(উৎসর্গ: বল্লরী সেন)
বেশি দেরি না-করে সকাল-সকালই কণাকে ফোন করলাম। আজ ওর জন্মদিন। গত কুড়ি বছরেরও বেশি, এই দিনটায় মনে করে ওকে আমি ফোন করি। ফোনটা ধরেই কণা বলল—
–ভাবছিলাম কখন তোর ফোনটা আসবে। নিলাম নিলাম।
–আরে, বলতে দে!
–আচ্ছা, বল বল।
–শুভ জন্মদিন কণা। অনেক আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা।
–আশীর্বাদ! মার খাবি।
–এই, আমি তোর থেকে বড়ো রে!
–ভুলে যা।
–কীভাবে উদ্যাপন করবি জন্মদিন? কেক কাটবি?
–আর উদ্যাপন! জুমজুমের পরীক্ষা না সামনে! এখন কোনো কিছু করব না। এই চাপটা সামলে নিই, তারপর দেখব। এই তুই আয় না একবার। সেই কবে আঠারো বছর আগে এসেছিলি। আর তো এলি না। সৌগতও বলছিল তোর কথা আসতে পারবি?
–হ্যাঁ, জুমজুমের অন্নপ্রাশনে গেছিলাম। ওর পরীক্ষা হয়ে গেলে যাব।
–সেই ভালো। আমাকে জানাস। স্টেশনে থাকব। এসেই চলে যাবি না। দু-একদিন থাকতে হবে কিন্তু!
–শুধু তোর বাড়ি নয়। অন্য কোথাও নিয়ে যাবি বল?
–ঠিক আছে। আমার মায়ের মামাবাড়ি নিয়ে যাব।
–সেটা কোথায়? বর্ধমানেই?
–হ্যাঁ। বাঘার বলে একটা জায়গায়।
–গ্রাম?
–বলতে পারিস। দাদুদের জমি-বাড়ি গ্রামে। ওখানে। আমি প্রায়ই যাই।
–আর কী আছে? নদী আছে?
–না, ঠিক নদী নেই। তবে বড়ো দিঘি আছে।
–গান শোনাবি তো? দিঘির পাড়ে বসে?
–আর গান! আচ্ছা, গাইব। তুই আগে আয় তো।
–চল, ঠিক যাব। এখন রাখি। খুব ভালো থাকিস। আনন্দে থাকিস।
–থাকব। তুইও আনন্দে থাকিস।
ফোনটা কাটতে যাব, কণা বলে উঠল—
–অ্যাই শোন শোন! দাঁড়া। কাটিস না। বলছি যে, বাইকে চাপতে পারবি তো?
–খুব পারব। তোর স্কুটিতে চেপেছিলাম মনে নেই? মাঝেমধ্যে বাইকে চড়ি। ক্রাচগুলোকে ধরে দিব্যি বসতে পারব। তুই একদম চিন্তা করিস না।
–তাহলে ঠিক আছে। তোকে বাইকে চাপিয়েই বাঘার যাব। নে রাখ।
চুপ করে বসেই রইলাম বারান্দায়। চোখ বন্ধ করে ভাবছি কণার কথা। কী সুন্দর গান গায় কণা! বর্ধমান স্টেশনটা মনে পড়ছে। স্টেশনের বাইরে বেরিয়েই দেখি স্কুটি নিয়ে কণা হাজির। সেটা জুমজুমের অন্নপ্রাশনের আগে। আমাকে পেছনে চাপিয়ে কী সুন্দর নিয়ে গেল! ওর বাড়ির অঞ্চলটার অদ্ভুত নাম। শ্যামলাল। কেন এমন নাম, জিজ্ঞেস করলে বলে জানি না। তুই খুঁজে বার কর। এখন কণা একটা লাল বাইক চালায়। সেটাতে বসার খুব লোভ আমার। ক্রাচ সামলে ঠিক বসব। বাঘার কতই বা দূর হবে!
চরাচর ব্যাপ্ত করে কুয়াশা। মনে হচ্ছে, কুয়াশা নয়, একটা তারের জাল। এতটাই সূক্ষ্ম যে, তাকে ধূসর চাদরের মতো মনে হচ্ছে। এবং, সেটা এই সকালকে আরো ছাই-ছাই আবছা করে দিচ্ছে। চরাচর জুড়ে অখণ্ড এক দিঘি জেগে উঠল। আর কনীনিকায় আলুলায়িত ছলাৎ ছল। ছবির মতো আবছা অন্ধকার চিরে হেঁটে গেছে একটা পথ দিঘির দিকে। পাশে-পাশে ষষ্ঠদশী চাঁদ। স্থির। অচঞ্চল। রূপের মাধুরীতে মোহাচ্ছন্ন করে দিচ্ছে আমায়। আমি অস্থির। হু-হু অস্থির।
বর্ধমান স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দেখি সৌগত দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম। বয়স বেড়েছে। সে কি আমার বাড়েনি। দু-হাতে দুটো ক্রাচ নিয়ে তো আর জড়িয়ে ধরা যায় না। আশেপাশের জনা কুড়ি মানুষ শুনতে পাবে, সেরকম চেঁচিয়েই বলে উঠলাম—
–কতদিন পর দেখা হল সৌগত! বুড়ো হয়েছিস।
সৌগত একগাল হেসে বলল–
–তুই একটুও হোসনি! দে ব্যাগটা আমাকে দে।
পিঠের ব্যাগটা সৌগতর হাতে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম–
–কণা কোথায়? বাইক তুই চালাবি?
–এই তোর দোষ। বাইক বাইক। না, বাইক আনিনি। রিক্সায় যাব। চল, ওই যে রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে।
–কেন আনলি না? কত আশা নিয়ে এলাম।
–শোন, তোকে বাইকে ওঠাবার রিস্ক আমি নেব না। কণাকেও নিতে দেবো না। কণার মাথার কোনো ঠিক নেই। তোকে বলে দিলো, বাইকে চাপাবে। তোদের ওই বাঘার-ফাগার যাওয়া বাইকে চড়ে হবে না। অ্যাকসিডেন্ট হলে তুই জ্যান্ত থাকবি? দুটো ঠ্যাং গেছে, কোমর গেছে, এবার পুরো বডিটাই যাবে। নে ওঠ।
আমি বডি? ভীষণ মুষড়ে পড়লাম। ভীষণ কান্না পেল। বললাম—
–ফিরতি শান্তিনিকেতনে আমি কলকাতায় ফিরে যাব। ব্যাগটা আমাকে দে।
–মারধোর খাবি এবার। নে ওঠ। আস্তে আস্তে ওঠ। আমি ধরছি।
বলে প্রায় ঠ্যালা মেরে আমাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে নিজে উঠতে উঠতে সৌগত বলল—
–বাইকে যেতে দেবো না, গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবো।
–কণার ওপর তোর ভরসা নেই?
–ওর ওই রোগাপটকা চেহারা। জেদ করে বাইক কিনল। নিজের পয়সায়। আমার গজগজ করা ছাড়া করার কিছু নেই। নিজে সামলে-সুমলে চালায়, ঠিক আছে। জুমজুমকে নিয়েও চালায়। আমি কোনোদিন পেছনে বসিনি। আমি গেলে, আমি চালাই। তোকে নিয়ে ও চালাতে পারবে না। পারলেও আমি দেবো না। বললাম তো, গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবো।
রিক্সা এগোচ্ছে। কার্জন গেট। লোকের ভিড়। ডাক্তারের সারবাঁধা চেম্বার। সীতাভোগ মিহিদানার দোকান। আমার বিষাক্ত লাগছে সবকিছু। সৌগতকে সহ্য করতে পারছি না। সে কি বাইকে চড়তে পারব না বলে, নাকি আমার পঙ্গুত্ব উল্লেখ করল বলে?
দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ হলে কণার ছোটোমামি বললেন—
–যাও, এবার তোমরা একটু বিশ্রাম নাও। বিকেলে চা-জলখাবার খেয়ে যাবে। সন্ধে-সন্ধে বর্ধমান পৌঁছে যাবে।
কণা ছোটোমামিকে বলল—
–ফেরার পথে দিঘিটাও দেখিয়ে দেবো ভেবেছি। ওর খুব ইচ্ছে দেখার।
ছোটোমামি বললেন—
–বেশ তো! হিদেকে বলে দেবোখন।
–দরকার হবে না ছোটোমামি। আমিই নিয়ে যেতে পারব।
শেষ বিকেলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠলাম। একটু এগোবার পরই কণাকে জিজ্ঞেস করলাম—
–ওখানে একটা কুঁড়েঘর। কে থাকে রে? আসার সময় দেখিনি তো?
–দেখবি কী করে? তখন তো তুই ওই পাশে বসেছিলি। ওখানেই তো যাচ্ছি। ওই কুঁড়েতে হৃদয়রাম আর রসকলি থাকে।
–হৃদয়রাম মানে হিদে? রসকলি ওর বউ?
–হ্যাঁ। কণ্ঠি বদলের। সবাই ওকে হিদেরাম বা হিদে বলে ডাকে। দিঘিটা দেখতে পাচ্ছিস?
–না তো!
–আর একটু কাছে গেলে দেখতে পাবি। হিদেকে তো দেখলাম কাজ করতে। এখনো ফেরেনি। তবে এখনি ফিরে আসবে। ওকে ছোটোমামি বলেছে আমরা দিঘি দেখতে যাব। আমাকে হিদে বলল, মা জননী, আপনারা এগোন। আমি আসছি।
কথাবার্তার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হৃদয়রাম আর রসকলির কুঁড়েঘরের কাছে। গাড়ি এর বেশি আর যেতে পারবে না। কণা আমাকে জিজ্ঞেস করল—
–হেঁটে যেতে পারবি তো?
–খুব পারব। তুই সামনে থাক। তোকে দেখতে দেখতে যাব, মনের জোর হারাব না।
অন্ধকার হয়ে গেলেও চাঁদের আলো চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। ধু-ধু শূন্যতা। যেদিকে তাকাই ধানখেত। আর দিঘিটা? কুড়ি-তিরিশ ফুট দূরে চাঁদের কণায় ঝিলমিল করছে। হাওয়ায় ছোটো-ছোটো ঢেউ উঠছে। আমার শহুরে চোখে তার আয়তন বিশাল। সার্থক হলাম যেন-বা। কণা আমাকে বলল—
–ওই দ্যাখ, হিদে আসছে।
আমি কণার দেখানো দিশায় তাকিয়ে একজন পুরুষের অবয়ব দেখতে পেলাম। হনহন করে হেঁটে আসছে আলপথ ধরে। কণা ডাকল—
–রসকলি!
একটু পরে একজন নারী কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এসে এক ঝলক দেখেই ভেতরে ঢুকে গেল। কণা এবার বলল—
–লজ্জা পাচ্ছ কেন? আর একজন দিদি এসেছেন তোমাদের ঘরে। আমার বন্ধু। এসো বেরিয়ে এসো। ওই দ্যাখো হিদে আসছে।
রসকলি একটু পরে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। চাঁদের আলোয় তার সাদা কাপড় জড়ানো লম্বাপানা চেহারা। ঘরের দরজার বাইরে এসে থেমে গেল দেখে কণা বলল—
–ভয় পেয়ো না। কাছে এসো।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি রসকলিকে। খুব রোগা নয়। দোহারা চেহারা। বয়স বড়োজোর পঁচিশ। গলায় কণ্ঠি। কপালে চন্দনের ফোঁটা। দু-হাতে এক গাছা করে সরু চুড়ি।
ইতিমধ্যে হৃদয়রাম এসে গেছে। এসেই করজোড়ে ঝুঁকে নমস্কার করে বলল—
–প্রণাম মা জননীরা। আপনাকে আমি দেখেছি। কলকাতা থেকে এসেছেন। মা জননীর বন্ধু হন। ঠাকরুন বলছিলেন। দাঁড়ান আপনাকে একটা আসন দিই।
বুঝলাম, পরের কথাগুলো আমার উদ্দেশ্যেই বলা। হিদের চেহারাও লম্বা। একটু রোগা। পরনে সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা, ওপরে সাদা ফতুয়া। গলায় কণ্ঠি। কপালে চন্দনের ফোঁটা। কণা বলে উঠল—
–হিদে, আসন নয়। টুলটা নিয়ে এসো। নতুন মা জননী নীচে বসতে পারবেন না।
–আচ্ছা আচ্ছা তাই আনি। বলে হিদে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। রসকলি যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে।
হিদে ঘর থেকে টুল এনে আমার সামনে রেখে বলল—
–বসেন মা জননী। আরাম করে বসেন।
তারপর রসকলির দিকে ফিরে বলল—
–অতিথদের জল দিয়েছ?
রসকলি কিছু না বলে ঘরে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পরে একটা থালায় দুটো কাঁসার গ্লাসে জল আর এক খাবলা গুড় নিয়ে এসে হিদের হাতে দিলো। হিদে আমাদের সামনে থালাটা ধরে বলল—
–ন্যান মা জননীরা একটু জল পান করেন।
জল পান করার পর কণার কাছে জানতে চাইলাম এদের সম্বন্ধে। কণা হিদেকে বলল—
–হিদে, আমার বন্ধু তোমাদের কথা শুনতে চাইছেন। তুমি আর রসকলি বলো।
হিদে বলল—
–ও আর কী বলবে! কথাই বলতে চায় না। আমিই বলি। আমার বয়স এই পঁয়ত্রিশ হল। আর ওর বাইশ। আমি কামারপাড়ার আখড়ায় সাধন-ভজন করতাম। সেখানেই বছর দুয়েক আগে রসো আসে। নদীয়া থেকে। মোতি মায়ের সঙ্গে। ও-ও সাধন-ভজন করত। মাধুকরিতে যেত। আমি ভালোবাসলাম রসোকে। বললাম। সে কোনো কথা কয় না। কিন্তু হাবেভাবে না-ও করে নাই। কণ্ঠি বদল হল। আখড়া ছাড়লাম। বুড়াবাবার খোঁজ পেয়ে এখানে এলাম। বললাম সব কথা। রসোর কথা। সংসার পাতার কথা। বুড়াবাবা এই জায়গাতে থাকতে দিলেন। সেরেস্তায় কাজ দিলেন। ঘর ছিলই। বুড়াবাবাই লোক লাগিয়ে ঠিকঠাক করে দিলেন। রসো তরকারি ফলায়। মা ঠাকরুন চাষের চাল দ্যান। দুজনে সাধন-ভজন করি। মাধুকরিতে আর যাই না। ভালো আছি।
আমি চুপচাপ শুনছিলাম হৃদয়রামের কথা। এবার বললাম—
–আপনারা কি বাউল?
হৃদয়রাম বলল—
–সে সাধন আর পুরোপুরি ধরে রাখতে পারলাম কই? সংসার টেনে নিল। এভাবে যদ্দিন…
–আর সন্তান? চান না আপনারা?
–আমার সেদিকে টান হয়। কিন্তু রসো চায় না। ও না চাইলে তো আর হবে না। এই বেশ আছি। কী বলেন? তা মা জননীরা কি এখনই চলে যাবেন? একটু থাকেন। ভাত চাপাই, গরিবের ঘরে দুটো সেবা করে যান।
কণা বলল—
–আজ আর হবে না হিদে। আবার আসব। এখন একটু গান হোক। কী বলো? রসকলি, দিদির শখ দিঘির পাড়ে বসে গান শুনবে। আমার আর গান গাওয়া হয় না। তুমিই শোনাও। নিয়ে যাও দিদিকে।
রসকলি একভাবে ঘরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সঙ্গে আছে না নেই, বোঝার উপায় নেই। গান শোনাতে বলল কণা, সেদিকেও কোনো হুঁশ নেই যেন। হৃদয়রাম উঠে গিয়ে ঘর থেকে একতারাটা এনে রসকলির হাতে দিলো। তারপর আমার কাছে এসে বলল—
–চলেন মা জননী।
আমি উঠতেই হৃদয়রাম টুলটা হাতে নিয়ে আগে আগে গিয়ে দিঘির পাড়ে রেখে বলল—
–বসেন মা। আরাম করে বসেন।
রসকলি একতারা হাতে খুব ধীরে ধীরে এসে আমার থেকে একটু দূরে একটা বড়ো গাছের নীচে দাঁড়াল। দিঘির পাড়ে এই একটাই গাছ। বাকি জমিতে ধান। কে যেন এই গাছটা রেখে দিয়েছে। যেন আমি আসব বলেই। ভালোই লাগছে দেখতে। চাঁদের কিরণ দিঘির জলে। ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ একতারার টুং-টুং আওয়াজে রসকলির দিকে তাকালাম। মনে মনে সুর মেলাচ্ছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, গান না হলেও এখানে সম্পূর্ণ রাত, যতক্ষণ চাঁদ, ততক্ষণ বসে থাকতে পারব। দিঘির জলে হাত ডোবালে অভ্রর মতো চাঁদের কণা হাতে লেগে যাবে। উঠে জলের কাছে যাব, এমন সময় রসকলি গান ধরল। উদাত্ত কণ্ঠে। ধানখেতে যেন ঢেউ খেলে গেল।
কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়?
জয় অজানার জয়।
এই দিকে তোর ভরসা যত, ওই দিকে তোর ভয়?
জয় অজানার জয়॥
চেঁচিয়ে উঠলাম—
–রসকলি, এ তুমি কোন গান ধরলে? এ গান তুমি কোথায় শিখলে? কোথায় শিখলে? কে তোমার এই সর্বনাশ করল?
আমার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম কোনো বাউল গান শুনব। রসকলি গেয়ে যাচ্ছে। গ্রাম্য আন্তরিক। শহুরে পালিশহীন কণ্ঠে। ওর কণ্ঠে তো কই সর্বনাশ নেই। কেন বললাম?
জানাশোনার বাসা বেঁধে কাটল তো দিন হেসে কেঁদে,
এই কোণেতেই আনাগোনা নয় কিছুতেই নয়।
জয় অজানার জয়॥
বসে পড়লাম দু-হাতে মুখ ঢেকে। কোথায় আমার দুয়ার। কোথায় আমার পার হওয়া। কোথায় কী? এই শূন্য প্রান্তর। এই ধানখেত। এই জ্যোৎস্না। গাছের নীচে ওই মানুষ। এই জলের গভীরতা কত? এই জলের নীচে কী আছে? সব কেমন একাকার হয়ে যাচ্ছে।
মরণকে তুই পর করেছিস ভাই
জীবন যে তোর তুচ্ছ হল তাই।
আমার ইচ্ছে করল রসকলির পা দুটো জড়িয়ে ধরি। ইচ্ছে করল এই দিগন্তব্যাপী বিস্তৃত দিঘির চারপাশ আমার হোক। আমি না-হয় গেলামই হারিয়ে। দিঘি আমাকে চুম্বকের মতো টানছে। আমি ওখানে যাব।
দু দিন দিয়ে ঘেরা ঘরে তাইতে যদি এতই ধরে,
চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়?
জয় অজানার জয়॥
একটু একটু করে চাঁদের কণা মেখে আমার অকেজো পা দুটো ডুবে যাচ্ছে জলের ভেতরে। আমি ক্রাচ ছাড়াই পায়ের তলায় জলের চাদরে হাঁটতে পারছি। উথালপাথাল করে ভেসে বেড়াচ্ছে—সেই কি শূন্যময়? জয় অজানার জয় জয় অজানার জয়। সেই সুরের রেশ মেলাতে না মেলাতেই ছপ ছপ একটা শব্দ আমার কোমর জড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল—
–মা জননী!
রোদ ওঠে। কুয়াশা কাটে না। সূর্যটা খুব ম্লান।
সুদেষ্ণা মজুমদার
জন্ম ১৯৬৫-র ১০ ডিসেম্বর উত্তর কলকাতায়। বেড়ে ওঠা, পড়াশুনো সবই আজ পর্যন্ত একটানা কলকাতাতেই। কিন্তু মনের তলায় সরষে, সেই ঘুরে বেড়ানো স্বভাব নিয়ে গদ্যসংস্কৃতির নির্দিষ্ট বাঁধা সুর, গঠন বা আঙ্গিকের ঢং অগ্রাহ্য করে সুদেষ্ণা মজুমদারের লিখছেন। চিরায়ত গদ্যসীমার অনুশাসন ভেঙে প্রতিবার জন্ম দিয়েছেন ভিন্নধারা ও ভাষার কারুকাজ আঁকা গল্প ও উপন্যাস।
প্রকাশিত বই :
১. সেই সাপ জ্যান্ত, (গল্প সংকলন, কৌরব, কলকাতা, ২০০৯)
২. নিঃসঙ্গতা এক অন্তহীন কারুকাজের আরামকেদারা (উপন্যাস, কৌরব, কলকাতা, ২০১১)
৩. মায়া, নগর এবং একটি গল্পনা (উপন্যাস, প্রকাশক আড়িয়াল, ঢাকা, ২০১৩)
এছাড়া অসংখ্য পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে রয়েছে নানা রকমের গল্প, গদ্য ও জার্নাল।
কী পড়লাম! কেন পড়লাম! বড্ড মন কেমন করা এ লেখা তুমি কেন লিখলে! আমি মুগ্ধ, ঘোরগ্রস্ত পুরো।
“দু দিন দিয়ে ঘেরা ঘরে তাইতে যদি এতই ধরে,চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়? জয় অজানার জয় ॥”
ভারী সুন্দর লেখা টা। যেদিন প্রকাশ হলো সেদিন ই পড়েছিলাম। আজ আবার পড়লাম। মন ভরে গেলো।