চেইন টেনে নেমে যাওয়ার ইচ্ছা আরেকদিন হয়েছিল নিধির, আর্ট কলেজে পড়ার সময়। সেদিন বন্ধুদের সঙ্গে খালেদ ইউসুফের বাসায় গিয়ে থেকেছিল, সারাটা দুপুর। ছেলে মেয়ে সবাই সিগারেট টেনেছিল। নিধি ততদিনে চুলে ব্যান্ডানা বাঁধে, নিজের হাত খরচা গায়ে হলুদের মঞ্চ, নববর্ষের কার্ড ইত্যাদি বানিয়ে নিজেই যোগাড় করে। অথচ ভর্তি ফিস দিয়ে বাড়ি ফিরে জিনিসপত্র গুছিয়ে হোষ্টেলে যাওয়ার সময় ঝড়ে কুঁকড়ে যাওয়া পাখির শ্বাস কষ্ট অনুভব করেছিল নিধি। হল গেটে ঠায় দন্ডায়মান পাহারাদার থেকে শুরু করে হাউস টিউটরের চশমার ফ্রেম সবকিছু দেখে কান্না পেয়েছে তার। চারজনের ঘর, রুমমেটরা তখনো ফেরেনি। রেজিষ্ট্রি খাতায় সই করে এসে হঠাৎ করে বড়সড় ঘরটায় নিজেকে একা আবিস্কার করে ব্যাকুল কান্না পায় নিধির। নিচতলার ঘর, মাঝখানে পুরানো ফ্যান, ঘড় ঘড় আওয়াজে বাতাস গরম বোধ হয়। খাটের ওপর হাত পা ছড়িয়ে বসে থেকেছে নিধি। আজকে থেকে অজুহাত বানানো শেষ, জবাব প্রত্যাশী কেউ তার দিকে চক্ষু তাক করে বসে থাকবে না। অথচ তার ভেতরটা খালি খালি লাগছে, খর, কিংবা দয়ায় আর্দ্র একজোড়া চোখের জন্য তার কান্না পাচ্ছে। এই বোধ তাকে সে রাতে নির্ঘুম রেখেছিল, মনে আছে।
-‘রুমমেটদের সঙ্গে রান্নাবান্নার ঝামেলায় জড়াইস না নিধি’, হলের ডাইনিং এ সদ্য আলাপ হওয়া ইংলিশ সেকেন্ড ইয়ারের কুমকুম নিধিকে সতর্ক করে।
-‘কতগুলি ছাত্রী আছে সারাক্ষণ বইয়ের মধ্যে মুখ, আর দেখ না দেখ হাড়িপাতিল নিয়া রান্নাঘরে দৌড়ায়। বাজার করা যদি দেখিস, মাছ –মুরগী-শুটকি দিয়া পারলে গোটা পলাশী বাজার উঠায়া আনে। আরে বাবা, এখনি যদি এত্ত রানবি তাইলে বিয়াশাদীর পরে কি করবি? এরা খালি বোঝে ক্লাসের পড়া আর খাওয়া দাওয়া। বছর গেলে পকেটে ফাষ্টক্লাশ।’
লম্বা টেবিলে কতগুলি মেয়ে, কুমকুম সবার সঙ্গে তুই তোকারি করছে। তার চুল চুড়ো করে বাঁধা, পরনে কালো কিউলটের ওপরে ঢোলা আসমানি রঙ্গের টি-শার্ট। সবার থেকে আলাদা মেয়েটা নিধিকেই কেন জানি সঙ্গ দিতে চাইলো। আগাগোড়া। আর করলো বকবক। ডালের পানি বেশী খেলে কি উপকার। আর্টস ফ্যাকাল্টির চেয়ে এনেক্স বিল্ডিং কেন তার বেশী পছন্দ আর হলের মেয়েদের কান্ড কারখানা রসিয়ে বর্ননা করলো।
নিধিকে একদম ছাড়লো না। ওর মনে হয় সঙ্গী না হলে চলে না।
খাওয়া শেষ হলে দু’জনে শিরিষ গাছের ছায়ায় এসে বসে। দুপুরের শেষ, ক্লান্ত ছাত্রীদের ক্লাশ শেষে ঘরে ফেরা দেখতে দেখতে নিধির পাশে ঘাসে শুয়ে পড়ে কুমকুম।
-‘ আয়, একটু দিবানিদ্রা দিয়া নেই’।
-‘যাহ্ এইখানে ঘুমাবো কিভাবে?’
¬-‘আমি এইখানে কতবার সারারাত ঘুমাইছি। জ্যোৎস্না থাকলে বুঝলি, খুচরা পয়সার মত জোৎস্না ঝরে গায়ে…’
-‘তোমাকে কেউ কিছু বলে নাই? হাউসটিউটর আপারা, দারোয়ান?
-‘আরে ধুর, আপারা কি দশটার পরে থাকে নাকি,আর দারোয়ান দাদু তো ঝিমায়, আর বড় কথা হচ্ছে তাকে আমার হাত করা আছে’…চোখ টিপে দিতে পারে এ কথা কুমকুম চুপচাপ বসে থাকলে কেউ বিশ্বাস করবে না।
কুমকুম খান সিঙ্গেল সীটেড রুমে থাকে। নিধির কাছে এটা একটা রহস্য। এ রুমগুলি সাধারনত সায়েন্সের ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী, তার ওপরে আবার যারা থার্ড ইয়ারে উঠেছে তাদের জন্য বরাদ্দ। ঢাকায়, মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা হয়ে এই মেয়ে কি করে শেষ মাথায় গাছের ছায়ার ঢাকা রুমটা পেল!
রহস্যের জট কুমকুম কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে নিজেই খুলে দেয়। শিরিষ গাছের ছায়ারা তখন দুপুর পেরিয়ে লম্বাটে আর মোলায়েম।
ঢাকায় বাসা থাকলে কি হয় ওর বাবা মা এখন দেশে নাই। বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিল, ভিসি হতে হতেও হয়নি। কুমকুম নিজেই বলে যে তার বাবার রাজনৈতিক লবি বেশ শক্তিশালী। গত বছর মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে রাজনৈতিক রিক্রুটমেন্ট পাওয়ার পর, আর কুমকুমের সেখানে কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সম্ভাবনা না থাকায়, এমনকি সহসাই ইউ এস বা ইউ কে’র কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া দূরহ হওয়ায় সে হলে সীট নেয়ার বুদ্ধি বের করেছিল। মোহাম্মদপুরের বাড়িতে তার ঘর সাজানো গোছানো থাকে। মন চাইলে চলে যায়। সেখানে আত্মীয়-স্বজন আছে। কিন্তু কুমকুমের মাঝে মাঝে নিজের বাসাবাড়ি অগ্রাহ্য করতে ইচ্ছে করে, তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোষ্টেলে চলে আসে।
কুমকুমকে ঘিরে মুখরোচক, চালু গল্পের খানিক শোনা হয়ে যায় দুতিন দিনেই।
নিধির রুমমেট রানু আপা খুব খুশী না যে সে কুমকুমের সঙ্গে মেশে। সন্ধ্যেবেলা খাওয়ার পরে বিছানায় জাঁকিয়ে বসে নিধিকে ডাকে।
-‘ক্ষমতাবান বাপের মেয়ে দুইদিন পরে বিদেশ যাবেগা, তোমার কিন্তু এইখানে লেখাপড়া শেষ করতে হবে নিধি। ওর পাল্লায় পইড়ো না’।
-‘রানু আপা আপনিও তো বিদেশ চলে যাচ্ছেন…’ নিধি হাসে।
-‘এই ছেমড়ি আমার কথা আলাদা, আমি কি কুমকুমের মত বেয়াড়া?’
সামনে মাষ্টার্স পরীক্ষা সামনে, রানু আপা ঘাড় গুজে কষ্টিং এর স্প্রেডশীট প্র্যাক্টিস করে, মাথায় ওড়না দিয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে মধ্য মেঝেতে নামাজ পড়ে। সন্ধ্যা পেরিয়ে প্রায়দিন আমেরিকা থেকে টেলিফোন আসে তার। হাউস টিউটর আপা ডাকতে পাঠালে রানু আপার মুখ লাল হয়ে ওঠে, সবার সামনে স্বামীর সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে লজ্জা লাগে তার। কিন্তু তার প্রবাসী বরটি শুনলে তো!
হলের রুমে কোনভাবে ফোনের কানেকশন নেয়া যায় কিনা – তার স্বামী জানতে চেয়েছে।
রানু আপা রুমে ফিরে নামাজে বসে সালাম ফিরিয়েই হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে। তার আয়ত কালো বড় বড় চোখের পাতা পানিতে টুইটম্বুর হয়ে উপচে আসে। আর মাত্র কয়েকটা মাস। সে ভিসার জন্য দাঁড়াবে ইউ এস এ্যাম্বাসীতে। আল্লাহ যেন এক কটা দিন তার স্বামীকে সহী সালামতে রাখে। এখানকার সি এ ফার্মে ইন্টার্নশীপ করার শখ আপাতত একপাশে সরিয়ে রাখে রানু আপা। নিধিকে ছোটবোনের ভালোবাসা দেয়, বলেও সে কথা। রান্না করলে তার জন্য খাবার রেখে দেয়। সেদিন আর ডাইনিং এ খেতে বেরুতে হয় না, নিধি তার ড্রইং খাতা খুলে জল রং গুলে বসে যায়। রানু আপার শখ, বিদেশ যাওয়ার আগে নিধি যদি তার একটা প্রোট্রেট এঁকে দেয়।
নাহার মনিকা
উৎকর্ষের দিকে মনযোগী লেখকদের তালিকায় নাহার মনিকা একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নাম। ঈদসংখ্যা ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’-য় কবিতা দিয়ে নাহার মনিকা’র লেখা প্রকাশের শুরু। তারপর দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন দেশের জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাস নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ছয়।
উপন্যাস— ‘মন্থকূপ’ (বৈভব প্রকাশন, ২০১৯), ‘বিসর্গ তান’ (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ২০১৬)।
গল্পগ্রন্থ—‘দখলের দৌড়; ( পুথিনিলয় ২০১৯), ‘জাঁকড়’ (দিব্যপ্রকাশ, ২০১৪), এবং ‘পৃষ্ঠাগুলি নিজের (দিব্যপ্রকাশ, ২০১১)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ চাঁদপুরে আমাদের বর্ষা ছিল’(বাংলামাটি প্রকাশন)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Health Policy, Planning & Financing এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। বর্তমানে ক্যানাডা’র ক্যুবেক প্রদেশে সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত আছেন।
লেখালেখি নাহার মনিকা’র কাছে অপার স্বাধীনতার জগৎ, যেখানে লেখক একমেবাদ্বিতীয়ম।