একজন মানুষের নানান সত্তা থাকে, থাকে নানান পরিচয়। এই যে আমি— আমি তো একজন বহুধা সত্তাসম্পন্ন মানুষ। আমি দক্ষিণ এশীয়, আমি বাঙালি, আমি একটি নির্দ্দিষ্ট বয়ঃক্রমের, আমি পুরুষ, আমি একজন শিল্প-সাহিত্য রসিক, আমি দু’কন্যার জনক ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার এই বহুধা পরিচয়ের নানান মাত্রিকতা আছে। তার অন্যতম হচ্ছে যে এ সত্তাবলয় আমি যত প্রসারিত করব, তত আমার সত্তার বৈচিত্র্য বাড়বে, সন্দেহ নেই। সেই বৈচিত্র্য যদি আমরা মেনে নেই, তার প্রতি যদি আমরা প্রত্যেকে শ্রদ্ধাশীল হই, তাহলে ঐ বৈচিত্র্য আমাদের শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে, আমরা প্রায়ই আমাদের বহুধা সত্তার একটিকেই বেছে নেই আমাদের একক ও অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে। এবং মনে করি সেটিই আমার শ্রেষ্ঠতম সত্তা— অন্য যাঁরা সে সত্তার অনুগামী নন, তাঁরা আমা চেয়ে নিকৃষ্টতর, আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নন। সে অবস্হায় বিভাজন, বিরোধ ও সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। উপর্যুক্ত চিত্রটি সবচেয়ে প্রকট হয়ে ওঠে ধর্মসত্তার ক্ষেত্রে।ধর্মসত্তা মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও বোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ কথা মেনে নিয়ে অন্য সবার ধর্মসত্তার প্রতি আমরা প্রত্যেকে যদি শ্রদ্ধাশীল, সহিঞ্চু ও সহনশীল থাকি— ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে, তাহলে যে কোন সমাজে বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্হান সম্ভব। এবং আমাদের সমাজে সনাতন চিরায়তভাবে সেটাই তো হয়ে এসেছে। কিন্তু কালক্রমে বিভিন্ন সমাজে এ জাতীয় ধর্মীয় সহিষ্ণ শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা লুপ্ত হয়েছে এবং তার বদলে স্হান করে নিয়েছে ধর্মীয় উন্মাদনা, অসহিষ্ণুতা এবং অসহনশীলতা। তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায়— বিভাজন তো অন্যান্য ক্ষেত্রেও আছে, কিন্তু তা তো একটা উন্মাদনাময়, অসহিঞ্চু সংঘর্ষে গিয়ে পৌঁছায় না। কই, অধূমপায়ীরা নানান পার্থক্য সত্ত্বেও ধূমপায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন না? কিংবা কখনো কিন্তু শুনি নি যে উচ্চাঙ্গ সংগীতপ্রেমীরা অন্যান্য সঙ্গীতের কসিকজনদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছেন। তাহলে ধর্মের ক্ষেত্রে এলেই ব্যাপারটা একটা উন্মাদ, অসহিঞ্চু ও অসহনশীল রূপ নেয় কেন? কারণ বোধ করি অনেক আছে— কিন্তু একটি কারণ হয়তো বেশ জোরালো। যেমন, ধূমপায়ী বনাম অধূমপায়ী প্রশ্নে যুক্তি, বিচারবুদ্ধি, তথ্য উপাত্ত কিংবা বিজ্ঞানমনস্কতা একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, যেখানে কোন চরম অবস্হান না নিয়েই একটি অর্থবহ বিতর্ক প্রায়শ:ই ঘটে। সেখানে ধূমপায়ী কিংবা অধূমপায়ী কেউই তাদের ধূমপান সত্তাকে তাঁদের একক ও অদ্বিতীয় স্বত্ত্বা হিসেবে চিহৃিত করেন না, তার শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করা তো দূরের কথা। ফলে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্হান সেখানে সম্ভব। কিন্তু অন্যদিকে ধর্মীয় সত্তার ক্ষেত্রে অনেকেই তাদের অন্যসব সত্তাকে গৌন করে ধর্মীয় সত্তাকেই তাদের একমাত্র ও অদ্বিতীয় সত্তা: হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফলশ্রুতিতে, এ সব ব্যক্তিবর্গ তাদের স্ব স্ব ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব, খাঁটিত্ব, কুলীনতা সম্পর্কে অনড় দৃষ্টিভঙ্গীসম্পন্ন একটি চরম অবস্হান নেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে অন্যদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আত্মপরিচয়ের প্রতি তাঁদের নমনীয়তা, শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা সম্পূর্ন বিলুপ্ত করে দিয়ে একটি ধর্মীয় উন্মত্ততা, অসহিঞ্চুতা ও সংঘর্ষের সূচনা হয়। এ অনভিপ্রেত অবস্হটা এড়াতে হলে তিনটে বিষয় বোধহয় করা যেতে পারে। এক, আমরা শেকড়ে ফিরে যেতে পারি। ‘মানুষই প্রথম এবং প্রথমেই মানুষ’ এই ভিত্তিভূমি থেকে আমরা বলতে পারি যে মানবিকতাই সব মানুষের মৌলিক পরিচয় এবং সব সত্তার ন্যূনতম যোগসূত্র। দুই, উপর্যুক্ত কথাগুলোকে আমরা যদি মেনে নেই, তা’হলে অন্যের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে, তাকে মেনে নেয়া, তার প্রতি সহিষ্ণু হওয়া সহজ হয়ে যায়। তিন, আমাদের স্ব স্ব ধর্মীয় বিশ্বাসটিকে আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিগত নিজস্ব বলয়ে ধারন করি, তা’হলে ধার্মিক হয়েও আমরা ধর্মনিরপেক্ষ হত পারবে । এ তিনটে পন্হাকে অনুসরণ করলেই সব বিভাজন এবং সব সংঘর্ষ থেকে উত্তরণ সম্ভব হতে পারে। আমি মনে করি চূড়ান্ত বিচারে যা আমি ধারণ করে আছিএবং যা আমাকে ধারণ করে আছে, তাই আমার ধর্ম। আমি ধারণ করে আছি সার্বজনীন মানবতা বোধ, মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ, মুক্ত বুদ্ধি এবং মুক্ত চিন্তা। আমাকে ধারণ করে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনবোধ, আমাদের সমাজ ও তার পরিমন্ডল। আমার ধর্ম এ সবকিছু নিয়েই আর সেখানে মানুষ হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় ধর্ম আমার মানবিকতা। সেলিম জাহান ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.
|
|
|
সেলিম জাহানের মুক্তগদ্য: আমার সত্তা, আমার ধর্ম
Facebook Comments