একজন লেখক বন্ধু বলেছিল, তোমার যখন মন খুব খারাপ হবে, কষ্ট হবে, তখন তুমি কষ্টের কিছু লিখবে না। বেশি বেশি আনন্দের কথা লিখবে, সুখের কথা লিখবে। এরপর, সুখী গল্প লিখতে থাকলাম। সব গল্প সুখের। লিখতে লিখতে; এক সময় দেখলাম, আমি দুঃখ ভুলে গেছি! হায়, আমি কবিতা লিখতে ভুলে গেছি! চিঠি; চিঠি লিখতেও ভুলে গেছি! কতকাল চিঠিও লিখিনা কাউকে! কেউ কী আমার চিঠির অপেক্ষা করে! কাউকে কী চিঠি লিখবার কথা ছিল? মায়া! মায়ায় বুকের ভেতর দুমড়ে-মুচড়ে উঠে না আর। কী অদ্ভুত! আমার ভেতরে আর কোনো কিছুর জন্যেই দুঃখবোধ জন্ম হয় না। মায়া হয় না কিছু ফেলে দিতে। কতকাল কান্নাও ভুলে গেছি! আমার চোখ শুকিয়ে চৈত্রের মরা নদী।
আজকাল কারো সাথে গল্পও জমে না। আমার মেইল বক্স দীর্ঘদিন শূন্য। মেসেঞ্জারও নেই। জরুরী মেসেজ ছাড়া মেসেজ বক্স খোলা হয় না; উত্তর দেই না বলে, কাউকে ফোন করি না বলে, প্রতিদিন প্রতিদিন কাছের মানুষদের সাথে দূরত্বই বেড়েছে। আজকাল আমি দূরত্বকেও ভালোবাসি। দূরত্ব বাড়ছে য’ত, ত’ত আমার দিকে সুখী বাতাস ধেয়ে আসছে! আমার মাথার ওপর য’ত ধূসর মেঘ জমে ছিল, সব মেঘ দূরের পাহাড়ে উড়ে যাচ্ছে… জানালায় আর বুনোমেঘ ওড়াউড়ি করে না। আমারও আর বুনোমেঘ জাপটে ধরতে ইচ্ছে করে না। রাত গভীর হবার আগেই ঘুমে চোখ মুদে আসে। কোজাগরী চাঁদ আমায় আলোড়িত করে না। ভোর হলেই একদল পাখি ঠোঁট দিয়ে ঠুক ঠুক শব্দ করে বারান্দার কাচের দরোজায়। বলে, মনিকাপাখি তোমার জন্য আরেকটা সূর্য অপেক্ষা করছে, ওঠো.. আমি আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ি। স্লাইডিং কাচের দরজাটা খুলে দিতেই। দেখি, ঘাসের ওপর ঝকঝক করছে রোদ্দুর। আমি রোদ মাখি দু’চোখে, শরীরে; দু’পায়ের প্রতিটি আঙুলে, নাকে, গ্রীবায়। তারপর সারাদিন কেবল আমার এলোমেলো ঘর গোছাই। আমার সবুজরঙা ঘরের খসে পড়া দেয়ালে রঙ দেই। বেলা পড়ে এলে ছাদে ইজি চেয়ারে বসে গাছের সাথে গল্প জুড়ে দেই, হঠাৎ শুকনো পাতা উড়ে আসে চুলে। বসন্ত বাতাস। মৃদু শব্দে। নাকে ভেসে আসে। ভারী মিষ্টি সে বাতাস। চোখে-মুখে চুল উড়িয়ে দিশেহারা করে। অনেকক্ষণ বসে থাকি সবুজ ঘাসে পা বিছিয়ে। টবের মাটির ওপরে শুয়ে থাকা গাছে নিয়ম করে ফুল ফোটে, আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়েই থাকি। পাশ থেকে জোরে চিৎকার করে পালিয়ে যায় একদল টিয়ে পাখি। উদাস চোখে আমি বসে কত কি ভাবি। কত প্রশ্ন করি নিজেকে; প্রশ্ন বাতাসে ধাক্কা খায়। উত্তর গুলো কাছে এসে বসে। আমি প্রশ্ন আর উত্তরের সাথে খেলা করি। বুঝি, নিয়তি কাউকে তার হিসেব থেকে বঞ্চিত করে না। কড়ায় গণ্ডায় হিসেব করে ফিরিয়ে দেয় সব, দেবেই; আজ অথবা দীর্ঘ সময় চলে গেলেও!
আজ ঝকঝকে একটা সুন্দর দিন। আজ আমার মন খুব ভালো। আজ কেউ একজন বলেছে, আমার চোখ খুব সুন্দর। আজ পর পর তিনটে রবীন্দ্রসংগীত শুনে, আমি আকাশ হয়ে রইলাম। যেন হাওয়ার সাথে আমার কত প্রেম! আজ ঘরের ভেতর একটা মিষ্টি ঘ্রাণে আমার মন উতল হয়েছে, মান্নাদের গানটা কেউ কি কোথাও বার বার শুনছে! জানালায় কী শব্দ ভেসে ভেসে আসছে! আমি কান পেতে আছি। আজ কেউ বলেছে, তোমায় মেঘ মনিকা বলে ডাকি? আমি বললাম, তবে মেঘদূত হয়ে যাও। আজ কেউ ফোন করে বলেছে, রাতে আমরা কফি শপে যাব, আজ ভুলেও রান্নাঘরে যাবে না কিন্তু! আজ কেউ বলেছে, সন্ধ্যে হবার আগেই তোমার প্রিয় নদীর কাছে চলে এসো, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। অপেক্ষা করব, তোমার মরা নদীর কাছে। মরা নদী কেন বললাম? নদীর জল শুকিয়ে গেছে। শুকিয়ে জল কালো হয়ে আছে, তবুও এই নদীই তোমার এত পছন্দ, কেন?
এইসব প্রশ্নের উত্তর আমি কখনোই দেব না। তা ছাড়া, আজ আমার মন খুব ভালো। প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় আজ নয়। আজ আমি সুখী স্ট্যাটাস লিখছি। সুখের গল্প জমাচ্ছি…
মনিকা আহমেদ
জন্ম, খুলনায়। শেকড়, চট্টগ্রামে। বড় হওয়া, ঢাকায়। বই ও সাহিত্যের প্রতিটি শাখা তার প্রিয়। ভালো লাগে মানুষ ও প্রকৃতি । জীবন দর্শন: গৌতম বুদ্ধ। কাছের, দূরের মানুষকে শুদ্ধ সৃজনশীলতা, সুন্দরের হাত ধরে মননশীল চর্চায় অনুপ্রাণিত করার দায়িত্বশীলতাই তার কর্ম দর্শন । আজন্ম ভালোবাসা, কবিতার সাথে।