বিলীয়মানতার গান
আমি থাকবো না, চামেলীও চলে যাবে বাতাসে কর্পুর,
গন্ধ ছিল কি না, এ প্রশ্নে লোকেরা মাতুক
সে মাতমও থাকবে না কিছুকাল পর
লোকেরা সমস্ত ভোলে, সত্য থাকে
প্রত্যেহের প্রভাতের থলি
ইলিশে ভরাতে যায় দিন
কোমলগান্ধার অজস্র চাঁদমুখ আকাশের ছবি অমলিন।
আমি থাকবো না, চামেলীও মিশে যাবে মাটিতে পটাশ
কিছু ঘটেছিল কিনা, এ মীমাংসায় আগ্রহ কার?
সে ফিসফিস মিলিয়ে যাবে কিছুকাল গুনগুন শেষে
লোকেরা সমস্ত ভোলে, সত্য থাকে
দিবসের সকল সজ্জায়
রাত্রির নীরব বজরায়
অনন্তপারের যাত্রী মুহূর্তের কড়ি হাতে সঙ্গোপনে ধায় ।
মৃত্যু অপরাজিতা ফুলের মত নীল
ওরা তো সহাস্য বলে, আরে এ দেবতার মূর্তি বড় ভাল—
ভাবমূর্তি টনটনে উড়ে যাবে বেলুনের মতো;
আরে দেখো দেখো, তার পা হস্তির ন্যায় অত্যন্ত সুদৃঢ়,
এ গনেশ শুড়ে তুলে আছড়ে দেবে মৃত্তিকার পিঠে।
তবু সে গনেশ ভালো, তবু সে মূর্তির দিকে যাবি,
বালকের মত বিশুদ্ধ চোখ মেলে অবাক তাকাবি;
আকাঙ্ক্ষায় উড়ে আসে পাখি ও পরাগ, প্রাণ পায় ফুল
সব ঘ্রাণ প্রতিস্থাপিত হতে গিয়ে গন্ধপরাহত।
বকুলেরা সাতবোন সে কাহিনী দেবত্বচর্চিত,
মৃত্তিকায় গিয়ে শুয়ে থাকি, হাতি পা থেঁতলে দিতে
উঠেছে আকাশে, নীলিমার পাশে মৃত্যু অপরাজিতা
ফুলের মত নীল, নীলদংশনে প্রতিভাত অধরা জংশন
জীবনের ট্রেন থামে, নাকি ছুটে গিয়ে পরিখা পেরুয়,
অথবা সে হুড়মুড় পড়ে যায় নিশিপ্রাণ অবাক পরিখায়
যেখানে পনিরের সাথে খুব গাঢ় দাহ্য বিষ মিশে থাকে
সেখানে দেবতাও বামনমূর্তি, নক্ষত্র উজ্জ্বলতাহীন।
জীবনের মিছিলে মৃত্যুর কারাভান
পাশ ফিরলেই গলা জড়িয়ে ধরে।
মৃত্যু জীবনের এত কাছে শুয়ে থাকে?
শৈশবে দেখেছি দূর আকাশের গায়ে
মৃত্যুদূতকে বিদ্যুতের চাবুক হাঁকাতে।
ভেবেছি মৃত্যু বুঝি ঐ গরগর গরিলামেঘ
ঈষাণ কোনে জমে থাকা পুঞ্জিভূত রাগ;
প্রমত্ত্ব মোষের মত আগুনের শিঙের ঝলকে
উল্টে দেয়া নড়বড়ে টিলা, বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি।
কখনো মৃত্যু সুদূরের দূত, আজ্ঞাবহ, কেননা
গৃহের চাল উড়ে গেলেও গৃহস্থ বেঁচে থাকে;
কিন্তু এখন দেখছি সে অত্যন্ত নিকটে দাঁড়ানো
শ্বাস ফেলে ঘাড়ে, না দেখা দৈত্য ঐ নিম্নচাপ
বঙ্গোপসাগরের জানু ঘেঁষে ধেয়ে আসা সিডরের রূপে।
আবার কখনো ভীষণ প্রেমের চোখে তাঁকায়
প্রেমিকার মূর্তি ধরে আসে, নিয়ে যায় বিবাহ
বা মৃত্যুবাসরে, পরক্ষণেই তাঁকিয়ে দেখি
হাঁটি হাঁটি জীবনের শিশুটি এসেছে;
এবং শিশুর মিছিল জীবনকে কলহাস্যে ভরে।
তখন মৃত্যুকে পালাতে দেখি ঊর্ধ্বশ্বাসে
কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে একলাফে সে নেমে আসে
মানস সরোবরে, আর
পলির প্রদেশে তার প্রবাহিত জলে
অবিরত জীবনের নন্দন নৌকা বেয়ে চলে।
কবরখানার কাব্যপাঠ
গ্রেভইয়ার্ডগুলো প্রতিভাবান মানুষে ভরে গেল।
তারা মগজে করে নিয়ে গেল কত উজ্জ্বল চিন্তার রেণু
অত্যুজ্জ্বল সূর্যের সন্ত চাঁদরে মুড়ে
অযুত পথের দৃশ্য, প্রকৃতিমুখ, সন্তানের আলোহাস্য ভরে,
পৃথিবীর পথে পথে জ্ঞানের আলোককণা তারা তো কুড়াল,
অতঃপর বিতরণহীন, নির্দেশনাহীন ঢুকে গেল কবরের খাঁপে।
তাদেরই সামান্য কিছু কালো হরফের বুননে ঠাঁসা আছে পুস্তকের পাতায়,
আর কিছু শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের মগজের মেধাবী খোঁপে খোঁপে
সন্তানের মর্মচেতনার ভেতর অন্তর্যামী চুপ
বাকী সব ছাইভস্ম, ক্রমশ পচনশীল জৈব সার, বস্তুর অবিনাশী রূপ!
মৃত্যুর মত প্রতিমা বা প্রতিমার মত মৃত্যু
সে ছিল মৃত্যুর দূত মাহেন্দ্রক্ষণে ডাক দিয়েছিল
অত জড়িময় অত উদ্ভাসন পড়িমড়ি দৌড় দিয়েছিল
সে দেবীর মূর্তির দিকে
যে দাঁড়িয়েছিল জীবনের দারুণ চৌকাঠে
যুগ সন্ধিক্ষণের পয়মন্ত মাঠে
প্রখরাবতী বিদ্যুতের ফলা হাতে ডেকেছিল ’আয়, আয়’
দুজনে মিলে চলে যাই সহমরণের অলীক ডাঙ্গায়!
মৃত্যুর এত রূপ হয়, এত দূর উদ্ভাসনে জগৎ কাঁপায়?
এতকাল সে কেবল মুগ্ধচোখে দেখেছিল জীবনের রূপ!
বিমুগ্ধ বিস্ময়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঐ অগ্নিময় বিদ্যুতের স্রোতে
আগুনের পাখাটি পোড়াতে
গিয়েছে মৃন্ময়ী যত চিন্ময়ীর চূড়ান্ত কপোলে
ফুটে আছে মানবী আদলে
পুরুষ প্রেমিক আর নারী হল মৃত্যুর দূত;
উদ্ভাসনে কাঁপায় সুন্দর আর ডাকে ভয়াল মরণে!
বলে, আয় ছুটে এই জীবনের ঝুঁকিময় সীমান্ত ধরে
বহুবর্ণিল মৃত্যুর ঘরে
সুন্দর সারথী সব সারসের দীর্ঘ গলা ধরে বাড়ায় গ্রীবা
বলে, আয় তোর জীবন পোড়াতে!
প্রণয়ে কেন এত বিষ ঢেলে দাও প্রভূ? প্রমোদে মরণ?
রূপ নিয়ে কালোর কবরে
রূপ নিয়ে তাদের গর্ব কাল গর্ভাশয়ে প্রোথিত ভ্রূণের
মিলিত কোলাজ হতে গিয়ে যৌবনের অশেষ তেজের
অপভ্রংশ পড়ে থাকে দলিত শয্যায় কত যে মুখভঙ্গি
এরা পথে রেখে গেছে, মুগ্ধ কালোর দিকে কত যে মুখোশ
ছুঁড়ে রতিতীব্র হয়েছে বেহুশ, এখন পিষ্ট হতে ভালবাসে
নগর সৌধচূঁড়া, খোঁপা থেকে খুলে যাওয়া নিভৃতের ফুলে।
রাত্রির আঁধারের নিচে কী করে যে প্রস্ফুটিত করে তোলে রূপ
তখন কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে পাওয়া যায়, তখন ত্থুত্থুরে
পিতামহী ঘনিষ্ঠ দাঁড়ায়, লোলচর্ম এতখানি লুক্কায়িত ছিল
ঐ টানটান স্নেহের প্রলেপ, ঐ তেজোদীপ্ত অহঙ্কারী গ্রীবা
ঘোরাতে ঘোরাতে তারা কবেকার, চলে গেল কালোর কবরে।
নুলো ভিখিরিকে কত প্রাণ দিলে
কতরূপে আস তুমি, জাভার উপকূলে সুনামীর ছলে,
বিসুবিয়াসের উদ্গরিত জলন্ত লাভায়
বাংলায় বন্যারূপে, জাপান সমুদ্রে ক্ষীপ্র হারিকেনে
অস্ট্রেলিয়ার বনে বনে ভয়াল মরাল তুমি দাবানল
মাইল মাইল বৃক্ষ নয় শুধু, পশু-পাখি, মানুষ পোড়াও।
আস ঘাতক ট্রাকের রূপে, অতিক্ষুদ্র ভাইরাসের ছায়ায়
প্রেমিকার রূপে এসে অপ্রস্তুত ঘাড়টি মটকে যাও
ঐ নড়বড়ে জীবনের সাঁকো ধরে নাড়ো, ঘূর্ণাবর্তে হুমড়ি খাও
ঐ অথৈ সাগর আর তাতে পড়ে যেতে পারে যে বিমান
তার অদ্ভুত কম্পন আর অনির্ভর ধাতব ডানায়
জঙ্গলে বাঘের রূপে, সাপের ফণায় দৈত্যরূপে দোল
আসো কখনো এমন ক্ষুদ্র অনুবীজের মূরতি ধরে
দেখে নিই ঐ সামুরাই চোখ সমুদ্রের ভয়াল হাঙরে
মৃত্যু তুমি উদাসীন, অচঞ্চল; জীবনে হঠাৎ বজ্রপাত!
মৃত্যু তুমি বেহিসেবী, ক্রূর হন্তারক, অবিমিশ্র বেদনাবিশ্রুত
নুলো ভিখিরিকে প্রাণ দিলে আর প্রতিভাকে মেরে ফেল্লে দ্রুত!
নীরব যাত্রী
সে পথে তুমি তো নীরব যাত্রী, সঙ্গীহীন একা
এত উজ্জ্বলতা, এত কোলাহল, এত হুরপরী মুখ
কেউ যাবে না সাথে, পৃথিবীর পানশালাগুলো
এরকমই ভেঙে যাবে পরীদের ডানার উল্লাসে,
পানীয়ের মুক্তোবিন্দু ভরে দেবে কাচের স্বচ্ছতা!
এই যে অমিত ভক্তদল টেনে রাখে রূপশালী বাহু
এই যে প্রিয়মুখ মুখভরে এঁকে দেয় সহস্র চুম্বন,
পৃথিবীর ভেড়ারা জড়িয়েছে কত তপ্ত ওমের আদরে
কার্পাশেরা জড়িয়ে রাখে শীততীব্র রাতের গভীরে।
ঐ যে প্রজাগণ তোয়াজের অতি নম্রশীর
এই যে পরীগণ ডানামেলা ভীষণ অধীর
ওরা তো অপারঙ্গম তোমাকে ফেরাতে
ওরা কেউ রাজী নয় সে পথে যেতে…
মাছ দেখা
ছিল, এইমাত্র আলোড়ন তুলে চুপ, জলে
বিস্তারিত ঢেউ সাক্ষী, ছিল বায়ুপর্দা তুলে
মহাকাশ বিহারী নাক শেওলা-সর মুছে।
দেখেছি তার পুচ্ছময় বিপুল খেলাধূলা।
আঁশে গ্রন্থিত সাঁতারের মাইলেজ
গ্যালারী নন্দিত ঝাঁপ, পাখার ঝাঁপট
যা কিছু দেখেছি তার প্রবল দাপট
নব্বই শতাংশ ছিল জলে।
ছিল, এখন নিথর সব, মৃত্যুজলে হিম!
নম্রফাঁদ এখনি এনো না
এসব জীবনের ব্যগ্র আয়োজন মৃত্যুকে মুখভঙ্গী করে
বলে, যাও, পিছু পিছু ঘুর না, পরে এসো অবসরে
তোমার কালীর মূর্তি আঁধারের দীঘিতে ফুটিয়ে
নেব সে পদচিহ্ন ভূমিশয্যা পেতে
কান্নাভরপুর পথে, আমাকেও ওভাবে যেতে হবে…
এখন আনন্দদায়ী দশদিক উজ্জ্বল রেখেছে
ভূ-বসন্তে ডিগবাজী খাচ্ছে শালিখ, গলা খুলে গেছে কোকিলের
শিশুর মিছিল দেখ কলহাস্যে ভরেছে নগর
এখন আশ্চর্য শিলা ঈশ্বরের মুখচ্ছবি ধরে।
এখন প্রসন্ন দিন সূর্যের সন্ততি বুকে বাড়ে
মহাপ্রস্থানের পথ থেকে দূরে
অবাক আনন্দলীলা সামান্য সরেছে
যোজন পৃথিবী থেকে দূরে, অতিউল্কা প্রয়াণের পথে।
এমনি অসময়ে কেন মৃত্যু নম্রফাঁদ পাতো
টেনে নাও যুবতীউজ্জ্বল খাটে, বিপুল ঈপ্সায়
মেঘদের কৃষ্ণসভায় ময়ূরের মত নীল পরীরা নেমেছে
তোমার বিদ্যুৎফলা, বজ্ররথ এখনি এনোনা…
কামরুল হাসান
কামরুল হাসান এর জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১, শরীয়তপুরে। তিনি মূলত কবি। অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও ভ্রমণ গদ্যকার হিসেবেও খ্যাত। আছে নানা দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।
ভারতের বিশ্বখ্যাত খড়গপুর আইআইটি থেকে এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ সমাপ্ত করেন। এছাড়াও স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন যুক্তরাজ্যের ব্রাডফোর্ড ও এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কামরুল হাসান শিক্ষকতা করছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে। কামরুল হাসান দু’হাতে লেখেন। এপর্যন্ত ১৪ টি কাব্যগ্রন্থ, ১ টি ছোটগল্প, ১টি প্রবন্ধ, ৪টি ভ্রমণ গ্রন্থ, ২ টি অনুবাদ কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সমীর রায় চৌধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে পোস্টমর্ডান বাংলা পোয়েট্রি ২০০৩ সম্পাদনা করেছেন।