে একটু বাজিয়ে গুলবাহারের হাতে দেয়, গুলবাহার কারিগরের উম্মে কুলসুমের গানের নাচের সঙ্গে মন্দিরা বাজাতে থাকে। কারিগর গানের ফাঁকে গুলবাহারের হাত ধরে তার সঙ্গে নাচতে আমন্ত্রণ জানায় ইঙ্গিতে। গুলবাহার কারিগরের কোমর ধরে নাচতে থাকে। উম্মে কুলসুমের প্রায় প্রহরাধিক দীর্ঘ গান গেয়ে-নেচে কারিগর রাত কাটায়। পাশের বাড়িগুলো থেকে নতুন জামাই বউ দেখতে আসা হিন্দু কিশোরী ঝি-বউয়েরা কারিগর ও তার নতুন বউ গুলবাহারের এই সব কাণ্ড দেখে উলুধ্বনি দেয়। ‘মোগোর সেই নিশি কাটে কান্দিয়া কান্দিয়া’ একথা বলে মোতালেব কারিগর ততক্ষণে হিক্কা দিয়ে কাঁদতে শুরু করলে এক বিব্রতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যা এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করে নূপুরের মনে।
মেম সাব পেরথম রাইতেই মোর ‘উম্মে কুলসুমের’ পায়ে বড় যত্ন কইরা আলতা মাইখ্যা দিয়াছি। তার পায়ে মোর হাত দিয়া আলতা মাখতে গেলে সে প্রায় ছিটকায়া পড়ে এই কথা বলে যে, স্ত্রীর পায়ে পুরুষের হাত! আমি বলিলাম, বউ যাহার সঙ্গে সঙ্গম করা যায় তাহার সঙ্গে বাড়তি সম্মান অসম্মানের কোনো ব্যাপার নাই। তিনি বলিলেন, আপনার যত উল্টা-পাল্টা ধরনের কতা। কারিগর তার উত্তরে গুলবাহারকে বলে, না এইডা আমার নিজের কতা না, এইডা অইল যাইয়া আপনার হাদিসের কতা। সন্দেহ থাকে না বুড়ো মোতালেব কারিগরের এই দীর্ঘ আবেগী ভালবাসার কথা শুনে ওয়াসিমা পারভিনের মনটাও ভারী হয়েছিল, সে তার চোখের সামনে দেখতে পায় শিল্পীর জাত দাবিদার এক সময়ের পাগল ধরনের যুবক যে কিনা গুলবাহারকে ভালবাসার পুকুরে ডুবিয়ে ভাসিয়েছিল। কিন্তু নূপুর চমকে ওঠে যখন কিনা শোনে কারিগর তার স্ত্রী গুলবাহারকে হাদিসের বরাতে বলেছে যে যার সঙ্গে সঙ্গমের সম্পর্ক তার সঙ্গে বাড়তি কোনো সম্মান অসম্মানের ব্যাপার নাই। নূপুর প্রশ্ন করে কারিগরকে, হাদিসে কী ওই ধরনের কোনো কথা আছে নাকি? কারিগর চোখের পানি মুছে একটু হেসে বলে, জানি না তো ম্যামসাব, মনে হয়না এমন কতা হাদিসে আছে। তবে এমন কথা হাদিসের বরাতে বললেন কেন, নূপুরের এ প্রশ্নের উত্তরে কারিগর বলে, তবে যদি সে বিশ্বাস না করে তাই হাদিসের বরাতে কইয়া দেলাম। নূপুর এই আর একদফা বুঝতে পারে মোতালেব কারিগর খুব সাদাসিধে মানুষ নয়, তার ভেতর রয়েছে আর একটা মানুষ যে কিনা রূপকথার গল্পে বিশ্বাসী না হয়ে জাগতিক যুক্তিনির্ভর জীবন যাপন পন্থী। এর আগে যে ঘটনাটা ঘটে তা হলো এই ফাঁকে কারিগর যখন তার গুলবাহারকে নিয়ে উম্মে কুলসুমের গান শোনানোর গল্প করছিল তখন তার মনে হয়েছিল যুবক কারিগর যেন নিজ হাতে নূপুরের পায়েই পাকা সিঁদুরে আম রঙের ঘন লাল আলতা মেখে দিয়েছে এবং সে যেন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া উপকূল গির্জায় এক পিরামিডের জমিন প্রান্তে সনাতনী মিশরীয় পোশাকে যুবক কারিগরের হাত ধরে গান গেয়ে নাচছে। সে কারিগরের প্রেমের শক্তিতে আচ্ছন্ন হয়েছে, একটি পুরুষকে কল্পনা করেছে যে কিনা পুরুষ ছাপিয়ে অধিকতর মানুষ হয়ে উঠেছে, তার চেয়েও বেশি প্রেমিক হয়ে উঠেছে।
তারপর কী আপনার স্ত্রী গুলবাহার বিশ্বাস করলো ওই আপনার হাদিসের বরাতে বলা কথা? নূপুরের এ প্রশ্নের উত্তরে মোতালেব কারিগর তার মাথা হেসে-হেসে আড়াআড়ি দুলিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নূপুর মনে করে ব্যাচারা কারিগর স্ত্রীকে বোঝাতে ব্যর্থ হলো নারীর প্রতি তার অনুভূতি। তারপর কারিগর জানালো, জানেন মেম সাইব মোর উম্মে কুলসুম কী কইল? গুলবাহার কইল, এই হাদিস-খান কারিগর ওয়ালার নিজের গড়া হাদিস, ঠিক কইছি না? গুলবাহার সবই অবগত আছিল, তবে সে পরীক্ষা কইর্যারও দেইখ্যা লইতে চাইছিল ওই পেরথম রাইতে। বুড়ো হাসে, নূপুরের মনে কোথায় যেন একটা ফোঁটায় ফোঁটায় বেদনার রসপাতে হাঁড়ি প্লাবিত হয়। পড়াশুনা শেষ করতে কত শত ছেলের সঙ্গে এ জীবনে দেখা হয়েছে কিন্তু ঠিক কাউকেই মনে হয়নি যে কিনা লিঙ্গ ভুলে ‘পুরুষের’ বাইরে ‘মানুষ’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। নূপুর কোথায় যেন একটু ঈর্ষান্বিতও হয় ওই বুড়ো কারিগরের অজানা-অচেনা স্ত্রী উম্মে কুলসুম উপমার গুলবাহারের প্রতি এবং সে কারিগরকে বলে, দেখছি আপনার স্ত্রী ভাগ্যবতী ছিলেন, আপনার আন্তরিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন। মোতালেব কারিগর এবারেও নূপুরকে ফিরিয়ে বলে, না ম্যাম সাইব হে কিল্লাইগ্যা একলা ভাইগ্যবতী অইবে মুইও ভাগ্যবান আছিলাম তার পিরিতি, স্নেহক্তা পাইয়া, নাকি? এ কথা বলে কারিগর এমনভাবে নূপুরের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন নূপুরের হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
নূপুর মোতালেব কারিগরের অতীত জীবনের গল্পের প্রেমে পড়ে, তার গল্প নূপুরের চাকরির এসাইনমেন্টের মূল বিষয়বস্তু থেকে যত দূরেই থাকুক এখন আর নূপুরের তা বিরক্ত লাগে না। বরং মনে হয় মানুষের পূর্ণ জীবন সে রকমই চলে যেভাবে বুড়ো মোতালেব কারিগর তার সম্পর্কে বলছে, বলছে তার প্রেমিকা স্ত্রী গুলবাহার বা উম্মে কুলসুমকে নিয়ে। বুড়ো মোতালেব কারিগরের বাড়ি থেকে নূপুর প্রকল্প অফিসের দিকে ফিরতে ফিরতে টের পায় শরীর খুব দুর্বল লাগছে। এলাকার হাই স্কুলের একাংশ প্রকল্প ভাড়া করে কার্যালয় খুলেছে যার একাংশে আবার প্রকল্পের কর্মচারীদের আবাসিক ব্যবস্থাও করা হয়েছে। মোতালেব কারিগরের ঘর থেকে ফেরবার সময় নূপুর লক্ষ্য করেছে আজ আর কারিগর নূপুরের দিকে ফিরে মুচকি হেসে চোখ কুচকিয়ে বলেনি “আইজ আর থাউক ম্যাম সাইব”।
নূপুর জানে এর কারণ মোতালেব কারিগরের কাছে খুব গভীর, সে চায় না আজ সে যেভাবে তার স্মৃতিতে গুলবাহারের মুখ তার মনে ভেসেছে সে মুখ ডোবাতে চাচ্ছে না নূপুরের দিকে তাকিয়ে। মোতালেব কারিগরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাটির রাস্তায় নেমে প্রকল্পের কার্যালয়ের দিকে যেতে যেতে সে বুড়োর এ ভালবাসা দেখে একা মনে মনে নিজের সঙ্গে হেসেছে।
তার খুব দুর্বল লাগছে সে শুধু শরীর খারাপ বলে নয়, বিষণ্নও লাগছে। সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল যে, তার বছরে একাধিক বার কারণহীন বিষণ্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার নিয়ম রয়েছে। একটু পরে তার খেয়াল হয় ঋতু পরিবর্তনের আমেজ এসেছে পরিবেশে, বিশেষ করে রোদে, আকাশে, সবুজ গাছ-গাছালিতে। এই বাতিকটি তার মেয়েবেলা থেকে; কিন্তু ক’বছর আগেও জানা ছিল না যে, কেন তার এই বিষণ্নতা। সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে টিএসসিতে কবিতাচক্র বৃত্তে গিয়ে শরৎ নামের একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। নামটি ছাড়া যাকে দেখে নূপুরের মোটেই পছন্দ হয়নি টিএসসির ঘাসে বসে। তাও সন্দেহ হয় এ নিশ্চয়ই নিজের পাতানো নাম আর যাদের নাম বদলানোর বাতিক আছে তারা সময়-সুযোগ অনুযায়ী নাম বদলায় এমন কী বাবা মায়ের নামও। দ্বিতীয় দিনে কবিতাচক্রে গিয়ে আবার যখন শরৎ’এর সঙ্গে দেখা হয় সে জানতে চায়, কেমন আছেন? নূপুর বলে, ভাল না। কেন কী হয়েছে? বলতে পারবো না তবে ভাল লাগছে না সেটা বলতে পারবো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই নূপুরের মেজাজ খারাপ হয় কেন লোকটি অনেকটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো যে কেন ভাল লাগছে না। সে তখনই সিদ্ধান্ত নেয় যে কবিতাচক্র থেকে এ আপদ বিদায় না নিলে সে আপাতত কবিতা চর্চা স্থগিত করবে। শরৎ নূপুরকে আরো রাগিয়ে তোলে, বাঙালিরা তো ‘কেমন আছেনের’ উত্তরে ‘ভাল নাই’ সে কথা বলতে পারে না, আপনি দেখি পেরেছেন। নূপুর জানে মাঝারি ধরনের ট্যালেন্ট দাবিদার কিছু ছেলে কতিপয় মেয়েদের মন জয় করতে এ ধরনের ব্যবস্থা নেয় এবং তা কার্যকরও হয়। ইচ্ছে হয় তার দুটো কঠিন কথা ঝেড়ে শরৎ সাহেবকে এক লাছা নিয়ে নিতে, আর ত্রাসের কথা এলে ঠাস্ ঠাস করে অপরাধীর পশ্চাৎ-দেশে গোটা কয়েক চড় থাপ্পড় দিতে, তার এও মনে হয় চড়-থাপ্পড় গালে দিলে সেখানে দাগ হয়ে যাবে আর তখন শরৎকে কেউ সেই দাগের কথা জিজ্ঞেস করলে সে কী সবাইকে বলবে, ওই যে নূপুর নামের ‘মহীয়সী কাদম্বিনী রমণী’ আছে না! এসময় তার আরো মনে হয় বাঙালি লেখক-সাহিত্যিকরা ফ্রয়েডীয় তাড়নায় আক্রান্ত হয়ে নারী সম্বোধনে একটা তালগোল পাকিয়ে ফেলে আর সেই সব পড়ে গোটা যুবক সমাজ প্রেমিক সমাজে পরিণত হয়ে রাজ্যের সব অসংলগ্ন কাজ করে ফেলে, যেমন, যতসব অসম্ভব সম্বোধনে তারা নারীকে ডাকে। সে যাক, শরৎকে সে সেই সুযোগ দেবে না যে বলবে ‘মহীয়সী-নূপুর-আঙ্গীনী’ আমার গালে হেতা শক্ত ধরনের স্পর্শ করে, নিশ্চয়ই রমণীর হাতের থাপ্পড়কে শরৎ ঘুরিয়ে বলবে তখন শ্রোতার কাছে এবং তার কথা শেষ করবে এভাবে, সেই শক্ত মায়াময় স্পর্শেরই ছোঁয়া বা দাগ রহিয়াছে আমার কপোলে। নূপুরের এ সব ভাবনার মধ্যেই শরৎ বলে, না, না মাঝারি গোছের বুদ্ধিজীবী ধরনের অপবাদে দুষ্ট শনাক্ত না করে, চড় থাপ্পড়ের চিন্তা না করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিন, ধরুন আপনি অনেকদিন ভীষণ ব্যস্ত, আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষার পরও প্রতিদিনই সকালে কী বিকালে ঘন পাতলা মেঘ, কখনো বৃষ্টি কী রোদ। হঠাৎ একদিন দেখলেন সারা দিন রোদ, আকাশ পরিষ্কার নীল, কোথাও টুকরো সাদা মেঘ, বিকেলে সামনের গাছে চোখ পড়তে দেখলেন কোনো কোনো পাতা হলদে বর্ণে বিবর্ণ হয়েছে, আপনি দেখতে থাকলেন এবং তখন এও দেখলেন একটি পাতা ঝরে পড়ছে, আপনি তাকিয়ে থাকলেন, দেখতে থাকলেন কেমন করে একটি বিবর্ণ হলদে পাতা উল্টে-উল্টে পড়ে যাচ্ছে, এমনকি আপনার কানে বাজলো ওই পাতা পড়বার সময় একটি পাখিও ডেকে গেল, ঠিক এ সব মিলিয়ে আপনার মনে একটি প্রতিক্রিয়া হলো: আরে তাই তো, বিবর্ণ হলদে পাতার চক্রাকারে পতন, হঠাৎ পাখি ডেকে উড়ে যাওয়া, সব কিছুই ভিন্ন যা এতদিন দেখে আসছেন, আপনি চাচ্ছেন মনে করতে কোন পাখিটি ডেকে গেল, অথচ মনে করতে পারছেন না আপনার অতি চেনা পাখিটিকে, কী পাখি কী পাখি করে যেন অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে দিলেন। ঠিক সে সময় থেকে আপনি অসুস্থ হয়ে গেলেন অথচ জানলেন না কেন হলেন। হয়তো সে রকমই কারণহীন কারণে ভাল নেই। শরৎ এর এ ব্যাখ্যা নূপুরের কাছে যথার্থই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়, কিন্তু এই পণ্ডিতি ঢঙের বক্তার কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল ভীষণ।
নূপুর মোতালেব কারিগরের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে নিজের বিষণ্নতা ও শরীর ভাল না লাগার মাত্রায় টের পায়, ঋতু পরিবর্তনের সময় এসেছে। প্রকল্প আবাসিকে ক্লান্ত ঘুম-নির্ঘুমের মাঝে রাতভর স্বপ্নে দেখে সে উম্মে কুলসুম, মিসরীয় পোষাকে যুবক মোতালেব কারিগরের সঙ্গে ঢাক পিটিয়ে মিশরের গির্জায় রাজা কুফুর পিরামিডের সামনে হরদম নেচে বেড়াচ্ছে, যে পিরামিডের সামনে গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডেটাস পঁচিশ’শো বছর আগে গিয়েছিলেন এবং তারও সাতাশ’শো বছর আগে ফারাও কুফুর এক লাখ লোক কুড়ি বছরে বানিয়েছে সেই পিরামিড। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার সে স্বপ্নে মোতালেব কারিগরকেই দেখে যুবক হিসেবে। এবং সেই যুবক মোতালেব কারিগর কিনা আবার টিএসসির কবিতাচক্রের দু’দিনের জন্যে দেখা হওয়া সেই শরৎ এর চেহারার সঙ্গে মিল। সে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানে এবং তার নিজের উপর আস্থা আছে স্বপ্নের তার নিজস্ব ব্যাখ্যাই আধুনিক ও যুক্তিসঙ্গত। স্বপ্ন ব্যাখ্যার কথা মনে হতেই সে সকালে বিছানা ছাড়বার আগে হেসে ফেলে একথা ভেবে যে, সে যদি খোয়াবনামায় স্বপ্নের ব্যাখ্যা খুঁজতে যেত তবে তার এই স্বপ্ন পাওয়া যেত না, কেননা খোয়াবনামার রচয়িতারা জানে না পিরামিড কী জিনিস, অতএব সে যা পেত তা হলো বুড়োর সঙ্গে যুবতী রমণীর যেনা খোয়াব দেখিলে কঠিন ব্যারাম জাতীয় কী অমঙ্গলের সংকেত জাতীয় ব্যাখ্যা। খোয়াবনামা ও তার রচয়িতাদের যেনার প্রতি যে এক প্রবল আগ্রহ রয়েছে তা সে জানে। হয়তো সে খোয়াবনামায় আরো বলা থাকত যে, বৃদ্ধের সঙ্গে নাচতে দেখার অর্থই হচ্ছে যেনা করা, সুতরাং একটি অমঙ্গল অবশ্যম্ভাবী এবং সে অমঙ্গলের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে একমাত্র উপায় হচ্ছে প্রকৃতই কোন বুড়োর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া। নূপুর এরপর শব্দ করেই হাসে এবং নিজের সঙ্গে বলে, খোয়াব নামায় যদি যুবকের সঙ্গে সঙ্গমের কথা বলা থাকত তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারতাম। নূপুরের এই নিজের সঙ্গে কথা শুনে পাশের বিছানায় প্রকল্প সহকর্মী সুষমা বলে, এই নূপুর তুমি কী পাগল হয়ে গেলে নাকি একা আবোল-তাবোল বকছ কেন এই গ্রামীণ সকালে? মুখের ডান দিক থেকে কপাল গড়িয়ে আসা ঘুমন্ত চুল সরিয়ে হাসি অব্যাহত রেখে নূপুর আবারো বলে, খোয়াবনামার লেখক বুড়ো বয়সে তার পুস্তিকাটি লিখেছে বলে যাবতীয় সঙ্গমের পরিণতি বুড়োদের দিকে ঠেলেছে। সুষমা বলে, নূপুর সত্যি তোমার মাথা খারাপ হয়নি তো? নূপুর সুষমার দিকে তাকিয়ে থেকে একটু সময় নেয়। তখন সুষমা বুঝে ফেলে যে নূপুর এবার সিরিয়াস আলোচনা টানবে এবং যথারীতি তাই হয়, শোনো সুষমা তোমরা মানুষের চিন্তার উন্মুক্ততা দেখলে পাগল হওয়ার ভয় পাও কেন? আমার তো মনে হয় মনের মধ্যে আমরা যা সারা দিন ভাবি এবং বলি চলি, তা সাধারণ চোখে সবই পাগলামি, অথচ মানুষ সেই পাগলামির জগতেই বেশি থাকে।
নূপুর অক্লান্ত লেগে থাকে বুড়ো কারিগর মোতালেবের পেছনে, পরেরদিন কারিগর গল্পের শুরুতে একটি একতারা নেয় এবং বাম হাতে সে একতারা নিয়ে নির্দেশক আঙ্গুল দিয়ে বাজিয়ে সুর করে গান গায় “বুঝলি না মন বুঝলি তবে, বুঝলি তবে বুঝলি কিসের বুঝলি না।”
চোখ বন্ধ করে এই একই বাক্য পুনঃ পুনঃ গাইতে থাকে। এবং অনেকক্ষণ পরে নূপুর বুঝতে পারে “বুঝলি না মন বুঝলি তবে, বুঝলি তবে বুঝলি কিসের বুঝলি না” কথাটার মানে সে ধরতে পারছে না। কারিগর সুর থামিয়ে এমন ভাবে নূপুরের দিকে তাকায় যেন সে আগেই জানে নূপুর নামের এই উচ্চ শিক্ষিত তরুণী তার গানের অর্থ বুঝবে না। সে বলে, মেমসাব গানখান নিজেই রচনা করছি। নূপুর তার না বোঝার ব্যর্থতা প্রকাশ করতে চায় না, উল্টিয়ে কারিগরকে অপ্রস্তুত করতে চায়, বলে, ওই এক লাইনের গান রচনা! বুড়ো মোতালেব কারিগর এবার নূপুরকে চমকে দিয়ে বলে, না এক লাইন না সাড়ে তিনশ লাইন এবং তা এক ছত্তরও লিখিত না, দেলের ভেতর। এ কথা বলে চোখ টিপটিপ করে বুড়োদের যথারীতি ভঙ্গীতে হাসতে থাকে। নূপুর বুঝতে পারে না এখন কী বলবে বুড়োকে, বুড়োর ওই দীর্ঘ গান শুনতে তো আর চাওয়া যায় না, তাহলে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। আবার এও বোঝে বুড়ো যা চায় তা করবেই, নূপুর তা চাউক কী না চাউক। কারিগর একতারা এবার হাত বদল করে ডান হাতে নেয় এবং টুং টাং করে কয়েকটি বেসুরো টান দিয়ে বলে, সাধের ডম্বুরা তাল থুইয়া বেতালে গাইও না। মেমসাব, ডম্বুরা কী নিজে তাল থুইয়া বেতালে গাইতে পারে, যদি না ডম্বুরার বাদক বেতাল বাজায়? কারিগর আবারও হাসে, বলে, মেমসাব, হাসি কেন জানেন? নূপুর কোনো কিছু বলবার আগেই আবার সে বলে, হাসি, কারণ আমি নিজে আপনার সঙ্গে আগাগোড়া তাল থুইয়া বেতাল গাইলাম, আইছেন এক গপ্প হুনতে আর কইতে আছি দুইন্নাই ছাড়া গপ্প যা মনে লয়।
মোতালেব কারিগর এরপর যে বিষয়ে আলোচনা করে তা হলো কর্ম তৃপ্তি সম্পর্কে। ওই কারিগরি কাজে তার কোনোদিন অতৃপ্তি হয়নি। এই যে শীতের দিনে কী আমনের ভুঁই রোয়া শেষে ঘর থেকে পাতলা কাঁথায় বানানো গাঁট নিয়ে কারিগরি কাজে হাঁটতে নামা জীবনভর ভাল লেগেছে। গৃহস্থের বাড়িতে মাথার ফিতা সমান চওড়া ত্যানা কাপড় পুড়িয়ে কলা পাতার উপর রেখে কাজ শুরু করা থেকে সুন্নত করার পর আর এক ত্যানা কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে বাঁধা পর্যন্ত। কারিগর বিস্তারিত বর্ণনা করতে থাকে কী কী এবং কিসব কারণে তার এই পেশা ভাল লাগে। সে নূপুরকে তার পেশা ও জীবিকার সঙ্গে হিন্দুদের পেশার হুবহু মিল বলে দাবি করে। তার নিজ মতে যে সব লোক দৈহিক ভাবে দুর্বল কিছুটা, বাউলা ধরনের, গায়ে গতরে খাটবার শক্তি নাই তারাই এইসব লাইন ধরে, ঠাউরামি, কী যাবতীয় কারিগরি, কী রাজ্যের সব কাম যা গতর-পুষ্ট লোকদের সয় না। কারিগর বলে, সে যদি এই সামান্য চামড়া কর্তনের কাজটুকু না করতে পারত তাহলে ভিক্ষা করতে হতো, কেননা সে কোনো দৈহিক কাজ করতে পারে না। এই যে গ্রামছে গ্রাম বাড়ির পর বাড়ির কিশোররা তাকে দেখে পালায় এ মজা নাকি কারো সঙ্গে ভাগ করবার নয়। এই যে কিশোরদের মায়েদের তাকে দেখে সলজ্জ ঘোমটা এবং ঘোমটার আড়াল থেকে বিনীত সম্মান পূর্বক কারিগরের সঙ্গে কথা বলা। গৃহস্থ নিজের পিঁড়িখানা ছেড়ে কারিগরকে বসবার জন্যে এগিয়ে দেয়, ঘরে সঞ্চিত সুপারি দিয়ে এগিয়ে দেয়া পান। আগের বছরগুলোতে খৎনা হয়ে যাওয়া কিশোরদের বিনীত আদাব। কারিগর নূপুরকে আরো একটি তথ্য দেয়, তা হলো কখনো কখনো সদ্য সুন্নত হওয়া কিশোররাও তাকে দেখে ভয় পায় আরো বেশি, কেননা অনেক সময় বড়রা ভয় দেখায় যে, কারিগর এরপর আসবে ‘কুইনছাচ’ দিতে, অর্থাৎ কিনা আগের বছর করানো খৎনার উপর ‘মিহি চাঁছা’ যা ভাবতেই কিনা আগের চেয়ে অনেক বেশি ভীত হয়ে পড়ে কিশোররা। পুরো সুন্নত কাজের শক্ত কাজটুকু কোথায় তা বর্ণনা করে কারিগর, লিঙ্গের আগার বর্ধিত চামড়াটুকু ঠিক করে টেনে চিকন বাঁশের কঞ্চির ক্যাচকিতে আটকিয়ে ফেলা। এই কাজটুকু হয়ে গেলে আর চাকুর কোনো কষ্ট হয় না কেটে ফেলতে। বুড়ো হেসে হেসে জানায়, কোনো শিশু কিশোর এই কাজে বসতে চায় না, কেবল মাত্র পূর্ণাঙ্গ পুরুষ মুসলমান হওয়ার দম্ভ করবার লোভে পরে রাজি হয়। কিন্তু মুসলমান সে যতই হতে চাউক না কেন বাঁশের কঞ্চির ক্যাচকিতে পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ আটকা পড়লে কোনো সন্দেহ থাকে না ‘কাটা’ মুসলমান হতে তার আর ইচ্ছে হয় কিন্তু না হয়ে সে যায় কোথায় তখন? বুড়ো হেসে হেসে তার গল্প অব্যাহত রাখে। অনেকে শান্ত হয়, যদি শোনে সে সুন্নত কাজ শেষে চাকুখানা দেখতে পাবে। বাবা-মা তেমন ধারণা আগেই দিয়ে থাকে যে ওস্তাগারের চাকু দেখলে সব ব্যথা-যন্ত্রণা চলে যাবে। ওস্তাগার সাধারণত তার চাকু জনসমক্ষে সহসা দেখায় না।
নূপুর ভুলেই যায় বুড়ো মোতালেব ওস্তাগারের কাছে সে কেন এসেছে। সে বোঝে বুড়োর এক অসম্ভব গল্প বলবার ক্ষমতা আছে, যে ক্ষমতা সে ব্যবহার করে গল্প দীর্ঘায়ত করে, প্রসঙ্গান্তরিত করে, অথচ তা শুনতে মন্দ লাগে না। নূপুর যেন এসব গল্প শুনতে মনের অজান্তেই দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে ছিল। সে যেন উম্মে কুলসুম, ঝালর লাগানো মাথার কাপড়ের ফাঁকে হেসে হেসে, দুলে দুলে নেচে গান করে। সে বুড়োর এই সম্মোহনী ক্ষমতার সাদৃশ্য খুঁজে পায় টিএসসিতে কবিতাচক্রের সেই শরৎ এর সঙ্গে, যে কিনা ওই একদিনেই নিজের পায়ে আঙ্গুল দিয়ে অদৃশ্য আলতা মেখে এঁকে দেখিয়েছে যে সে কী ভাবে তার স্ত্রীর পায়ে আলতা মাখাবে যদি তার অর্থাৎ স্ত্রীর আপত্তি না থাকে। কী ভাবে সারা রাত গল্প করে স্ত্রীকে ঘুম পাড়াবে এবং এ কথাটি বলতে যে কঠিন রসকষহীন উদাহরণ দিয়েছিল তা শুনে নূপুরের গায়ে কাঁটা দিয়ে ঝাড়া মেরেছিল। বলেছিল, এ ভাবে সাড়ে তিন মিনিটে স্ত্রী সহবাস করে আধা মিনিট ধুয়ে মুছে বাকি দেড় মিনিটে ঘুমে পতিত হওয়ার মানুষ আমি নই।
মোতালেব কারিগর বর্ণনা অনুযায়ী সে গুলবাহারকে প্রতি রাতে গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পাড়ায় তখন। একদা সময় গেছে যখন কিনা কারিগর গুলবাহারকে নৌকা সম্পর্কে গল্প করে রাত পার করেছে। কীভাবে চৈত্রের রাতে পাবদা ঝোলে ভাত খেয়ে ফড়িয়ায় ঘুমাতে গেলে নদীর কুলকুল ঢেউ নৌকার কোলে বাড়ি খেয়ে এক ঘুমপাড়ানি বাদ্যের সৃষ্টি করে, সে বাদ্যে গুন গুন করে রাতভর গান যে কীভাবে কারিগরের অন্তর আলোড়িত করত সে কথা কারিগর নূপুরকে বলে। সময়ের কথা কারিগর নূপুরকে মনে করায়, ম্যামসাইব, সত্তুরের বইন্যার বচ্ছর। বুড়ো মুখ টিপে চোখ টিপে হাসে নূপুরের দিকে তাকিয়ে এবং জিজ্ঞেস করে, জানেন তো ম্যামসাইব লয়ক্ষ্যে লয়ক্ষ্যে সেই বইন্যায় মানুষ গরু ছাগলের সঙ্গে ভাইস্যা যায়। নূপুর বলে, জানি ’৭০ এর নভেম্বরের জলোচ্ছ্বাস। বুড়ো আগের মতোই মুখ টিপেটিপে হাসি অব্যাহত রাখে এবং আবারও জিজ্ঞেস করে, ম্যামসাইব, সেই সত্তুরের বইন্যার বচ্ছর কী বইন্যার বচ্ছরই খালি নাকি আরো কিছু আছে? নূপুর দুষ্ট বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকে যাকে কিনা শত্রুরা গাল দিত ‘নুনু কর্তন-ওয়ালা’, নূপুরের ইচ্ছে হয় সেও একবার মিষ্টি করে গাল দিয়ে দেবে, এই দুষ্ট বুড়ো ‘নুনু কর্তন-ওয়ালা’।
ম্যামসাইব, ইলিকশনের বচ্ছর, মোরা নৌকায় ভোট দেলাম, সেই ভোটের সোময়ই মুই গুলবাহারকে রাইতের পর রাইত নৌকার বিষয় কিসসা হুনাই। গপ্প ধরবার পারেন নাই কেন মুই উম্মে কুলসুমরে অত নৌকার গপ্প হুনাইতাম, কারণ আমার মাথায় তহন শ্যাক সাইবের নাও মার্হার অমিলিক পাট্ট্যি জেতানো আর মোছলেম লিগ ঠগানো ছাড়া আর কিচ্ছু নাই।
মোতালেব কারিগরের গপ্পের এক মোহ নূপুরের কানে বাজতেই থাকে। বুঝতে পারে না কতটা সে তার মূল এসাইনমেন্টের সঙ্গে আছে আর কতটা নাই। দেশ স্বাধীনে প্রতিটি বাঙ্গালির কী ত্যাগ ও অবদান সেই প্রকল্পের এসাইনমেন্টে নূপুর আছে, প্রকল্প নির্বাহী আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করবে এবং প্রকল্প যে কমবেশি নির্বাহীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ণয়ে সহযোগিতা করবে তা নূপুর জানে। কিন্তু ‘নুনু কর্তন-ওয়ালা’ বুড়ো সাবেক কারিগর এ প্রকল্পে কীভাবে অবদান রাখবে তার দেশ স্বাধীনে অবদানের কথা বলে, তা নূপুর বুঝে উঠতে পারে না। নূপুর এসব বুঝুক না বুঝুক মোতালেব কারিগরের গল্প শুনতে তার মন্দ লাগে না, বরং এক ধরনের অসম্ভব আগ্রহ জন্মেছে ভেতরে গল্প শোনার জন্যে।
সত্তুরের বন্যার পর গুলবাহারকে মোতালেব নৌকার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াবার পর আর সে নাকি কোনো নতুন প্রসঙ্গ পায়নি যে গল্প কিনা গুলবাহারের ঘুমপাড়ানি গল্পে পরিণত হতে পারে। রাতের পর রাত মোতালেব কারিগর গল্প থেকে গল্পে যায় কিন্তু গুলবাহার আর ঘুমায় না, কেননা গুলবাহারেরও এখন সেই সময় নয় যে কারিগরকে একলা সজাগ রেখে ঘুমিয়ে যাবে।
যে কোনো সময় গানবোট এসে শ্রীমন্ত গাং এর তীরে বটেশ্বর হাটের ঘাটে লাগাবে এবং গ্রামের পর গ্রাম হিন্দু বাড়ি ঘর, মানুষ, গরু, হাঁস, আরশোলা, পরগাছা, সিঁধেল, সব কিছু, সব কিছু পোড়াবে, কেবল ‘নুনু কাটনে-ওয়ালা’ মুসলমান প্রস্তুতকারী হিসেবে তার বাড়িঘর অক্ষত থাকবে এই এলাকায়। যারা পালাতে পারবে না তারা প্রতিটি মানুষ আগুনে ঝলসাবে।
অনেকদিন পর গুলবাহারই বুদ্ধি বের করে কারিগরকে প্রস্তাব করে, কারিগর আইজ এমন বুদ্ধি বাইর করছি যাতে কারিগর আর তার উম্মে কুলসুম একসঙ্গে গুমাইতে যাইতে পারে। গুলবাহার বুদ্ধি বের করবার পর বাকী ক’রাত তারা দু’জন শেষরাতের জন্য ঘুমায় যদ্দিন পর্যন্ত না রাজাকার আলবদর সমেত পাক মিলিটারিদের গানবোট শ্রীমন্ত গাং’এর বটেশ্বর হাটের ঘাটে ভেড়ে। প্রথা হচ্ছে গানবোট ভেড়বার পর স্থানীয় পাক-পন্থীরা পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে হাত উপরে তুলে সেই বোটের কাছে গিয়ে স্থানীয় রিপোর্ট দেয়। এবং সেই সব রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে মিলিটারি রাজাকার আলবদররা হিন্দু গ্রাম ও মানুষ পোড়ায়।
মোতালেব কারিগর মাথায় একটি টুপি পরে, একখানা কোরান শরীফ মাথায় তুলে বোটের কাছে যায়। কোনো এক সময় কোলকাতায় থাকার কারণে যেটুকু হিন্দি জানা ছিল তা দিয়ে উর্দু করে কারিগর গান বোটের মিলিটারি ক্যাপ্টেনকে জানায় যে কার্যত এই তামাম এলাকায় কোনো হিন্দু নাই, কেননা তার বাবা মকবুল ওস্তাগার ’৪৭ সালের রায়টের সময় পুরা এলাকার পুরুষ হিন্দুদের কলেমা ও সুন্নত করিয়ে মুসলমান বানায়, ফলে এখন যারা আছে তারা সেই সময় ধর্মান্তরিত হওয়া লোকদের ছেলেমেয়ে, তারা জন্মসূত্রেই মুসলমান, মুসলমানের বাচ্চা মুসলমান। মোতালেব কারিগর কোরান শরীফখানা মাথায় রেখে তার দোহাই দিয়ে এ তথ্য দেয়। ক্যাপ্টেন আলহামদুলিল্লাহ বলে গানবোট ছেড়ে দিতে নির্দেশ করে এবং ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং’ বলে এ আশাও ব্যক্ত করে যায় যে, আর একদিন সে আসবে ওই সব ধর্মান্তরিত মুসলমানদের নামের তালিকা দেখতে।
গানবোট চলে যায় এলাকার হিন্দু না পুড়িয়ে। আর রাত জেগে মোতালেব কারিগর আর তার স্ত্রী গুলবাহার মোটা খাতায় হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়ার দীর্ঘ তালিকা তৈরি করে। ১৬ই ডিসেম্বর রাতে তারা যখন তালিকা তৈরির কাজ আবার শুরু করে তখন খবর পায় যে, আর কোনোদিনই সম্ভাবনা নাই পাক মিলিটারি ওই তালিকা দেখতে আসার। কয়েক মাসে সে কয়েক হাজার লোকের তালিকা বানায় যা তার গ্রামের হিন্দু সংখ্যার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি, তাদের হিসেব ছিল আশেপাশে যে কোনো এলাকায় মিলিটারি রাজাকাররা হিন্দু পোড়াতে এলে সে এই তালিকার বর্ধিত অংশ একই পদ্ধতিতে মিলিটারির সামনে উপস্থাপন করবে, যেখানে সবই তার কল্পিত সব নাম স্থান পেয়েছে।
মোতালেব কারিগর নূপুরের হাত ধরে তার ঘরের ভেতরে কাঠের বাক্সের কাছে নিয়ে বাক্সের তালা খুলে বিশাল একটি খাতা নেয়, প্রথমে তা বুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে, মোর উম্মে কুলসুম আর মোর ম্যালা দিনের রাইতের ফসল। বুড়ো শিশুর মতো কাঁদে। নূপুর সেই খাতাখানা হাতে নিয়ে খুলে দেখে প্রায় সব ভুল বানানে যেভাবে ওই সব নাম লেখা রয়েছে
হিন্দু নাম গণেশ মণ্ডল মুসলমান নাম গনি মিয়া
অমল পাল ওমর আলি বিজয় কৈবর্ত– বায়েজিৎ হোসেন
এই খাতা, এই নাম, এসব মুহূর্তের জন্য নূপুরকে ভিন্ন ভাবনা দেয়, বেঁচে থাকা ও এই জীবনের বোধহয় কোনো মানে হয় না। নূপুর খাতা বন্ধ করে, বন্ধ খাতার কভারে তার কান্নার তরল ফোঁটা পড়তে থাকে। খাতা দেখে সে মোতালেব কারিগরকে জড়িয়ে ধরে। এবং বোধ করে এমন কাউকেই একমাত্র ভালবাসা যায় এবং মনে মনে বলে, কারিগর ভাবতে অসুবিধা কী আমিই আপনার গুলবাহার, আমিই উম্মে কুলসুম।
ওয়াসিমা পারভিন নূপুরের প্রতিবেদনে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য স্থান পায়, মোতালেব কারিগরের এ কাজের কোনো উল্লেখ কোনো মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য গ্রন্থে নাই, অর্থাৎ লিখিত কোনো স্বীকৃতি নেই। সে কোনোদিন কোনো অনুদান বা সহযোগিতা পায়নি যদিও তার অসীম দারিদ্র্যের মধ্যে সে সব সময় তা আশা করেছে। এলাকায় তাকে মোনাফেক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, কেননা তাদের মতে মোতালেব ওস্তাগার কোরান শরীফ মাথায় নিয়ে মিথ্যা বলেছে, হোক তা মানুষের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে। এমনকি এলাকার কয়েকজন গোড়া হিন্দুও মোতালেব কারিগরের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের সঙ্গে একমত যে, মোতালেব কারিগর মোনাফেক কারণ সে কোরান শরীফ মাথায় নিয়ে মিথ্যা বলেছিল, তাদের মতে আরো কারণ যে কোনো ধর্মদ্রোহীই নাকি সমান, তা কী হিন্দু কী মুসলিম কী খ্রিস্টান কী অন্য কিছু। কেন ওস্তাগার ওই সব মিথ্যা বলেছিল তা নাকি ওই সব হিন্দুদের বিবেচ্য বিষয় নয়, তাদের মত অনড়— ধর্মদ্রোহী ধর্মদ্রোহীই!
boro valo laglo!
Anwar Shahadat kom likhen, kintu onek bhalo likhen, onar kono likha ba kormo na pora-dekha mane ekta notun avhigghota theke bonchito thaka…