জন্মদিনের খাওয়া
আজ মৃদুর সপ্তম জন্মদিন। শহরের সবচেয়ে বড় কমিউনিটি হলটি ভাড়া করে জন্মদিনের পার্টি হচ্ছে। পরিচিত যত মানুষ আছে সব্বাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। মৃদুর বাবা মা আয়োজনের চূড়ান্ত করেছেন মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে। তেরো রকমের স্টার্টার। পঁচিশ রকমের মেইন ডিস। পান্না কোটা, বেনফি পাই, কেক, রসগোল্লা, পায়েস, জিলাপি, ট্রাইফল আরো কত রকমের মিষ্টান্ন! একের পর এক খাবার চলে আসছে সামনে। লোকজন খেয়ে শেষ করতে পারছে না।
“ভাবী, এতো সব রান্না আপনি কখন করলেন?”
“ভাবী, আপনার এতো গুন! আপনার কাছে থেকে ট্রেনিং নিতে হবে।”
“আরে, বোরহানিটা একদম বাংলাদেশের বিয়ে বাড়ির বোরহানির মতো হয়েছে। সেই দেশ থেকে আসার পর এই প্রথম খেলাম।”
“ইস ছানার জিলিপি! ভাই বানিয়েছে? অবিশ্বাস্য।”
“ভাই, আপনারা দুজন একেবারে পারফেক্ট জুটি।”
“ভাবী, পোলাওতে যে ঘি দিয়েছেন সেটি নাকি আপনি ঘরে তৈরি করছেন? আমাকে ঘি বানানো শিখবেন প্লিজ!”
“জানো তৃণা, তিনতলা এই কেকটি ভাবী নিজেই বানিয়েছেন। সো সফট এন্ড ক্রিমি।”
“ভাই, আপনার হাতের রান্না সারাজীবন মনে থাকবে। আপনার হাতদুটি সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা দরকার।”
“ওরে ভাই আপনারা যে আয়োজন করেছেন মনে হচ্ছে মেয়ের বিয়ের খানা খাওয়াচ্ছেন। খুব ভালো। খুব ভালো।”
বড়দের এইসব আড্ডা আলোচনার মধ্যে কেউ কেউ চেয়ারে বসে তাদের ছোট বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন। একজন মা চকোলেট আর ভ্যানিলার লেয়ার করা কেকের একটি টুকরো তার তিন বছরের বাচ্চার মুখের সামনে নিয়ে খুব জোরাজোরি করছে, “একটু খাও। কত্তো মজার কেক দেখো। আন্টি নিজের হাতে বানিয়েছে।”
বাচ্চাটি কিছুতেই কেক খাবে না। তার কেক পছন্দ না। সে বারবার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
বাচ্চার পাশে বসে খুব মন দিয়ে তাদেরকে দেখছিল জন্মদিনের বালিকা মৃদুলা। ফিসফিস করে বললো, “আমি খাবো।” দূর থেকে মুখ হা করে আছে সে।
এতো গুণী রাঁধুনি বাবা ও মায়ের মেয়ে মৃদুলা এইসব খাবার কোনোদিন খেয়ে দেখতে পারেনি। জন্মের পর থেকেই তার খুব ফুড এলার্জি। দুধ, ডিম, মাছ, ঘি, বাদাম, পনির সহ আরো অনেক কিছুই খেতে পারে না। কেবল হাতে গোনা দু চারটি খাবার ছাড়া সব কিছুতেই ওর প্রাণনাশের আশংকা। তাই নিজের জন্মদিনের পার্টিতে বসে সে খাচ্ছে মায়ের হাতের রান্না করা জাউ ভাত আর পাতলা মুরগির মাংসের ঝোল।
উপকার
গত দুইদিন রোদ থাকলেও আবহাওয়া খুব ঠান্ডা আর বাতাস ছিল। নিজামী লোকটি খুব অলস হওয়ায় নিজেকে ঘর থেকে বের করতে পারে নাই কিছুতেই গাছের পরিচর্যা করতে। তাই বাগানের একটি গাছেও পানি দেয়া হয় নাই বেশ কয়েকটি দিন।
কাল যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে আমি গাছে পানি দিবই দিবো – মনে মনে এমন সংকল্প করে রাতে ঘুমিয়েছে।
সকালে এগারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন দেখলো আকাশে বাতাসে বৃষ্টির চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না, তখন নিজামী অনেক কষ্টে নিজের সংকল্পের বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
আপেল গাছ, ফুল গাছ, কিছু সবজি গাছ, স্ট্রবেরি বাস্কেট — সবগুলোকে ভালো করে গোছল করলো হুস পাইপের পানি দিয়ে ভুস ভুস করে।
সবচেয়ে বেশি পানি দিলো ফ্লাওয়ার বেডে আর ওয়ালের পাশে বীরবেশে মাথা উঁচু করে থাকা আগাছাগুলোতে। অযত্ন আর অবহেলা যাদের একমাত্র প্রাপ্তি এই জীবনে।
“…… আপনি মহানুভব, দয়ার সাগর… আমাদের মতো জংলী আগাছাকে মাতৃস্নেহের স্বাদ দিয়েছেন…. চির কৃতজ্ঞ রইলাম আমরা আপনার নিকট ….” বলে কেঁদে ফেলেছে হয়তো হোমরা চোমরা ডেনডিলাইনের হলুদ ফুলটি। আর তৃষ্ণার্ত আগাছার গুমসো পাতাগুলো দীর্ঘদিন পর প্রাণভরে ঠান্ডা পানি পান করতে পেরে অনেক দোয়া করলো নিজামীর জন্য।
আগাছায় পানি ঢালতে ঢালতে নিজামী ভাবে, বাগানের এই পাকা রাস্তার আগাছাগুলোতে আরো একবার ভালো মতন পানি ঢালতে হবে, তাহলে গোড়ার মাটি ভিজে নরম হবে ঠিক মতো। এরপর হালকা হাতের একটানেই উঠে আসবে আগাছাগুলো শিকড়সহ। বাগানটাও পরিচ্ছন্ন থাকবে বেশ কিছুদিন।
— সারাংশ
কিছু দান পেলেই আবেগে গলে যাবেন না,
এর প্রতিদান আপনার প্রাণ নাশেরও কারণ হইতে পারে ।
লুনা রাহনুমা
কলেজে পড়ার সময় থেকে লেখা শুরু। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিকীতে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে একটি পাক্ষিক পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন বছর খানেক। তারপর দৈনিক যায়যায়দিনে ছয় মাস কাজ করার পর স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাস আরম্ভ করেন ২০০৬ সাল থেকে। দীর্ঘ বিরতির পর আবারও লিখতে শুরু করেছেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুইটি। “ভালোবেসে এঁকে দিলাম অবহেলার মানচিত্র”(১৯৯৮), “ফু”(২০২০), দুটোই বিশাকা প্রকাশনী, ঢাকা থেকে প্রকাশিত। লেখার শুরু কবিতা দিয়ে হলেও বর্তমানে বেশ কিছু অণুগল্প, গল্প, ও ধারাবাহিক গল্প প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি অনলাইন সাহিত্য ম্যাগাজিনে। কর্মজীবনে তিনি একজন পে-রোল একাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করছেন।