লুৎফুল হোসেনর দুটি মুক্তগদ্য

এক জীবনের দুঃখ ভরা এক হোয়াং হো

বিকেলের অপেক্ষায় সময় তখন দুপুর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়। চতুর্মাত্রিক এক বৃত্তের আকর্ষণে তড়িঘড়ি হোমওয়ার্ক সেরে দুটা এঙ্কলেট হাফপ্যান্টের পকেটে গুঁজে বসে থাকি। বলটা কখনো আমার কাছে, কখনো সবু’র কাছে থাকে। সবু থাকে আমাদের দুখানা বাসা পরে। বল যার কাছে থাকে সে আগে গিয়ে বলটাকে দু-পাঁচটা ঊর্ধ্বমুখী লাথি মেরে শব্দ তৈরি করলেই হলো। আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে হ্যামিলনের ইঁদুরের মতো বেরিয়ে আসে ক্ষুদে খেলোয়াড়েরা। পাশেই পুরনো জমিদার বাড়ির রঙমহল, তখন সিআইডি পুলিশদের মেস। তার কয়েক ধাপ মার্বেল সিঁড়িকে গ্যালারি বানিয়ে একদল কিশোরের খেলা দেখে অনেকে।

অনেক বাহবা আর উৎসাহে ক্ষুদে খেলোয়াড়দের উৎকর্ষ বাড়ে। এক সময় পাড়ায় পাড়ায় খেলায় জিতে বাড়ে পরিচিতি আর সুনাম। টুর্নামেন্টে নাম লেখায় বড়দের আশ্রয় প্রশ্রয়ে। দেখতে দেখতে বছর না ঘুরতে বড় টুর্নামেন্টে নাম লেখায়। দূর দূর থেকে নানান দলের সাথে খেলা হয় অল্প দূরের এক হাই স্কুল মাঠে। আমাদের প্রাণপণ চেষ্টা। সবাইকে অবাক করে সেমিফাইনালে জিতেও যাই আমরা। উল্লাস বাঁধ ভাঙে। উচ্ছ্বাসে বাড়ি ফিরতে হয় দেরি। পড়াশোনা বেশ ক’দিন হলো মাথা থেকে পালিয়েছে। পড়ার টেবিলে বই খাতাগুলো বিষণ্ন পড়ে থাকে একটু দীর্ঘ সময়। ব্যাস, বাবার কড়া শাসনের খড়গ নামলো পিঠে। সামনেই হাফ ইয়ার্লি।

আমার সাহস নেই বাবার নিষেধ অমান্য করি। ফাইনালের দিন বাসায় বসে থাকলাম সম্পর্কহীন বই-খাতার সামনে। বাকীরা মন খারাপ করে গেলো ফাইনাল খেলতে। আমার তৈরি হলো এক জীবনের দুঃখ ভরা এক হোয়াং হো।

 

প্রেম

ছোটবেলায় প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম এক পাখির। সেই প্রথম প্রেম যার সঙ্গে, লোকে তাকে ডাকে পায়রা। ব্যাপারটা জানাজানি হতে প্রথম যখন বাসায় নিয়ে আসা হলো তাদের অনিন্দ্য এক জোড়া। ভেবেছিলাম ওরা আমার হলো। অথচ, তাদের ছোঁবো বলে খাঁচার দরোজা খুলতেই ডানা মেলে ছটফটিয়ে তা ছুটলো অদৃশ্যে, চোখের পলকে। জানলাম আপন ঘর তার চেনা, আর সে নিশ্চিত ফিরে গেছে সেখানেই। না সেই প্রথম প্রেম, মিষ্টি খয়েরি রঙের সেই পায়রাটা আর
কখনোই পাইনি খুঁজে।

আরো বড় হলে, একা দৌড়ে দূরে যেতে নির্ভয় হয়েছি যখন; গ্রামে গিয়ে ছুটছিলাম এক ঝাঁক জোনাকির পেছনে। ভেবেছিলাম বাড়ির আঙ্গিনায়, পুকুর পাড়ে দল বেঁধে কানামাছি খেলায় নিমগ্ন জোনাকিরা বুঝি আমার, আমাদেরই। অথচ আশ্চর্য, কিছুতেই কাছে ভিড়তে দেয় নি ওরা কখনো সহজে। কাছাকাছি গেলেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন সহসা ছলকে গেছে দূরে।

পরে কোনো এক সময়ে ঠিক ঠিক শিখে গিয়েছিলাম মুঠোয় জোনাকি বন্দী করার কূটকৌশল। শুধু জানা হয়নি একটা কথাই যে, ওরা ওভাবে আলো জ্বালে না খুব বেশিক্ষণ।

আজো তবু পায়রার জন্য ভালোবাসা, জোনাকির প্রতি প্রেম সারসের মতো উদগ্রীব রয়ে গেছে, সুরক্ষিত হয়ে আছে, এই এখনো।

 

লুৎফুল হোসেন

কবি, প্রকাশক ও সাহিত্যকর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর। বিভিন্ন রকমের পোর্টাল ও পত্রিকায় নিয়মিত গল্প, কবিতা, ফিচার, প্রবন্ধ এবং গান লিখছেন। বাংলাদেশের লিটলম্যাগ ও নানা প্রকাশনা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত আছেন সেই ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকেই। শৈল্পিক মননশীলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে একটু একটু করে গড়ে তুলছেন তার নিজস্ব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘রচয়িতা’।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top