পুষ্পিতার মা শবনম তাবাসসুম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করে এমএস করতে আসে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসেচুসেটস ডারমাউথ ইউনিভার্সিটিতে। একেবারে পিএইডি করে দেশে ফেরার ইচ্ছে। শবনমও বাবা ডঃ বদিউর রহমানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চায়। বাবারও তেমন ইচ্ছে। মা বেঁচে থাকলে তাঁর চাওয়ার সুরটাও বাবার সুরে মিশে যেত সন্দেহ নেই। মা বাবার যুগলবন্দী আলাপে কখনো ভিন্ন সুর শোনা যায়নি। শবনমের বড়োবোন দুলাভাই ইউনিভার্সিটি এলাকার কাছাকাছি থাকায় ওকে আর ডর্মে ওঠার ঝক্কি পোহাতে হয়নি। বোনের বাড়ি থেকে হাঁটা পথের দূরত্বে শবনমের ডিপার্টমেন্ট।
নতুন একটা দেশ-পরিবেশে আসবার প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে, শবনম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সাথে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই খাপ খাইয়ে নেয়। ওর ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক, সহপাঠী, সবাই খুব সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের। ছেলেমানুষি আনন্দ নিয়ে স্কাইপে শবনম বাবাকে তার ইউনিভার্সিটি দেখায়। তার ক্লাস, ডিপার্টমেন্ট, লাইব্রেরি, সযত্নে থাকা বাহারি ফুলেদের উচ্ছ্বাস, এমন কী ঘনসবুজ ঘাসের মাঠও বাদ যায় না। দূরত্বের সীমানা ছাড়িয়ে বাবাও যেন মেয়ের আনন্দে সামিল হন। কৃতী বাবার কৃতী সন্তান হিসেবে দেশে ফিরে যাবার শুভকামনা নিয়ে শবনমের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন দিব্যি কেটে যাচ্ছিল।
পূর্বপরিচিত সিনিয়র তরুদি, একদিন ক্লাস শেষে শবনমকে এসে অনুরোধ করেন, সে যেন ক্যাম্পাসে বাঙালি ছাত্র-ছাত্রী এসোসিয়েশান আয়োজিত পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। দেশে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার কারণে তিনি জানতেন শবনম দারুণ গান করে। প্রথমে রাজী না হলেও ওর জোরাজুরিতে শেষমেশ শবনমকে রাজী হতে হয়। কোথায় কবে রিহার্সেল জেনে নেয়। ক্লাস শেষে বা ছুটির দিনে রিহার্সেলের নামে চুটিয়ে আড্ডাতে ডুবে যেতেও সময় লাগে না। মাত্র কয়েক দিনেই রিহার্সেলে অংশ নেওয়া অনেকের সাথে শবনমের পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
শুধু একজনের সাথে আলাপ দানা বাঁধেনা মোটেও। সেই একজন তপন চৌধুরী। একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলেন যেন তপনদা। পিএইচডির স্টুডেন্ট বলেই কী তার এমন আচরণ, নাকি লোকটার স্বভাবটাই ওরকম ঠিক বোঝা যায় না। নীতুদি, রবিনদা ওরাও তো পিএইচডির স্টুডেন্ট, কই তারা তো কেমন দিব্যি সবার সাথে মিশে গেছে! তিনি যে মুখচোরা তাও তো মনে হয় না। পরিচয় না হলেও তপনদার প্রতি কেমন এক আকর্ষণ অনুভর করে শবনম। তপন তার ব্যারিটোন ভয়েসে দারুণ আবৃত্তি করেন। যখনই ওর আবৃত্তি শুনেছে, সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে শবনমের। প্রথম দিন তো রীতিমত কেলেঙ্কারী হতে হতে বেঁচে গেছে। তপনদার আবৃত্তি প্রথম যে দিন শুনে, শবনমের ভেতর বাড়িতে কী ভীষণ তোলপাড় শুরু হয়েছিল। নিজের অনুভূতি অন্যদের কাছে যেন ধরা না পড়ে যায়, হুট করে তাই কাজের অজুহাতে এক রকম পালিয়েই এসেছিল।
পর দিন রিহার্সেলে আসতেই হয় শবনমকে। কারণ আজ যন্ত্রীদের সাথে ওর ফাইন্যাল রিহার্সেল। খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে উপস্হিত হয় নিতু’দির বলে দেয়া নিদির্ষ্ট এ্যাপার্টমেন্টে। স্বস্তি নিয়ে লক্ষ করে আজ আসরে তপনদা উপস্হিত নেই। খুব গোপনে কোথাও যেন একটা শূন্যতাও অনুভব করে। যন্ত্রীদের সাথে নিজে যে গানটা গাইবে সেটা বার কয়েক রিহার্সেল দিয়ে তুলে নেয় শবনম। ওর চমৎকার গলার গান উপস্হিত বন্ধুদের মন কাড়তে সময় লাগে না। সবার অনুরোধে খান কয়েক বাড়তি গান গেয়ে শোনাতে হয়। পরিবেশ ভুলে মগ্ন হয়ে গাইছিল বলে, ওর জানা হয়নি কখন সেই ব্যারিটোন ভয়েসের মানুষটা পেছনে এসে বসেছেন। তার মুগ্ধ দৃষ্টি শবনমের মুখের ‘পরে ঝরে ঝরে পড়ছে! রিহার্সেল শেষে ফেরার সময় রিতুদের সাথে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শবনমের বুকটা কেমন ধড়াস ধড়াস করেছিল। তড়িঘড়ি পালিয়ে বেঁচেছিল সেদিনও।
বৈশাখী অনুষ্ঠানটার পর তপন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের আর তেমন সুযোগ হয়নি শবনমের। কাকতলীয় ভাবে আবার যোগাযোগ ঘটে যায় শবনম তার পাসপোর্টটা হারিয়ে ফেলার পর। ওই সময় খুব সাহায্য করেন তপন চৌধুরী। থানায় রিপোর্ট করা, বাংলাদেশ কনস্যুলেটে ছোটাছুটি করে নতুন পাসপোর্ট বের করা। অন্যের বিপদে সহৃদয় এক নতুন তপনের সাথে পরিচয় হয় শবনমের। তার মনের গভীরে মানুষটা সম্পর্কে গেঁথে থাকা ভুল ধারণার পলেস্তরা খসে পড়ে। আপনি সম্বোধন তুমি’তে নেমে আসে। ওদের বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
সে পরিচয় প্রেমের পথে দ্রুত হাঁটতে সময় নেয়নি। বাইরে থেকে তপন কে যতটা নিরাসক্ত মনে হতো আদতে সেরকম নয়। আগাগোড়া একজন রোমান্টিক মানুষ তপন। গম্ভীর মুখে এমন এমন সব মজার কথা বলতো যে হাসতে হাসতে শবনম গড়িয়ে পড়তো। পড়াশোনায় সিরিয়াস দুজন মানুষ, প্রেমের ব্যাপারেও দারুণ সিরিয়াস হয়ে ওঠে। তপন আগেই জানিয়ে দেয়, তার কাছ থেকে চিটাগংয়ের গল্প শুনে শুনেই শবনমকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কারণ বউ হিসেবে তার প্রাচীনপন্থী গোঁড়া পরিবার কোনো দিনই তাকে স্বীকার করে নেবে না। শবনমেরও জানা ছিল তার দিকের পরিণতি, পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের সম্পর্কটা সহজে মেনে নেওয়া হবে না। হয়ওনি। শবনমের বড়ো বোন-দুলাভাই তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন, সে যেন সম্পর্কটা থেকে সরে আসে। পড়াশোনা শেষ করে নিজের পছন্দ মতো স্বধর্মের কাউকে বেছে নিক, তাতে কারো আপত্তি উঠবে না। কিন্তু শবনমকে টলানো যায়নি। দেশ থেকে বাবা,ফুপা, ও অন্যান্য আত্মীয় পরিজনেরা শেষ চেষ্টা হিসেবে সম্পর্ক ছেদের হুমকি দিলেও জেদি শবনম নিজের ভালোবাসাকে মুঠো খুলে গড়িয়ে যেতে দেয়নি। ফলাফল হিসেবে আজন্মের সম্পর্কগুলোর গিঁটখুলে যায়। বোনের বাড়ি ছেড়ে ডর্মে ওঠে যেতে হয় শবনমকে। বাবা সাফ জানিয়ে দেন, আজকের পর থেকে শবনম নামে কোনো মেয়ে তাঁর ছিল এটা তিনি ভুলে যাবেন। তার মুখ তিনি এ জীবনে আর দেখতে চান না। দেশে ফিরে এলে তাঁকে যেন বিরক্ত করা না হয়। বড়ো বোন দুলাভাইও বাবার সুরে তাল ঠুকলো। পরিস্হিতির এতটা জটিলতা, প্রেমের মোহে মা কীভাবে সামাল দিয়েছিল সেকথা ভাবলে একাকী মায়ের জন্য পুষ্পিতার বুকের ভেতরটা কেমন একটা করে।
ওই ঘটনার বহুদিন পর চেষ্টা করেও কোনোভাবে মায়ের কাছ থেকে বড়োখালা কিংবা নানাভাইয়ের কোনো তথ্য বের করতে পারেনি। ওদের কথা তুললে মা কেমন অচেনা ব্যবহার করতো। অসুস্হ হয়ে পড়তো দেখে পুষ্পিতা নিজে থেকে মা কে চাপাচাপি করেনি। মা নিজেই এক সময় জানাবে এই আশা নিয়ে অপেক্ষায় থেকেছে। মানুষের সব আশা পূরণ হয় না বোধহয়। মায়ের দিককার সম্পর্কগুলো পুষ্পিতার অজানাই থেকে যায়। শুধু মায়ের দিকের কেন? বাবা নামের মানুষটার সঙ্গে তার সম্পর্কই বা কতটা পরিচিত!
প্রায় দেড় বছরের প্রেমপর্ব শেষে শবনম-তপনের বিয়ে তিন বছরে পা ফেলে। তপন ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়ে ততদিনে ভালো চাকরিতে ঢুকে গেছে। এম এস শেষ করে শবনম পিএইচডির তোড়জোড় শুরু করে। পিএইচডি করা নিয়েই দু’জনের মধ্যে ঠোকাঠুকির সূত্রপাত। তপনের মোটেও ইচ্ছে ছিল না শবনম পিএইচডি করুক। তপন চেয়েছিল আপাতত আর পড়াশোনায় না গিয়ে শবনম বরং অনাগত সন্তান, সংসারে মন দিক। অথচ বিয়ের আগে থেকেই এ বিষয়ে দুজনের বহুবার কথা হয়েছে। তখন তপন অন্য মানুষ, অন্য রূপ তার। এত দ্রুত সে রূপের রঙ বদলে যাবে শবনম ভাবেনি।
শবনম যেমন আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, নতুন এক তপনকে আবিষ্কার করে, তপনও একরোখা, জেদি আরেক শবনমের মুখোমুখি হয়। যে তার জেদে অটল। শবনমের এক কথা, প্রয়োজনে দু’দিকই সামাল দেবে, নিজের স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতে কোনো ভাবেই একতরফা আপোষের পথে সে হাঁটবে না। এ ব্যাপারে তার প্রফেসরের কাছ থেকে সাধ্যের অতীত সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছিল। উইলিয়াম বার্ণার নামের ফেরেশতার মতো মানুষটা না থাকলে শবনমের ইউনিভার্সিটি বদল, ক্রেডিট ম্যাচ, গ্র্যান্ট বরাদ্দ এত কিছু সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ। সেক্ষেত্রে শবনমের জেদ আর স্বপ্ন হয়ত ব্যর্থতার কাছে নতজানু হতো। পৃথিবীর লক্ষ কোটি স্বপ্নহারাদের তালিকায় আরো একজনের নাম অদৃশ্য কালিতে লিখে রাখতো সময়। কিন্তু এই একটা দিক থেকে শবনমের ভাগ্য সত্যিই বরাবর তার আর্শিবাদের হাতটা উপুড়ই রেখেছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও তাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে সে সময় মতো।
পুষ্পিতার জন্ম পিএইচডি’র মাঝখানেই। বাচ্চাটা হবার পর পর সবদিক সামাল দেয়াটা শবনমের পক্ষে এক সময় সত্যিই কঠিন হয়ে ওঠে। শবনমের জেদটা মোটেও ভালোভাবে নেয়নি তপন। সেও পালটা গো ধরার অঘোষিত প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। যেহেতু তপন স্ত্রীর পিএইচডি নিয়ে আগ্রহী ছিল না, সে কারণে সংসারে বা শবনমকে সাহায্য সহযোগিতায় দিন দিন উদাসীন হয়ে পড়ে। নানা ছুতো তুলে সংসারে নিত্য অশান্তির ঝোঁক বাড়তে থাকে তার মধ্যে। নারীর পক্ষে শরীরের চাহিদা অগ্রাহ্যের ক্ষমতা থাকলেও অনেক পুরুষের মধ্যে সেটা তুলনামূলক কম থাকে। সে ইস্যুতেও তপন রীতি মতো অমানবিক আচরণ শুরু করে। সব সামলে স্বামীর শারীরিক চাহিদা মেটানো শবনমের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। এ অবস্হা কতদিন আর চলতে পারে। এক সময় তপন আরেক নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। শবনম সবটা জেনেও স্বামীর আচরণ নিয়ে সরব হওয়ার চেষ্টা করেনি। যাকে ভালোবেসেছে, তার বদলে যাওয়ার কষ্টটা নিজের মধ্যেই আগলে রেখেছে। কাউকে তার ভাগ দেয়নি। মেয়ে পুষ্পিতাকেও না।
পুষ্পিতার যখন দেড় বছর বয়স, লোকটার সঙ্গে মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। তার সব অপবাদ মা চুপচাপ মেনে নেয়। ভালোবাসার ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে নিজেকে সর্বহারা ঘোষণায় মায়ের কোনো সংকোচ ছিল কিনা জানে না পুষ্পিতা। না হলে চাইলেই স্বামীর সব অপবাদ মিথ্যা প্রমাণ করা যেত। মা সে পথে হাঁটেনি। ওকে নিজের জীবনের গল্প বলার সময় দু’চোখ উপচানো জলের ভেতর মায়ের দীঘল চোখ জোড়া কেমন হাসতো। সে হাসিতে কতটা ভালোবাসা, কতটা নিজের সাথে নিজের প্রতারণা ছিল, পুষ্পিতার জানা নেই। কেবল যখন মা গভীর স্বরে বলতো, সব হারিয়ে ফেলেছি, শুধু একতরফা ভালোবাসাটা মুঠো গলে হারিয়ে যেতে দেইনি। নাইবা সে ভালোবাসলো, আমি কেন তাই বলে ভালোবাসবো না। তার বিবেচক, বুদ্ধিমতি মায়ের এমন যুক্তিহীন, অদ্ভুত ভাবালুতাকে পুষ্পিতা না পেরেছে অগ্রাহ্য করতে, না মন থেকে পুরোপুরি মেনে নিতে। যদিও প্রকাশ্যে নিজের মতামত দিয়ে মায়ের দুঃখ বাড়াতে চায়নি। অথচ কী হাস্যকর ভাবে আজ পুষ্পিতার এই শহরে আসার পেছনের পরোক্ষ কারণ সেই মানুষ। যে মানুষটার প্রতি একজনের তীব্র ভালোবাসা আর অন্যজনের তীব্র বিরাগ থাকা সত্ত্বেও এই শহর তাকে ঠিকই টেনে এনেছে।
নাহার তৃণা
জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে আমেরিকার ইলিনয়ে বসবাস। ২০০৮ সালে লেখালেখির জগতে প্রবেশ। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে লিখছেন গল্প, প্রবন্ধ, গল্প, অনুবাদ, সাহিত্য সমালোচনা। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একইবছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশী গল্প’। নাহার তৃণার প্রকাশিত বই দুটি এখন বইয়ের হাট প্রকাশনায় অ্যামাজন কিন্ডেলেও পাওয়া যাচ্ছে।