দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল ভাষার মাস। লেখক পাঠক প্রকাশকের অধীর আগ্রহের বাংলা একাডেমি একুশে বই মেলার মাস। অতিমারি কোভিডের ছোবল বিশ্বজুড়ে অগণিত প্রাণ ও অসংখ্য ঘটনা মানুষের জীবন থেকে কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি কেড়ে নিল বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনের অধীর আগ্রহ ও ঐতিহ্যের এক উৎসব, এক মিলনমেলার মাস।
সময়টা পেরিয়ে গেলেও উৎসব যজ্ঞটা হারিয়ে যায়নি। কোভিড সংক্রমণের ধারা ও পূর্বাভাস বলছিল ফেব্রুয়ারি মাসটা হবে বাংলাদেশে কোভিডের দ্বিতীয় ধাক্কার (সেকেণ্ড ওয়েভ) মাস। বাংলা একাডেমি তাই সঙ্গত কারণেই জনমানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টা বিবেচনায় এনে ফেব্রুয়ারি মাসের নির্ধারিত বই মেলাটি পিছিয়ে মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি, এই সময়টায় করবার সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল।
পিছিয়ে কোনো একটা সময়ে মেলা করার সিদ্ধান্তটি চট করে আসেনি। প্রথম প্রস্তাবনা ছিল অন্তর্জাল ভিত্তিক বইমেলা আয়োজনের। যা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা লেখক প্রকাশক ও পাঠকদের কাছে খুব একটা সুখপ্রদ সিদ্ধান্ত ছিল না। নানা মতের পক্ষ বিপক্ষ নিয়মিত সশরীর উপস্থিতির আয়োজন আর অন্তর্জাল ভিত্তিক আয়োজন নিয়ে বহুবিধ প্রস্তাবনা ঘিরে অনেক তর্ক-বিতর্ক চলেছে। ভার্চুয়াল নাকি রিয়েল? সচেতনরা ভার্চুয়াল বইমেলার আয়োজন মেনে নিলেও রিয়েল বইমেলা না হবার শোকে কাতর ছিলেন। বইমেলা তো আর স্রেফ বইমেলা নয়, লেখক পাঠকের বাৎসরিক মিলনমেলা, অবারিত মিথস্ক্রিয়ার সম্মিলনী। প্রকাশকদের একমাসের বিক্রয় উৎসব।
এমন একটা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল বইমেলা নিয়ে যারা গভীরভাবে ভেবেছিলেন তারা এক অর্থে খুশি হচ্ছিলেন। যদিও প্রযুক্তির পরিভাষা ও কলাকৌশলে স্বচ্ছন্দ নন এমন অনেক পাঠক লেখক প্রকাশক এতে খুব একটা সম্মত ছিলেন না। কিন্তু ভার্চুয়াল বই মেলার পরিধি, বিশেষত প্রকৃত ব্যপ্তি ও সুফল এক অর্থে রিয়েল বইমেলার চেয়ে অধিকতর বিস্তারে, বহুলাংশে সফল ও বৃহৎ বৃত্তে মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে; মেলার শশরীর আগমন উপস্থিতি সংখ্যা এবং স্থান ছাপিয়ে দেশব্যাপী, এমন কী দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী বাঙালিদের মধ্যে সহজে ছড়াবে, অনায়াসে পৌঁছে যাবে এ সত্য সর্বাংশে উপলব্ধি করতে পারেননি সনাতনীরা। বিষয়টা একটু খোলাসা করে একে একে সবিস্তারে বলি।
এক। সশরীর বা রিয়েল বইমেলায় উপস্থিত হয়ে তার আস্বাদ নিতে পারবে ঢাকায় থাকা মানুষগুলো এবং বইমেলাকে উদ্দেশ্য করে ঢাকার বাইরে বা দেশের বাইরে থাকা মানুষগুলো ঢাকায় এসে বইমেলায় গেলে। পক্ষান্তরে অন্তর্জাল ভিত্তিক বইমেলায় ঘরে বসে সারা দেশের এমন কি গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়েছিঁটিয়ে থাকা যে কেউই সহজে উপস্থিত হতে পারবে।
দুই। বইমেলায় সশরীরে এসেও প্রতিটি মানুষ সবগুলো স্টল ঘুরে দেখে উঠতে পারেন না। সব বইয়ের হদিস জেনে উঠতে পারেন না। অথচ অন্তর্জাল (অনলাইন) ভিত্তিক বইমেলায় কেউ চাইলেই প্রত্যক স্টল দেখা, প্রত্যেক স্টলে প্রকাশিত বইয়ের হদিস বের করা সম্ভব করে তুলতে পারবেন।
তিন। বইমেলার আঙ্গিনায় রোজ নতুন বইয়ের ঘোষণা, মোড়ক উন্মোচন, বই আলোচনা, লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের উপস্থিতি ও আলাপ আলোচনার সবই কিংবা স্রেফ তার পছন্দেরটিও দেখে বা শুনে উঠতে পারবেন এ নিশ্চয়তা নেই। না পারার সম্ভাবনাই প্রখর। প্রতি বছর অগণিত মানুষের এই নিয়ে আফসোস থাকে। ভার্চুয়াল বইমেলায় যে কেউ ঘরে বসেই এমন আলাপ-অনুষ্ঠানগুলোর সব বা তার পছন্দের সব দেখতে ও শুনতে পারবেন সহজেই। যে কোনো অবসরে ঘরে বসে।
চার। মেলায় সশরীরে রোজ আসা কিংবা কাজের ভিড়ে যথাসময়ে আসা এই জ্যামের শহর ঢাকায় একটা অটল প্রতিবন্ধকতা, সুবিশাল চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ভার্চুয়াল বইমেলায় যে কোনো সময় কেউ তার ঘরে বসেই রোজ মেলায় ঘটে যাওয়া প্রতিটা আয়োজনের নাগাল পেতে পারবেন তার নিজস্ব সুবিধা মতো। যেনো তিনি প্রতিদিনই মেলায় উপস্থিত থাকলেন।
পাঁচ। রিয়েল বইমেলা বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্থানিক সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে যাতে পারবে। গোনাগুনতি মানুষের বদলে কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যেতো ঢাকার সীমাবদ্ধ আঙ্গিনা পেরিয়ে। পৌঁছে যেতো বাংলাদেশের সর্বত্র, এমন কি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে গোটা বিশ্বে।
ছয়। শুধুমাত্র মেলায় উপস্থিত মানুষটিই ক্রেতা না হয়ে গোটা দেশের যে কেউ চাইলেই ক্রেতা হতে পারতো। ক্রেতার সংখ্যা ও বই বিক্রির সংখ্যা অনেক পরিমাণে বাড়তো। এমন কি এই বিপনন প্রক্রিয়া ক্রমে সারা বছরের জন্যও চলমান থাকতে পারে। ঢাকায় উপস্থিত প্রকাশক ছাড়াও দেশের যে কোনো জায়গা থেকে একজন প্রকাশক সহজেই বইমেলার অংশ হতে পারতো।
সাত। ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং বৈশ্বিক প্রযুক্তিনির্ভর নৈমিত্তিকতার সাযুজ্যে বইমেলা ঘিরে নতুন এবং অতীব প্রয়োজনীয় একটা প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চ তৈরি হয়ে যেতো। গোটা বিশ্বে সকল প্রকার কেনাবেচায় অনলাইন বিপণনের যে জোয়ার বিদ্যমান এবং ক্রমশ বর্ধিষ্ণু পরিধিতে সম্প্রসারমান, তার সাথে সঙ্গতি রেখে এগিয়ে যাওয়ার পথ চলা শুরু করতে পারতো বাংলাদেশের প্রকাশনা খাতটিও।
আট। প্রতিটি লেখক, প্রকাশক ও বই আরও অনেক বেশি মানুষের হাতের ও জানার নাগালে পৌঁছে যেতো। এমন কি গত এক দশক ধরে মৌসুমি লেখক এবং অনুরোধের বই কিনে বাজেট অপচয় (অপচয় বলছি কারণ এই অনুরোধের বইগুলো অধিকাংশ ক্রেতাই সত্যিকার অর্থে পড়েন না) না হয়ে ভালো বইয়ের বিক্রয় বাড়ার ভিতর দিয়ে শ্রেয়তর সাহিত্য নির্মাণের পথ সুগম হতো।
এভাবে নানা যুক্তির মোড়কে আরও কারণ তুলে ধরা যাবে। তা বাদ দিয়ে বরং ভার্চুয়াল বইমেলা আয়োজনে চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতা এবং তা থেকে উত্তরণের প্রশ্ন এবং সম্ভাব্য পথ ও নাগালে অবস্থান করা সাফল্য সম্ভাবনার সুবর্ণ সুযোগটা নিয়ে দুটা কথা বলি।
দেশের সকল প্রকাশনী ও সকল প্রকাশিত বইকে একটা অন্তর্জাল ভিত্তিক সূত্রে তুলে ধরা সম্ভব হতো, রোজ বইমেলায় যত বই নিয়ে আলোচনা, মোড়ক উন্মোচন, লেখক সাক্ষাৎকার বা আলাপ হয় বিভিন্ন মঞ্চ জুড়ে তার সব অডিওভিজ্যুয়াল অন্তর্জালের সেই আয়োজনে সংযুক্ত করা সম্ভব হলে তা যে কোনো সময় যে কেউ তার হাতের নাগালে পেয়ে যাবে; কিছুইবিথারে হারাবে না। কেনাবেচার লেনদেনগুলোর অনলাইন সুবিধা যে কেউ চট করে করে উঠতে পারা সহজ ও সম্ভব একটি কাজ নয়। কিন্তু বাংলা একাডেমি জাতীয় অবকাঠামোর সহায়তায় ও সরকারী সহযোগিতায় অনায়াসে এমন একটা আয়োজন করে ফেলতে পারে।
এইসব সুবিধার সুবিবেচনায় একবার শুরু হলে নিয়মিতভাবেই বই বিপননের দেশব্যাপী মঞ্চটা তৈরি হয়ে যেতো। তাতে লেখক, প্রকাশক, পাঠক সকলেই বিদ্যমান পরিধি ও পরিমাপ ছাড়িয়ে অনেক বৃহৎ একটা পরিসরে পৌঁছে যেতো। আমি মনে করি বাংলা একাডেমির পক্ষে সেই আয়োজন করবার সময় সুযোগ এখনও আছে। কারণ, ভার্চুয়াল বইমেলা ঘিরে যেভাবে আলোচনা হচ্ছিল এবং বইমেলা হবে হয়তো যথাসময়ে কিংবা বিলম্বিত কোনো সময়ে – এই রকম ভাবনা থেকে বাংলা একাডেমি কিছু না কিছু প্রস্তুতি নিশ্চয় আগে থেকেই নিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে এই কাঙ্ক্ষা ও অনুরোধ বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে যাক, রিয়েল বইমেলার পাশাপাশি ভার্চুয়াল বইমেলার আয়োজনও হোক, এই কামনা রইলো।
আমি নিশ্চিত ঠিক আজ না হলেও দেশের সকল লেখক পাঠক প্রকাশক এই আয়োজন বাস্তবায়নের সুফল আগামীতে পাবেনই। সুনিশ্চিত ভাবেই পাবেন। বাংলা একাডেমি ও বইমেলার বর্তমান কর্ণধারদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে তাঁরা যদি এই কোভিডকালে এমন একটা সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন।
বই প্রকাশ বাড়ুক, পাঠক লেখক বাড়ুক, সাহিত্য নির্মাণের সুফল আরও ভালো সাহিত্য সৃষ্টির সুযোগ করুক, আরও ভালো ও বেশি পাঠক তৈরি করুক, আরও ভালো প্রকাশনার উৎকর্ষ দৃশ্যমান করুক, হাজির করুক। এই শুভাকাঙ্ক্ষা রইল। আর তা যদি হয় তো আরও সচেতন, পরমতসহিষ্ণু, প্রাজ্ঞ ও শ্রেয়তর মানুষের একটা সমাজ সমষ্টি নির্মাণে তা সক্রিয় অবদান রাখবেই।
অতিমারি কোভিড দুর্যোগের পিঠে আমরা গড়ে নিই ইতিবাচক নতুন এক অধ্যায়। শুরু হোক শুভ, সঙ্গত ও ফলপ্রসূ ভার্চুয়াল বইমেলার আয়োজন।
লুৎফুল হোসেন
কবি, প্রকাশক ও সাহিত্যকর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর। বিভিন্ন রকমের পোর্টাল ও পত্রিকায় নিয়মিত গল্প, কবিতা, ফিচার, প্রবন্ধ এবং গান লিখছেন। বাংলাদেশের লিটলম্যাগ ও নানা প্রকাশনা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত আছেন সেই ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকেই। শৈল্পিক মননশীলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে একটু একটু করে গড়ে তুলছেন তার নিজস্ব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘রচয়িতা’।
ভালো লিখেছেন কবি।