পর্ব ১২
দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড
৪
সাউথ ক্যারোলাইনা
৪
অ্যান্ডারসন আর তাদের সন্তানদের কাছ থেকে বিদায় নেবার কথা ভাবতেই পারে না কোরা।
মিস লুসি জানেন কীভাবে এসব সামলাতে হয়। এ পরিবারের সবাই তাকে ভালোবাসে।
“কোন ভুল হলো?” কোরা জানতে চায়। কোরা জানে গৃহাস্থলির কাজে সে ঠিকমতই মানিয়ে নিয়েছে। বুড়ো আঙুল দিয়ে নিজের পাঞ্জা আর আঙুল ঘসে ঘসে সে দেখল হাত এখনও বেশ নরম আছে তার।
“তা কেন হবে? তুমি খুবই ভাল কাজ কর, বেসি।” মিস লুসি বলে চলেন, “আমরা তোমার কথাই ভেবেছি। আমিই তোমার নাম বলি, আর মিস হ্যান্ডলারও। এই যে এখানে একটা জাদুঘর আছে, সেখানে বিশেষ কাজের একটা মেয়ে দরকার। দেখ, বেসি, এখানে এসে তুমি যত তাড়াতাড়ি সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছ, সব কিছু তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পেরেছ সেটা কিন্তু সবাই পারে না। আমার মনে হয়েছে তুমিই সবচেয়ে উপযুক্ত। তাই আমি তোমার নাম বলি। এটা তোমার জন্য পুরস্কার।”
বারবার আশ^স্ত করার পরও কোরার অস্বস্তি যেন কাটে না। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।
“কিছু বলবে, বেসি?” হাতে কাগজটা মেলিয়ে ধরে মিস লুসি জানতে চান।
সেই রাতের ঘটনার পর দু’দিন কেটে গেছে। কিন্তু কোরার মানসিক স্বস্তি ফেরে নি। সেই মায়ের বুকফাটা আহাজারি বারবার কোরার মনে পড়ে আর সে যেন কেমন হয়ে যায়।
সব শুনে মিস লুসি তাকে সান্তনা দেন। “তুমি গারট্রুডের কথা বলছ? হতভাগা। সবারই খারাপ লেগেছে। কিন্তু এখন সে ভাল। যতদিন পুরো সুস্থ না হচ্ছে ততদিন দরকার মতো সেবাযতœ চলবে।” ব্যাখ্যা করে তিনি আরও বললেন যে, সেখানে তার সেবাযত্নের জন্য সব সময় একজন নার্স রাখা আছে।
“এধরনের সমস্যা মোকাবেলা করার জন্যই ডরমিটরির পিছন দিকে একটা আবাসিক ব্যবস্থা আছে। কারো এ ধরনের মানসিক সমস্যা হলে সেখানে রেখে চিকিৎসা করা হয়। এমন রোগীদের আলাদা রাখাই নিয়ম। চিকিৎসা চলাকালে অন্যদের সাথে তাদের মিশতে দেয়া হয় না। ৪০ নম্বরে রেখে তাদের সব চিকিৎসাই দেয়া হয়।”
“আমি জানতাম না, চল্লিশ নম্বর ইস্পিসাল।” কোরা বলল, “আমি মনে করতাম, ইটা আপনের হব।”
“বুঝিনি।”
কিন্তু কোরা আর কথা বাড়াল না।
“মাত্র ক’দিন ওখানে রাখা হয়… সেরে ওঠা পর্যন্ত। মনে হয় শিগগির সেরে উঠবে। আমরা খুব আশাবাদী।”
কোরা “আশাবাদী” শব্দটার মানে বুঝল না। সে রাতে অন্য মেয়েদের কাছে জানতে চাইল “আশাবাদী” কথাটার মানে। কিন্তু তারা কেউ এমন শব্দ আগে শোনেনি। কোরা ভাবল, শব্দটার মানে হল “চেষ্টা করছি”।
জাদুঘরে যাবার জন্য বেসি এন্ডারসনদের বাড়ি যাবার পথেই হাটল। তারপর কোর্টহাউসের কাছে গিয়ে ডানে মোড় নিল। এখান থেকে চলে যেতে হবে বলে তার মন খারাপ। বাবার সাথে তার কদাচিৎ দেখা হত। তিনি বেশ ভোরেই বেরিয়ে যেতেন। গ্রিফিন থেকে ফিরতেন সবার শেষে। তুলো তাকেও দাসই বানিয়েছে। ডাক্তার ব্যবস্থাপত্র দেবার পর মিসেস এন্ডারসন রোগীদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। লোক নিয়োজিত করার দায়িত্ব তারই। বাচ্চারা বেশ খুশি। মেইজির বয়স দশ বছর। এ বয়সে র্যান্ডেলে কারো আনন্দ বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। আজ হয়ত বেশ হাসিখুসি, তো কাল দুঃখের সীমা থাকে না। এরই মধ্যে গোলামির জিঞ্জিরে বন্দি হয়ে পড়ে। মেইজির বরাত মন্দ। তবে এ বয়সী কোন কালোর জন্য তা রীতিমত ভয়াবহ। এতটুকু বাচ্চা! কোরা খুব অবাক হয়। একদিন তার নিজের বাচ্চারও এমন দশা হতে পারে। কোরা ভেবে অস্থির হয়।
এ পথে যাবার সময় সে অনেকবারই নেচারাল ওয়ান্ডার ভবনটি দেখেছে। কিন্তু সে জানে না চুনাপাথরে তৈরি এ ভবনের ভেতরে কী আছে। একটা গোটা ব্লক জুড়ে আছে বিশাল বাড়িটা। প্রবেশপথে দু’টো তৃষ্ণার্ত সিংহের মূর্তি যেন সামনের পানির ফোয়ারা পাহারা দিচ্ছে। একবার কোরা এর ভেতরে ঢুকেছিল। প্রবেশপথ পেরোতেই পানির শব্দে বাইরের কোলাহল হারিয়ে যায়। তারপরই সে হাজির হয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে।
ভেতরে ঢোকার পর একটা দরজা পেরিয়ে লম্বা ঘরের সারির মধ্য দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আধেক-খোলা দরজা গলিয়ে সে অদ্ভুত সব কান্ডকারখানা দেখে অবাক হয়। একটা মরা মানুষ হাতের সুঁইয়ে সুতো পরাচ্ছে। উজ্জ্বল আলোর নিচে দেখল একটা লোক বড় একখণ্ড হলদে পাথর সরাচ্ছে। আরেকটা ঘরে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা নানা যন্ত্রপাতি। এই প্রথম তার মাইক্রোস্কোপ দেখা। একটা টেবিলের উপর রাখা। যেন একটা কালো রঙের ব্যাঙ। এরপর তাকে পরিচয় দেয়া হল লিভিং হিস্ট্রি জাদুঘরের কিউরেটর মিঃ ফিল্ডের সাথে।
ভালো মতো দেখে নিয়ে তিনি বললেন, “তুমিই পারবে।” বেশ তড়বড় করে কথা বলেন তিনি। তার কথায় দক্ষিণের টান নেই। এই জাদুঘরটা হালনাগাদ উন্নতি করার জন্য মিঃ ফিল্ড তাকে বোস্টন থেকে এনেছেন। “এখানে আসার পর খেয়েদেয়ে বেশ নাদুসনুদুস হয়েছ, অ্যা। ভাল, খুব ভাল। তুমিই পারবে, তুমিই পারবে,” কোরাকে তিনি বেশ উচ্ছ¡াসের সাথেই বললেন।
“এখান থেকেই ঝাড় দি’?” কোরা মিঃ ফিল্ডের কাছে জানতে চায়।
“ঝাড় দেবে? আরে না, না।”
“আগে কখনও এখানে এসেছ?” তারপর কোরাকে এই জাদুঘরের কাজকারবার বুঝিয়ে বললেন তিনি।
“সবে যখন আমেরিকান জাতি গড়ে উঠছে তার ইতিহাস ধরা আছে এখানে। লোকজনদের শিক্ষিত করার বড় কাজ। উত্তর আমেরিকার বুনো গাছপালা, জীবজন্তু, খনিজ সম্পদ সবকিছুর সাথে সবাইকে পরিচিত করার ব্যবস্থা আছে এখানে। এই মাটির নিচে লুকিয়ে আছে কত সম্পদ! সে সবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। কিছু লোক যেখানে জন্মেছে তার বাইরে কখনও যায় নি। রেলরোড যেমন গোটা দেশটাকে চিনতে সাহায্য করে, ঠিক তেমনি এই জাদুঘরে এসে লোকজন জানবে দেশের কোথায় কী আছে। একেবারে ফ্লোরিডা থেকে মেইন পর্যন্ত, ফ্লোরিডা থেকে পশ্চিম তীর পর্যন্ত। কোথায় কেমন লোকজন বাস করে, সেসব। ঠিক তোমার মতই মানুষ, তোমার মতই, বুঝলে?”
কোরার কাজ তিনটে ঘরে। ধূসর রঙের পর্দা দিয়ে ঢাকা বড় বড় কাঁচের জানালাগুলো। পর্দা দিয়েই এক ঘরের সাথে আরেক ঘর আড়াল করা।
পরদিন সব পর্দা সরিয়ে খুলে দেয়া হল জাদুঘর। দর্শনার্থীর ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠল জাদুঘর।
পয়লা ঘর সাজানো হয়েছে ঘোর অন্ধকার আফ্রিকার দৃশ্যাবলি দিয়ে। কাঠের দেয়ালঘেরা, উঁচু খড়ের চালের একটা আফ্রিকান কুটির এ ঘরের প্রধান আকর্ষণ। লোকজনের ভীড়ে ক্লান্ত হলে কোরা এ ঘরের আড়ালে গিয়ে বিশ্রাম নেয়। ওখানে রান্নার লাকড়ি সাজানো। রঙিন লালচে কাঁচ দিয়ে উনুনের আগুন দেখানো হচ্ছে এমন মুন্সিআনায় যে বোঝারই উপায় নেই আসল, না বানানো। পাশে বসার জন্য আখাম্বা কাঠের একটা ছোট বেঞ্চি পাতা। আছে নানা ধরনের হাল-হাতিয়ার, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি। ছাদ থেকে ঝুলানো তারে তিনটা বড় আকারের পাখি। নিজে দেশে আফ্রিকানদের ঘরবাড়ি, আশপাশের পরিবেশ, জীবনযাপন বোঝানোর চেষ্টা। এসব যখন সাজানো হচ্ছিল তখন কোরার মনে পড়ছিল খামারে তাদের সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা। তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল তখন।
অথৈ আটলান্টিক মহাসগরের নির্মল নীল আকাশের নিচে দাসভর্তি একটি জাহাজ রাখা হয়েছে এ ঘরে। একটা ফ্রিগেটের ডেকে মাস্তুলের চারপাশে অনেকগুলো ছোট ছোট ব্যারেল, পাশে দড়ির স্তূপ। আফ্রিকান পোশোকে এই জাহাজের পাশে কোরাকে বেশ মানিয়ে যায়। জাহাজে দেখা যাচ্ছে কেতাদুরস্ত ক্যাপ্টেন আর সারেংদের। দেখা যাচ্ছে, একজন নবিশ আফ্রিকান ছেলেকে টুকটাক কাজ করতে। কোরা তার মাথায় একটা লাল টুপি পরিয়ে দিল। মোমের মূর্তিটা খাঁটি আফ্রিকান ঢঙে বানানো। উঠা-নামার সরুপথে একজন নাবিক হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মোমের মূর্তিটার চোখ, নাক, মুখ, মাথা বিরক্তিকর ঢঙে রাঙানো।
কোরার মন থেকে সন্দেহ যায় না। সত্যিই কি সাগর পথে এমন করে আফ্রিকা থেকে মানুষ ধওে আনা হত? তবে সে যাই হোক, সে কিন্তু এখন এ বিষয়ে একজন গাইড। অনেক কিছুই তাকে বলতে হয় দর্শকদের উদ্দেশে। কোরা নানা সমালোচনা করে কর্তৃপক্ষের সাথে। মিঃ ফিল্ড স্বীকার করেন, আসল জাহাজে এভাবে সুতোকাটা চরকা বাইরে বসানো হয় না। তবে সে যাই হোক, এখানে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তুলো চাষ থেকে কাপড় বোনা দেখানোর জন্য তো আরও অনেক বড় জায়গা দরকার।
ছোট একটা ঘরে জাহাজ বানিয়ে সব কিছু ঠিকঠাক দেখানো বেশ অসম্ভব। তাই নানা আপোস করেই এগুলো সাজানো হয়েছে।
আলনায় রাখা মোটা সুতায় বোনা জামা-কাপড় সত্যিকারের নিগ্রো পোশাক কি না তা নিয়ে মুখে কোরার কোন সমালোচনা নেই। এগুলো দেখে সে লজ্জায় জ্বলে মরে।
মিঃ ফিল্ড তার কাজের জন্য মিস হ্যান্ডেলের স্কুল হাউস থেকে আরও দু’জন মেয়েকে এনেছেন, বেটি আর আইসিস। তারাও কোরার বয়েসী। গড়নও অনেকটা তারই মত। অবসর সময়ে সাজানো পোশাকগুলোর ভাল-মন্দ দিক নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলে। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেবার জন্য মিঃ ফিল্ড দু’দিন সময় দেন তাদের। এটা বেশ ভাল লাগে বেটির। সে বলে যে, সাহেব কখনও দেমাগ দেখান না। আইসিস তেমন কথা বলে না, চুপচাপ থকে। অনেক আগে সে একটা ছোট খামারে ছিল। সেখানে তাকে অনেক কষ্ট করতে হত। প্রায় রাতেই তাকে মালিকের সাথে রাত কাটাতে হত, তার সাথে মদ গিলতে হত, তার লালসার বলি হতে হত। কোরা আগের মত সুন্দর করে সাজানো দোকানের মনোহর দৃশ্য উপভোগ করতে না পারলেও রোজ সন্ধ্যায় হেটে ঘরে ফেরে। তবে এখানে জানালার মনোহর রূপ তাকে আকর্ষণ করে।
প্রতিদিনের দর্শকদের ভিড়ে নিজেদের কাজ বেশ সম্মানজনকই মনে হয়। বাচ্চারা এসে কাঁচে ঘেরা এটা ওটা দেখে, অন্যকে আঙুল তুলে দেখায়। কখনও বা কাঁচে থাবাথুবোও মারে আর আনন্দ করে। কালোদের জামাজুতো দেখে কেউ বা মুখ ভেঙচায়। এখানে সারাদিন প্রায় চুপচাপ এসব দেখা বেশ একঘেয়েমি লাগে। মিঃ ফিল্ড অবশ্য তাদের জন্য একটাই নির্দশনা দিয়েছেন আর তা হল তারা যেন অনেক ক্ষণ বসে না থাকে। তবে এটা নিয়েও তিনি খুব চাপ দেন না।
আমিরুল আলম খান
জন্ম যশোর জেলার ভারতীয় সীমান্তলগ্ন শিববাস গ্রামে ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ১৫ই অগ্রহায়ণ।
পড়েছেন এবং পড়িয়েছেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য। এরপর মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে যুক্ত থেকেছেন। যশোর শিক্ষা বোর্ডে প্রথমে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরে চেয়ারম্যান ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি অপেশাদার সাংবাদিকতায় যুক্ত গত পাঁচ দশক ধরে। ইংরেজি দৈনিকে নিউ নেশান-এ প্রায় এক দশক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলো, সমকাল, বণিক বার্তায় কলাম লেখেন।
গ্রামীণ পাঠাগার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশে গ্রামোন্নয়নের নতুন মডেল ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম গণপাঠাগার যশোর পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
শিক্ষা, ভাষা, প্রকৃতি, কৃষি, বাস্তুসংস্থানবিদ্যায় আগ্রহী। এসব নিয়েই তার বই: বাঙলার ফল, অরণ্যের পদাবলী, পারুলের সন্ধানে, কপোতাক্ষ-মধুমতীর তীর থেকে, বিপর্যস্ত ভৈরব অববাহিকা, পারুল বিতর্ক, বাংলাদেশের শিক্ষার স্বরূপ সন্ধান এবং বিদ্যাবাণিজ্যের রাজনৈতিক-অর্থনীতি।
তাঁর অনুবাদগ্রন্থ: আফ্রিকান-আমেরিকান উপন্যাস দি স্লেভ গার্ল। হ্যারিয়েট অ্যান জেকব রচিত এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসটি বোস্টন থেকে প্রকাশিত হয় ইনসিডেন্টস ইন দ্য লাইফ অব এ স্লেভ গার্ল শিরোনামে, ১৮৬১ সালে।