বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা
ফুল ভলিয়্যুমে রেডিও বাজার শব্দে একদিন ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমচোখে ঠাহর করতে পারি না, এমন ভোর ভোর অমন জোরে রেডিও বাজাচ্ছে কে? আমাদের বাসায় এরকম জোরে রেডিও বাজে না। আর সকালে তো অবশ্যই না। এরকম সকালগুলিতে আমরা ঝুমতে ঝুমতে পড়ার টেবিলে বসে থাকি। নয়তো হাত-মুখ ধুয়ে বই-খাতা খোলার মৌসুম করি। এত সকালে রেডিও বাজালে আর রক্ষে নাই আমাদের। কিন্তু আজ কি না রেডিও এত জোরে বাজছে যে, সেই শব্দে আমাদের ঘুমও ভেঙে যাচ্ছে! তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে চোখমুখে পানি ছিটিয়ে এসে বাসার অবস্থা কী বোঝার চেষ্টা করি। দেখি আব্বা-আম্মা দুজনেই মুখ গম্ভীর করে খবর শুনছে। কে যেন একজন ঘুরে-ফিরেই একই খবর পড়ছে। খেয়াল করলে শুনি, ঠিক খবর নয়, কে একজন কি জানি ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। আমি কান পাতলে শুনি—
শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। খোন্দকার মোশতাক আহমেদ দেশের নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে।
বিষয় কী বা কী ঘটেছে সেসবের কিছুই তেমন করে বোঝার বয়স আমার নয়, তবুও যেন খানিকটা অনুমান করতে পারি, মারাত্মক খারাপ কিছু একটা ঘটেছে। অনেক পরে, বড় হয়ে উপলব্ধি করেছিলাম— দেশের রাষ্ট্রনায়ককে হত্যা করে তা সগৌরবে ঘোষণা দেয়ার মতো পচনশীল-জাতি বাঙালীরা ছাড়া আর কেই-বা হতে পারে?
রেডিও বেজে চলার শব্দ সত্ত্বেও আমাদের সমস্ত বাসা কেন জানি নিঝুম মনে হতে হয়ে থাকে— যেন কোনো গোরস্তান। এইমাত্র গোরখোদকেরা তাদের কাজ সম্পন্ন করে চলে যাওয়ার পর হু হু শূনতা বিরাজ করছে। আমি আর প্রদীপ ভয়ে কোনো শব্দ করি না। আব্বার গম্ভীর মুখ দেখে আন্দাজ করি— আমাদের চারপাশের দুঃসময় দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে!
পাশের বাসার ছাতিমগাছের ঝুঁকে আসা শাখাপত্র আমাদের একচিলতে পাকা-উঠানে বার-মাসই ছায়া বিস্তার করে চলে। আর ফুল ফুটিয়ে আমাকে তীব্র মাথাব্যথায় আক্রান্ত করে দিয়ে যে পুষ্প-মচ্ছব করে— সেই ছাতিমের ডালে বসা এক দাঁড়কাক হঠাৎ তারস্বরে কা-কা করে ডেকে ওঠে। আম্মা প্রায় দৌঁড়ে যায় তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশে। দুই হাতের কব্জি দিয়ে বানানো পিস্তল উঁচিয়ে আম্মা কাকের দিকে তাক করে আর মুখে বলে—
হুশ হুশ হুশ
কিন্তু কাকের কানে আম্মার ‘হুশ হুশ’ পৌঁছায় বলে মনে হয়না বা আম্মার আঙুল গুটিয়ে বানানো পিস্তলকে সে থোড়াই কেয়ার করে। ফের সে কর্কশ ডাকে সকালের জমে থাকা নির্জনতাকে ভেঙেচুরে দিলে আম্মা স্পষ্টতই বিরক্ত হয়ে হাত নামিয়ে বলে—
দুরমুইশ্যা কাকের ডাক কিছুতেই থামেনা!
তারপর আম্মা অনেকটা আপন মনেই বলে—
কয়দিন ধইরাই কাকটা কু ডাকতে আছিল। আমি কতবার তাড়াইছি, তাও সে যায় নাই। এখন বুঝতাছি তার এত কু ডাকের কারণ কী? বিপদ আসার আগেই কাকেরা টের পায়, তাই তারা কা কা করতে থাকে।
আম্মা আরও কয়েকবার তার বানানো হাত-পিস্তল দিয়ে কাকটা তাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কাকটা গাছের ডাল থেকে সামান্য নড়েও বসে না। কাকের কর্কশ ডাক আর রেডিওর ঘোষণা দুইটাই একই সঙ্গে চলতে থাকলে আব্বা খুবই বিরক্ত হয়। বিরক্ত হয়ে ঘর ছেড়ে উঠানে এসে দাঁড়ায়। ছাতিমের ঘন-পাতার আড়ালে বসে থাকা কাকের দিকে আব্বা রাগত দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্তু কাকের কোনোদিকেই ভ্রক্ষেপ নাই। সে তারস্বরে ডেকেই চলে। এই সকাল বেলায় কাকের অনর্গল ডাক শুনে আমার আর প্রদীপেরও কেমন যেন ভয় ভয় করে। কারণ আমরা শুনেছি, মন্দ স্বভাবের জ্বিন-ভুত কাকের সুরত ধরে এসে এইভাবে ডাকাডাকি করে। তাদের তাড়িয়ে না -দিলে মানুষের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে নানান ক্ষতি করে বেড়ায়।
ফলত কালো রঙের যে কোনো জীব-জন্তুকেই আমরা সুরত-ধরে-আসা জ্বিন-ভুত ভেবে ভয়ে সারা হয়ে যেতাম। গোরস্তানে কালোবেড়াল দেখলে ভয় পেয়ে চোখ বুঁজে দিতাম ভোঁ দৌড়। কালো-কুকুর, কালো-কাক, কালো-বেড়াল ইত্যাদি আমাদের শংকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আম্মার হাত-পিস্তল দেখেও কাকটা যখন উড়াল দেয় নাই, এখন আমরা নিশ্চিত যে, অইটা দুষ্ট জ্বিন এবং জ্বিন-ই! নিজের রূপ পালটে দাঁড়কাকের রূপ ধরে আমাদের ক্ষতি করতে এসেছে।
আব্বা আগের মতোই গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকে রেডিওর নব ঘোরায়— সব স্টেশনে একই ঘোষণা সম্প্রচার চলছে। আব্বা চিন্তিত মুখে আম্মাকে বলে—
রানী, আইজ আর চুলার পাড়ে যাইও না। ভর্তাভার্তি কিছু একটা কইরা ফালাও।
যে কোনো বিপদ এলেই আমাদের বাসার সাধারণ রান্নাবাড়াও বন্ধ হয়ে যেত। তখন আমরা ডিমভাজি দিয়ে বা কিছু একটা ভর্তাভার্তি দিয়ে কোনোমতে একমুঠো ভাত খেয়ে নিতাম। যখন প্রদীপের সিরিয়াস হাম হয়েছিল, প্রদীপ আব্বাকে বলেছিল—
আব্বা, আমি তো চোখে কিছুই দেখতে পাইনা।
প্রদীপের চোখের সামনে আব্বা দুইটা আঙুল ধরে বলল—
এই খানে কয় আঙুল, বল?
আব্বা, আমি তো দেখতেছি না।
শুনেই আব্বা দ্রুত শার্ট পরে ছুটেছিল ডাক্তারের কাছে। আমাদের বাসায় ওই ঈদ কিছুই রান্না হয় নাই। এমনকী সেমাই পর্যন্ত না। আমরা যে কেউ অসুখ হলেই কোনো ভালোমন্দ খাবার আমাদের বাসায় রান্না হতো না। অর্থাৎ কাউকে ফেলে আমরা কেউ ভালো খাবার খেতাম না। বিপদ-আপদ এলে যে শাহী-খানাদানা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, এটা আমরা সেই শিশুকাল থেকেই জেনে এসেছিলাম। আজ আব্বা যখন আম্মাকে ভর্তাভার্তির কথা বলল, তখন আমরা বুঝে গেলাম যে— আজকের দিনের কোনো ঘটনাই সামান্য কোনো ঘটনা নয়।
আব্বা আর আম্মা রেডিওর সামনে থেকে নড়লোই না। ছুটা-ঝি এসে ঘরদোর মুছেটুছে কাপড়চোপড় ধুয়ে দিয়ে গেল। আমরা দুই-ভাইবোন আম্মা-আব্বার চারপাশে ঘুরঘুর করতে লাগলাম।
জুম্মা নামাজের আজান ধ্বনিত হলে আব্বা গোসলের সঙ্গে অজু সেরে ঘরে এল। এবং মাথায় টুপি পরে জায়নামাজ বিছিয়ে সটান দাঁড়িয়ে গেল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম— আব্বা আজ জুম্মা পড়তে মসজিদে গেল না!
আব্বার যোহরের নামাজ যেন অন্যান্য দিনের চাইতে দীর্ঘায়িত হতে লাগল। আব্বা মোনাজাতে অনেক সময় নিল। মোনাজাত করতে করতে আব্বাকে হু হু করে কাঁদতে দেখলাম। নামাজ অন্তে আব্বা কোরান শরীফ নামিয়ে রেহেলের উপর রেখে তেলওয়াত করতে শুরু করল। অন্যান্য দিন আব্বা ফজর বা মাগরিবের ওয়াক্তে কোরান পাঠ করে, কিন্তু আজ যোহরের ওয়াক্ত থেকেই আব্বার তেলওয়াত চলতে লাগল। আব্বার সুমিষ্ঠ স্বরে কোরান তেলওয়াত শুনতে শুনতে আমার কেন যেন ভয় বেড়ে গেল। আমি ভেবে পেলাম না, আজ আব্বা যোহরের ওয়াক্তেই কেন রেহেল পেতে বসেছে? আর এত বিষণ্ণ সুরে কেন কোরান তেলওয়াত শুরু করেছে?
আম্মাকেও দেখলাম গোসলআছল সেরে মাথায় ঘোমটা টেনে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। আম্মাকেও অনেক সময় নিয়ে মোনাজাত শেষ করে আঁচলে চোখ মুছতে দেখলাম । আম্মা চুপচাপ জায়নামাজ গুটিয়ে রেখে রান্নাঘরে চলে গেল আমাদের খাবার গোছাবার জন্য।
ভাত খেতে বসেও আব্বা তেমন কোনো কথা বলল না। বরং রেডিওটা এনে শীতলপাটির উপর রাখল, যাতে করে খেতে খেতে খবর শোনা যায়।
এইবার ঘোষণায় সামান্য রদবদল শোনা গেল, আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে উৎখাত করা হয়েছে।
আব্বাকে দেখলাম আরও গম্ভীর মুখ করে রেডিও শুনতে লাগল। একসময় মাখানো ভাতে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে উঠে গেল। আব্বা কেন আজ ভাতও খেতে পারছ না? আমরা দুই-ভাইবোন কিছুই বুঝতে পারলাম না।
পরেরদিন শনিবার, সমস্ত সিলেট শহর একেবারে থমথমে হয়ে আছে। রাস্তাঘাটে লোক চলাচল নাই বললেই চলে। আব্বা আমাকে আর প্রদীপকে ইশকুলে যেতে দিল না। তার পরের প্রায় দিন পনেরো আব্বা আমাদের কিছুতেই ইশকুলে যেতে দেয় নাই।
পাপড়ি রহমান
নব্বই দশকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন কথাশিল্পী। এ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। কথাসাহিত্যে কাজের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনাও। বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা গ্রন্থ ‘ ভাষা শহিদ আবুল বরকত’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর ভিন্নধারার উপন্যাসগুলি প্রকাশ মাত্রই বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) প্রকাশিত হয় মাওলা ব্রাদার্স থেকে। পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আট বছর বিরতির পর বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ (২০১৯)
২০২০ সালে উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ রি-প্রিন্ট হয় কলকাতার বনেদী প্রকাশনা সংস্থা ‘অভিযান’ থেকে।
তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন ২০১০ সালে। কলকাতার ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘সাদ’ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।
সেই সময়টায় বড়দের দেখেছি কেমন যেন একটা দু:শ্চিন্তা, উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। কি হবে, না হবে! আমাদের শিশু মনেও সেটার ছাপ পড়েছে।