১
জীবনকাল
ঝুনঝুনিটি হাতে নিয়ে খুব সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে ছোট্ট অনিকেত। সদ্য হাঁটতে শেখা অশক্ত পা দুটি টলমল করে উঠে।
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে অনিকেত দৌড়োতে শিখে। স্ফুলিঙ্গের মত একটুখানি নিজের অস্তিত্বের জানান দিতেই আবার টলমল করে উঠে পা দুটি। সিঁড়ির পাশে লোহার রেলিংটা আঁকড়ে ধরলো সমস্ত শক্তি দিয়ে।
ঝুনঝুনি হাতে সিঁড়ি বাওয়া অনিকেত পৌঁছে গিয়েছে সিঁড়ির শেষ ধাপে। এবার তার এই জগতে বিচরণকাল শেষ হলো। মহাকালের হিসেবে এই যাত্রাপথ কতটুকু দীর্ঘ ছিল? হয়তো এক মিলিসেকেন্ড, এক মাইক্রোসেকেন্ড, অথবা এক ন্যানোসেকেন্ডেরও কম!
২
পুরুষতন্ত্র
নিরুপমা আর নিলয়ের সুখের সংসার। একযুগ প্রেম করে, টেলিফোনে, চিঠিতে, পার্কের বেঞ্চিতে হাত ধরাধরি করে ওরা একে অপরকে মনের সব কথা বলেছে দিনের পর দিন। নিজেকে যতটা বুঝতে পারে নিরুপমা তারচেয়েও বেশি বুঝে নিলয়ের মন, মনের ভাঁজ- খাঁজ, সিন্ধান্ত গ্রহণ, সিদ্ধান্তহীনতার দোনোমোনা আর সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তের অপারগতা।
নিরুপমা যখন মা হলো, ওদের প্রেমের প্রথম ফসল তিলোত্তমাকে কোলে নিয়ে ফ্যাকাশে হেসেছিলো নিলয়। সামলে নিয়েছে নিরুপমা। প্রশ্নের আঘাতে আহত করেনি প্রেমিক পুরুষকে।
পরেরবার তোয়ালে প্যাচানো মনোরমাকে দেখেও একই মুখ হয় নিলয়ের।
প্রিয় উপন্যাসের খোলা পাতার মতো যে মানুষটিকে আনন্দ নিয়ে পড়তো এতদিন নিরুপমা, সেই উপন্যাসের গল্পে এখন ক্লাইমেক্স অধ্যায় এসেছে। শব্দে শব্দে দ্বিধা। নিঃশব্দে সরে গেছে উপন্যাসের শুরুর সেই রোমান্টিকতা।
নিলয়ের মনে ভয়, একটি যদি পুত্র সন্তান তার না হয়, মৃত্যুর পর খাটিয়া বহন করবে সব বাইরের লোক। জানাজার নামাজে যারা দাঁড়াবে তারা সবাই হবে বাইরের লোক। কবরের ঘরে তাকে শুইয়ে দেবে বাইরের লোক। গোরস্থানে কবরের পাশে বসে বিলাপ করে কাঁদবে – বাইরের লোক।
স্বধর্ম মতে, পিতা আর মাতার মৃত্যুতে সশরীরে শরিক হবার অধিকার আছে কেবল পুত্র সন্তানেরই। এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ম। পুরুষেরা নিজেই তৈরী করেছে এই নিয়ম। একা নিলয়ের কি সাধ্য আছে শত বছরের পুরুষতন্ত্রকে ভাঙে!
তাই কেবল সহজভাবে নিজের ভেতরে নিজেকেই সে ভাঙে প্রতিনিয়ত। আশাহত হবার তীব্র ব্যথা বুকে নিয়ে প্রতিদিন মরে যায় একবার করে।
৩
আওয়াজ
– কুসুমের মা, কতদিন কইছি সন্ধ্যা বেলাত ঘর ঝাড়ু দিবা না।
– ক্যান, আন্ধাইরে আফনের গাঞ্জার পোটলা ফালাই দিমু ডরাইতাছেন?
– সন্ধ্যাবেলা ঘর ঝাড়ু দেয়া অলক্ষ্মীর কাজ, বাপ মায় কিছুই শিখায় নাই?
– ঘরে যদি সোনা দানা থাকতো, আন্ধাইরেও চিলিক মারতো। এই ঘরে মুরগির পাখনা আর উঠানের শুকনা পাতা ছাড়া আর কিছুই নাই।
– তাও তুই কথা শুনস না। তোরে আমি তালাক দিলাম।
– আইজ রাইতের কাস্টমার ম্যালা দামি। ময়লা ঘরে প্যান্ট খুলে না। কাইল সকালে যদি টেহা পাইতে চান তাইলে অক্ষন আফনের গাঞ্জার পোটলা লইয়া গঞ্জের মাঠে চইল্যা যান।
৪
ফাঁস
লোকটি ফাঁস নিয়েছে গলায়। কলা গাছের মতো মোটা লোকটি সিলিং ফ্যানের কোমরে লুঙ্গি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়েছে।
লোকে বলে, পুরুষ মানুষকে লড়তে জানতে হয়। আত্মহত্যা করে কাপুরুষে।
বেঁচে থাকতে লোকটি খুব সাহসী ছিল। কিন্তু ফুলশয্যার রাত থেকে একের পর এক ব্যর্থতা, পুরুষত্ব প্রমাণে অক্ষমতা, প্রেমিকার উদাসীনতা, সংসারের দরোজা জানালা ভেঙে প্রেমের নিঃশব্দ প্রস্থান …. আর কত সইতে পারতো সে!
অনঙ্গ সুখের নিবিড় আলিঙ্গন পেলো না লোকটি এই জীবনে। মৃত্যুর সাথেই মাখামাখি হউক তবে। মুক্তি দিয়ে গেলো সে প্রাণের মানুষটিকে: মেয়েটি অন্তত বেঁচে থাক আত্মহত্যার চিন্তা না করে।
লুনা রাহনুমা
কলেজে পড়ার সময় থেকে লেখা শুরু। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিকীতে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে একটি পাক্ষিক পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন বছর খানেক। তারপর একটি দৈনিকে ছয় মাস কাজ করার পর স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাস আরম্ভ করেন ২০০৬সাল থেকে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুইটি। “ভালোবেসে এঁকে দিলাম অবহেলার মানচিত্র”(১৯৯৮), “ফুঁ”(২০২০)। লেখার শুরু কবিতা দিয়ে হলেও বর্তমানে বেশ কিছু অণুগল্প, গল্প, ও ধারাবাহিক গল্প প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি অনলাইন সাহিত্য ম্যাগাজিনে। কর্মজীবনে তিনি একজন পে-রোল একাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করছেন।