শিশু
তবু তোমার স্তন থেকে ছেড়ে দাও
নিরুপম এই যমুনা নদী
ছেড়ে দাও শিশুবিকাশের দিকে
যারা সূর্যের নিচে আবারো
হাততালি দেয় তোমাকে স্মরণ করে
মনে হয় কত স্বার্থপর ওরা
তুমি হাসো স্বপ্নে একবার
আরেকবার চোখ মেলে
স্বপ্ন ও কান্নার সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে
তুমি ভাবো অপার পাড়ের কথা
ভাবো কেন এমন অসহনীয়
জীবনের এই ভার
সন্তানের ভেতর নিজেকে দেখতে পেয়ে
কাঁপো একবার ফের ভাবো একবার
সব পুনরাবৃত্তিময়
পুনরাবৃত্তিবিহীন এক পৃথিবীতে
ভাবো ডিমের কুসুমও চায়
উজ্জ্বল রক্তঘূর্ণি সবুজবিস্ফোরণ
শুক্রাণুর নক্ষত্র-ত্রাণ ও প্রিয় উল্কাপাত
এর বেশি কিছু হয়তো তুমিও চাওনি
তবু জেনেছ চির-অসহনীয় এক পাহাড়
আর নিরুপম এই যমুনা নদী
পোকাখাওয়া স্বপ্নের স্তূপে
আমার সমস্ত ডাল শুধু ফুল নয়, পত্রশূন্যও হয়ে এলো তরুণ দুপুরেই!
তবু আমি কখনো লিখতে চাই না সাতরঙা এক ফুলের গভীর থেকেই
চিরকাল উঠে আসে এই অনুপম ব্যর্থতা।
আর এই ব্যর্থতাই শাশ্বত আমি কখনো তা স্বীকার করতে চাই না।
আমিও টের পাই নিজের রূপের ওপর ঠিকঠাক বিশ্বাস নেই
এমনকি সবচেয়ে অপরূপ ফুলেরও।
কাঁটার রাজধানীতে দেখি ওদের রূপ আশা ও হতাশায় কত কম্পমান।
অস্তিত্বের এ গভীর বেদনা দেখি কী রঙিন করে রেখেছে চারপাশ। এমনকি
মরুভূমিতেও দেখি কঙ্কালসার কত গাছের ফুলের পিপাসা মরে না।
প্রতিটি পাতা কাঁটায় রূপ নিলেও ওই দুঃখভরা ফণিমনসাকে
দেখি ধু-ধু রোদের সমুদ্রে রূপসী নারীর মতোই একদিন
কানে কানে পরে নেয় বিন্দু বিন্দু ফুল তারপর
বারোহাত শাড়ির মতোই কাঁটা আর ফুল সে জড়িয়ে নেয় সবুজ শরীরজুড়ে।
আপন রক্তের ভেতর বানিয়ে তোলা অগণন রঙিনমুক্তোবিন্দুগুলো
কোন অপরাজেয় স্বপ্নের স্বাক্ষর লিখে চলে
এমন অন্তহীন মরুপৃষ্ঠায়? দেখি সূর্যের বালির এই সাম্রাজ্য অস্বীকারের
কী অদ্ভুত আস্পর্ধা ওদের মেঘের জলের অভাব তুচ্ছ করার
কী অদ্ভুত এক অহংকার ওদের
পৃথিবীর সমস্ত মরুর বিরুদ্ধে দেখি নীরবে হাততালি দিচ্ছে ওরা
আমি এসব দেখি আর নিজেকে সান্ত্বনা দিই। আমি কি তা-ই
কাঁটার পোশাকে দাঁড়িয়ে
আমার অতলে কোনো পুষ্প-সম্ভাবনার প্রতি বিশ্বাস রেখে যাব
বোকার মতো আরো অনেকদিন পোকাখাওয়া স্বপ্নের স্তূপে পড়ে থেকে
কত ভুল গান গাই অনিচ্ছায় আর শুনি বন্ধুরা
জ্ঞানী বলে আমাকে ভেংচায় এই নাকি অনুপম পুরস্কার আমার!
মাঝে মাঝে ভাবি, এই নিখিল সবুজনরকে, বিরাট স্ববিরোধ আছে হয়তো
আমাদের স্বভাবে, বন্ধুত্বে, এমনকি প্রেমেও
সাতরংফুলের গভীরে গিয়েও দেখি সেই একই শিকারি স্বভাব
দেখি অস্তিত্ব কীভাবে প্রেমকে অনিবার্য করে তুলে ফের হত্যা করে চলে!
জল
যেদিকে তাকাই আদিগন্ত জল আর জল। কোথাও কোনো ঘরবাড়ি নেই। জলের ওপর স্থির হয়ে আছে চির-দূরের আকাশ। ওই নির্বিকার নীল। ঠিক মাঝখানেই দাঁড়িয়ে আব্বা আর আমি। জলের এই পাথার আব্বার কোমর আর আমার বুক পার হচ্ছে এখন। আমি হাত উঁচিয়ে আব্বাকে দেখাই, কত দূরে ভেসে যাচ্ছে বইগুলো। আমার মুখের দিকে চাইলেন একবার, তারপর তিনি তাকিয়ে রইলেন দূরের বইগুলোর দিকে। কী হতাশ আর মায়াময় দৃষ্টি তার। পলক পড়ে না। ‘কী ঘটছে, আব্বা, কী ঘটছে এসব!’ আমার চোখেমুখে এমন প্রশ্ন আর বিস্ময়। আব্বা দেখতে লাগলেন, দূরে আরো দূরে ভেসে যাচ্ছে পার্থিব ও অপার্থিব বইগুলো।
জল উঁচু হতে হতে আব্বার বুক আর আমার কাঁধ ছুঁই ছুঁই করছে এখন। দেখতে পাচ্ছি না আর বইগুলো। আব্বা কি দেখতে পাচ্ছেন? দিগন্ত পার হয়ে কে জানে কত দূরে চলে গেছে ওরা! আর ঘণ্টার কাঁটার মতো শান্তসন্ত এই জল হয়তো এবার আমার নাক আর আব্বার কাঁধ পার হয়ে যাবে!
যদি দেখতে পেতাম, জলের বুকে প্রশ্নের অগণন ঢেউ উঠছে আজ কেন কেন এভাবে ডুবতে হচ্ছে আমাদের! যদি দেখতে পেতাম, হাওয়ার শিশুরা জন্ম নিচ্ছে অবিরাম। নির্বিকার আকাশকে ফুটতে দিচ্ছে না আর!
বাঁধাকপি
বাঁধাকপির মতোন নিজের মাঝে লুকিয়ে থেকে বলো তো কী লাভ! ফুটব না ফুটব না এই ব্যাকুলতা বুকে লুকিয়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীর ন্যায় তারও দেহ দেখো কেমন ফুলে ওঠে, নিজের অজান্তেই, আর পাশেই ফুটে থাকা ফুলকপি তা দেখে হাসে। সে ফুটেছে অনেক আগেই!
ফুলকপি জানত, জগতে গোপনীয়তা বলে কিছু নেই। বাঁধাকপি জেনেছে ঠেকে, কিন্তু ততদিনে পুরোই ভুলেছে ফোটার কৌশল। বিশাল চাঁদ পড়ে থাকে মাঠে, তারও প্রস্ফুটন দেখবে বলে, আর সে দেখে, বাঁধাকপি কী প্রবল নিজের বিরুদ্ধে, অসংখ্য পাতাদের অনির্বাণ-কল্লোল, নিজের বিকাশের বিরুদ্ধে, হায়, কেবলি জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
বাঁধাকপি এক অপূর্ব অভিশাপ, এক অন্তঃমুখী দর্শন, ভদ্রবধিরতা, এক সবুজ ব্যর্থতা, এক সক্রেটিস বিদ্যার কুফল, এক নিদারুণ ব্যর্থ-বুদ্ধ। আত্মনং বিদ্ধি’র মাতলামো, চাঁদেরও মুখ দেখতে ভুলে গেছে যে!
কিংবা আছে তার কুরুক্ষেত্র-স্মৃতি, কিংবা শুনছে স্যাটেলাইটযুদ্ধ, বোমাফাটা শব্দ! সেঁধিয়ে গেছে নিজের ভেতর আরো, চোখ গেছে নিজেরই ভেতরে বেঁকে। আহ সবুজ-অন্ধচোখ, সত্যি করে বলো তো, বংশ পরম্পরায় বাধ্য, না ভীতু হয়ে এমন হলে তুমি! বাঁধাকপি তবু তুমি নির্বাণ নও, বরং এক সবুজ-গর্জন, ভোরবেলা শিশিরে সূর্যের।
বাঁধাকপি, অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে, ঠিকই সূর্য ওঠে রোজ। আরো অনেকের সাথে দেখো সুধীন্দ্রনাথও তোমাকে ডাকছে সহযোদ্ধা হিসেবে। হে অনির্বাণ-সবুজ, জন্মান্তরও মুক্তি দেবে না তোমাকে। চোখ-বোজা দর্শন বাহিরে তাকাও এবার, অন্তত একবার দেখো জগৎটাকে। দেখো, ফুলকপির সাথে একই ঋতুতে কাটা হচ্ছে তোমাকেও, আর চোখ বুজেই হাটে যাচ্ছ তুমি!
রথো রাফি
জন্ম ৩১ মার্চ, ১৯৭৫; দক্ষিণ তারুয়া, আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বিএসসি অনার্স, রসায়ন। পেশায় সাংবাদিক। প্রকাশিত কবিতার বই: অক্ষর ও বালির পৃথিবী।
ই-মেইল : [email protected]