আমাদের আবাসিক ভবনের ফটক থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরুলেই মাঝারি মাপের একটি উদ্যান। বেশ বড় বড় বার্চ গাছ দু’সারিতে। মাঝে মাঝে অনেকগুলো ম্যাপল গাছ। বার্চ আর ম্যাপল মিলে ঢেকে দিয়েছে পুরো উদ্যানটা। উদ্যানে ঢোকার মুখেই বাঁ-হাতি একটা মানুষ সমান ঝোপ। ওটার পাশ দিয়েই প্রতিদিন যাই আমাদের দ্বীপের লাল বাসটি ধরার জন্য। ঝোপটি ধর্তব্য কিছু নয়, চোখেও পড়ে না তেমন – বৈশিষ্ট্যহীন একটি বুনোঝাড় মাত্র।
কিন্তু এতদিনের চেনা নামহীন বুনোঝাড়টি দৃষ্টি কাড়ল ক’সপ্তাহ আগে। তেমন কিছু নয়— চোখে পড়ল ঝাড়টির একটি শুকনো ডালে একটি সুতো বাঁধা। ঠিক সুতো বলা চলে না, আসলে দেড় হাতি গোলাপি রঙ্গের একটি উলের টুকরো। বুঝলাম না কেমন করে এবং কেন এলো ওখানে। কেউ তো বেঁধেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু কেন? ঝাড়ে বাঁধা উলের টুকরোটির অন্য প্রান্তে কি কিছু ছিল? নাকি কেউ কোন অভীষ্ট লক্ষ্যের জন্য ওটা বেঁধেছে?
তা যে কারণে বা যে ভাবেই উলটা ওখানে আসুক না কেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে ওটা বেশ দ্রষ্টব্য হয়েই উঠল আমার চোখে। বাতাস এলেই সুতোটি ‘মায়াবী পর্দার’ মতো দুলে ওঠে, পাশ দিয়ে যেতে আস্তে চোখে মুখেও এসে লাগে – যেন কোন কিছু একটা বলতে চায়। ‘কি কথা তাহার, কে জানে?’
রহস্যটা শুরু হল সুতোটি দেখার দু’সপ্তাহ পরের থেকে। একদিন সকালে হঠাৎ দেখি গোলাপি সুতোটার সঙ্গে একটি মাঝারি আকারের হলুদ বেলুন বাঁধা। কি আশ্চর্য! বেলুন কোথা থেকে এবং কেমন করে এলো? কে বেঁধে দিল এবং কেন? বেলুনে বাঁধা পড়ার পর মনে হল যে এবারে এ সুতো আর এখানে থাকবে না। আমি নিশ্চিত যে এরমধ্যে কোন একদিন বেলুনটি কোন একটি শিশুর নজরে পড়বে, সে ওটা হস্তগত করার জন্য জেদ ধরবে এবং শেষ পর্যন্ত তার মা-বাবা শিশুটির জেদের কাছে নতি স্বীকার করে বেলুনসহ উলটিকে শিশুর হাতে ধরিয়ে দেবেন। ব্যস, সুতোর ইতিহাস শেষ হয়ে যাবে।
উঁহু, তা’ হল না। আমার প্রত্যাশার মুখে ছাই দিয়ে সুতোসহ বেলুনটি যথাস্থানে বহাল রইল – কেউ সেটা খুলেও নিলো না, কেউ বেলুনটির ক্ষতিও করল না। ‘আমাদের প্রাণের পতাকা’- ‘আসাদের শার্টের’ মতো সুতো সহ বেলুনটি তার ওড়া অব্যাহত রাখল। ঝোপটার পাশ দিয়ে গেলে নির্ঘাত মাথায় বা মুখে লাগে – মাঝে মাঝেই হয়, এড়ানো যায় না।
ঘটনা মোড় নিলো তার পরের সপ্তাহে। এক বিকেলে বাড়ী ফেরার সময়ে সুতো বাঁধা বেলুনটির দিকে চোখ গেল। দেখি কি, বেলুনটির ওপরে কালো কালিতে একটি কিশোর আর একটি কিশোরীর মুখ আঁকা। অবশ্য কোনটা যে ছেলে আর কোনটা যে মেয়ে তা এই বিমূর্ত চিত্রকরের কাজে বোঝা যাচ্ছিল না। তবে মজার ব্যাপার হল, ঠিক ছবির নীচে লেখা কার্লা + টম। আহা, এতদিনে বোঝা গেল যে পুরো বিষয়টি একটি প্রেমের ব্যাপার। ‘প্রেমেরও ফাঁদ পাতা ভুবনে’ , আর তার মাঝেই ধরা পড়েছে সুতো, বেলুন, কার্লা ও টম। বাঁচা গেল।
সুতোর কথায় তিনটে কথা মনে হল। প্রথমত: সুতো কথাটির কতরকম প্রয়োগ যে আমরা করি। কখনো কখনো যখন বলি, ‘দ্যাখো, সুতো টেনো না, তখন অন্তর্নিহিত বক্তব্যটি থাকে যে, ‘ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা কোর না’। আবার যখন উচ্চারণ করি ‘সুতো গোটাও’, তখন বলতে চাই, ‘কাজ গুছিয়ে নিয়ে আসো’। ‘সুতো ছাড়’ মানে ‘পেটের কথা বার করো’। আমাদের কালে বন্ধু বা সতীর্থরা অন্য বন্ধু বা সতীর্থদের যখন বলত, ‘কি রে সুতো বাঁধতে যাচ্ছিস?’, তখন অবধারিতভাবে জানতাম যে যার সঙ্গে ভাব আছে তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। আসলে সহপাঠিনীদেরকেই এ কথাটা বেশী ব্যবহার করতে দেখেছি।
দ্বিতীয়ত: ঘনাদা’কে নিয়ে প্রেমেন মিত্রের একটি বিখ্যাত গল্পের নাম ‘সুতো’। একটুকরো সুতোকে নিয়ে কেমন করে অমন একটা ঘন গল্প লেখা যায়, সে প্রেমেন মিত্তির না পড়লে বোঝা যাবে না। একখণ্ড ছোট্ট সুতো নিয়ে রহস্য সৃষ্টি করে মেসের অন্যসব সদস্যদের ঘনাদা’ কেমন করে বোকা বানিয়েছিলেন, তারই আখ্যান গল্পটি এখনও ভুলিনি।
তৃতীয়ত: কত মন্দিরে, গির্জায়, দরগায় মানুষকে সুতো বাঁধতে দেখেছি – ছোট সুতো, বড় সুতো, সাদা সুতো, রঙ্গিন সুতো, মোটা সুতো চিকন সুতো। ফতেহপুর সিক্রিতে সেলিম চিশতীর মাজারের বাইরের চিক সুতোয় সুতোয় ভরে গেছে দেখেছি। জেনেছি, ঈপ্সিত কোন অভীষ্টা নিয়ে সুতো বাঁধতে হয়, তা অর্জিত হয়ে গেলে সুতো খুলে দিতে হয়। সুতো বাঁধতে অনেককে দেখেছি, খুলতে কাউকেই দেখিনি -হয়তো আমার চোখে পড়েনি। কে জানে?
গত পরশু যখন বাড়ী থেকে বেরুই, ঝোপটার দিকে তাকিয়ে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। মনটা কেমন যেন করে উঠল। বেলুনটাকে কেউ ফুটো করে চুপসে দিয়েছে। ওই চোপসানো বেলুনেও দেখা যায়, কার্লা আর টমের নাম দুটোতে কাট্টি দেয়া, এবং গোলাপি উলটি ছেঁড়া অবস্থায় মাটিতে পড়ে।
আমার কেমন যেন মায়া লাগল। আমি ঐ সুতোটা তোলার জন্য যেই নিচু হয়েছি, তখনই পেছনে একটি কিশোরী কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘তুলবেন না। টম কার্লাকে ছেড়ে চলে গেছে’। চমকে তাকিয়ে দেখি সোনালী চুলের বাদামী চোখের ১৪/১৫ বছরের ভারী মিষ্টি একটি মেয়ে।
ঐ কথাটি বলার সময়ে মেয়েটির গলা কি বুজে আসছিলো আবেগে? কিংবা ওর চোখ দু’টো কি ভেজা মনে হল না? না কি এসবই আমার কল্পনা? ‘তুমি, তুমিই কি কার্লা’? জিজ্ঞেস করলাম আমি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। মেয়েটি দ্রুতপদে আমাকে পেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়েছে। দালানের আড়ালে ওর নীল স্কার্টের আভাসটুকু শুধু দেখা যাচ্ছিল।
নাহ, মেয়েটিকে আর ধরা যাবে না, জানাও যাবে না ব্যাপারটি। তা’ কি আর করা যাবে? পৃথিবীতে সবাইকে কি ধরা যায়, না সবকিছু জানা যায়? এটা ভাবতে ভাবতে আমিও পা বাড়ালাম সামনের দিকে। পেছনে মাটিতে পড়ে রইল শুধু এক টুকরো সুতো।
সেলিম জাহান
ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.
A nice short story, full of expectations, trepidation’s and sadness. But it portrays life and love in its purest and truest form. Thank you, Selim.
মুক্তগদ্য বলা হলেও, ছোটগল্পের মজা এর পরতে পরতে! মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা!