তমালিকা জরুরী ভিত্তিতে খবর পাঠালে নিধির মা আবেদা আর মেয়েকে নিয়ে মজনু’র রিক্সায় চেপেছিল। মিনিট বিশেকের দুরত্ব বেশ দীর্ঘ মনে হয়েছে।
দুপুরের আগে আগে শোবার ঘর অন্ধকার ক’রে তমালিকা কুন্ডুলি পাকিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার রক্তশূন্য মুখ, নিধি’র মা’কে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। ঘরের মেঝেতে রক্তের ক্ষীণ স্রোত। নিধি’কে বসার ঘরে টেবিলে ছবি আঁকতে বসিয়ে তমালিকার তত্ত্বাবধান করে। ঘি’ রঙ্গের দুটো টাওয়েলই ভিজে লাল হয়ে গেছে।
-‘বিয়ের সময় উপহার পাইছিলাম’- তমালিকার কণ্ঠস্বরে অপরাধবোধ,‘নেয়ার মত তখন হাতের কাছে আর কিছু দেখি নাই। বুবু, অনুপ এই তোয়ালা দুইটারে খুব যত্ন করে, বলে যে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক এই তোয়ালা দিয়া প্যাচায়া কোলে নিবে’।
নিজের চেয়ে অনুপের প্রিয় তোয়ালে নষ্টের কষ্টে তমালিকা ভেসে যায় বেশী। অনুপ অফিসের ট্যুরে ঢাকা গেছে। আর এই সংবাদ সে অন্যান্য সরকারী অফিসারদের বৌদেরকে দিতে চায় না (বিশেষত যারা তার অন্তস্বত্তা হবার সুসংবাদে মিষ্টান্ন খেয়েছে)।
তার শোবার ঘরের দেয়ালে বাঁধানো বিয়ের ছবির পাশে শিশুর ছবির বড় পোষ্টার স্কচ টেপ দিয়ে আটকানো, দুটি ছেলে শিশু। দু’জনের খালি গা, আপেলের বাক্স থেকে গড়িয়ে পড়া লাল আপেল দেখে খিল খিল হাসছে। ঘুম ভেঙ্গে তমালিকা এই শিশুদের ছবি দেখে। কথিত আছে, অন্তঃস্বত্তা মা সুন্দর শিশুর কল্পনা করলে তার সন্তান রূপবান হয়। এই ছবি তমালিকার কল্পনায় সাহায্য করে। খাটের বাজুতে ভাঁজ করা অনুপের লুঙ্গি। ওয়ার্ডোবের ওপরে অনুপের বই খাতা।
সকালে ঘুম থেকে উঠে রোজকার মত বাগানে পানি দিচ্ছিল তমালিকা। উরু গড়িয়ে নামা তরল আসলে কি বুঝতে পারে নি। মাটিতে লাল ফোটা দেখে তৎক্ষনাৎ পা চেপে বসে পড়েছিল, রক্তের ধারা যদি কোনমতে ঠেকানো যায়। এত বড় ক্ষতি সে পুষিয়ে নিতে পারবে না। অনুপের বিরাশি বছর বয়সী বাবা নাতি’র মুখ দেখে মরতে চায়।
তমালিকার বিরামহীন কথা প্রলাপের আকার ধারণ করে।
ভাগ্যিস মজনুকে রিক্সা সমেত দাঁড় করিয়ে রেখেছিল নিধির মা। ডাক্তার আসতে খুব বেশী সময় লাগে না। তমালিকা ব্লাউজের হাতা গুটিয়ে, চোখের কোন শক্ত করে কুচকে ইঞ্জেকশনের নেয়। পরের দিন হাসপাতালে গিয়ে ডি এন্ড সি করিয়ে আনতে বলে ডাক্তার, ছোট্ট হাসপাতাল হলেও সেখানে এর সুবন্দোবস্ত আছে।
আবেদা ডেটল পানি ঢেলে ঘর ধুয়ে মুছে দিলে ঘরময় হাসপাতাল হাসপাতাল গন্ধ ছড়াতে থাকে। গরম দুধের গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়ে হু হু করে আবার কেঁদে ওঠে তমালিকা।
বাড়ি ফিরতে সেদিন বিকেল গড়িয়ে গেল। নিধিকে ডলে ডলে কলের নিচে দাঁড় করিয়ে গোসল দিচ্ছে এমন সময় বাবা বাড়ি ফেরে। তাকে দূরের হাটে, যেখানে পাটক্রয়ের শাখা খোলা হচ্ছে- যেতে হয়েছিল। সব শুনে ভ্রু কুচকায়।
-‘মানুষের বৌ নিয়া টানা হেঁচড়া করার তোমার কি দরকার। প্রয়োজন পড়লে ওদের ডিসি, এ’ডিসির বৌ’রা ছাড়াও কত মানুষ আছে। অনুপ নাই, এখন খবরদার এইসব ঝামেলায় জড়াবা না’।
যেন রায় ঘোষণা করে বাবা।
নিধির মায়ের চোয়ালের কাছ একটুখানি শক্ত দেখায়। ঠোঁট টিপে চুপ থাকে, আইন মানার ধারে কাছে যাবে না যেন ঠিক করে রেখেছে।
পরের দিন সকালে রুটি ভাজি খেয়ে নিধির বাবা বেরিয়ে গেলে, শাড়ি পালটায় সে। নিধিকে না
নিয়েই বেরোতে চেয়েছিল, কিন্তু মেয়েটা এমন প্রবল কান্না জুড়ে দিলো যে হাল ছেড়ে দিয়ে
তাকেও সঙ্গে নিতে হলো। কি না, সে হাসপাতাল দেখবে।
-‘হসপিটালে তোমার বমি আসবে নিধি। গন্ধ, মানুষের অসুখ, কতক্ষণ লাগবে জানি না তো। বাসায় থাকো মা, আবেদার সঙ্গে খেলো।
অনেকক্ষণ লাগবে শুনে নিধি আরো ব্যাকুল হয়ে গেল, মায়ের আঁচল ধরে রিক্সার সীট জাপ্টে থাকলো।
-‘বুবু আমি মারা যাচ্ছি না তো’?
তমালিকা মাথায় আঁচল তুলে দিয়েছে। গায়ে বেগুনি রং শাল জড়িয়ে রেখেছে। হাসপাতালের প্রায় ফাঁকা করিডোরে নতুন চুনকাম থেকে রঙ্গের গন্ধ আর ভাপ বের হচ্ছে। নিধির মা তমালিকাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। একটু পরে তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হবে। একজন নার্স শাড়ির কড়মড় শব্দ তুলে ভেতরে ঢুকে যায়। তমালিকা অল্প কাঁপতে শুরু করে।
-‘অনুপ কালকে রাত্রে ফোন করছিলো বুবু? আমার এত ভয় লাগলো। কিছুতেই বলতে পারলাম না। চাকরীটা ছাড়া আমাদের আর কিছু নাই, ওর ফ্যামিলিটাও নিডি ফ্যামিলি। ওই তো বড় ছেলে। আমি বললেও সে অফিসের ট্রেনিং বাদ দিয়া আসবে না। আর ডাক্তার যে বললো আজকেই সব করতে?’
নিধির বাবার কুচকানো কপাল চোখের সামনে ফিরে ফিরে আসে। এখানে কতক্ষণ লাগে কে জানে! ততক্ষণে ও কি ফিরে আসবে বাসায়?
হাসপাতালে অবশ্য বেশী সময় লাগে না। তমালিকা ভেতরে ডাক্তারের টেবিলে। নিধি আর তার মা হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে হেঁটে সময় পার করে। নার্স যখন তাদেরকে ভেতরে ডাকে, তমালিকা রক্তশূণ্য, হতবিহবল।
-‘বুবু, ডাক্তার বলল আমি এখন পরিস্কার। আগে কি আমি নোংরা ছিলাম! জানলাম না আমার ছেলে না মেয়ে রক্তের সাগর হইয়া ধুইয়া গেল বুবু’।
মজনু’র রিক্সায় বসে তমালিকা নিধির মা’র হাতের কব্জি আঁকড়ে থাকে, আতংক হচ্ছে তার – অনুপের মুখোমুখি হওয়ার ভয় তাকে ছোট্ট গুটিপোকা বানিয়ে দিচ্ছে।
ঢাকা থেকে অনুপ ফিরে এসেছিল আরো দু’দিন পরের এক সকালে।
নিধিদের বাসায় এসেছে আরো পরে, বিকেলের দিকে। যথেষ্ঠ দিনের আলোতেও অনুপের মুখ অন্ধকার। তমালিকা নাকি কাটা গাছের মত তার পায়ের কাছে পরে থেকেছে সারা দুপুর, কিন্তু তার মন গলেনি।
নিধির মা’য়ের সঙ্গে কথা বলার কোন ইচ্ছাই তার নাই। চেয়ারে পেছন ফিরে বসেছিল নিধির বাবার মুখোমুখি।
-‘আপনার ওয়াইফ এটা একটা কাজ করলো? আমার একটা মান সম্মান আছে না? এইভাবে সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে, আমার পরিবার। এই ছোট্ট শহরে কিছু গোপন থাকে? আমি একজন ম্যাজিষ্ট্রেট। আমি কল্পনাও করতে পারতেছি না, ওহ’!
আর্তনাদ বেরিয়ে আসে অনুপের চেপে রাখা দু’ঠোঁট থেকে। দু’হাতে কপাল চেপে রাখে সে।
নিধির বাবার বিস্ফারিত চোখ ঘরের মধ্যে পাক খায়।
কই, সে তো কিছু জানে না! তার না জানার সংবাদ অনুপের দৃষ্টিকে আরো খর করে দরজার কিনার ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নিধির মা’র অঙ্গ স্পর্শ করে।
-‘ঘরের স্ত্রীলোক আপনার অনুমতি ছাড়া আমার পরিবারকে কোন সাহসে হাসপাতালে নিয়ে যায়?’
নিধির বাবাকে নিরুত্তর দেখে এইবার দরজা ছেড়ে এগিয়ে আসে মা- ‘এইভাবে বলতেছেন কেন? হাসপাতালে না নিলে তমালিকা মরেও যাইতে পারতো!’
-‘মরলে আমার বউ মরতো, আপনের কি?’… অনুপ প্রায় হুঙ্কার দিয়ে ওঠে… ‘আমারই ভুল হইছিল, আপনারা মেলামেশার উপযুক্ত না, জাতের মানুষ না আপনারা’।
নিরুত্তর নিধির বাবাকে রেখে এক পর্যায়ে অনুপ চলে যায়।
নিধির মা তখন চেয়ার টেনে সামনে বসে- ‘তুমি এই লোকটাকে কিছুই বলতে পারলা না? বাড়িতে আইসা অপমান করলো?’
-‘কি বলবো ভদ্রলোককে? আমার নিজের লজ্জা রাখার কোন জায়গা আছে? তুমি আমাকে অপমান করছো আর ওই ভদ্রলোককেও।’
নিধির বাবা কি ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি! কোন মন্ত্রবলে জেগে উঠে উগরে দিচ্ছে লাভাস্রোত, তপ্ত শাণিত। হিস হিস নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। নিধির মা’র মনে হয়- এই লোক আসলে কোনদিন তাকে ভালোবাসে নাই। ভালোবাসাহীন চোখের দিকে তাকিয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে সে।
দুপদাপ উঠে গিয়ে তার মোটর সাইকেল স্টার্ট নেয়ার শব্দ পাওয়া যায়। মুহূর্তে উৎকন্ঠিত হয়ে ওঠে নিধির মা। কোথায় বেরিয়ে গেল এই রাত্রে? যদি কিছু হয়, দুর্ঘটনা!
পাওয়ার হাউসের সাইরেন বাজে, রাত এগারোটার। এখন নাইট ডিউটির কর্মচারীরা এসে পড়বে। রাত নিঝুম হতে শুরু করেছে, ক্যানালে পানির কলকল শব্দ স্পষ্ট হতে থাকে। বিছানায় ন্যাতানো না খাওয়া নিধিকে ঘুমে রেখে মা বারান্দায় ঠায় বসে থাকে। যদি হঠাৎ ঝলকানি দিয়ে মোটর বাইকের আলো উঠোনে এসে পড়ে।
তার ঝিমুনি আসে, কিন্তু বাবা সেই রাত্রে আর ফেরে না।
নাহার মনিকা
উৎকর্ষের দিকে মনযোগী লেখকদের তালিকায় নাহার মনিকা একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নাম। ঈদসংখ্যা ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’-য় কবিতা দিয়ে নাহার মনিকা’র লেখা প্রকাশের শুরু। তারপর দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন দেশের জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাস নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ছয়।
উপন্যাস- ‘মন্থকূপ’ (বৈভব প্রকাশন, ২০১৯), ‘বিসর্গ তান’ (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ২০১৬)।
গল্পগ্রন্থ- ‘দখলের দৌড়; ( পুথিনিলয় ২০১৯), ‘জাঁকড়’ (দিব্যপ্রকাশ, ২০১৪), এবং ‘পৃষ্ঠাগুলি নিজের (দিব্যপ্রকাশ, ২০১১)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ চাঁদপুরে আমাদের বর্ষা ছিল’(বাংলামাটি প্রকাশন)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Health Policy, Planning & Financing এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। বর্তমানে ক্যানাডা’র ক্যুবেক প্রদেশে সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত আছেন।
লেখালেখি নাহার মনিকা’র কাছে অপার স্বাধীনতার জগৎ, যেখানে লেখক একমেবাদ্বিতীয়ম।