১.
বাংলা কবিতায় নানান আঙ্গিক, উপস্থাপনা, ভাষাশৈলী ও ভাষাকে শাসনের সময় চলছে এখন। বিশ্বকবিতার সাথে পাঠক ও কবিদের ব্যাপক পরিচিতির জোয়ারে এ সময়টাতে বাংলা কবিতাতেও আসছে নতুন নতুন নিরীক্ষার প্রবণতা। তবে নিবিড়ভাবে আমাদের মনোযোগী হতে হয় টেক্সটের শক্তির কাছে এসে। বাক্য কতটুকু অর্থবোধকতা নিয়ে হৃদয়ে অভিঘাত সৃষ্টি করে, কতটা ঘোরের ভেতরে টেনে নেয় পাঠককে, কতখানি গভীরতায় আশ্রয় দেয় কবিতার ভেতর— এ এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমরা পড়েছিলাম ফ্রান্স কাফকার মেটামরফোসিসের একজন সেলসম্যান তেলাপোকা হবার পরও তার অফিস, পরিবার, রুটিন-এর ক্লান্তিকর ভাবনার চক্র চলতেই থাকে মাথার ভেতর, নিজেদের চিন্তার দাসত্বের সঙ্গে মিল পেয়ে পাঠক চমকে ওঠে, হৃদয়ে দাগ কেটে যায় বহুকালের জন্য। সেরকমই মনস্তাত্ত্বিক এক দ্বন্দ্বের দেখা পাই, ইদানিং পড়া ‘একটি কদর্য কবিতা’র ভেতরে, যেখানে কবি নিজেই মূল চরিত্র। ভেতরে দ্বিধাময় সিদ্ধান্ত, ভালোবাসা ছাড়া কাউকে ছুঁয়ে দেখবেন কি না, এমন সময় যদি কোথাও এক মেয়াদ উত্তীর্ণ নারীর মুখোমুখি হতে হয়, আর সে নারী যদি অবজ্ঞা নিয়ে খসখসে গলায় অবহেলার স্বরে বলে, ‘কবিদের আজকাল কেউ…’ বাকিটুকু শোনা হয় না। কবি শামুকের মতো গুটিয়ে যান আরো, চলে যান অন্ধকারে, আরো সহজের খোঁজে, বোধিবৃক্ষের তলায়, আর জিজ্ঞেস করে ওঠেন,
‘স্যার, ন্যায্যমূল্যে কোথাও কি
ভদ্র যোনি পাওয়া যেতে পারে?’
[একটি কদর্য কবিতা]
আহ্, বর্তমান সমাজের জটিলতা ও অস্থিরতার কাছে হার মেনে কবি খুঁজে ফিরছেন শান্ত স্নিগ্ধ দুদণ্ড শান্তি।
২.
বলছি কবি সরদার ফারুকের কবিতার কথা। জীবনঘনিষ্ঠ একজন কবি, যার অভিজ্ঞতায় আছে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা : ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, দারিদ্রের সঙ্গে বসবাস, এমনকি স্বচ্ছল বিলাসী জীবনেরও অভিজ্ঞতা। তাঁর দেখার চোখ আপনাই নিজস্ব মাত্রার, এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়, যে পয়েন্ট অব ভিউ থেকে তিনি কলমটা ধরে লিখছেন—রচিত সেইসব কবিতাই পরিচয় করিয়ে দেয় তাঁর ভাবনার, দেখার, নিজস্ব জগতটাকে। সমাজের সঙ্গতি—অসঙ্গতি চোখ এড়ায় না। ফলে স্পষ্টত তাঁর কবিতায় উঠে আসে জীবনবোধ, জীবনের টুকরো টুকরো গল্পগুলো।
সমাজে দুমুখো সাপদের অনুকূল পরিবেশ এখন, কবির সৎ চোখে তা অসঙ্গতি হিসেবে ধরা পড়ে, উঠে আসে মেটাফোরিক্যালি, যা প্রসঙ্গ বর্ণনা করেই থেমে যায় না, এতে কবিতার স্বাদটিও পুরোপুরি হাজির থাকে। এবং তা দৃশ্যতই কবির শক্তি হিসেবে দৃশ্যমান। যেমন—
গলির মুখেই বিপ্লবের পানের দোকান
বিপ্লব ভালো ছেলে, এলাকার ইমাম ও পুরোহিত দুজনেই
বলাবলি করে
…
বুড়ো রেইনট্রির ডালে বাদুরেরা ডানা ঝাপটায়
[বিপ্লব]
এখানে ‘বিপ্লবের পানের দোকান’ বা ‘বিপ্লব’ নামটুকুর আড়াল পাঠককের চোখে লেগে থাকে ভাবনার খোরাক হিসেবে!
সরদার ফারুকের কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাঁর ভাবনার স্বাধীন প্রকাশ। কোনো ফর্ম—কে প্রাধান্য দিয়ে ভাবনার আবহকে কমতে দেননি। ফলে ভাবনাগুলোর পরিধি পাঠকের ভেতরেও নতুন অভিঘাত ও বোধের জন্ম দেয়। পাঠকের মনেও প্রশ্ন জাগে, যেমন এই লাইনগুলোতে—
কবুতর আদিকালে শুধু পোস্টম্যান ছিলো, না কি ওড়ার আনন্দে
খেলাচ্ছলে পার হয়ে গেছে মাঠ–ঘাট, দুর্গের দেয়াল!
[আখের ফলন]
আর ভাবনার পরিণতি হিসেবে এরকম লাইন উঁচুমানের সাহিত্য ও আবেগের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন—
শ্মশানে কবরে আমাগের নেবে নানে, নিজিরাই হইয়ে গিছি
দাউ দাউ চিতা
[ভালোবাসা]
মানগত দিক থেকে এই করুণ মনস্তত্ত্ব মনে করিয়ে দেবে ফিওদর দস্তয়েভস্কির গল্পগুলোর কথা। এছাড়া দক্ষ খেলোয়াড়ের মতো কবিতায় খেলতে দেখেছি প্রতিকবিতার জনক নিকানোর পাররা-কে, উইট-এর পরিমিত মিশেলে চারপাশের যে চিত্র ফুটিয়ে তোলেন, তা পাঠকসমাজের কাছে খুব পরিচিত গল্প, তবে সরদার ফারুকের কবিতায় তা নিজস্ব ফ্লেভারে। যেমন, ‘প্রতিবেশী’ কবিতায় বর্ণনা করেন এভাবে, তার প্রতিবেশী ও তিনি— একে অন্যের সাথে খুব ভাব-ভালোবাসা, এবাড়ি ওবাড়ি খুব যাতায়াত, ভালো মন্দ রান্না হলে দেয়া নেয়াও চলে। কিন্তু চিরায়ত সমাজের স্বভাবদোষ যে পরনিন্দা করা, সে কথাই রম্য করে কবি বলতে থাকেন—
“বিয়ের ব্যাপার? ছোট মেয়ে?
ভীষণ মেধাবী আর মায়াবী চেহারা
তবে একবার না কি মাস্টারের সাথে—
না না, তেমন কিছুই নয়
ফিরে এসেছিলো দু’দিন পরেই
জানি তো অনেক কিছু
অন্যদের বদনাম করা আমাদের ধাতে নেই
যেমন মানুষ হোক
বড় কথা—ওরা আমাদের প্রতিবেশী”
[প্রতিবেশী]
বইয়ের অনেক কবিতায় এমন করুণ কৌতুক স্বভাব পাঠককে টেনে রাখে ঘোরের ভেতর। মায়া হয়, হাসিও পায়, দৃশ্যগুলোও স্পষ্ট— আমাদেরই পরিচিত ঘটনার একাংশ যেন, শিল্পী আদর করে তুলে এনেছেন একটুখানি।
৩.
সিংহাসনের ছায়া—পুরো বইটি জুড়ে বাস্তব সব বাক্য, কাব্যিকতা যেভাবে উঠে এসেছে—তা কবি সরদার ফারুকের নিজস্ব শক্তি ও প্রতিভার ফসল। বাক্যের স্মার্ট উপস্থাপন, অভিজ্ঞ বিষয়, প্রেমপূর্ণ তারুণ্য ভরপুর মন, সবই তাঁর সৎ উপাখ্যান। তাঁর যাপিত জীবনের টুকরোগুলোই যেন একেকটি গল্প। কবি সরদার ফারুক তাঁর কবিতায় গল্প দেন। তবে তা উদ্ভট ও সস্তা মগজ চমকে ব্যয় করেননি। বরং শক্তভাবে একেকটি মেটাফোর, ইমেজ যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা গভীর কবিতাপিপাসু পাঠকমাত্রই উপলব্ধি করে চমকে উঠবেন। ধরুন এই কবিতাটিই—
আইলে আইতে পারো
গ্যালে যাও, সে তুমার খুশি
থাকলে থাকতে পারো হারাডা জীবন
যদি ভাবো—পোষায় না আর,
এবার উড়াল দিমু, কিছুদিন পর—
দ্যাহো, কোনো খাঁচা নাই
আমার বুকটা আসমান, নিচে খোলা মাঠ
[বিবৃতি]
যেখানে কবিতার শেষ, এবং পাঠকের ভাবনার শুরু। কবির আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারের দক্ষতা আশাব্যঞ্জক। তবে পাঠককে এমন মুগ্ধ করবার ক্ষমতা রয়েছে যার, সেই কবির প্রতি প্রত্যাশা স্বভাবতই আরো বেশি থাকবে। নতুন আঙ্গিক, আরো নতুন ভঙ্গিমার নিরীক্ষা—কবির মেধা ও দক্ষতার কাছে দাবি অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। কেননা, কয়েকটি কবিতাকে লিনেয়ার বক্তব্য বলেই মনে হয়, কমফোর্ট জোন থেকে সরবার প্রয়াস তেমন দেখা যায়নি, কিছুক্ষেত্রে বাক্যের উপস্থাপনায় ভিন্নতা চোখে পড়েনি—যেগুলো আরো সতর্কতার দাবি রাখে, যেগুলো কবির সিগনেচার ফর্ম হিসেবে প্রকাশ হয়ে উঠতে পারত। তবে যে কোনো পাঠকের কাছে বইটি উপভোগ্য হয়ে উঠবে বলেই বিশ্বাস করি।
সিংহাসনের ছায়া—কবিতাগ্রন্থটি বেরিয়েছে কালাঞ্জলি প্রকাশ থেকে ২০১৮ এর অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। গায়ের মূল্য : ১৬১ টাকা। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমিন।
রনক জামান
কবি ও অনুবাদক ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১, মানিকগঞ্জে জন্ম।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : অগ্রন্থিত ওহী [তিউড়ি, ২০১৯] এবং
ঘামগুলো সব শিশিরফোঁটা [অনুপ্রাণন ২০১৬]