নর্থ ক্যারোলাইনা
৪
দাসপ্রথা বিরোধীরা সব সময় নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে তাড়া খেয়ে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে। ভার্জিনিয়া কিংবা ডেলভার তাদের বরদাস্ত করলেও, তাদের বিক্ষোভ আয়োজনে বাঁধা না দিলেও তুলো উৎপাদন হয় এমন রাজ্যে তা বরদাস্ত করা হয় না। কারো কাছে দাসপ্রথা বিরোধী কোন প্রচারপত্র পাওয়া গেলে তার জেল অবধারিত। শুধু তাই নয়, তার পক্ষে সে শহরে বেশিদিন থাকাও অসম্ভব হয়ে ওঠে। এসব রাজ্যে এমন সব আইন পাস করা হয়েছে যে, কারো কাছে যদি এসব নিষিদ্ধ প্রচারপত্র পাওয়া যায়, অথবা কেউ কোন দাসকে বা দাসবিরোধী কাউকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, অথবা কোন কৃষ্ণাঙ্গকে কেউ কোন রকম সাহায্য-সহযোগিতা করে, তাহলে তার বিচারের ভার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের উপর বর্তাবে। কার্যত, এ রকম অভিযোগের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চুল ধরে ঘর থেকে টেনে হেঁচড়ে গ্রেফতার করা হয়। কোন দাসমালিক যদি স্থানীয় আইন অমান্য করে (অর্থাৎ দাসদের উপর মালিকের নিরঙ্কুশ অধিকার বা তাকে মালিকের সম্পত্তি হিসেবে মানতে অস্বীকার করে) তাহলে তাকে খুন করে গাছে ঝুলিয়ে রাখাই আইন। এই আইনের আওতায় কোন সহৃদয় শে^তাঙ্গ যদি কোন কৃষ্ণাঙ্গকে তার গোপন কোন কুঠুরিতে, মাটির নীচে কোন গোপন ঘরে বা কয়লার গর্তে লুকিয়ে রাখে তাহলে তার জন্যও একই দণ্ড।
কিছুদিন এই আইন প্রয়োগে শিথিলতার সুযোগে অনেক শহরে শে^তাঙ্গ দালালের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। আর তখন প্রতিদ্ব›দ্বী ব্যবসায়ী বা পুরনো শত্রুতার জেরে বা প্রতিবেশীকে শায়েস্তা করতে তাদের বিরুদ্ধে দালালির অভিযোগ তুলে হয়রানি শুরু করে। স্কুল শিক্ষকদের কাছে শিখে বাচ্চারাও এ ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে বাবা-মার পাশাপাশি জটলা পাকাতে শুরু করে। মার্টিন একটা গল্প শোনাল। এ শহরে একটা লোক তার স্ত্রীর হাত থেকে নাকি কিছুতেই নিষ্কৃতি না পেয়ে চরম কষ্টে ছিল। বউটার কী অপরাধ তা অবশ্য কেউ কখনও বুঝে উঠতে পারেনি। শেষমেশ লোকটা আরেকটা বিয়ে করে বসে।
“সে সুখি হয়েচে?” কোরা জানতে চায়।
“কি বললে?”
মার্টিনের বর্ণনা শুনে কোরা হতভম্ব হয়ে গেল। সে হতাশচোখে রাস্তার দিকে চোখ ফেরালো।
আগে পেট্রোলাররা ইচ্ছে করলেই যে কোন কৃষ্ণাঙ্গের বাড়িতে তল্লাসী চালাতে পারত, তা সে দাস অথবা মুক্ত যাই হোক না কেন। তাদের ক্ষমতা এতদূর বেড়ে গিয়েছিল যে, ইচ্ছে করলেই যখন তখন যে কোন বাড়িতে ঢুকে তাদের বিরুদ্ধে যে কোন অভিযোগের ছুঁতোয় বাড়ি তছনছ করত। তারা এসব করত নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার নামে। তারা যেকোন সময় যে কোন বাড়িতে, তা সে ধনী বা গরিব যাই হোক না কেন, অভিযান চালাতে পারত। চেকপয়েন্টে ওয়াগন, গাড়ি থামিয়ে তল্লাসী চালাত। অভ্রখনিটা ছিল মাত্র কয়েক মাইল দূরে। মার্টিনের পক্ষে কোরাকে নিয়ে পালাতে চেষ্টা করা সম্ভব ছিল না। কারণ, এক কাউন্টি থেকে আরেক কাউন্টিতে প্রবেশে খুঁটিনাটি পর্যন্ত তল্লাসী করা হয়। তাদেরও সে তল্লাসীর মুখে পড়া অনিবার্য ছিল।
কোরা ভালই বোঝে যে, সাদারা কখনও কালোদের স্বাধীনতায় বিশ^াস করে না। তারা যে অজুহাত খাড়া করবে সেটা হল ওই জানমালের নিরাপত্তা। এ ধরনের ধারণা বা ঘৃণা কমাতে মার্টিন তাকে বলেন যে, সব কাউন্টিতে পেট্রোলারদের একই রকম বাড়াবাড়ি চলে তা কিন্তু নয়। একেক কাউন্টিতে পেট্রোলারদের আচরণ একেক ধরনের।
পেট্রোলাররা তাদের তল্লাসী কাজের জন্য বেশ গর্ব করে। যেমন কত সুচারুভাবে তারা তল্লাসী চালিয়েছে আর কত চমৎকার সার্টিফিকেট তারা দিয়েছে। এক তরুণীর ঘরে একজন নাইট রাইডার এত ভদ্রভাবে তল্লাসী করেছিল যে, পরে তাদের বিয়ে পর্যন্ত হয়ে যায়।
কোরা আসার আগে তারা মার্টিনের বাড়িতে দু’ দু’বার তল্লাসি করে গেছে। রাইডাররা খুব ভাল আচরণও করেছিল এবং তারা ইথেলের আতিথেয়তায় মুগ্ধ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল। তারা চেলেকোঠায় তল্লাসী করেনি। একবারও সে প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, আরেকবার তল্লাসী করতে আসলে তারা এটা তল্লাসী ছাড়াই বিদায় নেবে। দ্বিতীয়বারের তল্লাসীর পর মার্টিনকে রেলরোডের দায়িত্ব ছাড়তে হয়। কোরা পরবর্তীকালে কোথায় যাবে বা তার তার বিষয়ে রেলরোডের লোকদের কী পরিকল্পনা তার কিছুই মার্টিন জানেন না। তারা তাকে কিছুই জানায়নি। তেমন একটা সংকেতের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই।
স্ত্রীর আচরণের জন্য মার্টিন আবারও কোরার কাছে মাফ চাইলেন। “তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে সে প্রায় মরতে মরতে বেঁচে গেছে। নিতান্ত বরাত জোরে বেঁচে আছি আমরা।”
“আপনি নিজেরে গোলাম ভাবেন?”
“ইথেল এগুলো পছন্দ করেন না।”
“আপনি গোলাম হয়ে জন্মাইলেন?”
সে রাতে এর বেশি আর কোন কথা তাদের মধ্যে হয়নি। খাবার আর পানি নিয়ে কোরা চিলেকোঠার দূরপ্রান্তে চলে গেল।
অচিরেই কোরা এসবে অভ্যস্থ হয়ে উঠল। না হয়ে উপায়ও ছিল না। প্রায়ই তার মাথা ছাদে ঠোক্কর খায়। তাতে এটা মনে পড়ে যে, ঘরটা কত ছোট; আর তাকে কত সাবধানে ঘোরাফেরা করতে হবে। ছোট্ট এতটুকু জায়গায় কোরা ঘুমায়। যেমন জাহাজের খোলে পুরে দাস আনা হয়। সে পার্কটা দেখতে থাকে। দক্ষিণ ক্যারোলাইনায় থাকতে যেটুকু অক্ষরজান তার হয়েছিল তার ভিত্তিতে এই সামান্য ছিদ্রপথে আসা স্বল্প আলোয় সে একটু পড়াশোনার চেষ্টাও করে। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না রাতে আর দিনে এত ফারাক কেন হয়। সকালে কিছু পরিশ্রম আর রাতে ভয়ংকর কষ্ট।
ফি শুক্রবারে এখানে সেই মেলাটা জমে। এসব দৃশ্য যাতে আর না দেখতে হয় সে জন্য কোরা কুঠুরির পেছন দিকে সরে যায়।
দিনের বেলা প্রচণ্ড গরম পড়ে। তখন তার মনে হয়, সে যেন একটা ছোট বোয়েমে রাখা মাছ, বাতাসের অভাবে আর গরমে খাবি খাচ্ছে। কোন কোন দিন সে বেহিসেবীর মত দুপুরের আগেই বেশি পানি খেয়ে ফেলে। আর তাই বিকেলে পানির টান পড়ে। তখন ওই পার্কে বানানো ফোয়ারাটার দিকে চেয়ে চেয়ে দিনের বাকি সময়টা কাটাতে হয় তাকে। কখনও কখনও সে তেষ্টায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে। দক্ষিণ ক্যারোলাইনায় গায়ে গতরে যেটুকু মাংস লেগেছিল এখন ক্ষুধা তেষ্টায় তা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার দুর্গন্ধ বিছানাটা ইথেল বদলে দেন। তার মেয়ে যে বিছানাটা রেখে গেছে সেটা কোরাকে দেন তিনি। জেন এমন পুরনো বিছানাপত্র প্রায়ই এখানে রেখে যায়। ফলে কোরা এখন একটা ভাল বিছানা অন্তত পেল।
মধ্যরাতে, পার্কের দিকের সব আলো নিভিয়ে দেয়ার পর এবং ফিওনা বাড়িতে চলে যাবার অনেক পরে মার্টিন তাকে খাবার দিতে আসে। কোরা তখন একটু খোলা জায়গায় আসে একটু নির্মল বাতাসের আশায়। তাদের মধ্যে সামান্য কথাবার্তা হয়। তখন মার্টিন এমন ভঙ্গিতে তার সামনে দাঁড়ান যেন তিনি বলছেন যে, যে কোন মূল্যে তাকে রক্ষা করতে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি সেখান থেকে সরে আসলে কোরা আবার সেই দূরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। মার্টিন চলে আসার পর কোরা কোনদিন তাড়াতাড়িই ঘুমিযে পড়ে, কোনদিন অনেকক্ষণ ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে তারপর ঘুমায়। ক্রমেই কোরা দুর্বল হয়ে পড়ছে যেন একটা মোমবাতি টিমটিম করে জ্বলছে। প্রায় রাতেই সে ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখে।
কোরা লক্ষ্য করেছে পার্কে নিয়মিত কারা কারা হাটতে আসে। তাদের চলাফেরার এক ধরনের সালতামামি করেছে সে। মার্টিন দাসবিলোপবাদীদের প্রচারিত কিছু প্যাম্পলেট এক কোণায় লুকিয়ে রেখেছেন। সেগুলো অবশ্য অনেক পুরনো এবং তার পিতা সংগ্রহ করেছিলেন। মার্টিন সেগুলো পুরাকীর্তির মতো যত্ন করে সংরক্ষণ করছেন। যেকোন মুহূর্তে সেগুলো বিপদ ডেকে আনতে পারে। ইথেল সেগুলো আর রাখতে ইচ্ছুক নন। কিন্তু মার্টিন মনে করেন, যেহেতু সেগুলো অনেক পুরনো তাই ধরা পড়ে গেলে তিনি এগুলোর মালিকানা অস্বীকার করতে পারবেন। হলুদ মলিন সেই অ্যালামন্যাকের একটি একদিন কোরা পড়ার চেষ্টা করেছিল। সেখানে আকাশের নক্ষত্রমণ্ডল নিয়ে এমন অনেক কথা লেখা আছে যা সে পড়ে কিছুই বুঝতে পারেনি।
মার্টিন দেখা করতে এলে কোন খবর আছে কি-না তাই কোরা জানতে চায়।
অবশেষে রোলরোডের সেই নীরবতা যেন ভঙ্গ হল। কয়েকটা ডিপো আর স্টেশন এজেন্টের বাড়িতে রেইড হয়েছে এবং তাদের গণধোলাই দেয়া হয়েছে বলে কাগজে খবর বেরিয়েছে। তবে এগুলো সব দাস-প্রধান রাজ্যের খবর। মার্টিনের বাড়িতে কেউ লুকিয়ে আছে এমন সন্দেহে কিছুদিন আগে অপরিচিত কিছু লোক এসে করে ঘুরাঘুরি গেছে। যারা এসেছে তারা কেউই দু’বার আসেনি। তবে একেবারে অবশ্য তেমন কেউ আসেনি। আর আসলেও মার্টিনের কিছু করার নেই।
“আপনি আমারে যাতি দেবেন না,” কোরা বলে।
জবাব খুবই সাদামাটা। পরিস্থিতি যাওয়ার মতো নয়। “একেবারে ফাঁদ পাতা। সবার জন্যই। তারা একবার তোমাকে ধরতে পারলে তোমার কাছ থেকে গোপন সব কথাই বের করে নেবে।”
“র্যান্ডেলে তারা যখনই মনে করত কাউকে শেকলে বাঁধবে, বেঁধেই ছাড়ত।”
“তুমি আমাদের ডুবাবে,” মার্টিন বললেন, “তুমি নিজে তো মরবাই, ইথেল, আমি আরা যারা যারা তোমাকে সাহায্য সহযোগিতা করেছে সব্বাইকে মারবা।”
মার্টিন তাকে সেদিনের খবরের কাগজটা পড়তে দিল। কোরা সেটা নিয়ে একেবারে কোণায় চলে গেল পড়বে বলে।
সামান্য শব্দও কোরাকে টটস্থ করে তোলে। এই আইরিশ মেয়েটিকে সে মাত্র একবারই দেখেছে। তাতেই সে বুঝে নিয়েছে কী পরিণতি হতে পারে যদি এখানে লুকিয়ে থাকার কথাটা সে জেনে ফেলে। প্রায়ই ফিওনা জঞ্জাল নিয়ে ওই কুঠুরির মুখে ফেলে। আর যখনই সিঁড়িতে ফিওনার সামান্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, কোরা সতর্ক হয়ে ওঠে, গুটিশুটি মেরে কোণায় প্রায় দম বন্ধ করে রাখে যেন সামান্যতম শব্দও না হয়। তাকে দেখে কোরার র্যান্ডেল খামারের সেই অসভ্যতাগুলোর কথাই বারবার মনে পড়ে। কোথাও যেন বিদ্রোহের সামান্যতম কোন প্রকাশ না ঘটে।
পার্কের মধ্য দিয়েও সে যাওয়া আসা করে না। তাই কোরা কখনই তার মুখ দেখতে পায়নি। অনেকটা কল্পনার চোখে ফিওনার ছবি সে এঁকে নিয়েছে। বেমানান চেহারা হলেও জেদি; দুর্ভিক্ষ আর কঠিন সময় জয় করে সে বেঁচে আছে। মার্টিন তাকে বলেছেন যে, সে তার মা আর ভাইয়ের সাথে জাহাজে চড়ে এদেশে এসেছিল। মার ফুসফুসের অসুখ ছিল। এবং জাহাজ থেকে নামার পরদিনই মারা যায়। ছেলেটা এত ছোট আর এত রোগাপাতলা যে কোন কাজই করতে পারত না। বয়ষ্কা আইরিশ নারীরা তাকে দেখভাল করত। আইরিশটাউন কি সাউথ ক্যারোলাইনার মতই কালো মানুষে ভরা? এক স্ট্রিট পার হলেই সেটা বুঝা যায় লোকের কথাবার্তায়। নিরন্তর তারা পূর্বতন গৃহের সাথে রূপান্তরিত জীবন ও স্বপ্নের মিলমিশ কতটা ঘটেছে, তাই আলোচনা করে।
আর মাত্র ক’মাস পরেই তুলো তোলার মৌসুম। শহর যেখানে শেষ আর শুরু যেখানে ফসলী জমির সেখানে সারি সারি তুলো গাছে তুলোর কুণ্ডলী (বল) দেখা যাবে। তারপর সেগুলো তুলে বস্তায় ভরা হবে। এখানে তুলো তুলবে সাদা হাতে। এখানে জার্মান বা আইরিশ যারা আছে তারা কি একবারও নিগারদের নিয়ে ভাবে? অথবা তাদের মুজুরি বৈষম্যের কথা কি তারা একবারের জন্যও বিবেচনায় নেবে? তুলোর খেতে একজন রিক্তহস্ত শে^তাঙ্গ একজন রিক্তহস্ত কৃষ্ণাঙ্গের কাছ থেকে তুলে নেন বটে; কিন্তু দিনশেষে শ্বেতাঙ্গ তো রিক্তহস্ত থাকেন না! কালোরা ধার করা টাকা শোধ করতে না পারলেও সাদারা কিন্তু ঠিকই তুলো থেকে উপার্জিত অর্থে দিব্যি বাবুগিরি করতে পারে। তাদের জীবনে শুরু নতুন অধ্যায়।
জকি প্রায়ই সে কাহিনী বলেন। কীভাবে দাসবণিকরা আফ্রিকার আরও গহীনে ঢুকে দলে দলে মানুষ ধরে ধরে দাস হিসেবে বিক্রি করত, তাদের চালান করে দিত আমেরিকার তুলোর খেতে; কীভাবে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে নারী-পুরুষ-শিশু ধরে ধরে আনা হত গলায় শেকল বেঁধে। নানা জায়গার নানা গোত্রের মানুষ ধরে তাদের ভুলিয়ে দেয়া হত মায়ের মুখের বুলি। কোরা কল্পনার চোখে দেখতে পায়, নতুন লোকেরা আসবে দলে দলে, আইরিশদের বদলে তারা লেগে যাবে এই হাড়ভাঙা খাটুনির কাজে। আইরিশেদের চলে যেতে হবে অন্য কোথাও, অন্য কোন রাজ্যে। তার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইঞ্জিন এখন দম নিচ্ছে। এখন তাতে কয়লা ভরা হচ্ছে। পিস্টন ঘুরতে শুরুর অপেক্ষা। তারপরই দৌঁড়াতে শুরু করবে গাড়িটা।
কোরার এই বন্দিশালার ঢালু দেয়ালটা যেন এক বিশাল ক্যানভাস যা দিয়ে সে মৃত্যুচিন্তা, বিশেষ করে সন্ধ্যা আর গভীররাতে মার্টিনের সাক্ষাৎ পাওয়ার ছবি আঁকে। সিজার যেদিন প্রথম তাকে পালানোর প্রস্তাব দিয়েছিল সেদিন সে দু’ ধরনের কথা ভেবেছিল। কষ্টে অর্জিত উত্তরের কোন এক শহরে সুখি জীবন অথবা অবধারিত মৃত্যু। তাদের পালিয়ে আসার সময় টেরেন্স হয়ত তার জীবনকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে দেখতে চেয়েছিলেন। বিরক্ত হয়ে পড়ে তিনি হয়ত তার জীবনকে একটা দোজকে পরিণত করতেন।
ছোট্ট চিলেকোঠায় প্রথম কয়েক সপ্তাহে তার উত্তরের জীবনের স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ছোট্ট ছিদ্রপথে কোরা দেখতে পায় একটা সুন্দর সাজানোগোছানো রান্নাঘরে ছেলে এবং মেয়ের উপস্থিতি, পাশের ঘরে প্রেমঘন স্বামী-স্ত্রী বসবাস না দেখা গেলেও কল্পনায় বেশ স্বপ্নীল মনে হয়। দিন যত এগিয়ে চলে ঘরগুলো সাধারণ কিন্তু মনোরম রুচিশীল আসবাবপত্রে সাজানো। সাউথ ক্যারোলাইনায় শপিং মলগুলোয় যেমন সে দেখেছে। একটা শোবার ঘর। বিছানাটা সাদা চাদরে ঢাকা, বাচ্চারা সেখানে আমোদ করছে, বাবার গায়ে গিয়ে পড়ছে গড়িয়ে, আর অর্ধেকটা মায়ের কোলে। অনেক বছর আগের আরেকটা দৃশ্য মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। শহরের ব্যস্ত রাস্তা পার হয়ে কোরা গিয়েছিল তার মায়ের সাথে দেখা করতে। নয়নজুলির পাশে এক নুয়েপড়া বৃদ্ধা ভিক্ষে করছে। মেবেল চেয়ে দেখেছিল কিন্তু মেয়েকে চিনতে পারেনি। কোরা লাথি দিয়ে পয়সার বাঁটিটা ফেলে দিয়েছিল। আর পয়সা সব এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়েছিল। আর সেদিন মা তার ছেলের জন্মদিনের কেকটা কিনতে পারেনি।
এখানে আসার জন্য সিজার প্রায়ই রাতের খাবারের সময় আসত। এসে তাকে মুক্তির কথা শোনাত। তারপর র্যান্ডেল থেকে পালিয়ে আসার সেই দুঃসহ স্মৃতি। সিজার ছোটদের বলেছিল কী করে তার চোখের কোণে একটা ক্ষত হয়েছিল সে কথা। ভ্রূর ওপর দিয়ে আঙুল ছুঁয়ে সে বলে, নর্থ ক্যারোলাইনায় একবার পাকড়াওকারীদের হাতে সে ধরা পড়েও মুক্তি পেয়েছিল সে কথা।
যে ছেলেটিকে কোরা খুন করেছিল তার কথা কদাচিৎ সে স্মরণ করে। সে রাতে ওই জঙ্গলে নিজেকে রক্ষার জন্য ভিন্ন কিছুই করার ছিল না। সে রাতে সে যা করেছিল সে বিষয়ে কারো প্রশ্ন তোলার কোন অধিকার নেই। টেরেন্স র্যান্ডেল নর্থ ক্যারোলাইনার মতই এমন একটা মডেল খাড়া করতে চেয়েছিলেন। পরিস্থিতির কারণেই হানাহানির মাত্রাটাও বেশি ছিল। ভয় তাদের তাড়া করছিল। তুলোর টাকার চেয়ে প্রবল হয়ে উঠেছিল সে ভয়। খামারে এমন একটি কালো হাতের কারবার চলে যে, এক হাতে যা কিছু দেয়, অন্যহাতে তার সবটাই কেড়ে নেয়। এক রাতে সে এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে। একটা শে^তাঙ্গ বালককে খুন করেছিল। তার ফলে সে এমন এক ভয়ংকর দানবে পরিণত হয়েছে যে সবাই তার ভয়ে টটস্থ। প্রত্যেকের ভয়, এবার বুঝি তাকে খুন করবে দানবটা। প্রতিশোধ নিতে তারা সব দলবদ্ধ হয়েছে। ভয় থেকে তারা প্রতিশোধ নেবার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। শতবর্ষ পূর্বে এই ভয় থেকে খুনের উৎপত্তি এবং এখনও তা জারি রেখেছে। সেটা ছিল এক সমুদ্রে তুলো চাষের কাল। দাস ব্যবসায়ীদের হুকুম ছিল সার বেঁধে তুলোর বীজ বুনতে হবে। কিন্তু কিছু বীজ এই সারির বাইরে গিয়ে পড়ে। সেগুলো থেকেই হানাহানি আর খুনের সৃষ্টি। এই হানাহানি থেকেই তুলোর দ্রুত বিস্তার ঘটে। শ্বেতাঙ্গদের ভয় পাবার সত্যিই কারণ ছিল। একদিন বিপুল রক্তদানের মাধ্যমে এর পতন অনিবার্য।
সে এক বিদ্রোহ। সর্বশেষ বন্দিজীবনে সে এই প্রথম হাসল। দেয়ালের গায়ে ইঁদুরের মত ঘেঁষে থাকতে হয় তাকে। মাঠে কিংবা মাটির তলে কিংবা কোন ছ্ট্টো চিলেকোটায় সর্বত্র আমেরিকা হল একটা বিষমদেহী পাহারাদার। (চলবে)
আমিরুল আলম খান
জন্ম যশোর জেলার ভারতীয় সীমান্তলগ্ন শিববাস গ্রামে ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ১৫ই অগ্রহায়ণ।
পড়েছেন এবং পড়িয়েছেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য। এরপর মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে যুক্ত থেকেছেন। যশোর শিক্ষা বোর্ডে প্রথমে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরে চেয়ারম্যান ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি অপেশাদার সাংবাদিকতায় যুক্ত গত পাঁচ দশক ধরে। ইংরেজি দৈনিকে নিউ নেশান-এ প্রায় এক দশক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলো, সমকাল, বণিক বার্তায় কলাম লেখেন।
গ্রামীণ পাঠাগার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশে গ্রামোন্নয়নের নতুন মডেল ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম গণপাঠাগার যশোর পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
শিক্ষা, ভাষা, প্রকৃতি, কৃষি, বাস্তুসংস্থানবিদ্যায় আগ্রহী। এসব নিয়েই তার বই: বাঙলার ফল, অরণ্যের পদাবলী, পারুলের সন্ধানে, কপোতাক্ষ-মধুমতীর তীর থেকে, বিপর্যস্ত ভৈরব অববাহিকা, পারুল বিতর্ক, বাংলাদেশের শিক্ষার স্বরূপ সন্ধান এবং বিদ্যাবাণিজ্যের রাজনৈতিক-অর্থনীতি।
তাঁর অনুবাদগ্রন্থ: আফ্রিকান-আমেরিকান উপন্যাস দি স্লেভ গার্ল। হ্যারিয়েট অ্যান জেকব রচিত এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসটি বোস্টন থেকে প্রকাশিত হয় ইনসিডেন্টস ইন দ্য লাইফ অব এ স্লেভ গার্ল শিরোনামে, ১৮৬১ সালে।