দাদুর এক বন্ধু ছিলেন চিত্তবাবু। উনি থাকতেন বাঁশদ্রোণী বাজারের উল্টোদিকে খালের ওপারে। আমরা তখন নেতাজীনগরে থাকি। প্রায় প্রতিদিনই আসতেন বেলা সাড়ে দশটা এগারোটা নাগাদ। আধো ময়লা ধুতি পাঞ্জাবী আর বিরাট কালো ছাতা। আমরা বাড়িশুদ্ধ সবাই ওঁকে চিত্তবাবু বলতাম। এমনকি আমরা বাচ্চারাও। চা’এর সঙ্গে থিন অ্যারারূট বিস্কুট খেতে ভালোবাসতেন। মা যত্ন করে এক কাপ চা আর আলাদা প্লেটে গোটা আষ্টেক বিস্কুট পাঠিয়ে দিতেন বসার ঘরে। আমার দাদু ছিলেন বিক্রমপুরের ব্রাহ্মণগাঁ স্কুলের হেডমাস্টার, ইংরাজী গ্রামারের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শিক্ষক। চিত্তবাবু ওই গ্রামেরই মানুষ। এক একদিন দেশগ্রামের গল্পে গল্পে বেলা বেড়ে যেতো। মা বলতেন আজ ভাত খেয়ে যান চিত্তবাবু। উনি বলতেন, না বৌমা, বাড়িতে অপেক্ষা করবে। আমি যাই, আপনি দিয়ে দেন অবনীবাবু’কে। মা কতবার বলেছে, তবু উনি কিছুতেই “বৌমা, আপনি” থেকে “বৌমা, তুমি”তে যেতে পারেন নি। ভাতও খাননি একদিনও দাদুর সঙ্গে বসে।
দাদু মারা যাবার পরেও চিত্তবাবু আসতেন। তখন আমরা নেতাজীনগর থেকে বৈষ্ণবঘাটা চলে এসেছি। বাঁশদ্রোণী থেকে হাঁটা পথে অনেকখানি, বিরাট কালো ছাতা’টা তখন খুব কাজে লাগতো চিত্তবাবুর। বাইরের ঘরে বসে খানিক গল্প করতেন মা বাবা’র সঙ্গে, তারপর কখন থেকে যেন আমার ক্লাস সেভেনের ইংরাজী গ্রামারের ভার নিয়ে নিলেন। রেন এন্ড মার্টিন’এর বই থেকে বিদঘুটে সব গ্রামারের নিয়ম উল্টেপাল্টে পড়াতেন আমায়। সঙ্গে স্পেলিং কারেকশন। বঙ্গলিপি খাতা ভর্তি করে লিখে রাখতে হতো অনেককিছু। চিত্তবাবু লাল কলম দিয়ে সেসব কারেকশন করতেন। এদিকে আমার তখন ক্রিয়েটিভ রাইটিং’এর দিকে খুব ঝোঁক। একটু একটু পাকতেও শুরু করেছি। স্কুলে মিনতি মিস ইংলিশ ক্লাসে আলফ্রেড নোয়েস’এর হাইওয়েম্যান কবিতা পড়াচ্ছেন:
“One kiss, my bonny sweetheart
I am after a prize tonight,
But I shall be back with the yellow gold
Before the morning light…..
Yet, if they press me sharply,
And harry me through the day
Then look for me by moonlight
Watch for me by moonlight,
I’ll come to thee by moonlight,
Though hell should bar the way….”
Kiss শব্দে তখন ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চ! চন্দ্রাহতের মতো সারাদিন “look for me by moonlight, watch for me by moonlight” বিড়বিড় করতে করতে আমি গরমের ছুটিতে জীবনের প্রথম ইংরাজী কবিতা লিখে ফেললাম। মনে আছে ডিকশনারী ঘেঁটে বেশ ভারী ভারী শব্দ ব্যবহার করেছিলাম কবিতা’তে।
পরের দিন যখন চিত্তবাবু এলেন আমি সগর্বে বঙ্গলিপি খাতা খুলে প্রথমেই দেখালাম আমার কবিতা। উনি থিন অ্যারারূট চায়ে ডুবিয়ে এক একটা কামড় দিচ্ছেন আর বলছেন “বাঃ, শক্ত শব্দ, এটার ব্যবহার সেদিন শিখাইছিলাম তোমায়।” লাল কলম হাতে ধরা, একটা দুটো পানচুয়েশন’এ রং লেগেছে। মনে মনে একটা “কেল্লা ফতে” আর “এই রে, এবার আবার কি কারেকশন হয়” এই দুই’এর মাঝামাঝি একটা নিঃশব্দ জায়গায় যখন ঘোরাফেরা করছি, ঠিক তখনই শুকনো থিন অ্যারারূট’এ কট করে একটা কামড়, টুপ্ করে একটা দাঁত পড়লো বঙ্গলিপির পাতায়, আর তারপরেই ঘরের নিস্তব্ধতা খান খান করে চিত্তবাবুর হাহাকার “ও হো হো, এ কি করলা! এ তো গোদুগ্ধে একফোঁটা চোনা হইয়া গেলো!” খসে পড়া দাঁত অগ্রাহ্য করে চিত্তবাবু বিলাপ করতে লাগলেন “পাস্ট সিম্পল আর পাস্ট পার্টিসিপল গুলায়ে ফেলছো, এদিকে psychedelic hours লিখতাছো! ও হো হো, অবনীবাবু!”
দাঁত পড়েছিলো যে কারণে, কবিতার সেই তেইশ থেকে পঁচিশ নম্বর লাইনগুলো এরকম ছিল,
“We have swam in the moonlight
Many psychedelic hours
But alas my love, I have to let you go….”
তারপর থেকে চিত্তবাবু আমাদের বাড়ীতে শুধু চা খেতেন, থিন অ্যারারূট ছাড়াই। ইংরাজী টেন্স বোঝাতে বেলা বেড়ে গেলে কোন কোনদিন ভাতও খেয়ে যেতেন, আর আপত্তি করতেন না।
মৌসুমী ব্যানার্জী
আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের বায়োস্ট্যাটিসটিক্স-এর অধ্যাপক ড: মৌসুমী ব্যানার্জী, গবেষণার বিষয়বস্তু ক্যান্সার ডাটা মডেলিং । জন্ম এবং লেখাপড়া কলকাতায়। কর্মসূত্রে বিশ্বনাগরিক। লেখালেখির শুরু কলেজ জীবন থেকেই। কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ লেখেন। বাতায়ন, পরবাস, বাংলা লাইভ, সুইনহো স্ট্রিট, কেয়াপাতা, TechTouchটক, Antonym ইত্যাদি বহু পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: একলাঘর (যাপনচিত্র প্রকাশনী)।