পুলক দত্ত
বেশ ক’বছর আগের ঘটনা।
পাড়ার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে নন্দিনী কলেজ শেষে বাসায় ফিরছিল। ছেলেটি এগিয়ে এসে বলেছিল,
– শুভ জন্মদিন, নন্দিনী।
হাতে তুলে দিয়েছিল, কিছু তাজা লাল গোলাপ আর রঙিন কাগজে মোড়া প্যাকেট।
নন্দিনী সবগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিল,
-অভদ্র।
ছেলেটি শান্তভাবে ফেলে দেয়া ফুলগুলো কুড়িয়ে তুলে বলেছিল,
– ফুল দেয়ার জন্য যে অভদ্র বলে, সেকি ভদ্র?
নন্দিনী রেগে গিয়ে মুখে যা আসল বলেছিল।
এসব ঘটনায় যা হবার তাই হয়েছিল। কিছু লোক নন্দিনীর পক্ষ নিয়ে প্রথমে ছেলেটির সাথে তর্ক, তারপর হাতাহাতি।
অপমানিত হয়ে যাবার আগে ছেলেটি বলে গিয়েছিল,
– সবাই বখাটে হয়না, কেউ কেউ সত্যিকারের প্রেমিক হয়।
তারপর সময় গড়াতে লাগল সময়ের নিয়মে। মাঝেমাঝে ছেলেটির কথা নন্দিনীর মনে পড়ত। কলেজে আসা-যাওয়ার পথে ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকত। পিছু পিছু কিছুদূর হাঁটত। তারপর ফিরে যেত। কোনদিন বিরক্ত করেনি। সেদিন কিছু বুঝে উঠার আগেই কিযে হয়ে গেল।
তারপর থেকে সেই ছেলেটি আর কখনো নজরে আসেনি।
নন্দিনীর স্বামীর সাথে নিউইয়র্কে বাস প্রায় পাঁচবছর হয়ে গেল। এমন চাকচিক্যময় শহরের এমন দুর্গতি সে আর কখনো দেখেনি। চারদিকে শুধু মৃত্যু আর আতংক।
নন্দিনীর কদিন থেকেই জ্বর। চারবছরের মেয়েটিকে শ্বাশুড়ির কাছে রেখে স্বামীকে নিয়ে একরকম আতংক নিয়েই হাসপাতালে গেল।
যে ভয় করছিল, সেটাই। ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে গেল।
কোভিড-১৯ পজেটিভ।
সেদিনই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেল।
নন্দিনী লক্ষ্য করেছিল, পিপিই পরা এক ডাক্তার সাহেব একটু বেশি কেয়ার নিচ্ছিল। প্রায় সবসময় নন্দিনীর পাশে ছিল।
একসময় নন্দিনী করোনা জয় করল।
বাসায় ফেরার আগে ভাবল, ঐ ডাক্তার সাহেবকে একটা ধন্যবাদ দেয়া প্রয়োজন।
কেন জানি তার মনে হতে লাগল, ঐ ডাক্তারের সাহচর্য ছাড়া এ যাত্রায় হয়তো সে রক্ষা পেতনা।
সে ডাক্তারের খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারল-
রোগীর সেবা দিতে গিয়ে ডাক্তার নিজেই করোনা আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
নন্দিনীর এত খারাপ লাগছিল। মন হু হু করছিল।
তবে কি সে দায়ী?
কাস্টমার সার্ভিসে গিয়ে ডাক্তারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই অভ্যর্থনাকারী বলল,
– আপনি কি নন্দিনী?
নন্দিনী হ্যাঁ বলতেই অভ্যর্থনাকারী নন্দিনীর হাতে একটি চিঠি দিয়ে বলল,
– ডাক্তার সাহেব আইসোলেশনে যাবার আগে এই চিঠি আপনাকে পৌঁছে দিতে অনুরোধ করেছিল।
নন্দিনীর বুকের ভেতর কেমনজানি মোচড় দিয়ে উঠল।
অজান্তেই নন্দিনীর চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগল।
কাঁপা হাতে খাম খুলে চিঠি পড়া শুরু করল –
নন্দিনী,
দৃষ্টিসীমার যতই দূরে থাকো, আমি সবসময় তোমার পাশাপাশি আছি। তুমি টের পাও না? আমি তোমাকে সবসময় দেখতে পাই। আমি সবসময় তোমাকে কাছে পাই। যদি জিজ্ঞেস করো কেন, কিভাবে? আমি বলতে পারব না। সবার মধ্যে বসে থেকেও মনে হয়, কোন এক জায়গায় ঐ মেয়েটি একান্তই আমার। আমার মতন করে তোমাকে আর কেউ জানেনা। এই অনুভূতিটুকু সত্যি হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। কিন্তু এমন ভাবনা আমাকে গভীর তৃপ্তি দেয়। আমাকে এতদিন বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছিল। কেননা, এ স্বপ্ন তুমিই আমাকে দেখতে শিখিয়েছ। জানিনা, এ পৃথিবীর আলো আর দেখতে পাব কিনা। তাই শেষবার বলে যাই, সবাই বখাটে হয়না, কেউ কেউ আমার মতোও প্রেমিক হয়।
সুখে থেকো।
-গলির সেই অভদ্র ছেলে।
পুলক দত্ত
জন্ম ও বেড়ে ওঠা শ্রীমঙ্গল শহরে। বর্তমানে নিউইয়র্ক শহরে বসবাস করছেন।কবিতা ও গল্প লেখেন। অনুগল্প রচনায় রয়েছে বিশেষ আগ্রহ।