লণ্ডন, অভিসার, বর্মণ স্টুডিও
ক্বীনব্রিজ থেকে নেমে এলে সোজা যে পথ, তা গিয়ে ঠেকেছে সিলেট কোর্টের দোর গোড়ায়। তারও আগে একটা ট্রাফিক পয়েন্টে ফেলে হাতের সামান্য বাম দিকে ‘লন্ডন স্টুডিও’। ফুজিকালারের বড় বড় পোস্টারে লাস্যময়ী সুন্দরীদের ছবি। কিংবা টিউলিপ ফুলের নয়ন-জুড়ানো ছবি্র সমারোহ! ওইসব ছবি দেখেই ভেতরে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে হতো। ‘লন্ডন স্টুডিওর’ নাম বহুবারই শুনেছি। আগেই বলেছি— আমাদের ও চাচাজানের বাসায় বছর-ঘুরান্তি অতিথি-নেমানের কমতি নাই। অর্থাৎ সারাবছর জুড়ে থাকবে এমন অনাহুত লোকজনের অভাব নাই। আমরাও ক্রমে ওইসব বাড়তি নেমান [মেহমান] দেখে দেখে অভ্যস্ত। বড়চাচিমার সৎ ভাইবোনেরা চাচাজানের ওই ছোট্ট বাসার রেগুলার নেমান। বড়চাচিমার এক ছোটবোন, আমার চাইতে সাত/ আট বছরের বড়— পড়াশুনায় মোটামুটি ইস্তফা দিয়ে চাচাজানের বাসায় স্থায়ী সদস্যপদ নিয়ে ফেলেছিল। যেহেতু আব্বা আমাকে কিছুতেই কলোনির অন্য মেয়েদের সাথে মেলামেশা করতে দিতে চাইতো না, সেহেতু বড়চাচিমার ওই বোনের সংগে আমাকে খায়-খাতির করতেই হতো [আমি চিরকালই বন্ধু খুঁজে ফেরা পাবলিক, আমার কোনো বোন ছিলনা বিধায় নারীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য আমার প্রচণ্ড কাঙালপনা ছিল বা আজও তা রয়ে গিয়েছে]। যদিও আমার বয়স ছিল অল্প, আর সে-ও ছিল আমার চাইতে বয়সে ঢের বড়, কিন্তু তবুও বড়চাচিমার ওই বোনের ইর্ষা বা হিংসা বা অসূয়া যা-ই বলিনা কেন স্পষ্ট টের পাওয়া যেত। হয়তো চাচাজান আমাকে অত্যধিক স্নেহ করত বলে তার ওইরকম অনর্থক-অসূয়ার শিকার আমি হয়েছিলাম। অবধারিতভাবে আম্মাও সেসব টের পেতো। কিন্তু আম্মার সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো মনোভাব থাকাতে আমাকে সেসব আঁচ করতেও দিতে চাইতো না!
এরই মাঝে আমরা একবার ঢাকা ট্যুর করে এসেছি। আম্মার চাচাতো বোন হেলেনখালার বিয়ে উপলক্ষ্যেই ছিল আমাদের ঢাকায় বেড়ানো। আম্মা আমাকে ঢাকা শহরের বিশাল নিউমার্কেটে নিয়ে গিয়ে কিনে দিয়েছে কফি কালারের মিহি-সিল্ক কাপড়ের উপর হলুদ বলপ্রিন্টের জামা। আর গুচ্ছের ববিক্লিপ। খুবই আকর্ষণীয় ছিল সেসব ক্লিপ। প্রতিটা ক্লিপের মাথায় নানাকিছুর মুখ-মাথা বসানো থাকত। আমি চয়েস করেছিলাম পেট ফুলিয়ে রাখা একজোড়া নীল-শাদা খরগোস। আর লাল রঙের স্ট্রবেরি ও হলুদ রঙের আনারস বসানো আরও দুই জোড়া ক্লিপ। আম্মা আমাকে তখনই প্রথম কিনে দিয়েছিল একটা লম্বা লিপস্টিক। যাতে পাঁচটা আলাদা আলাদা রঙ পর পর বসানো ছিল। সামান্য মোচর দিয়ে একটা লিপস্টিক খুলে আলাদাভাবে ব্যবহার করা যেত। পাঁচটা রঙ-ই ছিল অদ্ভুত সুন্দর! আমি বলতাম ‘চকচকে লিপস্টিক’। যে লিপস্টিক লাগালে ঠোঁট চিকমিক করে উঠত। এখন এত যে সাজনগোজনের জিনিস, সেইগুলা লাগিয়ে কই যাওয়া যায়?
আম্মাকে একদিন বললাম—
আম্মা লন্ডন স্টুডিওতে ছবি তুলতে যাই চলেন।
আম্মা তৎক্ষণাৎ রাজি। [ আমার সব কথাতেই আম্মা তখন রাজিই ছিল!] এখন আমার অসম বয়সের সেই খালা-বান্ধবীকে ফেলে রেখে কীভাবে যাই? মানে বড়চাচিমার ছোটবোনকে ফেলে গেলে কেমন দেখায় না? উনার নাম ছিল মাইলু, আমরা ডাকতাম মাইলুখালা। ফলত উনাকেও সাথে করে নিয়ে আমরা চললাম লন্ডন স্টুডিওতে ছবি তুলতে। স্টুডিওর মালিক প্রফুল্ল বদনের। ছোটখাটো দেহ। কিন্তু দুর্দান্ত স্মার্ট।
আমাদের বলল—
আপনারা রেডি হয়ে নিন
রেডি মানে পাউডার আর কাজলটাজল দিয়ে চুল আঁচড়ে নেয়া, কী পোজে ছবি তুলব সেসবও ভেবে নেয়া।
আমরা কাজলটাজল চোখে মেখেই গিয়েছিলাম। আমি পরেছি শাদা বেলবটম সালোয়ার আর সবুজ-শাদার মিশেলে এক কামিজ। গলার উপর দিয়ে শাদা জর্জেটের ওড়না ঝুলিয়ে বুকের দুইপাশে নামিয়ে দিয়েছি। পায়ে বাটা কোম্পানীর ক্রসবেল্টের স্যাণ্ডেল। স্টুডিও মালিক আমাদের একটা বিশাল জাহাজ আঁকা সিনারির সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। [নিশ্চয়ই ওই জাহাজের নাম টাইটানিক ছিল]
আর আমরা দুইজন সমুদ্দুরের ঢেউয়ে পা ভেজাতে লাগলাম। কারণ পায়ের দিকে সমুদ্দুরের ঢেউ আঁকা থাকলেও আমাদের সেসব ঢেউ হয়তো ভাসিয়েই নিয়ে যাচ্ছিল। আমি আর মাইলুখালা খুব ঢঙঢাঙ করে পোজ দিয়ে দাঁড়ালাম ওই বিশাল টাইটানিকের সামনে। কিন্তু ছবিয়াল ভদ্রলোক ক্যামেরার পেছনে গিয়ে রেডি বলতেই আমি কিছুতেই হাসি আটকে রাখতে পারলাম না! [তখন আমি সামান্য সামান্য ফিচকে হয়ে উঠতে শুরু করেছি]। আমি এত হাসছিলাম যে ছবি উঠানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছিল। আমার হাসির কারণও ছিল। ভদ্রলোক ছিলেন বেজায় খাঁটো, আমাদের ক্যামেরায় ফোকাস করার জন্য উনাকে একটা ছোট্ট টুলের উপর দাঁড়াতে হয়েছিল। মাইলুখালা ছিল যথেষ্ট লম্বা, আমিও তাই। এখন উনাকে টুলের উপর দাঁড়াতে দেখে আমার এই হাসির ফোয়ারা। এবং উনি আমাদের ছবি তুলতে পারলেন একসময়। তা আমার ২৮ দাঁতের বিকশিত হাসির ছবি [তখনও আমার আক্কেল দাঁত গজিয়ে ৩২ দাঁত হয় নাই, ফলে আক্কেল-পছন্দ কমই ছিল]
শাদা-কালো ছবি! দিন কয়েক বাদে আম্মাকে নিয়ে ছবি আনতে গেলাম। এবং মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্রলোক অত্যন্ত ভালো ছবি তুলেছেন। শুধু আমার পা দুটো হাঁটুর নিচ থেকে ভেঙে রয়েছে। আমাদের পেছনে বিশাল সেই জাহাজ। আমার পা ভেঙে দাঁড়ানোর কারণ ওই সিনারির সমুদ্দুরের ঢেউ হতে পারে। অথবা আমার অতিরিক্ত হাসির তোড়ে পা আপনাআপনিই হয়তো ভেঙে এসেছিল! লন্ডন স্টুডিওতে পরে আরও অনেক ছবি আমরা তুলেছিলাম। আমাদের সময় ছবি তোলাই ছিল বিনোদন। ছবি তোলা ছিল একেবারে নেশার মতো। আরও বিনোদন বলতে ছিল সিনেমা দেখা। তখন তো আমাদের হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের এরকম ইজি এক্সেস ছিল না। ফলত আমরা একে অন্যের বাসায় বেড়াতে যেতাম। দল বেঁধে সিনেমা দেখতে যেতাম। [ কালেভদ্রে সিনেমা হলের ডিসি ক্লাসে বসতে পারতাম। বেশিরভাগ সময় রিয়ার স্টলই ছিল ভরসা। কারণ আমাদের সিনেমার টিকিট কাটতে হতো মা-চাচিমাদের সংসারের খরচ বাঁচানো হেরাফেরির টাকায়]। আর স্টুডিওতে গিয়ে আমরা ছবিও তুলতাম সেসব টাকা থেকেই।
জিন্দাবাজারের চৌরাস্তার পয়েন্টের একটা রাস্তার ডান দিকে ছিল ‘অভিসার স্টুডিও’। নিচতলার ওই স্টুডিও ফেলে সামনে এগোলেই আমার বন্ধু আনজুমান আরা লাভলীর বাসা। ওদের বাসাটা ছিল দোতলায়। আমি আর আম্মা বহুবার গিয়েছি লাভলীর বাসায়। ওর বাসা লাগোয়া ‘অভিসার’ স্টুডিওতে গিয়ে ছবিও তুলেছি। একবার পান্নাকে ওর বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম আমি আর আম্মা। লাভলীর বাসায় বেড়ানো শেষে আমি আর পান্না মিলে ছবি তুলেছিলাম। আবার দুজনেই সিংগেল পোজের ছবিও তুলেছিলাম। আমি একটা ছবি তুলেছিলাম এ্লোচুলে, ঠোঁটে গাঢ় খয়েরি রঙের লিপস্টিক দিয়ে। যাতে আমার ঠোঁট কালো দেখায় আর লিপস্টিক যে দিয়েছি তা যেন স্পষ্ট বোঝা যায়। তখন আমি আর পান্না ছিলাম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। আমার ওই ছবিটা ছিল পোট্রেট। একেবারে নায়িকা ববিতার কায়দায়। ওইরকম আলো-ছায়ার রহস্যে পরিপূর্ণ।
লন্ডন আর অভিসার ছাড়াও আরেকটা স্টুডিও খুব ভালো ছবি তুলতো। সেই স্টুডিওর নাম ছিল ‘বর্মণ স্টুডিও’। ওই স্টুডিওতে বহু ছবি আমি তুলেছিলাম। জালালাবাদ মার্কেটের আগে একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতে হতো। ওই স্টুডিওতে আইফেল টাওয়ারের ছবি আঁকা একটা ব্যাকড্রপ ছিল। আর ছিল বসবার সিঁড়ি। অভিসারেও ওই ধরণের সিঁড়ি ছিল। অভিসার স্টুডিওর সিঁড়িতে বসে আমি আর পান্না নায়িকা-নায়িকা-ভাব ধরে ছবি উঠিয়েছিলাম। পান্না চুলের হাফ-বিনুনি সামনে এনে বুকের একপাশে লুটিয়ে দিয়ে সিঁড়ির উপর বেশ কায়দা করে বসেছিল। আর আমি চুল এলিয়ে, পান্নার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে, ম্যানিকিউর করা সুচারু নখের প্রদর্শনী করতে করতে, স্মিত-হাসিতে জগত উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে!
আহা! কী দারুণ জীবন ছিল আমাদের! খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে তরণী বেয়ে যাওয়া। চিন্তা-ভাবনাহীন সে এক প্রজাপতি-জীবন! তেমনই রঙিন আর ফুরফুরে।
সিনেমা দেখে, স্টুডিওতে ছবি তুলে, ঘুরে বেড়িয়ে, পড়াশুনা করে, ঠোঁটে ঝিকঝিকে লিপস্টিক মেখে আমাদের দূরন্ত কৈশোরের সেই নির্মল জার্নাল নিজেদের অজান্তেই আমরা লিখে ফেলেছিলাম!
পাপড়ি রহমান
নব্বই দশকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন কথাশিল্পী। এ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। কথাসাহিত্যে কাজের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনাও। বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা গ্রন্থ ‘ ভাষা শহিদ আবুল বরকত’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর ভিন্নধারার উপন্যাসগুলি প্রকাশ মাত্রই বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) প্রকাশিত হয় মাওলা ব্রাদার্স থেকে। পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আট বছর বিরতির পর বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ (২০১৯)
২০২০ সালে উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ রি-প্রিন্ট হয় কলকাতার বনেদী প্রকাশনা সংস্থা ‘অভিযান’ থেকে।
তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন ২০১০ সালে। কলকাতার ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘সাদ’ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।