এনেছি আমার শত জনমের প্রেম
খালাম্মার হাউসকিপার সাহেরার আমাদের বাসায় আসা-যাওয়া হঠাৎ করে বেড়ে গেল। সাহেরা সকালে সিন্ধি-গাইয়ের দুধ দিয়ে যায় তো, বিকেলে নিয়ে আসে আলুর-সিংগারা ভেজে। ঝুম-বৃষ্টিতে ছাতা ফুটিয়ে সাহেরা নিয়ে আসে ভুনাখিচুড়ি আর বড় রাতা ভুনা। মিষ্টিকুমড়ার শাকের কচিডগায়, শুঁটকি আর বেগুন ফেলে রসা রান্না করে নিয়ে আসে। সাহেরার রান্নাও দারুণ টেস্টি। আর আমিও সেসব খুশি মনে খেয়ে যাই। আমার একটা বদভ্যাস ছিল— অচেনা-হাতের রান্না খাওয়া। [ তার মানে এই যে বাউল-বাউল-স্বভাব, এইসব আমার বহু আগে থেকেই ছিল। বহু কষ্টে আমি আমার সেই স্বভাব পরিত্যাগ করতে পেরেছি। কারণ যখনতখন যেখানেসেখানে পাত পেতে খেতে বসলে অনেকেই খেলো মনে করে। মনে করে এই মহিলা এত ছ্যাদর কেন? কিন্তু বিহাইন্ড দ্য সিন হলো, আমি মোনোটনাস যে কোনোকিছু থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাই। এমনকী নিজের রান্নাও আমার কাছে বিস্বাদ ঠেকে। সবকিছু থেকেই আমি পরিত্রাণের জন্য হাঁসফাঁস করি]।
সাহেরা নানান কিছুই নিয়ে আসে, কিন্তু সেসব দিয়েই তড়িঘড়ি চলে যায় না সে। আমার রুমে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। [ আমার রুম বলতে যেটা, সেটা আদতে আমাদের বাসার রান্নাঘর। তখন তো গ্যাস আসে নাই। ফলত আম্মা আমাকে আলাদা রুম দেবার অভিপ্রায়ে বেশ প্রশস্ত রান্নাঘরটাকেই কায়দা করে শোবার ঘর বানিয়ে দিয়েছে। শুধু ধোঁয়া বেরুনোর চিমনীটা ছাড়া আর কোনো খুঁত নাই এই ঘরে। তবে ওই চিমনীর তলাটাও দেখতে খারাপ লাগে না। অনেকটা বিদেশী সিনেমায় দেখা ফায়ারপ্লেসের মতো। আমি বালেগ হয়েছি (পিড়িয়ড হয়েছে, ওড়না ধরেছি) বিধায় আব্বা-আম্মার ঘরে তো আগের মতো শুতে যেতে পারি না। রান্নাঘরের জানালা ঘেষে আম্মা একটা সরু-চকি পেতে দিয়েছে। পাশে একটা বেতের বুকসেলফ। ঘুমগাছের কাঠ দিয়ে বানানো চকচকে বার্ণিশের পড়ার-টেবিল আর একই কাঠের চেয়ার। আম্মা আমার বিছানার জন্য ঢাকাডাইংয়ের সিংগেল চাদর কিনে দিয়েছে। চাদরের রঙের সাথে ম্যাচ করে পিলোকেইস। চেয়ার ছাড়াও বসার জন্য আছে বেতেরমোড়া। গায়ে দেবার জন্য পশমি কম্বল আর কাঁথা। আর আম্মা তার রান্নার কেরোসিনের স্টোভ আর মশলাপাতি নিয়ে শিফট করেছে স্টোর-রুমে।
সিলেটের ঠিরঠিরে-শীতকালে একটা ভাওয়া-ব্যাঙ এসে আমার ঘরের ফায়ারপ্লেসের নিচে বসে থাকে। হয়তো তারও প্রচণ্ড শীত করে। শীতের প্রকোপে সে একেবারেই নড়াচড়া করে না। আমি ততদিনে ‘ব্যাঙ-রাজকুমারের’ গল্পটা পড়ে ফেলেছি। আর অপেক্ষা করছি ব্যাঙটা কবে রাজকুমার হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ওই ব্যাঙ কোনোদিনই রাজকুমার হলো না। মনের দুঃখে ওই ব্যাঙটাকেই আমি কিনা এইচএসসি পড়াকালে ডিসেকশন ক্লাসে কেটে পরীক্ষা করে দেখেছিলাম! ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে, ব্যাঙের হাতেপায়ে পিন বিঁধিয়ে পেট কেটে দেখেছি তার তরতাজা পৌষ্টিকতন্ত্র, মেরুদণ্ডের শাদা হাড়গোড়। হয়তো প্রচণ্ড নিষ্ঠুর প্রকৃতির এক নারী ছিলাম আমি! যে প্রকৃতিরই হইনা কেন, আজও কিন্তু ওই ছোট্ট রান্না-শোবার ঘরটাকেই আমি মিস করি। এত বছর পার হয়ে, এই জীবনে এসে— তিনজন মানুষ তিনপ্রান্তের তিনরুমে তিনভুবনের বাসিন্দা হয়ে পড়ে থাকি। আর একটা খালি-রুম হাহাকার করে জানিয়ে দেয়, তার কোনো বাসিন্দা নেই। ঘরগুলি পরিপূর্ণ করে থাকার মতো মানুষেরও আজ বড় আকাল, সেখানে কোনো ব্যাঙের দেখা পাওয়া তো দিবাস্বপ্নের মতো। আজ আমি বিরসবদনে ভাবি, আহা, ওগো ব্যাঙ, তুমি যদি আরেকবার আসিতে আমার জীবনে। মাত্র একবার! তাহলে আমি তোমায় মিনারেল জল উপচানো সোনার-চৌবাচ্চায় পেলেপুষে রাখিতাম!]
সাহেরা এসে আমার মাথার ঘন চুলে বিলি কেটে দেয়। আমি তখন হয়তো অংক কষতে থাকি। সে মন দিয়ে আমার হাতের লেখা দেখতে থাকে। সাহেরা হাউসকিপার হলেও কিছুটা পড়াশুনা জানত। আর সে দুর্দান্ত স্মার্টও! বক্ষবন্ধনীর ফিতায় উঁচু করে বাধা স্তনযুগল দেখেই তার স্মার্টনেস অনুমিত হতো। পরনের শাড়িটাও সে বেশ কায়দা করেই পরে আসে।
এরই মাঝে তরতরিয়ে শীতকাল এসে গেল। ধুলায় ধুলাকার সমস্ত পথঘাট। বৃক্ষের বেশুমার পাতারা ধূলির আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেছে। আর সুরমার জল কমতে কমতে তলানিতে পৌছেছে। ইশকুলে যাতায়াতের সময় আমাদের খাঁড়া-কাছাড় বেয়ে ওঠা-নামা করতে হয়। কাছাড় বেয়ে সহজে নেমে যেতে পারলেও ওঠাটা বেশ পরিশ্রমের। একেবারে হাঁপ ধরে যায়। আমরা গায়ে ভালো করে পশমি কাপড় জড়িয়ে রাখতে শুরু করি। গলায় মাফলার। মাথায় কানটুপি পরে শীতের ছোবল ঠেকাতে চাই। শীতের এক ঝিমধরানো বিকেলে সাহেরা আমাদের বাসায় আসে। এসেই ইতিউতি তাকায়। ভালো করে দেখে নেয় আম্মা-আব্বা কোন রুমে আছে। আমার পড়ার টেবিলের কাছে এসে আন্তরিক ভঙ্গিতে বলে—
কী কর পাপড়ি? ইশকুল থিক্যা কখন আসলা?
আমি বলি—
এই তো মাত্র।
ভাত খাইছো আইস্যা?
আমি বলি—
হুম, মাত্র খেয়েছি।
সাহেরা ত্রস্ত চোখে আম্মার রুম-বারান্দা দেখে নিয়ে ব্লাউজের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেয়। খশখশ শব্দ করে কী যেন বের করে আনে। দ্রুত আমার হাতে দিয়ে বলে—
তুমারে উত্তর দিতে বলছে।
আমি হতবিহ্ববল হয়ে তাকিয়ে থাকি। ভয়ে নিজের হাতের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারি না। এদিকে সাহেরা হাওয়া হয়ে গিয়েছে! কখন, কোন ফাঁকে যে সে চলে গিয়েছে আমি বুঝতেও পারি না।
আমি ভয়ে ভয়ে আমার রুমের দরোজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দেই।
অত্যন্ত ভারী কাগজে বিশাল এক চিঠি খুলে পড়তে থাকি—
প্রিয়তমা
ছোট্ট একটি চুম্বন দিয়ে এ চিঠি শুরু করছি।
অতীব সুন্দর হস্তাক্ষর। নীলরঙের কালিতে ফুলস্কেপ কাগজের কয়েক তা জুড়ে লেখা দীর্ঘ চিঠি। কিন্তু ওই ‘চুম্বন’ শব্দ আমাকে আটকে দেয়। পুরো চিঠিটা আমি পড়ে উঠতেই পারি না কী এক অস্বস্তিতে। ধ্যাত, এসব কী? এই চুম্বনটুম্বন কী জিনিস? এত অশ্লীল করে ফেলেছে সমস্ত চিঠি শুধুমাত্র এই একটা শব্দ দ্বারা। আমার গা গুলাতে শুরু করে । [আজ অবাক হয়ে ভাবি, ওই বয়সে আমি কী করে অমন ছিলাম? চুম্বনের মতো নির্দোষ শব্দটাকে এত অশ্লীল কেন মনে হয়েছিল?]
চিঠি শেষ হয়েছে—
ইতি তোমারই…
এটা তাহলে ওই কিউটি-ভেজাবেড়ালের কাজ! নব্য-ইঞ্জিনিয়ার দেখি ভালো সেয়ানা!
চিঠিটা আমি বহুবার পড়ি। কিন্তু আমার উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। কেন যেন বিবমিষায় গা গুলাতে থাকে। [প্রথম চিঠি বা প্রথম সাক্ষাতে যে-ই আমাকে আদিম ইংগিত দিয়েছে, তার কাছ থেকেই আমি চিরতরে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, তাকে বয়কট করেছি। অথচ ইংগিতবিহীন যাদের ফেরেশতা জ্ঞান করেছি, পরবর্তীতে দেখেছি তারাই আপাদমস্তক মাকালফল! এ জগতে পুরুষের লীলাখেলা বোঝা বড় দায় হে!]
পরের হপ্তাহেই আরেকটা চিঠি নিয়ে এল সাহেরা। বের করে দিলো অন্তর্বাসের গোপন কুঠুরির ভেতর থেকে। আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল—
তুমি চিঠির উত্তর দাও না ক্যান? তোমার চিঠির জন্য সে অপেক্ষা করে।
আমি সাহেরার কথার কোনো উত্তর দিলাম না। চিঠিগুলি আমি একাধিকবার পড়ছিলাম, কিন্তু কেন যেন আমার উত্তর লিখতে ভালো লাগছিল না। [কিউটি আমাকে একবার কি দুইবার দেখেছে, এই সামান্য দেখায় কোনো সুশীল কাউকে চিঠি লিখতে পারে! আমার কিশোরী-মন কোথায় যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করছিল!]
খালাম্মা একদিন রাগে চোখমুখ লাল করে আমাদের বাসায় এলেন। আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বললেন—
ও তোমার পিছনে লেগেছে কেন? ও তো মোটেও ভালো ছেলে না। খবরদার, তুমি ওরে পাত্তা দিও না। ওর তো আরেকটা প্রেম আছে মমিংসিঙে। [হয়তো সে তার নিজের সন্তান ছিলনা, তবুও তিনি আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। খালাম্মা আমাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন বলেই হয়তো ওইসব বলেছিলেন]
খালাম্মার কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম! [ওই ট্রমা আমার এ জীবনেও কাটে নাই। যে-ই আমাকে প্রপোজ করেছে, পরে দেখেছি বা শুনেছি তাদের অন্য প্রেমও আছে বা ছিল! আজব! একই সঙ্গে বহু নারীদের সাথে প্রেমাভিনয়ে পুরুষেরা দেখি বেশ পারদর্শী!]
দিন দুয়েক পরে সাহেরা ফের অন্তর্বাসের গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে চিঠি নিয়ে এলে আমি সে চিঠি না-পড়েই ফেরত দিয়ে দিলাম। সাহেরা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। এবং আমি খালাম্মাদের বাসায় যাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিলাম। এমনকি ওই কিউটি-ভেজাবেড়ালের সাথে ইশকুলে যাওয়ার পথে কোনোদিন দেখা হয়ে গেলে আমি সোজা মাটির দিকে তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে যেতাম। তাকে কোনো কথা বলার স্কোপ দিতাম না। চোখের কোন দিয়ে দেখতাম, তার মলিন-মুখ। কিন্তু আমি রাগে তাকে পাত্তাই দিতাম না। ছুটি ফুরিয়ে গেলে সে-ও একদিন চলে গেল রুয়েট না কুয়েটে। হয়তো ছূটি পেলে সে তাদের বাসায় আসত, কিন্তু সেসবের আমি খোঁজই রাখি নাই। রাখার প্রয়োজনও মনে করি নাই।
সাহেরাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম—
ওই তোদের বড়মিয়ার নাকি আরেকটা প্রেম আছে?
সাহেরা তোতলাতে তোতলাতে বলল—
কে কইছে তুমারে? আফায়?
যে-ই বলুক। আছে কি নাই সেইটা আগে বল।
হ, মমিসিংয়ে আছে। মাইডার লাইগ্যা তো হেয় মাগীগো লাহান কান্দে।
তাহলে আমারে চিঠি লিখসে ক্যান?
আমি ক্যাম্নে কমু? আমারে দিতে কইছে, আমি দিছি তুমারে।
আমি কঠিন গলায় বললাম—
আমার সাথে বদমাইশি করতে মানা করিস। আমি কিন্তু সে-ই পদ না, বুঝলি?
সাহেরা মুখ কালো করে মাথা নিচু করে চলে গেল। কোনোদিন কোনো চিঠি নিয়ে সে আর আসে নাই আমাদের বাসায়…।
পাপড়ি রহমান
নব্বই দশকের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একজন কথাশিল্পী। এ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। কথাসাহিত্যে কাজের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনাও। বাংলা একাডেমী থেকে গবেষণা গ্রন্থ ‘ ভাষা শহিদ আবুল বরকত’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর ভিন্নধারার উপন্যাসগুলি প্রকাশ মাত্রই বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তন্মধ্যে জামদানি তাঁতিদের নিয়ে উপন্যাস ‘বয়ন’ (২০০৮) প্রকাশিত হয় মাওলা ব্রাদার্স থেকে। পালাকারদের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আট বছর বিরতির পর বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয় ‘নদীধারা আবাসিক এলাকা’ (২০১৯)
২০২০ সালে উপন্যাস ‘পালাটিয়া’ রি-প্রিন্ট হয় কলকাতার বনেদী প্রকাশনা সংস্থা ‘অভিযান’ থেকে।
তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সম্মাননা পেয়েছেন ২০১০ সালে। কলকাতার ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পরিচালিত ‘সাদ’ত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার’।