পথেঘাটে রোমিওর দল
আমাদের ইশকুলে আসা-যাওয়া, সিনেমা দেখতে বা ছবি তুলতে যাওয়া কিংবা আমাদের উঠতি-বয়স— এইসবের মাঝে আমাদের চলার পথ কেমন ছিল? বা তখনকার পুরুষদের মানসিকতা? উহু, আমাদের চলার-পথ কোনোভাবেই মসৃণ ছিল না। বরং তা ছিল কন্টকাকীর্ণ! নবীজির পথে সেই দুষ্টু-বুড়ির কাঁটা বিছিয়ে রাখা পথের মতো ছিল আমাদের পথ। তবে আমাদের চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো তরুণের-দল। যুবকের-দল। আর উঠতি বয়সী রংবাজেরা। ইভ-টিজিং ছিল অবধারিত। এত আজেবাজে কথা শুনতে হতো যে, আমরা লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতেও পারতাম না ওই অশ্লীল মন্তব্যকারীর দিকে।
আমি আগেই বলেছি, যে-ই আমার পিছু নিত—তাকেই আমার অবধারিতভাবে গুণ্ডাপাণ্ডা মনে হতো। ফলত অইসব গুণ্ডাপাণ্ডাদের সংখ্যা নেহায়েত অল্প ছিলনা। আমার ভয়ংকর লাগত—শাদা-লুঙ্গি আর শার্টের সাথে জুতামোজা পরিহিত পানগুয়া খাওয়া লোকগুলিকে দেখলে। তাদের লালচে দাঁতের উৎকট-হাসি— উফ! মাগো! আজও ভাবলে শিউরে উঠি একেবারে!
লাল বা কালো শার্ট পরিহিত যে কাউকে দেখলেই আমাদের কলিজা শুকিয়ে যেত। আমার মনে হতো, এরকম রঙ যে পরে আর আমার পিছু নেয়, সে নির্ঘাৎ গুণ্ডাষণ্ডা না হয়েই যায় না। এই দুইটা উগ্র রঙ আমাদের ভয়ের রাজ্যে ঠেলে দিত।
কারণ তখন কোনো ভদ্র পরিবারের ছেলেরা এই রঙের কিছু পরবে ভাবাও অসম্ভব ছিল। আর আমার ঘরে ছিল ছোটকা, আমার চাচাতো ভাইয়েরা— তারা ওইরকম রঙের কিছু পরার কথা চিন্তাতেও আনতে পারত না। আমার মতোই তাদের পোষাকও আব্বা-চাচাজান নির্ধারণ করে দিত।
আজ এত বছর বাদে আমি ভেবে অবাক হই, ওই উৎকট সাজসজ্জার লোকগুলি কীভাবে বা কোন সাহসে আমাদের পিছু নিত? নাকি তারা ওরকমই ভাবত, যাকে চাইব তাকেই পাওয়া যাবে? কিংবা আমাদের পুরুষতন্ত্র তাদের ওইভাবেই বড় হতে দিয়েছিল?
আমার অবস্থা ছিল সবচাইতে সঙ্গিন। আমাকে নদী পারাপার হয়ে ওইপারে গিয়ে নিতে হতো রিক্সা। এবং কোনো কোনো রোমিও আমার নৌকার ভাড়া আগেভাগেই দিয়ে রাখত! আমি ৫পয়সা দিতে গেলে মাঝি বলতো যে আমার ভাড়া আগেই দেয়া হয়ে গিয়েছে। আমি মাঝির কথা কানেই নিতাম না। তার বিছিয়ে রাখা চটের উপর ৫পয়সা ফেলে দিয়ে নৌকা থেকে দ্রুত পায়ে নেমে যেতাম। উপদ্রব সেখানেই শেষ হতো তেমন নয়— রিক্সাতেও একই কাণ্ড ঘটত। রিক্সাও রিজার্ভ রাখা হতো আমাদের জন্য। ইশকুলের সামনে নামলে রিক্সাওয়ালা বলত যে, ভাড়া আগেই পরিশোধ করা হয়ে গিয়েছে। এবং আমার দিকে বাড়িয়ে দিত মোটাসোটা কাগজ, কিন্তু আমি জানতাম ওই কাগজ হাতে নিলেই কিছু একটা বিপদ ঘটবে। আমি প্রায় দৌড়ে ইশকুলের গেইট দিয়ে ঢুকে যেতাম। রিক্সাওয়ালার বিকট হাসি কখনও ঘাড় ঘুরিয়েও দেখতাম না। দেখার রুচি হতো না। আমি আরেকটা কান্ড করতাম, কীভাবে যেন টের পেয়ে যেতাম আজ রিক্সাওয়ালার হাত দিয়ে কোনো চিঠি আমার দিকে এগিয়ে আসতে পারে। আমি আমার রিক্সামেটকে তখন বলতাম—
তুমি ভাড়া দিয়ে আসো, আমি দাঁড়াচ্ছি
বলেই গেইটের ভেতর ঢুকে পড়তাম। ইশকুল বাউণ্ডারির ভেতর ঢুকে রিক্সামেটের জন্য অপেক্ষা করতাম। দেখা যেত আমার রিক্সামেট হাতে করে চিঠিটা নিয়ে এসে আমাকে এগিয়ে দিয়ে বলছে—
এই যে, দিলো
আমি রেগে চিৎকার করে উঠতাম।
কেউ কিছু দিলেই তুমি নাও ক্যান? যাও ফেরত দিয়ে আসো, যাও।
আমার রিক্সামেট ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রিক্সাওয়ালাকে চিঠি ফেরত দিতে চাইতো। কিন্তু রিক্সাওয়ালাও পান খাওয়া দাঁত কেলিয়ে বলত—
নিতাম নায়
আমি আরও জোরে চিৎকার করে বলতাম—
বেবি, যাও, যাও এক্ষুণি যাও। গিয়ে ওই চিঠি রাস্তায় ফেলে দিয়া আসো।
বেচারা বেবি তাই করত। আমি জানতাম জালালাবাদ মার্কেটের সামনের জটলার ভীড়ে সেই রোমিও সবকিছুই ঠিক অবজার্ভ করছে। রাগে আমার গা জ্বলে যেত।
এসবের মাঝেই আরও এক বিপদ আমাকে একেবারে বিপর্যস্ত করে ফেলল। এক রোমিও আমার পিছু নিলো তো নিলোই। সে প্রতিদিন খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করত। আমাকে দেখলেই নৌকায় উঠে বসত। আমি তখন ওই নৌকায় আর উঠতাম না। পরের নৌকার জন্য অপেক্ষা করতাম। সে-ও তখন নেমে এসে পরের নৌকার জন্য অপেক্ষা করত। একদিন সে নৌকায় বসে আমার গায়ে পানি ছিটিয়ে দিলো। আমি রেগে চিৎকার করে বললাম—
এই কুত্তার বাচ্চা পানি ছিটাচ্ছিস ক্যান?
সে পানি ছিটানো বন্ধ করে বিষণ্ণ হয়ে বসে রইলো। তার দিকে আমি একদম না তাকিয়ে নৌকা থেকে নেমে গেলাম।
এইসব রোমিওদের বেশিরভাগই আমার নাম উচ্চারণ করতে পারত না। আমাকে ডাকত—
পাফিয়া, ও পাফিয়া
এই নাম শুনেও আমি রাগে ফেটে পড়তাম।
বেয়াদবগুলা, পাপড়ি নামটাও ঠিকমত বলতে পারিস না? আবার চিঠি লিখিস?
ওই রোমিও আমার পিছু ছাড়ছিলই না। আব্বা-আম্মাও টের পেল। কারণ আমাদের বাসার বাইরের বাগানের বেড়ার চারপাশে ঘুরে ঘুরে সে ডাকতে লাগল—
পাফিয়া, পাফিয়া, ও পাফিয়া
আব্বাকে খানিকটা চিন্তিত মনে হলো। যেহেতু এরা রংবাজ টাইপের ছিল, এদের পক্ষে যা কিছু করাই হয়তো সম্ভব ছিল।
ওই রোমিও একদিন ওয়ার্ডের মেম্বার না কি চেয়ারম্যান— না কি জানি হবে, তার হাতেপায়ে ধরে বলল—
আমার সাথে তার প্রেম আছে!
আব্বার সাথে দেখা করে ওই মেম্বার না চেয়ারম্যান একথা বলল। আব্বা বলল—আমার মেয়ের যে ওর সাথে প্রেম তার প্রমাণ কী?
তখন ছেলেটাকে ডাকানো হলো। ওই ছেলে বলল—
পাফিয়া আমারে রুমাল বানাইয়া দিছে
আব্বা রেগে গিয়ে বলল— আমার মেয়ে কোনো সেলাই-ই জানেনা, এমনকি সেলাই শিখতেও সে পছন্দ করে না।
আব্বার কথা সত্যি। আম্মা-চাচিমা-ফুপুদের সেলাইফোড়াই দেখতে দেখতে আমি সেলাইয়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলাম। সুঁইসূতা, কুরুশকাটা, সুতার-গোল্লা দেখলেই আমার গায়ে জ্বর আসত।
আব্বা ওই রোমিওকে ধমক দিয়ে বলল—
মিথ্যা বলার জায়গা পাস না, না? চড় মেরে দাঁত ফেলে দিব।
ছেলেটা নাকি আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল।
আব্বা-আম্মার চিন্তিত মুখ দেখে আমারও মন খারাপ হয়ে যেতে লাগল। ওই রোমিওর জ্বালাতন থেকে বাঁচার জন্য আমি ইশকুল কামাই দিতে লাগলাম।
আব্বা একদিন বলল—
আম্মার সাথে করটিয়া চলে যাও তুমি।
আব্বার কথা শুনে আমার মন আরও খারাপ হতে লাগল। একবার আবেদা খানম গার্লস হাই ইশকুলের বন্ধুদের ফেলে অগ্রগামীতে ভর্তি হয়েছি। এখন এই ৫/৬ বছর ধরে যারা বন্ধু হলো তাদের ফেলে যেতে আমার মন মানবে কেন?
আমি আমার ইশকুলের বন্ধুদের বললে তারাও মন খারাপ করে ফেলল। কিন্তু তাদের আমি বললাম না যে, কেন আমাকে চলে যেতে হতে পারে?
আব্বাও কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। আম্মাকে ফের গ্রামে পাঠিয়ে দিতেও হয়তো আব্বার মন সায় দিচ্ছিল না।
আব্বা-আম্মা দুইজনেই আমাকে একদিন বলল—
তুমি বোরখা পরে ইশকুলে যাওয়া-আসা কর।
শুনে আমি কেঁদেকেটে নাক-চোখ লাল করে ফেললাম। বোরখা পরে মানুষ চলাচল করে কীভাবে? যদিও তখন আমার ক্লাসের দুই কি একজন মেয়েকে আমি বোরখা পরতে দেখেছি।
আমি জোরে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম—
দরকার হলে আমি ইশকুলে যাওয়াই বন্ধ করে দিব। পড়াশুনাই করব না। কিন্তু কিছুতেই আমি বোরখা পরব না।
আমার কান্নাকাটি দেখে আব্বা-আম্মা আর কিছুই বলল না। আমিও কয়েক দিন পরে ইশকুলে যেতে শুরু করলাম। এবং বোরখা না-পরেই।
যাওয়া-আসার পথ থেকে সেই রোমিও ততদিনে উধাও হয়ে গিয়েছে। আমরা যতদিন সিলেটে ছিলাম ওই রোমিওর টিকিটিও আর দেখি নাই।
পাপড়ি রহমান
নব্বই দশকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন কথাশিল্পী। এ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। কথাসাহিত্যে কাজের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনাও। বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা গ্রন্থ ‘ ভাষা শহিদ আবুল বরকত’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর ভিন্নধারার উপন্যাসগুলি প্রকাশ মাত্রই বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) প্রকাশিত হয় মাওলা ব্রাদার্স থেকে। পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আট বছর বিরতির পর বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ (২০১৯)
২০২০ সালে উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ রি-প্রিন্ট হয় কলকাতার বনেদী প্রকাশনা সংস্থা ‘অভিযান’ থেকে।
তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন ২০১০ সালে। কলকাতার ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘সাদ’ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।