সূত্র সমাচার
পাঠ্য বইয়ের পাতায় শিশুকালে আমরা সেই যে পড়েছি মানুষ সামাজিক জীব আর সমাজ মানুষকে নানাভাবে নির্মাণ করে, তার বহুবিধ মানে বেড়ে উঠতে উঠতে নানা ধাপে উপলব্ধি করি আমরা। খুব কড়া ভাবে টের পাইয়ে দেয়, সে একটা পুরুষতন্ত্র–নিয়ন্ত্রিত সমাজ। আর জানি এমন শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সমতা এক স্বপ্নআক্রান্ত ফেলাসি। শ্রেণির ধারণার মূলে একটি বিষয়ই নির্ধারকের ভূমিকা নেয়— ক্ষমতা। মালিক শ্রেণি আর মালিকানাহীন শ্রেণির মোটা দাগের বিভাজনের বাইরে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, সূক্ষাতিসূক্ষ অনুভূতিগুলোও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেতে অপারগ। যারা শিল্পের বিমূর্ত কাঁটা–ভরা পথের যাত্রী তাদের কাজের ভেতর দিয়ে তা প্রকাশ পায় নিশ্চিত। কখনো তা রূপক ধরে, কখনো রঙ–রেখার কারুকাজে, কখনো সুর–বাণীর সমন্বয়ে, কখনো–বা পষ্ট চিন্তা–লেখায়। নারী–পুরষের প্রাত্যহিক সম্পর্ক ও তার অভিজ্ঞতা এই শ্রেণি বিভক্তির বাইরে মোটেও নয়। তৃতীয় লিঙ্গের ধারনা সেখানে আরো বেশি প্রান্তিক। মোদ্দা কথায় আমরা যে বিষয়েই কথা বলতে যাই না কেনো, আপাত দৃষ্টিতে “মোটা দাগ”এর এই শ্রেণি বিভাজন ও ক্ষমতা প্রসঙ্গ কোনো না কোনো সূত্র ধরে হাজির হয়ে যাবেই। আজ এ বিষয়গুলোর অবতারণা করছি একটি উপন্যাস পাঠের অনুভূতি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে। উপন্যাসটির নাম দাঁড়ানো সময়ের মাঝামাঝি।
শাহনাজ নাসরীনের প্রথম উপন্যাস দাঁড়ানো সময়ের মাঝামাঝি। একাধারে তার পরিচিতি কবি, তথ্যচিত্র নির্মাতা এবং গল্পকার হিসেবেও। উপন্যাসটি লিখিত হয়েছে উত্তম পুরুষে। একজন নারীর জীবন আবর্তে বৈবাহিক সম্পর্ক, প্রেম এবং ক্ষমতায়নের জটিল সমীকরণ উঠে এসেছে উপন্যাসের প্রতিপাদ্য হিসেবে। উপস্থাপনের ধরন বলে, একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে একজন শিক্ষিত নারীর জীবনের বাস্তব রূপটা হয়তো কম–বেশি এমনই। ঘটনা ও ঘটনার পরম্পরায় যা দৃশ্যমান, তা নিরেট বাস্তব। এখানে কোনো যাদুময়তা নেই, রূপকের আড়াল নেই, মোহময় বাকচাতুর্য নেই। হরহামেশা ঘটে যাওয়া বিষয়ই কোনো রকমের ভণিতা ছাড়াই উঠে এসেছে লেখায়। এই উপন্যাসে মূল নারী চরিত্রের পাশাপাশি সুবিধা বঞ্চিত নারীদের অভিজ্ঞতার কথাও বর্ণিত হয়েছে যা থেকে নারীর জীবনে অবদমন এবং ক্ষমতায়নের বাস্তব চেহারাটি পাঠক খানিকটা দেখতে পাবেন। মূল চরিত্রের নাম লেখক সচেতন ভাবেই এড়িয়েছেন। এ উপন্যাসে তার বয়ানে আমরা ঘটনাগুলো সম্পর্কে অবহিত হই। কাহিনীর শুরু শহুরে প্রেক্ষাপটে। মূল চরিত্র বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জননী। স্বামী চরিত্রটি উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে গমন করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দুটো সন্তান এবং শ্বশুরকূলের দায়িত্ব সামলে মূল চরিত্রটি যে জীবন যাপন করেছে সেসবের বিবরণ থেকে তার মানসিক গঠন এবং জীবনযাপনের বাস্তবতার সাথে তার সাংঘর্ষিক অবস্থা সম্পর্কে পাঠক একটা ধারনা লাভ করে। উপন্যাস শুরুর খানিক পরই বাংলাদেশ ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে মূল চরিত্রটির স্বামীর কাছে ইউরোপে যাওয়া, সেখানে থিতু হওয়ার চেষ্টা, নিজের নৈঃসঙ্গ্যের মুখোমুখি হওয়া, একজন চিত্রকরের সাথে তুমুল প্রেম ও প্রতারিত হওয়া এবং সংবেদনশীল মনের দোলাচলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় থাকা— এসব মিলিয়ে সেখানেই উপন্যাসটি একটি জিজ্ঞাসা চিহ্নের সূত্র রেখে সমাপ্ত হয়। মোটা দাগে এটিই কাহিনীর সারসংক্ষেপ বলা যায়।
বিবাহ জনিত আঘাত এবং চলমান বাস্তবতায় নারীর ব্যক্তিগত পরিসরের অবদমন
উপন্যাসটিতে মূল চরিত্র একজন শহুরে মধ্যবিত্ত নারী। একজন কবি, লেখক, ফ্রি ল্যান্সার গবেষক। বৈবাহিক সূত্রে তাকে সেই পরিবেশে বাধ্য হয়ে থাকতে হয় যেখানে তার কাজের স্বীকৃতি নেই। তার বয়ানে শোনা যাক— “আমার লেখালেখি বা এসব কাজ কাশেমের ভাষায় সুখে থাকতে ভূতে কিলানো রোগ।” স্ত্রীর ব্যক্তিগত পরিসর যা স্বামীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে কিংবা বোধগম্য নয়, তা স্বামীর ভাবনায় সন্দেহের উদ্রেকও করে বটে। তাই বিদেশে গিয়েও আত্মীয়–স্বজনের সাথে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে চলে নজরদারী। এমন একটি পরিবেশে মূল চরিত্র দুই শিশু সন্তান নিয়ে দিন পার করছে পরিবার এবং সমাজের চাহিদা মিটিয়ে। অথচ একজন লেখক ও গবেষক নারীর এহেন বাধ্যবাধকতার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে পাঠকেরা সম্যক ধারনা পান না। বিষয়টি আরেকটু খোলাসা হওয়ার সুযোগ ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। অন্য একটি জায়গায় স্বামী সম্পর্কে মূল চরিত্র বলছে, “আপাদমস্তক অপছন্দের একটি মানুষ”। স্বামীর সঙ্গে মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে যে যোগাযোগহীনতা, বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হতে হয় এবং এ কারণে প্রতিনিয়ত নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, অবদমন চলছে, সেই স্বীকারোক্তি দিয়েছে মূল চরিত্র। স্বামীর পদবী ব্যবহার না করায় স্বামী তাকে কী বলছে সেটা পড়া যাক— “কাশেম এই সুযোগে আমাকে নারীবাদী বলে ব্যঙ্গও করে নিল বেশ।” স্বামী নাম্নী ব্যক্তিটির প্রতি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ইঙ্গিত উপন্যাসের কোথাও দেন নি শাহনাজ যেখান থেকে মনে হতে পারে বুদ্ধিবৃত্তিক দূরত্ব সত্ত্বেও একজন লেখক এমন দাম্পত্য সম্পর্ক যাপন করার ক্ষেত্রে বাধ্য হতে পারে। কখনো কখনো মূল চরিত্রের মৃদু প্রতিবাদের ব্যর্থ চেষ্টা উঠে এসেছে,“ সব কিছু নিয়েই বলো, হয় প্রশ্ন করো নয় সিদ্ধান্ত দাও। আমি কি কিছুই বুঝি না, কিছুই পারি না! এত উপদেশ ভাল্লাগে না আমার।” এই নিরন্তর বিদ্রুপ, নজরদারীর অধীনে নিজের অসহায় অবস্থাকে ব্যাখ্যা করছে সে, “এই হলো আমার নিজের অবস্থা আর আমি কিনা রাস্তায় রাস্তায় নারীর ক্ষমতায়ন খুঁজে বেড়াই!” লেখক উপন্যাসের শেষদিকে মূল চরিত্রকে দিয়ে এক বাক্যে উল্লেখ করিয়েছেন এই পরিস্থিতিতে তার দাঁত কামড়ে পড়ে থাকার কারণ, “হায় সন্তান! তোদের জন্য আমাকে বার বার প্রেমহীন ঘরের দরজায় কড়া নাড়তে হয়!” হ্যাঁ, তৃতীয় বিশ্বের মধ্যবিত্ত নারীর জীবনে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্যে সন্তান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে চিহ্নিত হয় এখন পর্যন্ত। গোটা উপন্যাসটিতে এমন এক অসহযোগী দাম্পত্য সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ্ নারীর ছবি এঁকেছেন লেখক যেখানে প্রেমের নিঃশূন্য বাতাস বয়ে নিয়ে আসে চিত্রকর প্রেমিককে সম্পর্কের আরেক জটিল অধ্যায় খুলতে।
প্রেম ও নৈতিকতার আবরণে নারীর নৈঃসঙ্গ্য
“ঘর কইনু বাহির, বাহির কইনু ঘর
তার প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর”
প্রেম এলো চিত্রকর অভীক চৌধুরীর বেশে। স্পেনপ্রবাসী অভীক চৌধুরী একাত্তরের যুদ্ধশিশু। বেড়ে উঠেছে ফ্রান্সে। বিয়ে করেছে ভারতীয় চিত্রকরকে। শিল্পীর চোখ দিয়ে অভীক আবিষ্কার করল নারীর বিষণ্নতা, একাকীত্ব। ফক্সেনবুর্খের রাত্রিদিনগুলোর ভারী বাতাস হেসে উঠল অজস্র ফুলের সুবাসে। মুতসঞ্জীবনী সুধায় বেঁচে উঠল প্রেমাবেগ যা অচেনা ছিল মূল চরিত্রের নিঃসঙ্গ জীবনে। মূল চরিত্র তার প্রেমের অনুভূতিকে বোঝার চেষ্টা করছে, “কাশেম তার সব রকম যান্ত্রিকতার পরও আমার প্রতি সমান আগ্রহী আর সক্ষম। তবু তো জানি তা প্রেম নয়, প্রেম হয় নি ওর সাথে।” স্বামী–সন্তানের কর্তব্যের বাইরে তার ব্যক্তিগত পরিসরে এসে এক কবি মিলিত হলো এক চিত্রকরের সঙ্গে। শিল্পীর সঙ্গে দেখা হলো শিল্পীর। অভীককে নিয়ে প্রেমমগ্ন নারীর ইচ্ছে করে, চলে যায় বজ্রমুখর রাতে ঢোঁড়া সাপের কপাকপ মাছ খাওয়ার দৃশ্য দেখতে কিংবা সাগরানা থালায় নানা রকম দেশী পিঠা সাজিয়ে প্রেমাস্পদকে খাওয়াতে। মিলনের পর বিচ্ছেদের তীব্রতায় নারীর কবিসত্ত্বা লিখছে—
“হায় প্রেম! সে কি অন্তহীন যুযুধান আর
ফাঁসির আসামীর মতো একা হয়ে যাওয়া!
বুক খালি করা দীর্ঘ নিঃশ্বাস
পাজরের কাছে তীব্র হাহাকার”
এই তুমুল প্রেমের বানে ভেসে মূল চরিত্র কখনো কখনো হয়েছে স্পষ্টবাদী আবার কখনো গুটিয়ে গেছে আপন স্বভাবে। স্বামী তার পরিবর্তন টের পায় তবে তা দুর্বোধ্য ঠেকে তার কাছে। দূরত্ব বাড়ে। তবু পরোয়া নেই যেন কিছুর। কেবল অপেক্ষা জানে সময়। ঠাণ্ডা জানালার কাচে গাল চেপে কবি লেখে তার কবিতা। সেই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন লেখক—
“ফুটন্ত ভাতের মতো গুমড়ে ওঠে ক্ষোভ
একহাতা রাগ; বন্দি হওয়া নিজস্ব কারাগারে
এক চিমটে সন্দেহ; লেপের ভাঁজে জরাগ্রস্ত শীত
অনস্তিত্বের সম্ভাবনায় কেবলই ক্ষয়
চেতনার গভীরে জোঁকের মতো লেপ্টে থাকে পেয়ে হারানোর ভয়
উথলানো দুধের মতো হাঁড়ির সীমানা ভাঙে বিদ্রোহী অভিমান
বিনিময়ে কী পেলাম হিসাব–নিকাশ
হিসাব–নিকাশ লিখে স্থাণুর মতো বসে থাকি। হিসাব–নিকাশ! কীসব লিখছি আমি! কেন লিখছি এসব! আমি কি ভয় পেয়েছি, নিজেকে পরাজিত ভাবছি! আমি না মুক্ত মানুষ ভাবি নিজেকে! আমি কারও সম্পত্তি না কেউ আমার সম্পত্তি না, সম্পর্ক হবে স্বাধীন সার্বভৌম। শুধু প্রেম, প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ থাকায় বিশ্বাস করলে কেন এই হীনমণ্যতা এই গ্রাম্যতা! হু হু করে কাঁদি আর পুরো লেখা কাটতে থাকি আবার।”
এমন সর্বগ্রাসী প্রেম প্রতারণার মুখোশ নিয়ে আসে, অবশেষে। মিথ্যাচার ঢেকে দেয় সমস্ত আলোর চরাচর। মূল চরিত্র যে কিনা কেবল এই প্রেমের অধ্যায়ে পরিচিত হয় চৈতী নামে, হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। প্রেমের দোলাচল ও তুমুল সময়টির কাছাকাছি উপন্যাসে আবির্ভূত হয় আরেকটি চরিত্র, খসরু। চরিত্রটি মূল চরিত্রের স্বামীর মাধ্যমে পরিচিত হলেও সমমনা হওয়ার কারণে তার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। খসরু একটি ইতিবাচক চরিত্র এবং একদিক থেকে দেখতে গেলে মূল চরিত্রের দার্শনিক ও নৈতিক সহায়তাকারী হিসেবে পাঠকরা তাকে পায়। খসরু সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষন এমন—
“ও এত মেধাবী বলেই এত পছন্দ করি ওকে। অথচ মেধা ওকে ইবলিশ বানায় নি। মেধাবী মানুষের মধ্যে শয়তানির যে সহজাত প্রবণতা দেখা যায় তা দেখি না ওর মধ্যে।”
প্রবল আত্মিক দ্বন্দ্বে, অসম্মানে কবির আশ্রয় খসরু। প্রেম হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে ফোন করলে খসরু তাকে সেই স্পেস দেয়, নীরবতা দেয় যা একজন বন্ধুর জন্যে প্রয়োজন। তারপর এক পর্যায়ে খসরু বলে— “মনে রাখবি মানুষ মূলত দুই রকম: ডিসেন্ট, ইনডিসেন্ট। … শোন, কান্দিস না, রাত হইতেছে, বাড়ি যা গিয়া। আমি আসতেছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।” এই চরিত্র পাঠ করতে গিয়ে অপর্ণা সেনের পরমা ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র পরমার বন্ধু শিলা চরিত্রটির কথা মনে পড়ে যায়। গৃহিণী পরমার আকস্মিক প্রেমে পড়ার দোলাচলকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য যে চরিত্রটি খুব জরুরি ছিল। বন্ধু শিলা পরমাকে বলতে পেরেছিল যে প্রেম করার মোরাল সাপোর্ট আরেকজন দেবে তা হতে পারে না, সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হয় আর কোনো সম্পর্কেই কাউকে নিজের সম্পদ বলে ভাবাটা যুক্তি সঙ্গত নয়, নিজের অস্তিত্বের কথা ভাবতে পারাটা জরুরি। আবার প্রয়োজনে, দুর্যোগে বন্ধুর পাশে এসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে শিলা সব সময়। খসরু তেমনি চরিত্র যার বন্ধুত্ব মূল চরিত্রকে কোনো বিধ্বংসী পথের দিকে ঠেলে দেয় না। তেমনি ছোট আরেকটি চরিত্র জয়ন্তী তার নৃত্যনাট্য শকুন্তলার কথা বলার মধ্য দিয়ে মূল চরিত্রকে সতর্ক করে— “এখনো নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গী রাজা দুষ্মন্তের মতোই ভোগীর এবং সমাজে রাজা দুষ্মন্তের অবস্থানেই তারা আছে। আর নারীরা শকুন্তলার মতোই ব্রাত্য। তারা প্রেমে জড়ালে প্রতারিত, সমাজ বহির্ভূত তো হবেই আর শেষ গন্তব্য অবশ্যম্ভাবী আত্মহত্যা।” মূল চরিত্র তার আবেগীয় বিপর্যয়ের দিনে নৈতিকতার আবরণে মেনে নিয়েছে তার নৈঃসঙ্গ্যকে। যদিও সে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পথের মাঝামাঝি তবু পাঠক বুঝে নিতে সক্ষম হয় সে আত্মঘাতী হবে না কখনো। শেষ পর্যন্ত জীবনের বিস্তার সে দেখে নেয় তার বিষণ্ন একাকী দৃষ্টি মেলে।
নারীর পরিসর, নারীর অবদমন আর এক টুকরো হর্ষধ্বনি আয়ু
মূল চরিত্রের পাশাপাশি লেখক দুই বা ততোধিক নিম্নবর্গীয় নারীর চরিত্র উপন্যাসে এনেছেন যারা সামাজিক অবস্থানে সমান না হলেও অবদমনের দিক থেকে একই অবস্থানে থাকছে। এরকম চরিত্র যাহেরা অথবা রাবেয়া। তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিসরে তারা কখনো ঋণগ্রস্ত, নির্যাতিত, সন্তানবঞ্চিত, পরিত্যক্ত এবং নিগৃহিত। তাদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত লড়াইয়ের গল্প রয়েছে। নিম্নবর্গীয় নারী অবলীলায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে আর মধ্যবিত্ত নারী মানসিক নির্যাতনের ভেতর ক্রমশ নিমজ্জিত। এখানে শোষণের ধরন ভিন্ন কিন্তু চেহারাটা এক। এই উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলোর শোষণ একটা ‘কমন’ বিষয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বৈবাহিক সম্পর্কের ফাঁদ জারী রাখতে চায় বিবাহ–সন্তান–দাসত্ব’র ধারাবাহিকতা। নারী–পুরুষের ক্ষমতার চর্চা, আর্থ–সামাজিক প্রেক্ষিতে নারীর কাছে ‘কাঙ্ক্ষিত’ চাওয়া, নারীর ব্যক্তিগত পরিসর নেই হয়ে যাওয়ার ‘সামাজিক আকাঙ্ক্ষা’ সকলই পরস্পর সম্পর্কিত। এসবের মাঝে একটা বিষয় আমরা বুঝে যাই, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধ শ্রেণি প্রভাবমুক্ত নয়। সুবিধাপ্রাপ্ত ও সুবিধাবঞ্চিত দুটো শ্রেণি। তার ভেতর নারী আরেক শ্রেণি। শ্রেণির ভেতরে শ্রেণি। আর শাসক–শোষিতের অমীমাংসায় স্বাভাবিক ভাবে জেগে ওঠে ‘ব্যক্তিগত’র ধারনা। যে নারী তার ব্যক্তিগত পরিসর নিয়ে যত বেশি সচেতন, তার সামাজিক সম্পর্কগুলো তত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই উপন্যাসের মূল চরিত্রের ক্ষেত্রে সেটা দৃশ্যমান অথচ তার চরিত্রের আপোষকামী বৈশিষ্ট্যের কারণে তা অবদমিত হতে থাকে। যাহেরা, রাবেয়া যেখানে ঋণ পরিশোধের জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করে কিংবা নির্যাতনকারী স্বামী ও কোলের শিশুকে ফেলে চলে আসতে পারে, লড়াকু চরিত্র হয়ে টিকে থাকে বৈরী পরিস্থিতিতে, সেখানে উপন্যাসের মূল চরিত্রের মৌনতা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা স্পষ্টতই মধ্যবিত্তীয় বাতাবরণে আবদ্ধ। তারপরও এদের একসূত্রে গাঁথবার চেষ্টা করেছেন লেখক। যাহেরা, রাবেয়া এবং মূল চরিত্র উপন্যাসের শেষ দিকে একটি বাক্যে সংযোগ স্থাপন করছেন— “সেই মহাভারত থেকে রামায়ণ, যাহেরা থেকে রাবেয়া, নারীর কেবল একটিই গল্প, সে গল্প বঞ্চনার।” তবে এই যোগসূত্র স্থাপনের বিষয়টি আরেকটু বিশদ হওয়া প্রয়োজনীয় ছিল বোধ করি।
উত্তম পুরুষে লেখা নারী চরিত্রের ব্যক্তিগত অবদমন, অধঃস্তনতার বর্ণনা, ব্যাখ্যা, ধরন এবং সামাজিক সম্পর্কের কাছে সমর্পণের চিত্র আমরা পাই দাঁড়ানো সময়ের মাঝামাঝি উপন্যাসটিতে। একটা নির্মোহ স্বরে গল্পটা বলে যাওয়ার চেষ্টা আছে এখানে। কোনো সমাধান দেয়ার তাড়াহুড়ো নেই। অহেতুক পক্ষপাতিত্বের কিংবা যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার বাড়াবাড়ি নেই। তবু বর্ণনার কোথাও কোথাও অতি সংক্ষেপিত রূপ পাঠক হিসেবে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে। মনে হয়, এই দৃশ্য আরেকটু সময় পাওয়ার দাবী রাখে। কোনো কোনো ঘটনা আর একটু বিশদ বর্ণনা করা যেত বোধহয়। অস্তিত্ববাদী দর্শন চরিত্রের কোথাও কোথাও প্রভাব বিস্তার করেও ঠিক ঠাক পেরে ওঠে নি। একটা সময় নিয়তির হাতে ছেড়ে দিচ্ছে সব। ভেতরে ভেতরে কাজ করছে ‘কনফিউশন’। মূল চরিত্র নিজে যা বলতে পারছে না কিংবা যে ভাবনার মুখোমুখি হওয়ার সাহস পাচ্ছে না, সেটা বলিয়ে নিচ্ছে বিবেকরূপী বন্ধুর মুখ দিয়ে। পুরুষের প্রতারণা ও নিয়ন্ত্রণে বীতশ্রদ্ধ কবি ভাবে কোনো নারী কি কখনো তার প্রেমাস্পদের সাথে এমন করতে পারে? সে ভাবছে— “সত্যিই পুরুষের প্রতি মুখাপেক্ষিতা না থাকলে নারীর পৃথিবীটা অনেক অন্যরকম হতো নিশ্চয়ই।” কখনো ড্রামাটিক মনোলগের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় যেন উপন্যাসটিতে। নিজের প্রতি উচ্চারিত স্বগোতোক্তি নয়, কথা বলা হচ্ছে পাঠককে উদ্দেশ্য করে। এমন ভাবে বলছে কথক যেন তার ভেতর দিয়ে কথকের চরিত্রের চেয়ে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী বেশি ফুটে উঠছে। সে কাল্পনিক বক্তা আর পাঠক কাল্পনিক শ্রোতা। যেন বলে যাওয়াটাই মূল। অবরুদ্ধ মন–মনন এক–খোপের জানালা পেয়েছে আচমকা।
উপন্যাসের মূল মোটিফ, মনে হয়েছে, স্বপ্নদৃশ্যে প্রোথিত। পুকুরে ডুবে যাওয়ার দৃশ্য। সাঁতার না জানার ভীতি আর্তস্বরে বেরিয়ে আসে কণ্ঠ চিরে। দুটো স্বপ্নদৃশ্য খানিকটা পাঠ করি—
প্রথম স্বপ্নদৃশ্য
“কী সুন্দর পুকুর! চারপাশে নারকেল সুপারি গাছের ঘের। শানবাঁধানো সিঁড়ি, টলটলে জল। কী যে শখ আমার সাঁতার কাটার। সারা জীবন পুকুরের কিনারে বসে আমি অন্যদের সাঁতার কাটা দেখেছি। আর নিজেকে উলটে পালটে ভাসিয়েছি ডুবিয়েছি হাঁসের মত। আজ সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ঝাঁপ দেই মাঝ পুকুরে। বেশ খুশী হই, হাত পা নাড়ালেই তো সাঁতার কাটা যায় দেখি! এই যে বেশ পুরো শরীরটা পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছি! কিন্তু না, এগুতে পারছি না। একই জায়গায় হাত পা নেড়েই যাচ্ছি। হঠাৎ সম্বিত ফেরে, ডুবছি একটু একটু করে। হা ঈশ্বর সিঁড়ি থেকে আবার মাঝ পুকুরে সরে গেলাম কী করে… এবার ডুবতে শুরু করি, ডুবছি… ডুবছি.. ”
দ্বিতীয় স্বপ্নদৃশ্য
“সবুজ ছোট ছোট পাহাড়! তার গায়ে ফুটে আছে অজস্র সাদা সাদা বুনো ফুল। এর মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি নদী। পাহাড়ের গায়ে রোদ প্রতিফলিত হয়ে ঝরে পড়ছে সুন্দর টলটলে জলে। জলের গায়ে যেন হাজারো চুমকি। নিচের মাটি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। নুড়ির ফাঁকে ফাঁকে রঙ–বেরঙের মাছ সাঁতার কাটছে, সেখানে। আর তাদের সঙ্গে খেলছে অভীক। কেমন শিশু শিশু লাগছে ওকে। আমি তীরে বসে প্রাণ ভরে দেখি ওকে। মাঝে মাঝে বুনোফুল ছুঁড়ে দেই। অভীক ডাকে, চৈতী এসো, কী শীতল জল, কী শান্তি দেখে যাও।
আমি আর্তনাদ করি, কিন্তু আমি যে সাঁতার জানি না।”
যে সামাজিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের জালে সে আটকে পড়েছে সেখান থেকে উত্তরণের পথ তার জানা নেই। কেবল ডুবে যাওয়া নিরন্তর, খাবি খাওয়া। কোনো ক্রমে টিকে থাকা। পরিস্থিতির ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্যও সেটি নয়। সে জায়গা থেকেই মনে হয়, স্বপ্নদৃশ্যগুলোর আরেকটু বিস্তার মূল চরিত্রকে বুঝতে তুলনামূলক ভাবে পাঠককে বেশি সহায়তা করতে পারত।
তারপরও লেখক এর ভেতরেই আভাস দেন যেন পরিণতির। নারী চাইলেও খুব সহজে কোনো গণ্ডি পেরিয়ে যেতে পারে না। পুরুষতন্ত্র তার ছড়ি উঁচিয়ে আছে সর্বদা। পদে পদে ‘স্খলন’, অনিরাপত্তার সতর্কীকরণ নারীর ইচ্ছের সামনে বাধার পাহাড় তুলতে থাকে। নারীর প্রেম ভালোবাসা আবেগ দলিত মথিত হয় নিরন্তর। নারী–পুরুষের শ্রেণি বিভেদের রেখা আরো দগদগে হতে থাকে। কেউ কেউ লড়ে যায় শেষতক। কেউ কেউ ফেরে দুমড়ে মুচড়ে। মাথার ভেতর সমাজের নিয়ম–কানুন তার ঘূণপোকা ছেড়ে রেখেছে। আমরা তার কেটে চলার শব্দে শঙ্কিত হই। থেমে থাকাকে ধরে নিই মুক্তির এক চিলতে বাতাস। আদতে তা বৃত্তবন্দি মানুষের বিশেষ দিনের সামান্য হর্ষধ্বনি আয়ু। সকল অবদমন শেষে তবু দাঁড়ানো সময়ের মাঝামাঝি উপন্যাসটি সেই হর্ষধ্বনির আয়ূর সাথে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয়।
———
দাঁড়ানো সময়ের মাঝামাঝি ধরন: উপন্যাস
লেখক: শাহনাজ নাসরীন
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশক: সংবেদ
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৫
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৯৬
মূল্য: ১৫০ টাকা
সাবেরা তাবাসসুম
কবিতা লেখা শুরু পিতা মোঃ সাইদুল হক ভুইয়ার অনুপ্রেরণায়। পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বই ১৪টি। ১৩টি মৌলিক কবিতা এবং একটি হিন্দী ও উর্দু কবি গুলজারের কবিতার অনুবাদ-গ্রন্থ। একমাত্র পুত্রকে নিয়ে বেশিরভাগ সময় কাটে। চলচ্চিত্রের প্রতি রয়েছে তীব্র টান। সবকিছু্র বাইরে কবিতাই সাবেরার আরাধ্য ভূমি, পাশাপাশি অনুবাদ ও মুক্ত গদ্য লেখা তো আছেই।