কুমকুম টিভিরুমের সামনে নিধিকে পাকড়াও করে,´এই মেয়ে তোকে দেখিনা কেন? আয় আমার সঙ্গে’।
নিধির তখন টেলিভিশনে সন্ধ্যেবেলার খবর দেখার সময়। কিন্ত কে শোনে কার কথা!
তির তির করে সান্ধ্যকালীন গুঞ্জনধ্বনি ছড়ায় আঙ্গিনায়। করিডোর ধরে সে গুঞ্জনের রেশ কুমকুমের রুম অব্ধি পৌঁছায় না। ওর ঘরের জানালায় নীল পর্দা। কাঠের ছোট্ট শেলফে অনেকবার দেখা বই আবারো ঘাটাঘাটি করে নিধি। কুমকুমের পাঠ্য আর্মস এন্ড দ্য ম্যান, লর্ড অব দ্য ফ্লাইজ। বইগুলির মলাটের ভেতরে নিজেকে অন্ধের মত মনে হয়।
কুমকুম চায়ের সরঞ্জাম বের করে, চা পাতা চিনি। মেঝেতে বসে বের করে খাটের নীচে লুক্কায়িত হীটার। জ্বালানো অবৈধ, তবে ওকে কেউ ঘাটাবে না। বরং দরজা জানালা বন্ধ করে নিষিদ্ধ আনন্দের খিক খিক হাসি হেসে ছাকনি দিয়ে চায়ের তরল আলাদা করে।
দাঁতের সারি অসমতল না হলে এ মেয়েটাকে অনেকে পথের পাঁচালির দূর্গা বলে ভুল করতো।
নিধির বই ঘাটা দেখে একটা বই হাতে ধরিয়ে দেয়- ‘এইটা পড়তে পারিস’, অল কোয়ায়েট ইন দ্য ওয়েষ্টার্ণ ফ্রন্ট, লেখক এরিখ মারিয়া রেমার্ক।
-‘ এই শনিবারে বৃটিশ কাউন্সিলে এই বই নিয়ে তৈরী সিনেমা দেখাবে। তোকে নিয়া যাবো নে’।
বইটা নিয়ে এসে পড়তে গিয়ে কিছুই বোঝে না নিধি, খাতা পেন্সিল নিয়ে বসেছিল, সব অচেনা শব্দ লিখে নিয়েছে। বেশীদূর পড়তে পারে নি তবুও মনে হচ্ছে কিছু কিছু অংশ ঠিকঠাক বুঝেও গেছে।
শুনে কুমকুম ওর খাটের নিচ থেকে ছোট কয়েকটা বই বের করে দেয়, কিশোর ভার্সন অব ইংলিশ ক্লাসিকস। বাহ, এইগুলি নিধির কাজে আসবে।
সিনেমা দেখতে যাওয়ার দিন উত্তেজনায় দুপুরে ঘুমোতে পারে না নিধি। আচ্ছা ফিরবে কি ক’রে? হলের হাউস টিউটরদের পারমিশন নিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু কুমকুম কি নিয়েছে?
-‘দূর পারমিশন লাগবে না। চলতো’!
চার পাঁচজন নারী পুরুষের একটা গ্রুপ বাইরে লনে আড্ডা দিচ্ছে, সিনেমা শুরু হতে দেরী কিছু দেরী আছে। পরিচিত হবার পরে নিধির ফাইন আর্টস ফার্ষ্ট ইয়ার কাউকে তেমন আগ্রহী করলো না, শুধু খয়েরী পাঞ্জাবী পরা একজন সঙ্গের ছোট চুল নীল পাড় সিল্কের শাড়ি পরা শ্যামাঙ্গিনীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিধির দিকে ফিরলো।
-‘কেমন লাগছে?’
ফুলার রোডে বৃটিশ কাউন্সিলের বিকেল তখন বড় মনোরম। বাতাসে কলাবতীর লাল ঝাড় হেলছে। বেগুনি শাদা ডট প্রিন্টের সালোয়ার কামিজ পরা নিধির ভালো লাগছে। চুল বেঁধে আসেনি বলে অস্বস্তির কথা বলা যায়? বুঝতে পারছে না।
ওকে উদ্ধার করতে কুমকুম এগিয়ে আসে না। অগত্যা বলতে হয়।
-‘ভালো লাগছে, হল জীবন ভালো লাগছে। নিজের মত করে থাকা ভালো লাগছে’।
-‘ঢাকার বাইরে থেকে এসে ঢাকা কেমন লাগছে?’
প্রশ্নটা ঠাহর করতে হয় নিধির, সেতো অনেক বছর ঢাকা শহরের বাইরে যায়নি! আসলে তো সে ফুপুর বাড়ি আর স্কুল, কলেজ এর বাইরে যায় নি। ওর গায়ে কি মফস্বলের ছাপ আছে!
সামান্য হাসি ফেরত দেয়া ছাড়া আর কিছু বলে না সে।
ঢাকায় এসে একটা সিনেমাও নিধি দেখেনি।
ফুপুর বাসায় এসবের চল নেই। টিভির নাটকে কাজ চলে। ঢাকাই সিনেমার প্রতি বরং নাক সিঁটকানো ভাব আছে। নিধি সেই বাবা আর মা’র সঙ্গে বীরগঞ্জে থাকার দিনগুলোতে যা কিছু দেখেছে, কিছু মনে নেই কেবল শীতবোধ মনে আছে। সিনেমা হলে নিধির সব সময় শীত করবে, মা সেজন্য সোয়েটার নিতো সঙ্গে, হয়তো শীতকালে বেশী যেতো তারা।
আজকে বোকামী হয়েছে তার।
অল কোয়ায়েট ইন দ্যা ওয়েষ্টার্ণ ফ্রণ্ট’এর সঙ্গে সঙ্গে অডিটোরিয়ামের এয়ার কুলারে জমে যাচ্ছে সে। বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কাহিনী। সৈনিকের জীবনের স্বাভাবিক সাধারণ মানুষের জীবনে ফিরলেও কি ফেরা হয়? কাটিয়ে আসা জীবনের খন্ডাংশ তাকে তাড়া করে ফেরে! একজীবনে মানুষ মাত্রই তাহলে কোন না কোন যুদ্ধফেরত সৈনিক!
সিনেমা শেষে বের হলে থমকে যায় নিধি। রাত হয়ে গেছে, স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার সময় বাবার দেয়া ঘড়ি তার কব্জিতে। রাত ন’টা বাজে! বিদ্যুৎচমকের মত মানসিক চাপ ফিরে আসে, হলে ঢুকবে কি করে?
কুমকুম কলকল করে কথা বলছে সবার সাথে। নিধির দিকে এমন করে ফেরে যেন সম্বিত ফিরলো ওর,– ‘ও হ্যা, চল আজকে আর হলে যাবো না’।
– ‘তাহলে কোথায়?’ নিধির নার্ভাস কথা শুনে কুমকুম সাধু সন্ন্যাসীর মত অভয় দিয়ে হাসে। হাউস টিউটরদের বাসার ভেতর দিয়ে দেয়াল টপকে ওর হলের ফেরার গল্প শুনেছে নিধি। আজকে সে নিজে তেমন কিছু একটার প্রত্যাশা করেছিল মনে মনে। কিন্তু একদম সারারাতের জন্য না ফেরা!
-‘দুই জায়গায় যাওয়া যায়, বাসা তো একটা আছে আমার, না কি? আর ভিন্সেন্টের সঙ্গেও যাওয়া যাইতে পারে, সে খুবই ইন্সিষ্ট করতেছে। ঘ্যান ঘ্যান করতেছে যেন ওকে বেগুনভর্তা বানানো শিখায়া দেই। কোথায় যাওয়া যায় তুই ই বল নিধি…’
গোলগাল মুখ, সোনালী ফ্রেমের গোল চশ্মা আর ফিনফিনে সোনালী চুল নিয়ে ভিন্সেন্টকে এগিয়ে আসতে দেখে হকচকিয়ে যায় নিধি। জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির হয়ে রিসার্চ করতে এলেও লোকটার সিনেমা কালচারের সাধ পূরণ হয় আপাতত বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলিতে এসেই। ভিন্সেন্টের সঙ্গে হ্যান্ড শেক করতে না করতে তার ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির।
কুমকুম নিধির কানে কানে ফিস ফিস করে বলে- ‘চল সোনার গৌতম বুদ্ধের বাড়িতেই যাই’।
গাড়িতে বসে শীতবোধ আরো বেড়ে যায় নিধির।
তাকে ড্রাইভারের পাশে বসতে দিয়ে কুমকুম আর ভিন্সেন্ট পেছনে বসলে বেকায়দা লাগে তার। ভিন্সেন্টের বাসা কত দূর জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করে না।
এই বেলা রাতের ঢাকা শহর দেখার সুযোগ হচ্ছে কতদিন পরে! রাস্তার হলদেটে আলো, কোথাও কোথাও অন্ধকার আবার উজ্জল ট্রাফিক লাইটের মধ্যে চোখ ঢুকে যায়।
এত বছরেও এই শহর নিধিকে আপন করে নিতে পারলো না।
ফুপুর বাসায় সে থেকেছে অতি সন্তর্পণ, সাবধানী, অতি ভালোর ভূমিকায় অভিনয় করে করে। কতদিন তার নচ্ছার পাজী হয়ে কাপ ডিশ ভাঙ্গতে ইচ্ছে করেছে, কিন্তু করতে পারেনি। ফুপুর বাসা তার নিজের মনে হয়নি।
মথুরাপুরের কথা মনে হলে একটা পোড়া বাতাস পাক খেয়ে খেয়ে ধেয়ে আসে তার দিকে। শৈশবের সবচাইতে মধুর সময় ঐ বাতাসের ঘূর্ণিতে আটকে আছে।
আর থেকেছে সে ভোমরাদহে। ওখানে নিধির কোন ঘর, বিছানা ছিল না।
বাবার না থাকাটা কেন জানি নিধির মনে হয় তার সঙ্গে দাদুর সংযোগের সুত্রটিকেও ছিঁড়ে দিয়েছিল।
ঢাকা শহরের আলো আধারির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে সাইনবোর্ড পড়ে, চলমান মানুষের ভীড়ের চরিত্র আবিস্কার করে এই শহরের রাস্তাঘাট ভালো লাগাতে চায় নিধি।
নাহার মনিকা
উৎকর্ষের দিকে মনযোগী লেখকদের তালিকায় নাহার মনিকা একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নাম। ঈদসংখ্যা ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’-য় কবিতা দিয়ে নাহার মনিকা’র লেখা প্রকাশের শুরু। তারপর দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন দেশের জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাস নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ছয়।
উপন্যাস— ‘মন্থকূপ’ (বৈভব প্রকাশন, ২০১৯), ‘বিসর্গ তান’ (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ২০১৬)।
গল্পগ্রন্থ—‘দখলের দৌড়; ( পুথিনিলয় ২০১৯), ‘জাঁকড়’ (দিব্যপ্রকাশ, ২০১৪), এবং ‘পৃষ্ঠাগুলি নিজের (দিব্যপ্রকাশ, ২০১১)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ চাঁদপুরে আমাদের বর্ষা ছিল’(বাংলামাটি প্রকাশন)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Health Policy, Planning & Financing এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। বর্তমানে ক্যানাডা’র ক্যুবেক প্রদেশে সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত আছেন।
লেখালেখি নাহার মনিকা’র কাছে অপার স্বাধীনতার জগৎ, যেখানে লেখক একমেবাদ্বিতীয়ম।