সকালের ঘড়ির কাঁটা গড়াতে গড়াতে দশটা ছুঁতেই নড়েচড়ে বসলাম। বাইরে ঝাঁ চকচকে রোদ।
সুখিয়াকে ডাক দিয়ে প্রস্তত হতে নির্দেশ দিয়ে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে আরাম চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম।
শামীম বাংলো থেকে বেরোবার সময় বারবার সতর্ক করে গেছে। কিন্তু এতো আমার নতুন নয়।
শিকারের নেশা রক্তে ছড়িয়ে গেছে বছর দশেক হল । সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। জয়িতা বাবার বাড়ি না গেলে হয়তো সুযোগ পেতাম না। যদিও এসময় ওর পাশে থাকাটা খুব জরুরী, কিন্তু অফিস ট্যুর আর জয়িতাকে এই চরম সময়ে একা বাসায় রাখতে মন সায় দিলনা। তাই কদিন আগে ওর ভাই এসে নিয়ে গেল।
যাবার আগে জয়িতা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, পাশে থেকো ঐ মুহূর্তে । শুধু আমি নয়, তোমার অনাগত সন্তানও চাইছে , সে আসার আগে যেনো বাবা পাশে থাকে। বাবাই যেনো তাকে প্রথম কোলে তুলে নেয়। কপালে প্রথম চুমু এঁকে দেয়। আমরা দুজনেই প্রতীক্ষায় থাকব।
আর আরেকটা কথা রাখবে।
কি?
কথা দাও আর শিকার করবে না।
জয়িতার কপালে চুমু দিয়ে বললাম, এটাই শেষ শিকার, কথা দিলাম ।
গতরাতে কালেঙ্গা রেঞ্জ অফিসের ফরেস্ট অফিসার বন্ধু শামীমের বাংলোতে এসে পৌঁছেছি। পাশের জেলায় অফিসের কাজ সেড়ে রওনা দিয়েছিলাম।
দুদিন আগে কোজাগরী পূর্নিমা গেছে।
চেনা আঁধার সত্ত্বেও জোনাকিরা সারা পথ দেখিয়ে এনেছিল।
শামীমের নানা বিধি-নিষেধ ছুঁ মন্তরে উড়িয়ে বলেছি, তোর নাইট গার্ড সুখিয়াকে আমার সাথে দিয়ে দে। আর কিছু লাগবে না।
শক্ত গড়নের সুখিয়ার এ জঙ্গলের নাড়ি-নক্ষত্র সব মুখস্থ। জঙ্গলের স্থানীয় হওয়াতে কখন, কোথায়, কিভাবে – এ তিনটে প্রশ্নের উত্তর তার ভাল জানা।
সুখিয়ার ডাকে সম্বিৎ ফিরে বললাম, কি ব্যাপার সুখিয়া ? সব রেডি তো?
আর দেরি করা যাবে না। অল্প সময়ের মধ্যেই সুখিয়াকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম কালেঙ্গার চিরহরিৎ জঙ্গলের গহীনে।
সুখিয়া আমার প্রিয় এয়ার গান স্প্রিং-পিস্টন কাঁধে ঝুলিয়ে আগে আর প্রকৃতির অবাক সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ আমি পিছনে।
খুব সকালে এক পশলা বৃষ্টিতে ভেজা চিরচেনা মাটির বুনো গন্ধ। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে রৌদ্র ছায়ার আলো ঝিকিমিকি খেলা।
সুখিয়াকে বললাম, তুমি আমাকে মায়া হরিণ যেদিকে সেদিকে নিয়ে যাও।
সুখিয়া থমকে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করতে লাগল।
বললাম, তোমার সাহেবের সব জানা আছে এ বিষয়ে। ভয়ের কোন কারণ নেই।
ঘন্টা দুয়েক ঘুরাঘুরির পর সুখিয়া একটা গাছের আড়ালে এসেই বসে পড়তে বলল।
তারপর অদূরেই নজরে এল প্রতিক্ষিত লালচে বাদামী, পিংগল বর্ণের ফোঁটা বিহীন মায়া হরিণের কয়েকটা।
খানিকটা সময় নিয়ে পর্যবেক্ষন করতে লাগলাম। কারণ হরিণের ঘ্রানশক্তি খুব প্রখর। শত্রুর গায়ের সামান্য গন্ধ বুঝে নিতে পারে সহজেই। আর সন্দেহ জাগলে মায়া হরিণ কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করে ডেকে নিমিষেই ছুটে পালিয়ে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এভাবে ডাকে বলেই হয়তো মায়া হরিণের আরেক নাম বার্কিং ডিয়ার।
মোক্ষম সময়েই হাজির হয়েছি। দুপুরের এ সময়টায় হরিণের দল বিশ্রাম নেয়।
একটি মায়া হরিণ নজরে পড়ল। কেওড়া গাছটির পাশেই শুয়ে সবুজ কচি ঘাস আয়েশ করে চিবোচ্ছে। অন্য হরিণগুলো বেশ সতর্ক মনে হল। তাই ওই হরিণটাকেই নিশানা বানালাম।
আজ ভাগ্য সুপ্রসন্ন। বাতাস উল্টোদিকে বইছে। নইলে বাতাসে শিকারির গন্ধ শুকে নিমিষেই হাওয়া হয়ে যেত হরিণের দল। দেরি না করে গুলি করলাম কাঙ্ক্ষিত নিশানার দিকে।
আমার স্প্রিং-পিস্টন এয়ারগানের ০.১৭৭ গুলির গতি নিঁখুতভাবে আঘাত করল নিশানায়। অন্য হরিণগুলো সঙ্গীকে ফেলে পালিয়ে গেল।
সুখিয়া লাফিয়ে দৌঁড়ে গেল হরিণটির দিকে। গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি ছুটে গেলাম। আহত হরিণটির কাছে গিয়েই বুঝতে পারলাম, গুলি খেয়েও সে কেন পালিয়ে যায়নি।
হরিণটি গর্ভবতী। ওর চোখের দিকে তাকাতেই আমার হাত থেকে এয়ারগানটি পড়ে গেল। হরিণটির বড় বড় চোখ দিয়ে অবিরত অশ্রু ঝরছে।
দশ বছরের এ শিকারের অভিজ্ঞতায় এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হতে হবে ভাবতেই পারিনি। গর্ভবতী হরিণটির করুণ চোখের জল আমাকে নিস্তেজ করে দিচ্ছিল। আমার শরীর থরথর করে কাঁপছিল।
আমি মাটিতে বসে পড়লাম। সুখিয়া জলপাত্র থেকে একটু জল হরিণটির মুখের সামনে রাখতেই সে দম ছেড়ে দিল। আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
সুখিয়া, আমাকে বলল – আপনি বাড়ি চলে যান। আমি সব ব্যবস্থা করে ফিরে আসছি।
আমি যখন বাংলোতে পৌঁছলাম, দেখলাম শামীম অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল।
আমাকে দেখেই ছুটে এসে বলল-
জয়িতাদের বাসা থেকে তোর ফোনে অনেকবার কল করা হয়েছে।
আমি বুঝতে পেরেছি এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়না। তাই আমার কাছে তোর শ্বশুর ফোনে সব বলল।
তুই দেরি না করে এখনি জয়িতাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যা।
জয়িতার হঠাৎ করে ব্যথা শুরু হওয়ায় পরিবারের লোকজন ক্লিনিকে নিয়ে গেছে।
আমি জয়িতার বাবার সাথে কথা বলেই। গাড়ি নিয়ে ছুটে বেরিয়ে পড়লাম।
ঘন্টা দুয়েক পর আমি ক্লিনিকে যখন পৌঁছলাম, দেখলাম – জয়িতার মা চিৎকার করে কাঁদছে।
ওদের একজন নিকটাত্মীয় আমার কাঁধে হাত রেখে বলল- বড্ড দেরি হয়ে গেছে বাবা।
সব শেষ! মা, শিশু কাউকেই বাঁচানো যায়নি।
পুলক দত্ত
জন্ম ও বেড়ে ওঠা শ্রীমঙ্গল শহরে। বর্তমানে নিউইয়র্ক শহরে বসবাস করছেন।কবিতা ও গল্প লেখেন। অনুগল্প রচনায় রয়েছে বিশেষ আগ্রহ।