ইনকগনিটো
সবাই সতর্ক খেলছে। চেস, ট্র্যাাম্পকার্ড, হাউজির খেলা।
ছায়ার অন্তর্গত ভিন্ন ছায়াবাজির খেল;
ইন্দ্রজাল আর ছদ্মবেশের চৌকাঠে
পা আটকে যাচ্ছে বারবার।
হয়তো—
তোমার পিংক বাথটাবের কানাভর্তি স্বচ্ছতার
আড়ালে আছে কোন প্রাণঘাতী দাহক;
উপুড় অডিকোলনের শিশি ঢাললেই
রুদ্ধ হবেনা তার জ্বলনস্বভাব।
বিপরীতে—
গায়ে ভীতিকর রোঁয়া ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে
ভয় দেখাচ্ছে যে হতকুৎসিত শুঁয়াপোকা;
সে-ও একদিন ঠিক মধুবর্ণী প্রজাপতি হবে।
কোনটা যে কার আসল রূপ!
কে যে কোন আড়ালে লুকোনো!
কখনওবা আবরণও মনোহর
চরকির ফ্যাঁকাসে কাগজে
চড়ারঙের প্রলেপ মাখানো ঘূর্ণনে বুঁদ হয়ে থাকি।
একটি গাঢ়রাত যখন তিমিরাশ্রয়ী আরেকটা রাতকে
আবরণ খুলতে বলে;
অন্যরাত অবজ্ঞায় পাশ ফিরে শোয়।
যেন সে বধির। যেন সে স্পর্শস্পন্দনহীন।
দেয়াল এঁকে যাচ্ছে ঝড়মন্দ্র বাতাসের করতাল
ফুটে ওঠে একটা হাঙ্গরভয়ের ছায়া
ঝরে যাচ্ছে সব আচ্ছাদন…
আড়াল ভালোবাসি আমিও তো।
দুই হাতের ফাঁক
এরিনার ভেতর
একজন নবিশ গ্ল্যাডিয়েটরকে ঠেলে দিলে
সেও একবার ঘুরে দাঁড়ায় প্রাণের তাগিদে।
বিস্তর ভুলভ্রান্তি ফাঁকিজুঁকি ভরা বাল্যশিক্ষার সিলেবাস।
রূপকথার ঠাসবুনট ভরা শৈশব
দাদীমার মনোহর গাঁথা ; খরাহীন, জরাহীন
শুধু স্বপ্নের বাড়বাড়ন্ত গোলাঘর ভরা। শেখায়নি জীবন।
কেউ বলেনি
অনাগতঅরোধী এক রণক্ষেত্রের কথা।
হয়তো
উড়ন্ত ফড়িঙের লেজে সুতো বেঁধে দিলে
তার আকাশ সীমিত হয়ে যায় ভেবে।
মোড় ঘুরতে ঘুরতে সব পথই বাঁকা
অনায়াস উদ্যানের কোন মহাসড়ক নেই।
কোন পরাভব নয় ।
নুড়ি-কাঁকর বিছানো পথে টলোমলো পা ফেলতে ফেলতে
এক বৈরি মহাকালকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানোতে কোন বিভ্রান্তি ছিলো না।
শুধু
ঘুমের বিছানায় মাঝেমাঝে মনে হয়
দুই হাতের মাঝখানে এতোখানি ফাঁক হলো কবে!
দ্বিধান্বিত
আগুন এবং স্বর্ণবিভ্রমের দোদুল্যমানতায়
পার হচ্ছি এক আজব-ধ্রুপদ মহাকাল।
প্রতিটি আগুন আমি সোনা ভেবে স্পর্শ করেছি
আর হাতের দগদগে ক্ষত লুকিয়েছি গোলাপমোড়কে।
দ্বিধা;
হাপরের কঠিন তাপতরঙ্গে পুড়ছে যে ধাতুভাগ
সে কী স্বর্ণপিণ্ড হবে? না কী লৌহজঞ্জাল?
আগুনের অবশেষ
ড্যান্সহলে অগ্নিহোত্রী। তবলচী বৈশ্বানর।
কী করে ছড়ালো পাখির চোখ ঝলসানো এতোটা দাহক?
পুড়ল প্রজাপতিডানা। পেখমের ভাঁজ খুলে দূরান্তে পালালে ময়ূর।
দাবানল থেমে যাবে ঠিক। তার আগে
পাতা পুড়বে। বুনোফলফুল।
বৃক্ষপল্লবাদি কাঠকয়লা হবে।
আরো বহুক্ষণ
বনপোড়ানো রণভেরীর হুহুংকার শোনা যাবে।
ধীরে ধীরে স্তিমিত হবে আগুনের লেলিহান জিভ
বাতাসের হোসপাইপ ধুয়ে নেবে সব জঞ্জালধোঁয়া।
অবশেষ থাকবে
কিছু গাছের কংকাল
বহুদিন উড়বে কিছু ছাই।
যাবার সময় হলে
কোথাও যাবার কথা হলেই আমার ট্রেনের কথা মনে হয়
এবং টিকেট চেকারের বিষাদমগ্ন আঙ্গুলে ধরা টিকেটের কথা।
এক কামরাভরা যাত্রী,
সদ্য স্বজন ফেলে আসা বিরহব্যথা;
ইঞ্জিনের ঝিক ঝিক ঝিক বাজনার মন আনচান করা কোরাসে
সম্মিলিত বিষণ্ণ ব্যথা বেজে ওঠে।
পূর্বতন ভ্রমণের নস্টালজিক স্মৃতিমন্থনের সাথে দুলতে দুলতে
আমরা এক নিরূপিত গন্তব্যের দিকে ছুটে যাই।
শেষ হুইসেল বেজে ওঠার সাথে সাথে
আসন্ন একাকীত্বের যন্ত্রণাব্যাকুল প্লাটফরমের
হৃদয়মথিত দীর্ঘশ্বাসের কথা মনে হয়।
নাজনীন খলিল
জন্ম ৬ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে, বাংলাদেশের সিলেটে।
পড়াশুনা সিলেটেই, সরকারী মহিলা কলেজ এবং মুরারীচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ(এমসি কলেজ) থেকে স্নাতক।
লেখালেখির শুরু ৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে। তখন থেকেই রেডিও বাংলাদেশ সিলেটের একজন নিয়মিত কথক, গ্রন্থক এবং উপস্থাপক। সেই সময় থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি সম্পাদনারও কাজ শুরু। সাহিত্য-সংস্কৃতি মাসিক ‘ সমীকরণের’ নির্বাহী-সম্পাদক হিসেবে ১৯৮০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সিলেট থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনধারা নামে একটি পত্রিকার প্রকাশক এবং সম্পাদক ছিলেন। লেখালেখির বিষয়বস্তু মূলতঃ কবিতা এবং কথিকা।
প্রকাশিত কবিতার বই:পাথরের সাঁকো; বিষাদের প্রখর বেলুনগুলো; ভুল দরোজা এবং পুরনো অসুখ; একাত্তর দেখবো বলে(ব্রেইল,যৌথ);গুপ্তপধানুকী অথবা মাংসবিক্রেতা।