নারীর প্রতি সহিংসতা যুগ যুগ ধরে ঘটে আসছে এবং এর বিশাল ইতিহাসও রয়েছে। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে নৃশংস সহিংসতার স্বরূপ ভিন্নতা রাখে। এটি পৃথিবীব্যাপি বিরাজমান একটি ভয়াবহ সমস্যা। সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রতি তিনজন নারীর অন্তত একজনকে মারা হচ্ছে, জোরপূর্বক যৌনক্রিয়া করতে বাধ্য করা হচ্ছে বা অন্য কোনোভাবে তার জীবনে যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে যেখানে নির্যাতনকারী কোনো না কোনোভাবে নারীর পরিচিত কেউ। নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা মূলত ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা, জোরপূর্বক যৌন দাসত্বে বাধ্য করা, এসবের ভুক্তভোগী একমাত্র নারীরাই হয়ে আসছে। শুধু ভুক্তভোগীই নয়, অনেকসময় নারীর প্রতি নির্মম সহিংসতার বশবর্তী হয়ে তাদেরকে হত্যাও করে ফেলছে। ঠিক তারই আলোকে কানাডার ইতিহাসে স্মরণকালের ধর্ষণ এবং গুমের লোমহর্ষক এক কাহিনীর অবতারণা করবো এবং এই ধর্ষণ-গুমের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে রেড ড্রেস অর্থাৎ লাল জামা দিবস কিভাবে সৃষ্টি হলো তারও আলোকপাত করবো।
নব্বই দশকের শেষে কানাডার প্রভিন্স বৃটিশ কলম্বিয়ার হাইওয়ে থেকে যে সব আদিবাসী নারী ও মেয়েরা নিখোঁজ হয়েছিল এবং যারা আর কোনদিন ঘরে ফিরে আসেনি, তখন তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বনের ডালে ডালে উড়ন্ত লাল জামার মিছিল উড়েছিল। কেউ কেউ লাল জামা পরে তাদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল, অনুভব করতে চেয়েছিল তাদের ধর্ষিত হওয়ার রক্তাক্ত যন্ত্রণা। ১০ই অক্টোবর, ২০১৭ এর এই দিনে সারা বৃটিশ কলোম্বিয়া লালে লাল হয়েছিল। এমন যন্ত্রণা কাতর নিরব প্রতিবাদের বিষয়টি যখন জানতে পারলাম তখন বাংলাদেশে একের পর এক পৈশাচিক ধর্ষণ চলছে। তার প্রতিবাদে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনও সোচ্চার হচ্ছে। সেই সাথে বাংলাদেশে একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের কথাও মনে পড়ে গেলো । দেশ এখনো ধর্ষিতার রক্তে রঞ্জিত। ঠিক এমনই এক অনুভূতি থেকে রেড ড্রেস প্রতীকী প্রতিবাদটি আমার ভেতর গভীরভাবে নাড়া দিলো; যা ধর্ষিতার রক্তের প্রতীক, যন্ত্রণার প্রতীক হিসেবে ধরা দিলো এবং সেইসাথে ধর্ষিতার প্রতি সহমর্মি হয়ে আমার একাত্মতা প্রকাশ হলো। ভ্যাঙ্কুভারের মানবাধিকার কর্মী ও কবি নীনা হাসেল প্রতি বছর এ’দিনটির কথা স্মরণ করেন এবং তারই মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হই। পরবর্তীতে গুগুলের আশ্রয় নিয়ে রেড ড্রেস আন্দোলনের বিস্তারিত তথ্য আবিষ্কার করি।
ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে ১৯৭৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে আসছিলো। নারীদের বেশিরভাগই ছিল আদিবাসী। তাদের মধ্যে দরিদ্র কিছু অভিবাসীও ছিল। অধিকাংশ নারীকে হাইওয়ে থেকে তুলে নেয়া হতো। এসমস্ত নারীদের কোনো চিহ্ন বা প্রমাণ না রেখে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে ফেলা হতো। পরবর্তীতে বিসি’র কোকুইটলাম এলাকার একটি শুকরের খামার থেকে গুম হয়ে যাওয়া নারীদের হাড়, খুলির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ঐ সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৬৫ জন নারী ভ্যাঙ্কুভারের ডাউনটাউন ইস্টসাইড থেকে নিখোঁজ হয। তখন নিকটবর্তী বন্দর কোকুইটলামে শুকর খামার পরিচালনাকারী কুখ্যাত রবার্ট পিকটনেরর বিরুদ্ধে ২৬ জন নারীকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। প্রমাণ সাপেক্ষে ছয়টি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। এই হত্যাকাণ্ড কানাডার ইতিহাসের বৃহত্তম সিরিয়াল কিলার তদন্তের দিকে পরিচালিত এবং পিকটনের ফার্ম কানাডার ইতিহাসের বৃহত্তম অপরাধের জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হয়।
রবার্ট উইলিয়াম পিকটন (জন্ম ১৯৪৪) ব্রিটিশ কলম্বিয়ার পোর্ট কোকুইট্লামের একটি পরিবার-পরিচালিত শুকর খামারে বেড়ে ওঠে। পিকটন এবং তার ভাইবোনেরা নগর উন্নয়নের জন্য বেশিরভাগ সম্পত্তি বিক্রি করেছিলো। খামারটি তারা হ্রাস করে ৬.৫ হেক্টর জমিতে নিয়ে আসে। পিকটন ফার্মে তারা ছোট-বড় প্রাণিসম্পদ পরিচালনা করে আসছিল। সে রিয়েল এস্টেটের লেনদেন থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি অংশও পেয়েছিলো। তাছাড়া একটি উদ্ধার সংস্থায় কর্মরত ভাই ডেভিডের অংশীদারও সে ছিলো। পিকটন ছিলো এক সামাজিক কুৎসিত ব্যক্তি, যে নাকি অদ্ভুত আচরণ প্রদর্শন করে লোকের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে অভ্যস্ত ছিলো। সে একজন চূড়ান্ত পর্যায়ের মানসিক বিকারগস্ত বিকৃত রুচি সম্পন্ন মানুষও বটে। খামারের ট্রেলার বাড়িতে পিকটন একাই থাকতো ।
১৯৯৬ সালে, পিকটনের ভাইয়েরা শুকর খামারে ‘গুড টাইমস সোসাইটি’ অর্থাৎ সোস্যাল ক্লাব শুরু করেছিলো। এটি একটি ফেডারেল নিবন্ধিত দাতব্য, যা নাচ এবং অনুষ্ঠানের মতো ইভেন্টের মাধ্যমে পরিসেবা সংস্থাগুলির জন্য তহবিল সংগ্রহের ম্যান্ডেট নিয়েছিল। কিন্তু সেইসময় প্রতিবেশীরা নোংরা আচরণ, মাদকদ্রব্য ব্যবহার, মাতাল হওয়া এবং হট্টগোলের জন্য অভিযোগ করে আসছিল। পার্টিতে ভ্যাঙ্কুভার ডাউনটাউন ইস্টসাইডের বাইকার(বাইসাইকেল চালনাকারী) এবং যৌন ব্যবসায়ী কর্মী সহ প্রায় ১৭০০ জনের মতো লোক যোগ দিতো। তাছাড়া, রবার্ট পিকটন প্রায়ই ডাউনটাউন ইস্টসাইডে আসতো শুকরের বর্জ্য অংশগুলো নিষ্পত্তি করতে। তখন দলে দলে মেয়েদের ঘুরে বেড়ানো দেখতো এবং তাদেরকে অর্থ ও মাদকদ্রব্য সরবরাহ করে লোভ দেখিয়ে প্রায়শই এসমস্ত মেয়েদের পিকটন ফার্মে নিয়ে যেতো। ২০০০ সালে, সিটি অফ পোর্ট কোকুইটলাম শুকরের খামারটি বন্ধ করে দেয়।
ভ্যাঙ্কুভারের ডাউনটাউন ইস্টসাইড পাড়াটি উচ্চহারের দারিদ্রতা, গৃহহীনতা, ড্রাগের খোলাখুলি ব্যবহার এবং দেহব্যবসার জন্য পরিচিত। ১৯৯০ এর শেষদিকে, যৌন বাণিজ্যে কর্মরত ৮০ শতাংশ মেয়ে ও নারী ভ্যাঙ্কুভারের বাইরের দেশ থেকে এসেছিলো। বছরের পর বছর ধরে তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ ছিল না। ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে যৌনকর্মের বিকল্প কাউন্সেলিং অ্যান্ড এডুকেশন (পিএসিই) সোসাইটি কর্তৃক পরিচালিত ১৮৩ জন দেহ ব্যবসায়ী কর্মীদের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এই নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাগুলি প্রায়শই ঘটে আসছিলো। তাদেরকে ডাকাতি কাজে নিয়োজিত করা, মারধর করা এবং অপহরণ ও জোর করে বন্দি রেখে যৌনকাজে লিপ্ত করতে বাধ্য করতো। ‘A gulf between acts of violence suffered and acts of violence reported’ অনুযায়ী জরিপের মাধ্যমে ইঙ্গিত দেয় যে, এসব নারীদের প্রতি পুলিশের এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষের অবহেলা বিশেষভাবে লক্ষনীয় ছিল।
১৯৮৬ সালে, একটি যৌথ অভিযানের জন্য আরসিএমপি ও ভ্যানকুভার পুলিশ বিভাগ Missing Women Task Force গঠন করে নিখোঁজ মহিলাদের একটি তালিকা তৈরি করতে শুরু করে। পিকটনের সাথে সংযুক্ত তালিকার প্রথম দিকের ঘটনাটি ছিল ডায়ানা মেলনিকের, যাকে সর্বশেষ ২২ ডিসেম্বর ১৯৯৫ এ দেখা গিয়েছিল। পিকটনকে মেলনিকের হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। তার সাথে সংযুক্ত তালিকার সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম ঘটনা এবং ছয়টি হত্যার মধ্যে একটি, যেটিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, তিনি হলেন মোনা উইলসন; যাকে সর্বশেষ ২০০১ সালের নভেম্বরে দেখা গিয়েছিল।
পিকটনকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়ী করা ২৬ টি গুমের মধ্যে প্রথম একটি ১৯৯৫ সালে ঘটেছিল; ১৯৯৬ সালে আরো একটি; ১৯৯৭ সালে ছয়টি; ১৯৯৮ সালে চারটি; ১৯৯৯ সালে পাঁচটি; ২০০০ সালে দুটি; এবং ২০০১ সালে সাতটি। এই সময়ের আগে এবং এর পরে অন্যান্য অন্তর্ধানের প্রমাণের অভাবে পিকটনের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ডাউনটাউন ইস্টসাইডে দারিদ্র্য সীমার নীচে জীবনযাপন করা মানুষগুলোর প্রতিবাদ করার সাহস বা অভ্যাস ছিলনা বিধায় অন্তর্ধানগুলি প্রায়শই নজরে পড়েনি। ১৯৮৮ সালে শেরি রেলের নিখোঁজ হওয়ার খবর তিন বছরের জন্য পাওয়া যায়নি। ১৯৮৭ সালে, আরসিএমপি যৌন বাণিজ্য শ্রমিকদের অমীমাংসিত হত্যা এবং নিখোঁজ হওয়া তদন্তের জন্য একটি বিশেষ দল গঠন করে। সীমিত অগ্রগতির কারণে ১৯৮৯ সালে সেটি ভেঙে দেয়া হয়। বছরের পর বছর ধরে গুমের হার বাড়ার সাথে সাথে ডাউনটাউন ইস্টসাইডে সিরিয়াল কিলারের গুজব ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তখন যৌন বাণিজ্য কর্মীরা দলবেঁধে হাঁটা শুরু করে এবং যে গাড়িতে তারা চলাচল করতো সেই গাড়ির নাম্বার টুকে রাখে, যাতে হারানো মেয়েদের খুঁজে পেতে সুবিধা হয়। তবে নিখোঁজ হতেই থাকে।
১৯৯১ সালে, নিখোঁজ নারীদের পরিবার এবং যৌন ব্যবসায়ী কর্মীদের সাথে নারীবাদী সংগঠনগুলো নিহত ও নিখোঁজদের স্মৃতি রক্ষার্থে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’তে পদসভার আয়োজন করে এবং সেইসাথে তারা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের জন্য দাবি জানায়। তবে পুলিশের প্রতিক্রিয়া খুব কম ছিল। ভ্যাঙ্কুভার পুলিশ, কোনো সিরিয়াল কিলার কাজ করছে বলে বা এমনকি নিখোঁজ মহিলা মারা গেছে তা বিবেচনা করতে অস্বীকার করে। পুলিশের কাছে এমন তদন্তের জন্য কেস দেওয়ার মতো কোনো সংস্থাও ছিল না। পুলিশ ধারণা করেছিল এবং তাদের কাছে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়েছিল যে, কিছু মহিলা নিজ ইচ্ছায় সরে গিয়েছিল। আর অন্যরা ড্রাগের ওভারডোজের কারণে মারা গিয়েছিল।
ভ্যাঙ্কুভার সান পত্রিকার বরাতে পুলিশের উদাসীনতার কথা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। যৌন ব্যবসায়ীদের নিয়ে সংঘটিত অপরাধকে পুলিশ কম অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। সাইকোলজিকাল ক্রিমিনাল প্রোফাইলিং এবং জিওপ্রোফাইলিংয়ের মতো নতুন উদীয়মান তদন্তের পদ্ধতি অবলম্বন করতে অনীহা প্রকাশ করে ভ্যানকুভার পুলিশ বিভাগ। মূলত আদিবাসী বলে পুলিশ বিভাগ একরকম অবহেলাই করে। কিন্তু জোরালো সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে কানাডার আদিবাসী নারী ও মেয়েদের নিখোঁজ এবং খুন করার বিষয়টি বিস্তৃত ইস্যুতে কেসটি বিবেচিত হতে থাকলো। তারপরেও ২০১২ সালে এই মামলার তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাদেশিক সরকার এক সিদ্ধান্তে এসেছিল যে, যৌন ব্যবসায়ে নারী ও আদিবাসী মহিলাদের প্রতি পুলিশের অগ্রাহ্যতা এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাকে ‘স্পষ্টত ব্যর্থতা’, সেইসাথে এমন নির্মম ঘটনাগুলোকে ‘মহাকাব্যিক ট্রাজেডি’ বলে আখ্যায়িত করে।
পিকটনকে যেভাবে গ্রেফতার করা হলো- ১৯৯৭ সালে এক মহিলা পিকটনের খামারে গেলে সে মহিলাকে হাতকড়া দিতে চেষ্টা করে৷ তখন মহিলা রান্নাঘর থেকে ছুরি এনে পিকটনকে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকে। একপর্যায়ের ধস্তাধস্তিতে উভয়েই গুরুতর আহত হয়। মহিলা সেখান থেকে পালিয়ে এসে রক্তাক্ত অবস্থায় হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সাহায্য চাইতে থাকে। সেইসময় যাত্রীরা এম্বুলেন্স ডেকে মহিলাটিকে উদ্ধার করে। যখন হাসপাতালে মহিলাটির জরুরি অস্ত্রোপচার চলছিল ঠিক তখন পিকটন একই হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা নিতে আসে৷ পিকটনের পকেটে যে চাবিটি পাওয়া যায় সেই চাবিটি ছিল মহিলার হাতের হাতকড়ার চাবি। পুলিশের কাছে মহিলার জবানবন্দিতে বিষয়টি বুঝতে পেরে পিকটনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে সেই মুহূর্তে ছাড়া পেয়ে যায় এবং মহিলাটিকে ড্রাগ এডিকটেড, হিচকার বলে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯৯ সালের বসন্তে এক তথ্যদাতা ভ্যাঙ্কুভার পুলিশকে জানিয়েছিল, পিকটনের শুকরের কসাইখানায় এক মহিলার দেহ ঝুলতে দেখেছে। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তথ্যদাতা পিকটনের ভয়ে পুরো বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে বাস্তবে ঝুলন্ত দেহ দেখেছিল বলে স্বীকার করে। কারণ, তথ্যদাতাকে পিকটন মাঝেমধ্যে অর্থসাহায্য দিতো। ১৯৯৯ সালের প্রথমদিকে পিকটনের এক ঘনিষ্ট বন্ধু আরসিএমপিকে জানিয়েছিল, শুকর খামারে মহিলাদের পোশাক, পার্স, এবং অন্যান্য ব্যবহৃত সামগ্রী দেখেছিল। ঘনিষ্ট বন্ধুটি বিশ্বাস করেছিল যে এসব নিখোঁজ মহিলাদের জিনিস। তবে তাৎক্ষণিক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে প্রমাণ মিলেনি যে ওসবই নিখোঁজ মহিলাদের সামগ্রী।
২০০১ সালে ভ্যাঙ্কুভার পুলিশ এবং আরসিএমপি যৌথ উদ্যোগে আবার ইস্টসাইড ডাউনটাউনের নিখোঁজ নারী ও মেয়েদের উদ্ধারকাজের জন্য অভিযান চালায়। পরের বছর অর্থাৎ ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিকটন পরিবারে ট্রাকচালক হিসেবে নিযুক্ত এক ব্যক্তি আরসিএমপিকে জানিয়েছিলো, সে ব্যক্তিগতভাবে পিকটনের খামারে অবৈধ বন্দুক দেখেছে। তথ্যটি অনুসন্ধানের জন্য সরকারি পরোয়ানা তৈরি করে এবং ৫ই ফেব্রুয়ারী টাস্ক ফোর্সের কর্মকর্তারা পোর্ট কোকুইটলাম শুকর খামারে অভিযান চালায়। তখন বেশ কয়টি অবৈধ বন্দুক ছাড়াও মহিলাদের ব্যবহৃত সামগ্রীর সন্ধান পায়। পিকটনকে অস্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। তবে পুলিশ দ্বিতীয় তদন্তের তাগিদে পুরোপুরি তল্লাশি চালিয়ে যাওয়ার জন্য পিকটনকে নজরদারিতে রাখে এবং সেইসাথে শুকর খামারে ফিরে আসার অনুমতি তাকে আর দেয়া হয়নি । তারা যে প্রমাণাদি আবিষ্কার করেছিল তার মধ্যে ছিল মহিলাদের পোশাক, জুতা, গহনা এবং এজমার ইনহিলার, যা বিশেষভাবে প্রেসক্রাইভড। পরবর্তীতে নিখোঁজ নারীদের তালিকায় থাকা শেরিনা ওবসটওয়ের প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে ইনহিলারটি মিলে যায়। তাছাড়া শুকর খামারে প্রাপ্ত ব্লাডের ডিএনএ টেস্টে মুনা উইলসনের খুনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০২-তে পিকটনকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয় এবং এই দুটি হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে মোট ২৬টি হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। পিকটন যখন ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারেতে কারাগারে বন্দী ছিলো, তখন একজন গোপন আরসিএমপি অফিসারের সঙ্গে একটি সেল ভাগভাগি করেছিলো, যাকে সে বিশ্বাস করেছিলো একজন আসামী হিসেবে। তাদের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে পিকটন বলেছিলো, সে ৪৯জন মহিলাকে খুন করেছে এবং ৫০টি বানাতে চেয়েছিলো। এদিকে, শুকর খামারটি কানাডার ইতিহাসের বৃহত্তম অপরাধের জায়গায় পরিণত হয়। তদন্তকারীরা দুই লাখ(২০০,০০০) ডিএনএ নমুনা নিয়েছিল এবং ছয় লাখ (৬০০,০০০) বিভিন্নধরনের সন্দেহজনক সামগ্রী সিজড করেছিল । প্রত্নতাত্ত্বিক ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের জন্য নিখোঁজ নারীর সন্ধানে ৩৮৩,০০০ ঘন গজ জমিতে চলাচল করার মতো ভারী সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়েছিল। তদন্ত ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৭০ মিলিয়ন ডলার।
নিখোঁজ মহিলাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলো আদিবাসী। পিকটনের ঘটনাটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে অনেক আদিবাসী ভুক্তভোগী অর্থাৎ কানাডার আদিবাসী নারী এবং মেয়েদের নিখোঁজ ও খুন হওয়ার খবর বিস্তৃত আকারে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যার ফলশ্রুতিতে, ২০১৬ সালে এই ইস্যুতে একটি জাতীয় সরকার গঠনের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়। তদন্তের গতি বেগবানে ঘোরতর সামাজিক আন্দোলন বিরাট ভূমিকা রাখে। এই আন্দোলনে মানবাধিকার সংস্থা এবং নারীবাদী সংগঠনগুলোর সাথে সর্বশ্রেণীর জনসাধারণ যোগ দিয়েছিলো। তারা সকলেই নারী ও মেয়ে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া আদিবাসী এবং অভিবাসী পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো।
সেইসময় মাতিস শিল্পী জেইমি ব্ল্যাকের রেড ড্রেস অর্থাৎ লাল জামা প্রকল্পটি ভ্যাঙ্কুভারের সিফোর্থ পিস পার্কে প্রদর্শিত হয়। এই প্রকল্পটির অর্থ হলো, লাল পোশাকগুলি কানাডার আদিবাসী ধর্ষিতা নারী এবং মেয়েদের নিখোঁজ ও খুনের প্রতীক। এমন প্রতিবাদের আন্দোলনটি ছিল খুবই নিরব। গাছের ডালে, বনে, বাড়ির উঠোনে, ব্যালকনিতে, এমনকি গাড়িতে গাড়িতে, মানুষের হাতে হাতে, মিছিলে মিছিলে লাল নিশান উড়েছিল। আবার অনেকে লাল জামা পরে ধর্ষিতাদের জন্য প্রতীকী প্রতিবাদ করে। লাল জামা প্রতীকী প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তদন্তটি আরো তরান্বিত হয়৷ একটি সামাজিক আন্দোলন সমাজের চিত্র, গতিপ্রকৃতি কতটা যে পাল্টে দিতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো, এই রেড ড্রেস প্রতিবাদী আন্দোলন, যা মানুষের চিন্তাচেতনায় লাল লেলিহান হয়ে জ্বলেছিল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এমন আন্দোলনের কথা এখন আর ভাবাই যায় না। যেখানে মানবতা বিঘ্নিত, সেখানে মানুষের পাশে মানুষ থাকবে কেমন করে? চূড়ান্ত মানবতার ঝাণ্ডা উড়ে এই কানাডায়। আইনও সেভাবে শক্তহাতে প্রয়োগ হয়। রেড ড্রেস অর্থাৎ লাল জামা প্রতিবাদী আন্দোলনটিও সেই অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রতিবছর ১০ অক্টোবর ধর্ষিতা ও নিখোঁজ নারীদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন স্বরূপ রেড ড্রেস ডে গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয়।
আঞ্জুমান রোজী
আঞ্জুমান রোজী: ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি কানাডা প্রবাসী। কবিতার প্রতি প্রেম বেশি হলেও গদ্য এবং গল্প লেখায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।এ পর্যন্ত তার তিনটি কবিতাগ্রন্থ, দুটি গল্পের বই এবং একটি গদ্যের বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম কবিতার বই, ‘এক হাজার এক রাত’ (২০১০) , এবং গল্পের বই ‘ মূর্ত মরণ মায়া'(২০১২) সাকী পাবলিশিং ক্লাব থেকে প্রকাশিত হয় । ২০১৩ ও ২০১৫ তে নন্দিতা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কবিতার বই ‘বৃষ্টির অন্ধকার’ এবং তৃতীয় কবিতার বই ‘নৈঃশব্দ্যের দুয়ারে দাঁড়িয়ে’।২০১৭তে গদ্যের বই অনুপ্রাণন প্রকাশনা থেকে ‘মুখর জীবনগদ্য’ এবং চৈতন্য প্রকাশনা থেকে ২০১৯এ গল্পগ্রন্থ ‘সবুজ পাসপোর্ট ও অন্যান্য নিঃসঙ্গ গল্প’ প্রকাশিত হয়।ভ্রমণবিলাসী আঞ্জুমান রোজী লেখালেখির পাশাপাশি আবৃত্তি শিল্পের সঙ্গেও জড়িত আছেন । বাংলাদেশের অন্যতম সেরা আবৃত্তি সংগঠন- ‘কন্ঠশীলন’ এবং বাংলাদেশ গ্রুপথিয়েটারভুক্ত নাঠ্যসংগঠন- ‘নাট্যচক্র’র তিনি সদস্য ছিলেন।বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ করে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ সাক্ষী নিয়ে গঠিত গবেষণামূলক আর্কাইভ 1971GenocideArchive এর সঙ্গে জড়িত আছেন।
ভয়াবহ। তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। কিন্তু মাথায় চাপালেন, নতুন ভূত। আমার খুবই ইচ্ছা করছে – বিষয়টাকে উপজীব্য করে একটা উপন্যাস লিখতে।
এমনিতেই পড়ে আছে অসংখ্য প্লট,লেখার খসড়া… তার মধ্যে জুটল নতুন ভাবনার জট….
খুব ভালো লাগল লেখাটা
অনেক ধন্যবাদ, রাফি৷ লেখাটা শেষ করার পর এই ভয়াবহ বিষয় আমার মাথায় চেপে বসেছে৷ একটা আতংকও কাজ করে। আপনি ইচ্ছে করলে অবশ্যই লিখতে পারেন। আবারও সময় করে পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।