চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলতেই চমকে গেলাম। আলো উদ্ভাসিত ঘর— না, চড়া আলো নয়, বিকেলের নরম পড়ন্ত রোদের মোলায়েম আলো ডিমের হাল্কা কুসুমের মতো অনেকটা এলায়ে পড়েছে ঘরের মেঝেতে, তির্যকভাবে লেপ্টে আছে ঘরের সাদা দেয়ালে, তিরতির করে কাঁপছে জানালার পর্দায়। ভাবলাম, এরকম রোদেলা ঘর আগে তো কখনো দেখি নি। তখনই মনে পড়ল, ঠিক এই সময়টাতে আমি কখনো বাড়ী ফিরি না। আমি ঘরে ফিরি রোদ আরেকটু মরে এলে, যখন সাঁঝ নেমে আসছে অনেকটা ‘যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্হরে’ র সময়ে। শেষ বিকেলের আলো তাই আগে দেখা হয়নি ঘরের মাঝে।
শেষ বিকেলের কথায় হৃদয়ে গুনগুনিয়ে উঠল একটি নাম — ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’। ‘বরফ গলা নদী’, ‘ইউক্যালিপটাস নগরী’ আর ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ —জহির রায়হানের তিনটে উপন্যাসই পড়েছিলাম একই সঙ্গে স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়বার সময়ে। একটা ঘোরের মতো এক রাতে সারা রাত জেগে তিনটে বই-ই শেষ করেছিলাম। পরের দিন অনেক বেলায় জেগে দেখি, একটা বই বালিশের পাশে, একটা বই বুকের ওপরে আর হাতে তখনও ধরে আছি ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’।
প্রায় বছর দশেক আগে মস্কো গিয়েছিলাম পাঁচ দিনের জন্য কাজে। উঠেছিলাম হোটেল ইউক্রেনে। চিরায়ত নিয়মে কাজের প্রথম দিনই বিকেলে হোটেলে ফিরে বেরুলাম কাছাকাছি কোন একটা ছোট্ট সুন্দর ক্যাফে খুঁজতে। যে কোন শহরে গিয়েই এই হন্যে হয়ে কাছাকাছি ক্যাফে খোঁজার জন্য বকা খেয়েছি বহুজনের কাছে — আমার কন্যারা অবধি।
যা’হোক এবার আমার হোটেলের খুব কাছেই পাওয়া গেল ভারী সুন্দর ছোট্ট একটা ক্যাফে — রেড স্কোয়ারে যাওয়ার পথের ওপরে। ছাদ থেকে মেঝে থেকে স্বচ্ছ শার্সির জানালা, ছোট ছোট টেবিল জানালার ধার ঘেঁসে, ধব ধবে সাদা কাপড়ে টেবিল ঢাকা। মা আর মেয়ে মিলে চালান। মেয়ে পরিবেশনের দায়িত্ব নিয়েছে আর মা খদ্দেরের কাছ থেকে পাওনা বুঝে নেন, টাকা-পয়সা সামলান।
ভারী ভালো লাগল আমার ক্যাফেটি। পছন্দের আরেকটি কারন, মেয়েটি সুন্দর ইংরেজী বলে— অতএব আমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। নিশ্চিন্ত মনে প্রতি বিকেলে কাজ থেকে ফিরে ধরাচূড়ো ছেড়ে ওখানে যাই। ভীড় তেমন একটা থাকে না। জানালার কাছে একটি নির্ধারিত টেবিলে বসি। পরিবেশনকারী মেয়েটি এলে পরে একটা কালো কফির কথা বলি। ভারী সুন্দর নীল রংয়ের একটা বড় পেয়ালায় ধূমায়িত কফি আসে। আমি লম্বা একটি চুমুক দিয়ে বাইরে তাকাই।
কাজের শেষে ঘরে ফেরা মানুষদের দেখি — ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ, কম বয়স্ক-বেশী বয়স্ক। নানান রকমের চেহারা, কত বিচিত্রতর পোশাক তাঁদের, বিভিন্ন রকমের হাঁটার ভঙ্গি— তাকিয়ে দেখতে দেখতে নেশা লেগে যায়। তবে সবচেয়ে ভালো লাগে শিশুদের দেখতে। একটু বড় যারা, তারা মা বা বাবার হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। অপেক্ষাকৃত ছোট যারা, তাদের শিশুঠেলুনীতে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যান মা-বাবারা। ঘরে ফেরার তাড়া সবার।
কফির কাপ শেষ হলে পরিবেশনকারী মেয়েটি আবার ভরে দিয়ে যায়। ততক্ষনে শেষ বিকেলের আলোয় ভরে ওঠে সারা ক্যাফের ভেতরটা। একটি আভা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মোলায়েম রোদের ঐ আভাটুকু আর তার উত্তাপটুকু ভারী ভালো লাগে আমার। আস্তে আস্তে বিকেলের রোদ মরে আসে। সাঁঝ নেমে আসে ‘নামে সন্ধ্যা তন্দ্রালসা, সোনার আঁচল খসার’ মতো করে। আমার কফিও শেষ হয়ে আসে। আমি উঠে পড়ি। মা-মেয়েকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাস্তায় পা বাড়াই। হোটেলে ফিরতে হবে – তৈরী হতে হবে আগামী কালের জন্য। পেছনে তাকিয়ে দেখি, ক্যাফের দরজার কাছে এসে মেয়েটি আমার গমন পথের দিকে চেয়ে আছে — তাকিয়েই থাকে যতক্ষণ না আমি সামনের বাঁকে মিলিয়ে যাচ্ছি।
পাঁচ দিনের দিন মেয়েটি আমার টেবিলে কফির কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘প্রত্যেক দিন একই কফি খাও কেন? আমাদের এখানে কিন্তু অনেক রকমের কফি পাওয়া যায়’।’ ‘জানি, একটু হেসে আমি বলি, ‘কিন্তু আমার তোমাদের কালো কফিই ভালো লাগে’। ‘তুমি কি ভারতের?, জিজ্ঞেস করে মেয়েটি। ‘না, আমি বাংলাদেশের’, স্মিতহাস্যে আমি বলি। চক চক করে ওঠে মেয়েটির, ‘কেন জানি, আমারও মনে হয়েছে।’ ‘ঢাকার?’, উদগ্রীব হয়ে মেয়েটি জানতে চায়।
আমি আশ্চর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘ঢাকার নাম জানো তুমি?’ ‘হ্যাঁ। আচ্ছা, তোমার কি একটু সময় হবে?’, একটু ইতস্তত: করে সে বলে। ‘একটু কথা বলতাম তোমার সঙ্গে’, মেয়েটির গলায় একটা করুন মিনতির সুর টের পাই। আমার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে সে বলে, ‘এক মিনিট সময় দাও। এক পেয়ালা কফি নিয়ে বসি’। তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে ভাবি, মেয়েটি আমাদের কনিষ্ঠা কন্যার চেয়েও ছোট হবে। তিরিশ পেরোয় নি।
আমার মুখোমুখি বসে সে। আজ ভালো করে তাকিয়ে দেখি মেয়েটির মুখখানা ভারী মিষ্টি – কিন্তু টের পাই সেখানে লেগে আছে একটি ধূসর বিষন্নতার ছায়া। ‘আচ্ছা, ঢাকা শহরটা কত বড়ো’? জানতে চায় মেয়েটি। ‘অনেক বড়ো।’, হেসে জবাব দেই আমি। ‘তুমি ঢাকায় শেখর দত্ত বলে কাউকে চেনো?, দু’ চোখ তুলে জানতে চায় সে। ‘না, আমি চিনি না। আর অতো বড় শহরে চেনাও সম্ভব নয়। কিন্তু কেন বলতো’? মমতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করি আমি।
তারপর আমি শুনি ওর জীবনের গল্প। বাংলাদেশের ছেলে শেখর দত্ত এসেছিলো প্যাট্রিক লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। মেয়েটিও পড়ত ওখানে। পরিচয় হয়, ভাব হয় দু’জনের। তারপর কি যে সুন্দর সময় কেটেছে দু’জনের— প্রেমের মাদকতায়, বন্ধুত্বের উঞ্চতায়, ঘুরে বেড়ানোর আনন্দে। একদিন শেখর জানায় যে তার বাবা অসুস্হ, তাকে দ্রুত দেশে যেতে হবে। মেয়েটি শেখরের জিনিস গুছিয়ে দেয়, সান্ত্বনা দেয় বারবার, বিদায় জানাতে যায় মস্কো বিমান বন্দরে। শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত শেখর বলে যে বাবা একটু সুস্হ হলেই সে ফিরে আসবে। কিন্তু শেখর আর কোনদিনই ফেরত আসে নি।
‘জানো, আমি পাগলের মতো কতো জায়গায় গেছি ওর খোঁজে। বাংলাদেশের ছাত্রদের জিজ্ঞেস করেছি, তোমাদের দূতাবাসে খোঁজ নিয়েছি — কোথাও কেউ কিছু বলতে পারে নি’, মেয়েটি উদগত অশ্রু সামলাতে চেষ্টা করে। ‘এবার ভাবছি, ঢাকায় গিয়ে খোঁজ করব। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঢাকা কত বড়’, মেয়েটি থামে।
‘এ গল্প আমার জানা’, আমি নিজের মনে ভাবি। এ আমি শুনেছি বহু জায়গায়, বহুবার। আমি মেয়েটির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাই। তারপর শান্ত স্হির কণ্ঠে বলি, ‘শোন, শেখর আর ফিরে আসবে না।’ ‘কিন্তু ও আমাকে কথা দিয়েছিল’, ব্যাকুল কণ্ঠে মেয়েটি বলে। ‘না, ও কথার কোন মূল্য নেই। শেখরদের কথার কোন মূল্য থাকে না’, আমি দৃঢ় কণ্ঠে বলি। মেয়েটি কিছু বলার আগেই আমার মুঠোফোন বেজে ওঠে। যাঁর দেখা করার কথা হোটেলে, তিনি পৌঁছে যাবেন মিনিট দশেকের মধ্যেই। আজ আমাকে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।
মেয়েটি নিত্য দিনের মতো আমার সঙ্গে সঙ্গে দরজা পর্যন্ত আসে। ওর কান্না ভেজা মুখখানা দেখে ভারী মায়া লাগে আমার— আমাদের কন্যাদের কথা মনে হয়। ‘কাল আমি চলে যাচ্ছি’, খুব নরম গলায় বলি আমি। ‘শেখরের আশা ছেড়ে দাও— ঢাকা যাওয়ার চিন্তাও। শেখরেরা ফেরে না এবং তাদের খুঁজেও পাওয়া যায় না কোথাও’, আমি মেয়েটির চোখে চোখ রেখে বলি। দেখি শ্রাবণের ধারা নেমেছে সেখানে।
‘জীবন এখনো অনেক বড় তোমার জন্য, কিন্তু জীবন তো একটাই। এটা মনে রেখো’, আমি আমার কথা শেষ করি। মেয়েটি আমার দু’হাত ধরে, তারপর এগিয়ে এসে আমার দু’গালে চুমু দেয়— কন্যা যেমন পিতাকে দেয়। আমি দরজা খুলে বেরিয়ে আসি। শেষ বারের মতো ওর দিকে তাকিয়ে বলি, ‘তুমি ভালো থেকো’।
তখনই দেখি শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে মেয়েটির মুখে। সোনালী চুল, জলে টল টল নীল চোখ, আর ওর মিষ্টি মুখটিতে শেষ বিকেলের আলো পড়ে ওকে এক দেবীর মতো লাগছিল। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে— পেছনে তাকানোর সাহস হয় না আমার। কিছুদূর আসার পরে হঠাৎ মনে হলো, মেয়েটার নামটা তো জিজ্ঞেস করা হলো না। তারপরই ভাবলাম, কি আর হবে জেনে। তার চাইতে থাক না সে আমার কাছে ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ হয়ে।
সেলিম জাহান
ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.