চিটাগাং এবং কক্সবাজার দর্শন পর্ব চটপট সেরে পুষ্পিতা নির্ধারিত দিনের আগেই চড়ে বসে ঢাকাগামী প্লেনে। সে জন্য তাকে পূর্বনির্ধারিত স্ক্যাজুল পরিবর্তন করে ফেরত যাওয়ার টিকিটও রিঅ্যারেঞ্জ করতে হয়েছে। এর ভেতর একদিনও সে জর্জের সাথে যোগাযোগ করেনি। জর্জ ছেলেমানুষি একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল, তার উত্তরও করেনি।
জর্জের সঙ্গে পুষ্পিতার যে সম্পর্ক, সে সম্পর্ককে বিশেষ কোনে নামের বাঁধনে বাঁধা যায় না। ওরা বন্ধনহীন এক বাঁধনে জড়িয়ে আছে একে অন্যের সঙ্গে। মায়ের জীবন দেখেই হয়ত পুষ্পিতার ভেতর বিয়ে, বন্ধন ইত্যাদি বিষয়ে উদাসীনতার জন্ম।
জর্জকে বলাই আছে, তারা দু’পক্ষই স্বাধীন। তারপরও যদি একে অন্যের সঙ্গে থেকে গোটা জীবন উদযাপনে আগ্রহ জন্মায় তো ভালো, না জন্মালেও ক্ষতি নেই। জর্জ ছেলেটা ভারী কোমল আর রোমান্টিক স্বভাবের। তার ধারণা, পুষ্পিতা তার বাবার স্বভাব পেয়েছে, মায়েরটা পেলে উদযাপনের জন্য একজন্ম কমই পড়ে যেত। পুষ্পিতা ভাবালুতায় ভেসে যায় না, শুনে হাসে। জর্জকে সাবধান করে কপালে দুঃখ আছে বলে।
কক্সবাজার গিয়ে মায়ের পাশাপাশি জর্জের কথা খুব মনে হয়েছে পুষ্পিতার। বার বার ভেবেছে, ইশশ জর্জ যদি পাশে থাকতো! কখনও একবার জর্জকে নিয়ে সে শুধু কক্সবাজার বেড়িয়ে যাবে। সমুদ্র জলে পা ডুবিয়ে একসঙ্গে সূর্যাস্ত দেখবে। জর্জের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেও খানিক রোমান্টিক হবার চেষ্টা করবে…এমন বোকা বোকা ভাবনায় নিজেকে ভাসতে দেখে হাসিও পেয়েছে। মায়ের জিনও তার শরীর বহন করছে।
কক্সবাজারের সমুদ্র তীরে বসে পুষ্পিতা তার মায়ের উদ্দেশ্যে একটা বেলুন উড়িয়ে ছিল। যখনই খুব বেশি মায়ের কথা মনে পড়ে এভাবে সে বেলুন ওড়ায়। …এটা তার প্রিয় একটা খেলা। যেন এভাবে সে মায়ের সাথে অদৃশ্য একটা যোগাযোগ স্হাপন করতে চায়।
পুষ্পিতার জীবনের প্রায় সবটা জুড়েই মা। বাবা নামের কোনো অস্তিত্ব তার জীবনে নেই। সে অভাবটা মা রাখেওনি। নিজের সবটা দিয়েই মা পুষ্পিতাকে বড়ো করেছে। একা মানুষটা তাকে সবার আদর দেবার চেষ্টা করে গেছে। তীব্র অভিমানে পুড়েছে, কিন্তু কখনও কারো দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলেনি। এমন একজন বোকা মানুষকে পুষ্পিতার ভালো না বেসে উপায় থাকে না। মা-ই পুষ্পিতার সবটা জুড়ে।
নিজের সবচে’ প্রিয় মানুষ মায়ের জন্ম শহর না দেখে তাই ফেরার কথা ভাবতে পারেনি পুষ্পিতা। অনলাইনে হোটেল আম্বালা ইনে বুকিং দিয়ে রেখেছিল। চট্টগ্রামে থাকতে অ্যাভিনিউ হোটেলের স্টাফকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছে হোটেলটা ভালো। ওদের স্পঞ্জ রসগোল্লা নাকি খুব বিখ্যাত। আহা রসগোল্লা জর্জের খুব প্রিয়। পুষ্পিতা ঠিক করেছে জর্জের হয়ে সে নিজেই দু’ একটা মিষ্টি খেয়ে নেবে। অবস্হান গত কারণেই আম্বালা ইনে ওঠা, ধানমণ্ডির কাছাকাছি। মায়ের বাবার বাড়ি ধানমণ্ডি একুশ নম্বরে। পৌঁছে খানিক বিশ্রাম নেবে তারপর ফ্রেশ হয়ে বের হবে ঠিক করে পুষ্পিতা।
অনেকটা সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়েছে পুষ্পিতা। এয়ারপোর্টের ফুডকোর্টে খাওয়ার পর্বটা সেরে আসায় সে ঝামেলাটা নেই আপাতত। তৈরি হয়ে তার জন্য অপেক্ষায় থাকা গাড়িতে উঠে বসে। গাড়িটা হোটেল থেকে সারাদিনের জন্য ঠিক করে দেয়া হয়েছে। ড্রাইভার ভাইকে জানায়, এখানকার কিছুই তার চেনা নয়, সে ধানমণ্ডির আশেপাশে একটু ঘুরতে চায়। বিশেষ করে ধানমণ্ডি একুশ নম্বর। ড্রাইভারের বুঝে নিতে কষ্ট হয় না পুষ্পিতা এই শহরে একজন আগন্তুক। বলে না দিলে পুষ্পিতার মুখে বাংলা শুনে কেউ চট করে বুঝে ওঠতে পারে না ও এদেশে বাস করে না। খটমট কিছু শব্দ বাদে মায়ের শেখানো ভাষায় পুষ্পিতা দারুণ সাবলীল। যৎসামান্য লিখতে পড়তেও পারে।
ধানমণ্ডি একুশ নম্বরের প্রতিটা বাড়ি পুষ্পিতা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে যায়। ওর বুকের ভেতর কেমন এক অজানা অনুভূতি থেকে থেকে গুমড়ে ওঠে। মনে মনে আওড়ে যায়, মা গো কোন বাড়িতে তুমি জন্মেছিলে? কোন বাড়ির উঠোন ধরে রেখেছে আমার মায়ের পায়ের ছাপের স্মৃতি? কোন বাড়ির ইটের খাঁজে লুকিয়ে আছে তোমার শৈশব? লকেটে সেঁটে থাকা ছবির মা একবারের জন্যেও মুখ নেড়ে পুষ্পিতাকে জানিয়ে দেয় না, দেখ্ পুষ্পিতা, ঠিক এই বাড়িটায় আমি হেসে খেলে বড়ো হয়েছি! ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’ পুষ্পিতা তার দুচোখ দিয়ে একুশ নম্বরের প্রতিটা বাড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায়।
হুটহাট চোখ ভেজে না পুষ্পিতার। অথচ এমুহূর্তে ভিজে যাওয়া সমস্ত মন বুঝি তার ব্যথার ভার বইতে ব্যর্থ হয়। শত চেষ্টা ব্যর্থ করে পুষ্পিতার দু’চোখ ভিজে ওঠে। ড্রাইভার বেচারা কী করবেন বুঝে ওঠতে পারেন না। জ্যাম ঠেলে একই রাস্তায় বার বার চলাচলও বিরক্তিকর। অথচ পেছনে বসে থাকা ম্যাডামের কোনো তাড়া নেই। নিশ্চল, নিশ্চুপ বসে আছেন তিনি। নিঃশব্দে ব্যাগ খুলে একবার টিস্যু বের করতে দেখেন তিনি আড়চোখে। কাঁদছেন হয়ত.. গাড়ির ভেতরকার নিরেট নিরবতা ভেঙে নাক টানার শব্দও শোনা যায়। খানিক উশখুশ করে ড্রাইভার পুষ্পিতার কাছে জানতে চান, “আর কোথায় যাবেন ম্যাডাম?” সহসা পুষ্পিতার মুখে শব্দ যোগায় না বুঝি। কান্না ভেজা মায়া মাখানো মুখটা দেখে ড্রাইভারের কেমন মায়া হয়। তাদের মতো ড্রাইভারের সাথে ভদ্র আচরণ খুব একটা কেউ করেন না। কিন্তু এই ম্যাডাম প্রথম থেকেই তার সাথে খুব অমায়িক ব্যবহার করছেন। কৃতজ্ঞ মন যাত্রীর কী সমস্যা বুঝতে না পারলেও তাকে খানিকটা স্বস্তি দেবার আগ্রহে তিনি জানতে চান,
-রবীন্দ্রসরোবর যাবেন ম্যাডাম? পাশেই লেক, খুব সুন্দর জায়গা, দেখলে মন ভালো হয়…। মন ভালো করাটা এখন জরুরী মনে হওয়ায় পুষ্পিতা ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।
সত্যিই সুন্দর জায়গা রবীন্দ্রসরোবর। নামটাও পছন্দ হয় পুষ্পিতার। তবে পুস্পিতার পক্ষে শব্দটা চট করে উচ্চারণ একটু খটমট বৈকি। প্রথমবার ‘রবীন্দ্রসরবর’ বলায় ড্রাইভার ভাইয়ের হাসিতে নিজের ভুলটা বুঝে গিয়ে আর শব্দ করে উচ্চারণের ঝামেলায় যায়নি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে জায়গাটা ভালো লেগে যায় ওর। এখানে মনে হয় নাটক বা কালচারাল অনুষ্ঠানদি হয়। অ্যাম্ফিথিয়েটারের আদলে তৈরি ছিমছাম গ্যালারি। এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু মানুষ বসে আছেন। বিকেলের ফুরফুরে হাওয়া এসে ওর চোখে, মুখে, হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে যায় যেন। পরম সুহৃদের মতো দলছুট বাতাস বুকের দরজা খুলে ওর ক্ষতে মমতাভরে হাত বুলিয়ে দেয় যেন… গাড়ির চালককে বলা সত্ত্বেও নামেননি। হয়ত তিনি পুষ্পিতাকে একটু একা থাকতে দিতে চেয়েছেন। তার ভদ্রতাবোধ পুষ্পিতাকে ছুঁয়ে যায়। গোলচত্বর পেরিয়ে লেকের দিকে হেঁটে গিয়ে শান বাধানো জায়গাটায় বসে পড়ে পুষ্পিতা। আশেপাশের কিছু উৎসুক চোখ তাকে খানিক অনুসরণ করে আবার যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
লেকের পাড়ে চুপচাপ বসে থাকা পুষ্পিতাকে মনে হয় পথ ভুলে কোনো বিষণ্ন মৎসকুমারী বুঝি ডাঙ্গায় ওঠে এসেছে। তেইশ বছরের ছিপছিপে শরীরে হালকা আকাশি টপস আর দুধসাদা জিন্সে কী যে অনিন্দ্য সুন্দরী দেখাচ্ছে ওকে। লেকের পানিতে চোখ রেখে বুঁদ হয়ে কি এক ভাবনায় হারিয়ে যায় পুষ্পিতা।
-আপা গোলাপ কিনবেন? মাত্তর বিশটাকায় দশটা গোলাপ।
রিনরিনে একটা গলার আকর্ষণে বাস্তবে ফিরে পুষ্পিতা। মাথা তুলে দেখে ওর সামনে গোলাপের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে আছে বছর বারো কী তেরোর একটি মেয়ে। মেয়েটির চেহারা বেশ মলিন, পরনের কাপড় তারও অধিক। একটু দূরে আরো তিনজন, প্রথমজন কাঙ্খিত সাড়া পেলে তারাও এগোবে, এমন উৎসুক ভঙ্গিতে যার যার পসরা নিয়ে অপেক্ষামান। পুষ্পিতার বুকের ভেতর কেমন একটা মোচড় পড়ে। এধরনের বহু ছেলেমেয়েকে সে ইতিমধ্যে অনেক জায়গাতেই দেখেছে। জীবনের তোয়াক্কা না করে ট্রাফিক সিগন্যাল বা ব্যস্ত সড়কে ছেলেমেয়েগুলো ফেরি করে বেড়ায়। মিষ্টি হেসে সে মেয়েটার হাত থেকে ফুলের তোড়াটা নেয়। সারাদিনের ধকলে তোড়ার ফুল বাচ্চাগুলোর মতোই কেমন মলিন। হাতছানিতে অপেক্ষামান বাকিদেরও কাছে ডাকে পুষ্পিতা।
-তোমরা কে কী বিক্রি করছো দেখাও দেখি।
এমন সম্ভাষণে অনভ্যস্ত ক্ষুদে ফেরিওয়ালার দলটি প্রথমে খানিক থমকে যায়। তারপর ওদের শিশুমন যখন বুঝে যায় যে মানুষটি তাদের ডাকছে সে কৃত্রিমতায় ডুবে নেই, তখন পায়ে পায়ে সবাই এগিয়ে আসে পুষ্পিতার কাছে। একজনের ঝুড়িতে বাদাম ভাজা, বুট ভাজা। তো অন্য আরেকজনে কাছে রয়েছে চকলেটের প্যাকেট। নানা ধরনের চিপসের প্যাকেট নিয়ে এসেছে অন্য আরেকজন। ফুলের তোড়াটা পাশে নামিয়ে রেখে পুষ্পিতা দু হাত পেতে বলে,
-দাও দেখি তোমাদের যার যা আছে তার একটু করে।
এমন ক্রেতার দেখা এর আগে ওরা পায়নি, তাই ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না পরীর মতো দেখতে এই আপাটা সত্যি সত্যিই তাদের কাছে থেকে কিছু কিনবে নাকি ফাউ খেয়ে চম্পট দেবে। বয়স কম হলেও বাস্তবতা এরই মধ্যে মানুষের মুখোশহীন চেহারা ওদের কম দেখায়নি। ওদের ইতস্তত ভাব বুঝে নিতে দেরি হয় না পুষ্পিতার। নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে ফিক্ করে হেসে নিজের সোল্ডার বরাবর ক্রস ব্যাগটা দেখিয়ে বলে,
-ভয় নেই দাম দিয়েই নেবো। তার আগে তোমাদের কার কী নাম সেটা শুনি। সবাই এখানটায় বসো আগে। হাত দিয়ে নিজের পাশটা দেখায় সে।
কিছুক্ষণের ভেতর জাদু বলে যেন পরিবেশটা বদলে যায়। মলিন মুখের ফেরি করে বেড়ানো শিশুগুলো খলবল করে নিজের নিজের পরিচয় দেয়। খুব অল্প সময়ে পুষ্পিতার জানা হয়ে যায়, ফুল বিক্রেতা মেয়েটির নাম সালমা। ওর পুঙ্গ বাবা বড় রাস্তার মোড়ে চা বিক্রি করেন। মা বাসা বাড়িতে কাজ করেন। সালমার একটা ভাই ছিল, হারিয়ে গেছে কোথায়। ওর কথা শুনে পুষ্পিতা মেয়েটির তেলহীন রুক্ষ চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। সবটা না হলেও এইসব শিশুদের বাস্তবতাটা বুঝে পুষ্পিতা। তাই স্কুলে যাও না কেন’ ঠাট্টার মতো শোনায় এমন প্রশ্নে যায় না সে। ওদের বলতে দেয়। একে একে বলে যায় যে যার গল্প। এই দলের সবচে’ চটপটে ছেলে মামুনের কাহিনিও বড়ো করুণ। ওর মা-বাবা কেউ নেই। বুড়ি দাদির কাছে মানুষ। অসুস্হ দাদির ভেজে দেওয়া বাদাম-বুট বিক্রি করে কোনোভাবে ছাপড়াঘরে ওদের জীবন কাটে। নাসিরের পরিবার থাকে পাইপের ভেতর। বাবা নেই। মা হোটেলে মশলা বাটার কাজ করেন। ওর এক বোন আছে, সেও সালমার মতো ফুল বিক্রি করে বেড়ায়। জেনেভা ক্যাম্পের কামাল, ভীষণ হাসিখুশি ছেলে। ওর জন্মের সময় মা মারা গেছেন। বাবা, দাদি, বিধবা ফুপু আর এক ফুপাতো বোন নিয়ে ওদের বিরাট সংসার। ফুপু দর্জির কাজ করেন ক্যাম্পের আশেপাশে কোথাও। বাবা ঠিক কী করেন কামালের জানা নেই। দাদি সারাদিন কথার খই ভাজেন… বলে খিল খিল হাসিতে ভেঙে পড়ে সে। হাসি বড় সংক্রামক। ওর হাসি সবাইকে ছুঁয়ে দেয়। যেন ভীষণ মজার কোনো কাণ্ড ঘটে গেছে যার জের ধরে ওরা হাসিতে ভেঙে পড়েছে। দূর থেকে দেখলে এমনটাই মনে হবে ব্যাপারটা।
পুষ্পিতার মনে হয় এই বাচ্চাগুলো যেন দেবদূত। ওর মন খারাপ শুষে নেবার জন্য মর্তে নানা ছদ্মবেশে নেমে এসেছে। গোলাপ তোড়াটা খুলে সে প্রত্যেককে একটা করে গোলাপ দেয়। সালমার চুলটা পরিপাটি করে আঁচড়ে তাতে একটা গোলাপ গুঁজে দেয়। চিরুনিটা সালমার হাতেই গুঁজে দেয়। পালা করে সেই চিরুনি দিয়ে বাকিরাও চুল আঁচড়ে নেয়। ওদের সবার নানা ভঙ্গির কিছু ছবি তুলে পুষ্পিতা। সালমাকে পরী আপার গলা ধরে ছবি তুলতে দেখে, বাকিরাও তাকে জাপটে ধরে ছবি তোলার আবদার ধরে। পথ চলতি বিস্মিত এক ভদ্রলোক তাদের সে ছবিটা খুব যত্ন করে তুলে দিয়ে যান। এমন আনন্দের সময় ওদের জীবনে কখনও আসেনি। বাকি জীবনে বার বার বলার মতো গল্প আজকের এই সময়টা তৈরি করে দেয় ওদের জন্য। পুষ্পিতার মনে হয় কত অল্পে সন্তুষ্ট হতে জানে এরা। তার একটু সহৃদ সঙ্গ, ভাগ করে খাওয়া বাদাম, চিপস, চকলেট কী এমন অমৃত বা মহার্ঘ বস্তু! অথচ ওগুলোই ওদের কাছে অমৃতের স্বাদে ধরা দেয়। ইচ্ছে করে না ওদের ছেড়ে উঠতে, কিন্তু ফিরতে হবে। কিছু কাজ গোছানো বাকি আছে। ওদের প্রত্যেকের হাতে চকচকে একটা করে একশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় পুষ্পিতা। প্রত্যেকের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে,
-এবার আসি। তোমরা সবাই সাবধানে থেকো। পথে সাবধানে চলাফেরা করো। আজকের দিনটা মনে থাকবে আমার।
নিজের নাম বলা সত্ত্বেও ওকে ওরা প্রথম থেকে পরী আপা ডেকে গেছে। সবাই প্রায় সমস্বরে জানায় তাদেরও মনে থাকবে পরী আপাকে। বিদায়ের সময় ওদের শিশু মুখগুলো গাঢ় বিষণ্নতায় ছেয়ে যায়। নিজেকে সামলে নেয় পুষ্পিতা। ওদের পেছনে রেখে চলে আসার মুহূর্তে কামাল চিৎকার করে ওঠে,
-পরী আপা, ধরেন, ধরেন।
ঘাড় ঘুরিয়ে কী ধরার কথা বলছে সেটা বুঝে ওঠার আগেই বাচ্চাগুলো হইহই করে ওর কাছে চলে আসে। আঙুল তুলে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সালমা। চোখ তুলে তাকাতে তাকাতে উড়ন্ত বেলুনটা ততক্ষণে খানিকটা এগিয়ে গেছে। কী মনে হতে ঝটতি কয়েক পা দৌড়ে যায় পুষ্পিতা। খলবল হাসিতে ভাসতে ভাসতে পিচ্চিগুলোও ওর পিছু নেয়। বেশ খানিকটা নীচ দিয়ে উড়ে যাওয়া বেলুনের সুতোটা খপ করে ধরে ফেলতে পুষ্পিতাকে বেগ পেতে হয় না। গড়পড়তা বাঙালি মেয়ের তুলনায় পুষ্পিতার উচ্চতা বেশ ভালো।
বেলুনটা হাতে নিয়ে ওর সমস্ত শরীরে অজানা একটা অনুভূতি গড়িয়ে যায়! আশেপাশে তাকিয়ে দেখে এলোমেলো ভাবে বসে থাকা মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে মগ্ন হয়ে আছে। কিছু মানুষ জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা দূরে। এই বেলুনটা কোথা থেকে এলো আচমকা? আর বেলুনের এই লেখাটা! দৈব ব্যাপারে পুষ্পিতার একদম বিশ্বাস নেই। চোখের সামনে মাকে মারা যেতে দেখেছে পুষ্পিতা। তার পক্ষে বেলুনে ‘তোমার মা’ লিখে ওর উদ্দেশ্যে পাঠানো কোনো ভাবেই সম্ভব না। সে যেমন বেলুনে ‘প্রিয় মা’ লিখে ছেড়ে দেয়, সেভাবেই কি কেউ তার সন্তানকে মনে করে বেলুনলেখন ওড়ান? অসম্ভব কিছু না। বেলুনটা উল্টাতে চোখে পড়ে একটা ঠিকানা। ওর মনটা কেমন জানি চঞ্চল হয়ে ওঠে। সালমাদের দলটা বেলুনটা নিয়ে ওর এতটা আগ্রহ দেখে হয়ত অবাক হয়। ওরা হয়ত আশা করেছিল বেলুনটা সে ওদের দিয়ে দেবে। পুষ্পিতা ওদের হাতে আরো কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে এরকম বেলুন কিনে নেবার কথা বলে বিদায় নেয় ওদের কাছ থেকে। ওর মনে তখন একটাই প্রশ্ন-
কে এই বেলুন প্রেরক? যিনি ‘তোমার মা’ লিখে সাথে ঠিকানাও দিয়ে দিয়েছেন! গিয়ে দেখবে একবার কে সেই মা? ঠিকানাটা কাকতলীয়ভাবে ধানমণ্ডিরই। হাতে যখন সময় আছে, দেখাই যাক না গিয়ে…
বেলুনটা হাতে নিয়ে পুষ্পিতা গাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে।
নাহার তৃণা
জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে আমেরিকার ইলিনয়ে বসবাস। ২০০৮ সালে লেখালেখির জগতে প্রবেশ। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে লিখছেন গল্প, প্রবন্ধ, গল্প, অনুবাদ, সাহিত্য সমালোচনা। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একইবছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশী গল্প’। নাহার তৃণার প্রকাশিত বই দুটি এখন বইয়ের হাট প্রকাশনায় অ্যামাজন কিন্ডেলেও পাওয়া যাচ্ছে।