শিমুল ফুলের দুনিয়া—১৩
ইচিংবিচিং খেলায় সময় অন্যদের হাত-পা দিয়ে বানানো পিরামিডের তিনফুট উচ্চতা হাইজাম্প করে সহজেই পেরোতে পারি আমি। বা খেলতে পারি ছি-কুতকুত। কিন্তু ইশকুলে বউচি খেলায় দৌড়ে স্লো বলে আমাকেই ‘বুড়ি’ হয়ে ঘরে বসতে হয়। ঘোড়া ও আরোহী খেলায় এজন্যই আমাকে ঘোড়া সেজে হাঁটু ভেঙে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। রানার মতো আমিও ক্রমশ ‘ছোট-হাতি’ হয়ে উঠছি। ‘ছোট-হাতি’ না হবার কোনো কারণ অবশ্য নাই। আম্মা দুধ ঘন করে সর ফেললে সে সর খেতে আমার অত্যন্ত ভালো লাগে। আব্বা অলিম্পিয়া বেকারি থেকে মাখন-পাউরুটি কিনে আনলে সে স্বাদও আমার জিভে লেগে থাকে। বিকেলের নাস্তায় রেগুলার খেতে চাই ঘন-দুধে সুজির ফিরনী। ফানা ধরে আনা সাগরকলার কী অবস্থা হবে আমিই যদি না খাই? হররোজই টিফিন বক্সে থাকে আম্মার করে দেয়া পরোটা আর ডিম।
আমাদের বাসার নারিকেল গাছটা তার শীর্ণ দেহ ঝেড়ে ফেলে সোমত্ত হয়ে উঠছে! আম্মা কয়েকদিন তাকে যত্ন করে করে নিচের ডালগুলি ছেঁটে দিয়েছিল—তাতেই সে এমন সোমত্ত হয়ে উঠল। আম্মা একদিন আমার দিকে তাকিয়ে বলে—
তোমাকে এখন ঠিক এই নারিকেল গাছের মতো সুন্দর দেখায়।
শুনে আমি থমকাই, আম্মা আমাকে সুন্দর বলছে— এর মানে কী?
স্কার্ট পরার জন্য ঘ্যানঘ্যান করেছি বলে আম্মা কৃষ্ণচূড়া ফুলের মতো ‘ছিটকাপড়’ কিনে রেখেছে। [একটা কলার দেয়া শার্ট পরে তার উপরে চিকন ফিতার একটা সেমিজ জাতীয় কামিজকেই আমরা স্কার্ট বুঝতাম। বা উপরে ও নিচের আলাদা আলাদা কাপড়ের যে কোনো কিছুকে]। শাদা শার্টের উপরে ওই কৃষ্ণচূড়া-ফুল-রঙা -স্কার্ট একদিন পরেছি কি পরি নাই— আম্মা বলল
এই স্কার্ট পরে আর ইশকুলে যাওয়া চলবে না।
আম্মার কথা শুনে খুব আহত হয়ে বসে রইলাম। আমার যে জামাটাই সুন্দর সেটাই বাইরে পরার জন্য বারণ আসতে শুরু করল। একদিন কেঁদেকেটে হুলুস্থুল করে ফেললাম। আম্মা বিব্রত হয়ে বলল—
ওই স্কার্ট পইরা তুমি যখন বাসায় দিকে আসতে থাকো, তোমারে দেইখ্যা মনে হয় একটা পদ্মফুল হাঁইট্যা আসতেছে!
আব্বাকে দেখি আগের চাইতেও অনেক বেশি চোখে চোখে রাখছে আমাকে। বার্ষিক পরীক্ষার পর রেজাল্ট আনতে যাব একদিন, দেখি ইশকুল ইউনিফরম টাইট হয়ে শরীরে সেঁটে বসেছে। এত টাইট জামা পরে কীভাবে যাব ভাবছি— আরবী পড়ার সময় মাথায় ঘোমটা টানার ওড়নাটা আম্মা আমার শরীরে ছুঁড়ে দিয়ে বলল—
আপাতত এইটা পইরা ইশকুলে যাও, পরে ভাঁজ করা ওড়না বানাইয়া দিমু। তখন বেল্টের সাথে পইরা যাইও।
একদিন ইশকুলে ব্যাডমিন্টন খেলে বাসায় ফিরেই চমকে গেলাম—আমার শাদা চুড়িদার পায়জামায় ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে! রক্ত এল কীভাবে কিছুই বুঝতে পারছি না। রক্তপাতের উৎস খুঁজে হয়রান হয়ে যাচ্ছি, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছিনা। খানিক বাদে বাদে তুলা দিয়ে মুছে ফেলছি রক্ত, ফের পায়জামায় লেগে যাচ্ছে! এত রক্তপাতে আমি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি—না জানি আবার কি না কি অসুখ বাধিয়ে ফেলেছি! বছর তিনেক আগেই না কাশির সাথে সের কে সের রক্ত গেল! এখন আবার কোথা থেকে কোন অসুখ বাঁধালাম কে জানে? পায়জামা পালটে পালটে স্তুপ করে ফেলেছি— কিন্তু রক্তপাত থামার কোনো নাম-গন্ধ নাই।
আমার এত ঘনঘন বাথরুমে যাওয়া দেখে আম্মা সন্দেহ প্রকাশ করে বলছে—
কি-রে পেট খারাপ হইছে নাকি? এত ঘন ঘন বাথরুমে যাচ্ছিস ক্যান? আর এত পায়জামা ধুইছিস ক্যান?
আমি ভয়ে কিছুই বলি নাই।
ইউনিফরমের শাদা পায়জামায় লেগে থাকা রক্ত সত্যিই ভয়ানক ভয় পাইয়ে দিয়েছে আমায়। কোনো বদ-জ্বীনের নজর পড়াতেই এমন অসুখ হলো কিনা ভেবে মরছি। ফলত বাসার কাউকে বলার সাহস পাচ্ছি না।
সহসা মনে পড়ে গেল, করটিয়াতে থাকার সময় কতদিন একা একা জলাজংলায় ঘুরে বেড়িয়েছি, ছোটফুপুর বিয়ের সময়ও কতদিন আমি শিমুলগাছের তলায় গিয়েছি— তখন কিছু একটা ভজঘট হয়ে থাকবে? আমাদের গ্রামের বাড়ির শিমুলগাছের তলা আমার অত্যন্ত প্রিয় একটা ভ্রমনের জায়গা— ওইখানে নিরবতা ঝিম মেরে শুয়ে থাকে। আর শিমুলফুলের রঙ এতটাই গাঢ়-লাল যে চোখ ফেরানোই মুশকিল। পাপড়িগুলি মখমলের মতো কোমল-পেলব। সকালের ফুলগুলিতে রাতের শিশিরের ফোঁটা ফোঁটা চিহ্ন লেগে থাকে। আর আমাদের বাড়ির ওইদিকটা জংলা মতো বলে তেমন কেউ যায়টায় না। কবে যেন শিমুলগাছের তলা থেকে কিছু মাটি কেটে এনে উঠান ভরাট করা হয়েছিল। ফলে সেখানে একটা বড়সড় গর্ত প্রায় সারাবছরই দাঁত বিজলীয়ে থাকে। বাদলার কালে ওই গর্ত পুকুরের জলের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। গর্ত আর পুকুরের তখন এতটাই ভাব-বনিবনা থাকে যে, তাদের আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না। জলের তোড়ে কিছু সাপখোপ এসেও গর্তের ভেতর আবাস গাড়ে। অবশ্য বছরের বারো মাসই সাপখোপের ভয় থাকে—অত নির্জনে একা একা গেলে। কিন্তু আমার কেন জানি একা একা যেতেই ভালো লাগে। ঝরে পড়া তাজা-ফুলগুলি রোদ্দুরের উত্তাপে ধীরে ধীরে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে যায়। টুকটুকে-লাল ফুলের কঙ্কাল দেখে আমার ভারি মন খারাপ হয়। কালো-কংকাল-শিমুলফুল হাতে নিয়ে আমি আস্তে আস্তে হেঁটে বেড়াই। আমার পায়ের তলায় শুকনো পাতার নুপুর বেজে ওঠে। তখন আমার মনে পড়ে যায়— গত বসন্তে এই শিমুলেরা এন্তার ফুটেছিল। তখন বৃক্ষের শাখেপত্রে আর কোনো রঙ ছিল না, ছিল শুধু আগুন-রঙের-ঢেউ।
এক্ষণে শিমুল গাছের সেই আগুন-রঙের-ঢেউ এসে আমার শাদা পায়জামায় লাগল কীভাবে? আমার মাথার ভেতটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আম্মাকে বলার সাহস আর হয় না, আব্বাকে বলবার ভরসাও তেমন পাইনা। আমার মনে পড়ে যায়, কাশির সংগে রক্তপাতের দিনগুলির কথা! আব্বার কত কষ্ট হয়েছিল আমাকে সারিয়ে তুলতে— কতদিন কত ওষুধ আর পথ্য যে আমায় খেতে হয়েছিল? আমার মনে পড়ে— বিরক্তি ফুটে থাকা আম্মার সেই লালচে মুখমণ্ডল!
আমি আমার এই অজানা-অসুখ নিয়েই পরদিন ইশকুলে যাই। বারংবার বাথরুমে গিয়ে পায়জামা খুলে চেক করি। কিন্তু রক্তপাতের পরিমাণ দেখে ফের আমি ভয়ার্ত হয়ে উঠি। অর্ধেক-বেলা ছুটির এ্যাপ্লিকেশন দিয়ে বাসায় ফিরে আসি। আমার সব পায়জামা-সালোয়ার ধুয়ে মেলে দেয়া— বদলে ফেলার মতো আর কোনো কাপড় অবশিষ্ট নাই!
আম্মা কয়েকদিনের জ্বরে পাণ্ডুর মুখ নিয়ে খাটে শুয়ে আছে। আমি রাজ্যির ভয় আর সংকোচ নিয়ে আম্মাকে বলি—
আম্মা, আমার আবার একটা মারাত্মক অসুখ হইছে।
আম্মা কিছুটা সন্দেহ আর বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকায়।
জানতে চায়—
কী অসুখ হইছে?
আমি তো জানিনা কী হইছে?
তাইলে বলবি তো কী হইছে?
পায়জামায় খালি রক্ত লাগতেছে। বুঝতে পারতেছি না কই থেকে আসতেছে এত রক্ত?
আম্মা আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলে। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ভাবি আমার এত ভীষণ অসুখে আম্মা হাসছে কেন?
আম্মা বলে—
ও বুঝছি। আমি গতরাইতে স্বপ্ন দেখছি আমি একটা আন্ডার-ওয়্যার খালি পরতেছি আর খুলতেছি।
আম্মা হাসতে হাসতেই উঠে দাঁড়ায়। আলগোছে দরজা ভেজিয়ে সিটকিনি তুলে দেয়।
আমাকে বলে—
এইগুলা সব মেয়েগো হয়। ডরানের কিচ্ছু নাই।
ধেয়ে-আসা-রক্তস্রোত আয়ত্ত করার কৌশল শিখিয়ে দেয় আম্মা।
এই প্রথম আম্মাকে আমার বন্ধু মনে হয়। মনে হয়, আম্মা আসলে আমার সে-ই বন্ধু— যে আমাকে আমার সমূহ-বিপদ থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে।
পরেরদিন আমি ইশকুল কামাই দেই।
তার পরের দিন ইশকুলে গিয়ে দুই-একজন কাছের বন্ধুর কাছে ব্যাপারটা জানতে চাই। তারা হাসতে হাসতে আমাকে জানায়— ইতোমধ্যেই তারা এই বিষয়টা জানে। এবং অনেকেই প্র্যাক্টিক্যাল অভিজ্ঞতার মাঝে দিয়ে গিয়েছে। শুনে আমি অবাক হয়ে ভাবি— সকলেই কতকিছুই না জানে আর বুঝে? আমি রামভোঁদাই, এই পৃথিবীতে হঠাৎ আসা এক এলিয়েনের মতোই রয়ে গেলাম!
পাপড়ি রহমান
নব্বই দশকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন কথাশিল্পী। এ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। কথাসাহিত্যে কাজের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনাও। বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা গ্রন্থ ‘ ভাষা শহিদ আবুল বরকত’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর ভিন্নধারার উপন্যাসগুলি প্রকাশ মাত্রই বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) প্রকাশিত হয় মাওলা ব্রাদার্স থেকে। পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আট বছর বিরতির পর বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ (২০১৯)
২০২০ সালে উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ রি-প্রিন্ট হয় কলকাতার বনেদী প্রকাশনা সংস্থা ‘অভিযান’ থেকে।
তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন ২০১০ সালে। কলকাতার ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘সাদ’ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।