বেইলি রোডে বাল্মীকি/জুনান নাশিত
সেলাই করা ঠৌঁট/জাহানারা পারভীন
মারী ও মাধুর্য/সাবেরা তাবাসসুম
আমি ও জহির/জহির হাসান
বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়/ আবদুর রব
বেইলি রোডে বাল্মীকি থেকে নির্বাচিত পাঁচটি কবিতা
জুনান নাশিত
চলে যাচ্ছি
মাছেরা আকাশচুম্বী!
আমি ফিরে যাচ্ছি
ভেঙে যাচ্ছে কুয়াশার ঘের
সময়কে খনন করেছি কতোকাল
বিশুদ্ধ নির্মাণ ভেঙে খুঁজেছি অনেক
অনুচ্চারিত শিল্পের ভীড়ে
অলৌকিক কোন বেহুলার ঘাট
মনে পড়ে
সাদা ডানায় ছড়ানো ঈশ্বরের ডাকে
একদিন চোখ তুলে দেখি
শরতের চিত্রল আকাশ জুড়ে ত্রিকোণ মাছের ঘর
কিলবিলে
তাই দেখে ভেসে গেছে
পতনের বহুমুখী আনন্দ উজান
সেদিনও চিলের ডানায় ছিল
শিকারীর ধূর্ত হাহাকার…
সেদিনও কেঁদেছিল কালো পাখিটির সুর
তাতে ভরা ছিল শব্দের আগুন
সে আগুন আমাকে থামাতে চায়
ফেরাতে ব্যাকুল আবাল্য জলের নিষিদ্ধ বুদবুদ
যার অজস্র আলাপে কতোদিন ভেঙে গেছে ঘুম
দাঁড়িচিহ্ন সহ দাঁড়ানো পথের পাশে
কতোদিন কতো ভাঁটফুল
দেখেছি নিঃশব্দে
ভেঙেছিল
মহুয়ার কষ্টের পাথর।
আমি চলে যাচ্ছি
কান্নারা বরফ হচ্ছে
আর বেদনা চিৎকার!
কালো বিষ
ছুরির ফলায় গেঁথে আছে চোখ
হাড়ের ভেতর অগ্নিধারা
অদৃশ্য কপাল জুড়ে অপেক্ষার শিরস্ত্রাণ।
মণি দু’টো শব্দহীন কান্নার ভেতর ডুবে যাওয়ার আগে
আমি অপেক্ষার শিরস্ত্রাণ খুলে ঘুরে আসি
জীবন খোয়ানো সেই মুহূর্তের পাড়ে
একদিন যেখানে তোমার কাঁধ ছুঁয়ে উড়িয়েছি
অজস্র বাতাস, মিলিয়েছি ঠোঁট, জিহ্বার করতল।
আজ প্রতি তিরস্কারে বাজালে যে সুর
তাতে বৈকল্যের খরা, কালো বিষ।
চোখ দু’টো ছুরির ফলায়
নাকের দু’পাশে আকাঙ্ক্ষার রক্তদাগ।
ভ্রমণ
(অগ্রজ কবি ফেরদৌস নাহারকে
যিনি নিমগ্ন আজীবন কবিতার ঘরে)
দৃশ্যত ভ্রমণে থাকে না কোথাও কেউ!
স্বররিপিগুলো উড়ালের প্রস্তুতি নিতেই
কাঠঠোকরার দল নেমে এলো ঘাসের জমিনে
সেখানে প্রচুর লাল কাঁকড়ার সারি
মার্চপাস্ট করে চলে যাচ্ছে দূর সমুদ্রের দিকে..
অবতরণের হাওয়ায় ভেসে
নগরীর সব বাদামী উৎসব
থেমে গেছে
দূরন্ত পাখিরা তাই কথাহীন গল্পগুলো খুঁটে খুঁটে
তুলে আনে
অযাচিত অন্ধকার স্মৃতি!
ডাকপিয়নের কড়িগোনা দুপায়ে ইচ্ছের পাশে
একটিও সবুজ বাতাবী নেই
কেবলই সাদাফুল আর মার্চপাস্ট
কেবলই ঘাসের জমিন আর জেটলগ;
কাঠঠোকরা অথবা লাল কাঁকড়ার দল
নীলাভ ঘাসের ডগা পাড়ি দিতে দিতে ভাবে
হাতের তালুতে গ্যালাক্সিমন্ডল নিয়ে
তারাও হয়তো পৌঁছে যাবে কোন একদিন
বহুদূর শাশ্বতের যুগল কিনারে।
নিয়ানডারথালের কবর
জীবনটা শুয়ে আছে
নিয়ানডারথালের অদৃশ্য কবরে!
মৃতের শিয়রে আজ বেধড়ক দৌড়
মুখর মল্লিকা, সাইরেন, কোলাহোল
তাই দেখে টুটে যায় কাঠঠোকরার ঘুম
ইচ্ছেঘুঙুর মাড়িয়ে সেও সুর তোলে
প্রাক প্রস্তুর যুগের ইশারা ধ্বনির শীষে –
সে সুর বিষণ্ণ!
আগুনজ্বলা দু’চোখে তাই ঘূর্ণি তোলে মন্দ্রিত শূন্যতা!
অস্থিপোড়া দিন শেষে
কবরের হাতজোড়া খুলে দেয় বায়ুশূন্য ঘর
ঘরের জানালা আর নির্বাক প্রান্তর
বহু ক্রোশ দূর থেকে কান পাতি
শুনিনা কিছুই
কারণ সে ঘরে কোথাও ক্রন্দন নেই
ভুলেও কাঁপে না কোন দীর্ঘশ্বাস
আছে সারি সারি পাতার পোশাক
তারা উঠে আসে গায়ে, মুখে
শরীরে ছড়িয়ে দেয় অবিকল বিচিত্র প্রলাপ
যেন তারা বালিঘড়ির চিমনি ঘেরা অরক্ষিত হিম
অবেলার বেহালা বাদন।
একদিন ক্রোধ জমে সভ্যতা লোপাট হলে
জীবনটা খাবি খায়
চিমনির ধোঁয়া ছেড়ে সেও খোঁজে
আলতামিরার গুহাচিত্রে
কেবলই অবিরল এক জলের পাথার।
সমগ্র
ভুলে যেতে চাইনি কিছুই
টুকটুকে রঙের ভেতর থেকে নীলাভ নিবিড়
ছিনিয়ে নিতে চাইনি কখনও
মধ্যরাতের বেহালা বাদন যেদিন গড়িয়ে পড়েছিল
ভোরের বাতাসে
সেদিনই তর্কাতীত এক অন্ধকার দিন
আমাদের নিয়ে গেল করুণ ক্লান্তির পথে
সেদিনই অশ্রুপাত
সেদিনই নিস্তব্ধতার খাপে হৈ হৈ জলন্ত কলরোল।
ভুল বুঝনা প্লিজ! আমিতো তোমার পায়েই পা রেখে
ভেঙেছি ছায়ার প্রপাত।
আমাদের সমগ্র আজ নিম্নগামী শোক
তাকে বয়ে যেতে দাও
মিশে যাক ব্যাকুল কুন্ঠিত সম্মোহনে।
সেলাই করা ঠৌঁট থেকে নির্বাচিত পাঁচটি কবিতা
জাহানারা পারভীন
মসলার গান…
আমার মুঠোতে কোনও ঈশ্বর নেই
একটা পিঁপড়ে ছিল; সেও চলে গেছে
দাদীর সিন্দুক থেকে এনেছিলাম
যে সবুজ মার্বেল
সেও ছিল কিছুদিন
সেও জানে, মুগ্ধতা অনুতাপের মা
একটি এলাচ আমাকে বলেছিল—
মসলার বন তার ভালো লাগে না
সে চায় মুঠোবন্দী জীবন…
কাচের বয়ামে ভরে রাখি
মুঠোভর্তি এলাচের ইচ্ছে
অপরাধ
এক চিলতে বারান্দার দোতলা বাড়ি;
বাড়িতে আসা যাওয়া দখিন হাওয়ার
আর আসত চড়ুই
ছানাপোনাসহ চড়ুই শিকার করতেন মা
নিভিয়েছেন রান্নাঘরে বাস করা ক্ষুধা
বন্ধ দরোজা, জানালা, ঘুলঘুলি
পাখিদের ছুটোছুটি, আর্তচিৎকার
এখনও মনে আছে মায়ের নিষ্ঠুরতা
শিশু সন্তানের পাতে মা তুলে দিতেন
পাখি মায়ের বুক, ডানা, কলিজা,
যার সন্তানেরা তার জন্য অপেক্ষায়,
বাড়ির পাশের গাছে
গ্রিলে বসা চড়ুইয়ের কাছে ক্ষমা চাই
আমার মায়ের অপরাধের
নিমগাছের পরিচয়পত্র
নিমগাছটাকে চিনতেই পারিনি
ভেবেছি সে ছাতিম, সেগুনের সন্তান
সে বলেছে সব হাতেই থাকে কিছু তিতে রেখা
সরু পথ ধরে কিছুটা হেটে আসা যায়
আবার ফিরে আসতে হয় পুরনো পৃষ্ঠায়
যেমন ফিরে আসে
হুইল থেকে সুতো নিয়ে ছুটে যাওয়া মাছ
শিকারির হাতের নাগালে
পড়ি বিদ্রুপ, বিদ্রোহ,
মুখোশের আড়ালে থাকা মুখ
শিং মাছের ঘাই খেয়ে হেসে ওঠা মানুষ
দেয়ালে টানিয়ে রেখেছি জেদ; ফ্রেমে নিম কাঠ,
যার নাম ধরে ডেকে উঠেছিলাম একদিন…
অক্ষরের অট্রহাসি
একদিন ফিরিয়ে দেব সব অস্বীকার
মাফ করে দেব ঐ শীতকালকে,
মাথা নীচু করে দাড় করিয়ে রেখেছে পাচটি বছর
যে বলেছে, খবরের কাগজের সঙ্গে ঘর থেকে
বিদায় করা যায় পুরনো বছরের ক্রোধ, অক্ষরের অট্রহাসি
আয়নায় ভেসে উঠবে অপাঠ্য মুখ, দেবতার রক্তে ভেজা শার্ট
সংবিধান থেকে খসে পড়া অধিকার
কিছুটা কমে যাবে মরচে পরা দায়ের বয়স…
সে জানে, নত হতে হতে
কেন মাটির কাছাকাছি নেমে আসে ডাল
মনের মরচে গুরুত্বপূর্ণ খুব
সে তৈরি করতে পারে যেকোনও ইঙ্গিত
জাগিয়ে দিতে পারে ঘুম পাড়িয়ে রাখা শরীর
চোখের সীমানায় শর্ষে ফুলের হাসি
হলুদ পাখিটাকে উড়িয়ে দেব
আমার মুঠোতে যে ঘুমিয়ে পড়েছে
একদিন বলে দেব_
আমাকে কতটা রক্তাক্ত করেছে তোমাদের বাঘনখ…
সম্পর্ক
ঠান্ডা জলে হাত ধুয়ে দেখি…
সব রেখা মুছে গেছে জলে…
গাঢ় নির্জনতায় ঘন হয়েছি আরো
থার্মোমিটারে মেপেছি সব অন্ধকার
হাতের পিঠে আয়ুরেখার সংকেত
অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া বিরহ জানে
গাছ থেকে ছায়া কেটে আনা কাঠুরের কৌশল
কখনও কখনও ব্যর্থ হয় কুঠারের কাছে…
বিস্মিত বাকল তবু ঢেকে রাখে কাঠের সম্ভ্রম
হয়তো আর মরুকরণের গল্প হবে না,
বানাতে দেব না সম্প্রদান কারকের পোশাক
থেমে যাব প্রাসঙ্গিক প্রশ্নে
যে প্রশ্নে নিহত হয়েছে
অলৌকিক বিকেলে কথা বলে ওঠা বোবা সুখপাখি
কারো নামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীতে
আর ভাসিয়ে দেব না প্রিয় প্রবাদ
বিশ্বস্ত বাগধারা
সেলাই করা ছায়া
পায়ের জুতা জোড়া আমার নয়,
অন্য কারো মাপের;
ভ্রমণ বিষয়ক গবেষণা বলে
হাটার জন্য গুরুত্বপূর্ন পথের দৈর্ঘ্য
গন্তব্যে পৌছতে মনে রাখা চাই কালিম পাখির নাম
যে হীরামন পাখি হয়ে পিছু ডাকে
ফিরে তাকালেই পাথর হয়ে যায় শরীর
তোমাদের হয়তো মনে আছে,
গত গ্রীষ্মে জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে এনেছি
সেলাই করা ছায়া ছায়া
পায়ে নতুন বাটা জুতা
একজোড়া জুতার জন্য আর
দাড়িয়ে থাকব না অচেনা গোরস্তানের সামনে
আমার জন্য রেখে গেছে কেউ একজোড়া কাঠের খড়ম
যারা কোনও দিন হাটতে বের হয়নি আমার সঙ্গে
সাঁতার শেখা নদী
কারা যেন নিয়ে গেছে সমাধিফলকের পাথর
মনে আছে নীল আগুন,
নাশপাতির মতো সকাল;
ক্ষুধার্ত বাজপাখীর উড়াল…
আমাদের দূরত্বকে কি বলা যায়?
গ্রীষ্মের সঙ্গে বরফের দূরত্ব!
জন্মের সঙ্গে মৃত্যুর!
প্রথম আলাপ আর শেষ দেখার!
এক পোষ্টম্যান কুড়িয়ে নিয়ে গেছে সব প্রতিশ্রুতি
রেখে গেছে হাতের দস্তানায় লুকিয়ে রাখা সন্দেহ
আলনায় ভাজ করে রেখেছি কাগজের কাথা
তাকেও বলিনি সেই নদীর নাম;
যে নদীর কাছে রেখে এসেছি তার সাঁতার!
মারী ও মাধুর্য থেকে নির্বাচিত পাঁচটি কবিতা
সাবেরা তাবাসসুম
চিবুক নামিয়ে নিয়ো সন্ধ্যার আগে
চিবুক নামিয়ে নিয়ো সন্ধ্যার আগে
নেংটি পরিয়ে
আমাকে ফেলে এসো লবণের দ্বীপে
আলখেল্লার আগে, তীলকের আগে
সাদা হাতে উপহার এনেছিল কেউ
বহুকাল তাকে আর স্মরণে না আনি
তাকে আর ভালোই না বাসি যুগ যুগ
হাড়ে-মজ্জায় লেপা গুপ্ত-ঘাতক
আমাকে রেখো তবু আহারে-বিহারে
রাক্ষসমণ্ডলে তবু জেনো আমাকেই পাবে
সমস্ত ক্ষতমুখ বিষাদ-কাতর
সমস্ত শুশ্রুষা নেমে গেছে বদ্ধভূমিতে
ছেড়ে দাও, পৃথিবী কলহ থেকে বাঁচে
ছেড়ে দাও, পৃথিবী আমার থেকে বাঁচে
শিরায় ধাবিত যত কাকুতি-মিনতি
আমাকে মুড়ে দিও আরকে, আদরে
আমাকে রেখে এসো লবণের দ্বীপে
নেংটি পরিয়ে
চিবুক নামিয়ে নিয়ো সন্ধ্যার আগে!
একটা লাইন নিয়ে ফিরে যাচ্ছি বাড়ি
একটা লাইন নিয়ে ফিরে যাচ্ছি বাড়ি
শহরের ধূলায় মিশে থাকে স্মৃতি প্রাক্তন
চাদরের কোণায় ঢাকি ভাব, ঢাকি আড়ি
আমার এক চোখে প্রেম, অন্যটায় ছানি
একটা লাইন নিয়ে ফিরে যাচ্ছি বাড়ি
পুকুরে সাঁতার শেখা আমি ও মাছ
সকল শাসন ফেলে ছোটা কিশোর যৌবন
সাইকেল, লাল সোয়েটার, শস্য রকমারি
আমার এক চোখে ভুল, অন্যটায় ছানি
একটা লাইন নিয়ে ফিরে যাচ্ছি বাড়ি
একটা লাইন নিয়ে ফিরে যাচ্ছি বাড়ি
শহরে নেমেছে শীত, মুদ্রা ও সম্মোহন
আবার অপেক্ষা, প্রস্তর সারি সারি
আমার এক চোখে মৃত্যু, অন্যটায় ছানি
একটা লাইন নিয়ে ফিরে যাচ্ছি বাড়ি!
মাধুর্য এখানে থাকে না
পাঁচ.
মাধুর্য,
হাত ফসকে ডুবে যাওয়া প্রিয় সুগন্ধি সাবান
আমি কখনো তোমার অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ার কথা ভাবি
ভাবি সুগন্ধি বিলিয়ে বিভোর করা মুহূর্তগুলো
ভাবি কোন নর্দমায় অভিজাত খুশবু নিয়ে পড়ে আছো
কিংবা নদীতে
অথবা পুকুরে
হয়তো কোনো মাছ ফাতনার হাতছানি ভুলে
তোমাকে একটু খেয়ে নিয়ে সুগন্ধি বুদবুদ তোলে
আমি স্থলপথে
পথের মাঝখানে
একলা বিষাদে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
তোমার ঔদার্যের কথা ভেবে যাই
সুরভিত পৃথিবীর কথা ভেবে যাই
আমার থেকে যা বহু বহু দূর
তবু জীবন মধুর
আহা মাধুর্য, জীবন মধুর!
দশ.
খোদার কসম আমার কেউ নাই
কোনো প্রেম নাই, একা
চুমু খেতে চাই বলে
আমাকে বেহায়া ভেবে চটে গেলে
চটে গিয়েও যদি
হালকা চুম্বন পেতে দাও
পৃথিবীর একান্ত হলুদ বাড়িটি
তোমার হতে পারে
অবশেষে আমার যখন কিছুই নাই
না ভাত খাওয়ার পয়সা
না বাথরুমে উঁচু কমোড
না কোনো নিভু নিভু নেশা
না অফুরন্ত শ্রী, যৌবন
তবু আমি শৈবাল খেয়ে
বেঁচে থাকার কথা ভাবি
বিলুপ্ত হতে হতে টিকে যাওয়া
লালমাথা সারসের কথা ভাবি
অবশেষে যার কিছুই নাই
তার জন্যে তোমার দয়ার পালা সাঙ্গ হয়
মাধুর্য, তবু তুমি এসেছিলে
তবু তুমি আসো
তবু তুমি কী করে যে আসো!
সতের.
তোমার ভয়ে আমি মুদে থাকি আঁখি
নিথর পা আর নিথর চোখ
তোমার ভয়ে তল্লাট ছেড়ে
বড় রাস্তা ছেড়ে হাইওয়ে ছেড়ে
শুধু এক বেদম ছুট
হাওয়া কেটে জল কেটে
পাহাড় আর ধস কেটে কেটে
আমিও ঊর্ধ্বশ্বাস
কখনো আমিও নতমুখ
মন ও হৃদয় চিনে নিতে নিতে
দোষ ও গুণ বুঝে নিতে নিতে
আমার জিভে লেগে থাকে
বিস্ময়ের স্বাদ, স্বাদের বিভ্রম
এ কি ভীতি না ভীতিজাত ধ্বনি
কেননা রক্তের রঙ মূলত কালো
কেননা রক্তের রঙ আসলে
সহজ সম্পৃক্ত লাল
এবং গোঙানী সেও ঠিক
স্বর-সপ্তক ধরে আসে
সেই ভয়, তাই সবখানে
ভয়ই মোক্ষম মারণমন্ত্র
আমি তার মর্ম জেনেছি
আর কিছু দেখতে চাইনি বলে
প্রবল থেকে প্রান্তিকে
নিজেকে ঘষটে
নিয়ে যেতে চাইনি বলে
সমস্বরে ধারাপাত পাঠ
শ্রেয় হয়ে ওঠে
এই দেখো, মাখন কাটার ছুরি
নির্বিষ আমার হাতেও
আর দেখো পরিতাপহীন
অসংখ্য মানুষের মুখ
নিশিদিন ভীতি জাগে
ভীতি জেগে আছে বলে
জাগরণ আর তো জাগে না
অবশেষে থাকা কিছু
কৌশল ট্রমা নিয়ে
তোমার সন্ধানে নামি
তুমি বা কোথায়
উবে গেছে সংকেত
তোমার নিবাস নিয়ে
কী জানি কখন
লাঠি ঠুকে ঠুকে তবু পথে নেমে
একে তাকে জিজ্ঞেস করি
মাধুর্য এখানে থাকে কি?
মাধুর্য এখানে থাকে না?
মাধুর্য এখানে থাকে না।
আমি ও জহির থেকে নির্বাচিত পাঁচটি কবিতা
জহির হাসান
বৃষ্টির নোট
১
দুইজোড়া ঠোঁট ঝাঁপ দিছিল
আগুনের গভীর দিকেতে!
নিজেগেরে পোড়ানোর
তামাশা যদিও তা-
বৃষ্টিতে ভিজার প্রস্তুতি এ যে
তারা কী জানত নি!
প্রথমত ও
শুরুর শুরুতে!
২
কোন দেশে বৃষ্টির লগে
বদল হয় বুলেটের!
কোন দেশে
রেলগাড়ি ভিজে ঘাসে ঘাসে
পোষা পায়রার সাথে মিলমিশে!
৩
আমার আয়না আমার সাথেতে
ঝামেলা পাকায় না
নিজের ভিতর আমারে দেখায় না
এরকম আয়না আর কার আছে
সে কয় ফয়সালা
করো গে বৃষ্টির সাথে!
দেখাক,
সে যদি তোমার রূপ
এক নজর পারে
দেখাইতে!
৪
স্বপ্ন রাজি হয়
সে দেখাইবে সোমবার রাতে
বৃষ্টির থোকার নিচে
ঝুলি থাকবে আঙুর থোকা
তার নিচে অশ্রæর থোকা
আমারে শুধু বলতে হবে
কোনটি
বেশি টলমল
করতেছে!
৫
না হয় আমি বাঁশির সুরই আমি, বাঁশি ন!
একবার যেই বাঁশিরতে বাইর হইছি
আর কি ফিরুম কালারং আগুনে পোড়া ফুটার ভিতর!
নির্বাসন
গ্রহণ করবা নি ফের জন্মভূমি, ও বাঁশি!
এইখানে শিকড়ছিঁড়া বৃষ্টি আর প্রজাপতিমেঘ দেখতে দেখতে
পথে হইল দেরি
তারা নাম দিল মোরে ভোলা নাথ!
বৃষ্টি শেষে তাদের সাথে আমারে নেয় না!
তারাও খেদায়ে দেয় দেখি!
৬
কলার ভেলাটা
যেন সে জাহাজ
বরষার বিলের জলে ভাসতেছে একা একা
যেন কাপ্তান তারে ছাড়ি চলি গেছে
যেন ধ্বংসাবশেষগুলি জড়ো হয় নাই এবে!
কোথায় কোথায় গিয়া ঠিকানাহীনার মতো ভাসতেছে!
লাশগুলি ভাসি উঠছে দূরে কোনো তীরে সন্ধ্যার
অন্ধকারে ষ্পষ্ট ন!
একা দুলতেছে
আর সামলাই নিতেছে
একটা জাহাজ ডুবির পর
সঙ্গ দিতেছে
নিরুপায়
বাড়ি খাওয়া ঢেউগুলি!
অন্ধকারের সমাধির কাছে
চুপচাপ আমি শুই পড়ি শালপাতার তলায়, আমি মিশি যাইতেই চাইছি এইখানে কোনো ধারণার সাথে দেখা হয় নাই আমার অন্তর পাকা ডেওয়া ফল হইতে পারত তবু আমি রইছি হ্যানে একটু অক্ষত আমি ধারণার মধ্যে তর্করে চটুল ঘোরাফেরা দেখতে পাইয়ে আরেকটু নিচে ঐদিকে প্রাচীন পুস্তক পচা কাদায় মিশতে আছে তার অক্ষরের কালির ভিতর গিয়া হাজির হয়েছি আমি যেন একটা ঘরে উদ্বৃত্ত চোখের আড়াল খুঁজছি কি না মনের সাথেই জিহাদ করতেছি আমি সম্ভবনা নিয়া ব্যস্ত রইব না গো! জাহাজ ডুবির পর তার গল্প পরিবারের কেহ না কেউ মনে রাখে সেই রকমের যেন হ্যানে কুহেলি মাখায়ে স্মরণের অতীতের মতো ছায়ার অনেক মধ্যে প্রকৃত ছায়ার কাছে আসতে চাহিছি বোধবুদ্ধির নামে আমি উপসংহারের নিচে লিখি রাখছি উল্টা করি ‘জেবা’!
দেবদারু বন তুমি শালের বনের কাছে চলি আসো।
এইখানে
সোজা করি দাও
মোর মনে ‘জেবা’
নতুন চান্দের মতো উলি উঠা ঐ নাম!
আব্বার কবর
পৃথিবীর যেই গ্রামে যাই
নীরবতা মোড়ানো আব্বার একখান গোর
জাগি উঠতে দেখি সহসাই
হাইনজাবেলার মুখবন্ধ আব্বার কবর!
সোনালু গাছের নীচে জঙ্গলের ঝিঁঝি পোকা
শিশির ঘাসেরা মিলিমিশি কাওয়ালি গায়
সবলরা এখনও মার চরম দিতেছে ধোঁকা
এ জগতে কোন বা ছুতায়, উনারে জানাই!
আমার বেদনা যদি ভাষা পায়
রক্তারক্তি কানায় কানায়
রোজ-কেয়ামত বাঝাই দিবেনে, ভয় নাই-
আব্বাজির কবরের নীরবতাগুলি আমারে থামায়!
অস্তিত্ব একটা ঝোপ তারে বুঝি কোপ দেয়া
বড়ই কঠিন বুঝলা জহির, কাটো তো এবে জাবর
সন্ধ্যাবেলায় কবর পাশ ফিরি শোয় আব্বার ভিতর!
ক্ষত
তোমার বাগানে আইলে
একটা গোলাপ ঝাড় দিয়া বাড়ি মারো তুমি
আমার পিঠে-
আমি মূর্ছা যাই!
গোলাপের বাড়ি
দাগ উলি উঠে
কাঁটায় পিঠ চিরা যায়!
দাগ উলি উঠে!
ফুলের আঘাত কাঁটার চিরা পাশাপাশি রয়!
কেউ কারো বন্ধু হয়?
তোমার চোখে চোখে থাকুক ওরা আহত সন্তানের মতো!
বুঝতেই তো পারো বেহুশ আমি
কোনটা আন্ধার কোনটা জোনাকি
গোলাই ফেলে সদা এই জহির!
এই বৃষ্টিতে আনাল হকের সাথে দেখা
কোনো কিছুর সত্যরে বাগে আনতে গেলে আমি আক্রমণ করি না। আমি ভালোবাসি। পাশে বসি। পাশে বসলে কোনো কিছু পাওয়া যায় না। আমি ভিতরে ঢুকি। ভিতরে সাধারণ কেউ ঢুকতে পারে না। আমি পাগল হই। আমি তোমার ভিতর যখন ঢুকি ৫ মাস থাকি নতুন ভূগোলে। তখন আমি পাগল। আমার নাম আমি পাল্টাই ফেলি। সত্যরে পাইতে গেলে
আনাল হকের সাথে দেখা করা লাগে। আনাল তোমার ভিতরের শেষ কামরায় থাকে। আমি সেই দিকে আগাইতে থাকি। আনাল হক আমার আসার খবর পাই নিজের রূপ পাল্টাই ফেলায়। শুধু তুমি জানো, আনাল হক কোন ভাবে ডুব দিই থাকে।
আমি তখন ছটফট করি। আমি দৃশ্য রূপে আনাল হকরে যাচনা করি।
তখন আমি পাগল থাকি না।
আমি পাগলের পাগল হই ।
আমি বৃষ্টির ভিতর ঝাঁপ দিই
তোমার বৃষ্টির ভিতর।
তোমার বৃষ্টির ভিতর
আনাল হক গোসল করতে আসবে
তাই আমি ওয়েট করি বৃষ্টির নিচে
কয়েক যুগ আমি ভিজি
একদিন দেখি
বৃষ্টির ভিতর ভিজতে আসছে
এক লক্ষ হাঁস
সবগুলি হাঁসই আনাল হক।
গায়েবি আওয়াজ হয়
একজনই আনাল হক
বৃষ্টির ভিতর বহু হওয়ার তার দায় আছে।
আমি বহু আনাল হকের ভিতর
প্রকৃত আনাল হকের সাথে ভাসি
বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে ভিজি দোলা খাই
তোমার ভিতর!
নাকি তোমার ভিতর!
বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থেকে পাঁচটি নির্বাচিত কবিতা
আবদুর রব
বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়
গোটা বর্ষাকাল কেটে গেল গ্রামের মাথায় একটা বন্ধ দোকানের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশে কাশফুল সাদা মেঘগুলি ভেসে গেল অনন্তের দিকে। অসংখ্য ভোর হলো পাখিদের ডাকাডাকি শুনে।
১৩/০৯/২০২০
ঢাকা
দৈত্যপুরী
এ চিন্তা কতটা আধ্যাত্মিক
তা বলতে পারব না তবে
আত্মা আছে, দৈত্যপুরীতে ঘুমিয়ে থাকা
রাজকুমারীর মতো; কখন আসবে
রাজার কুমার,
চোখের ওপর থেকে সুচগুলি তুলতে?
রাজকুমারীর সুপ্ত আত্মা
নিজেকেই অতিক্রম করে যায়–
নীৎসের প্রোটোপ্লাজম।
ঘুম নয়, ক্ষুধা নয়–
দুর্নিবার এক ইচ্ছাশক্তি,
ক্রমশ বিস্তৃত হয় প্রবৃদ্ধি ও সংযোজনের ভেতর দিয়ে।
তার কি একবারও মনে হয় না
সবকিছু এক ধরনের মূল্যায়ন,
ঘুমিয়েও বেঁচে থাকাটা একটা সীমাবদ্ধতা কিংবা
পছন্দসই ভিন্ন কিছু একটা হয়ে ওঠা!
০৯/১০/২০১৩
ঢাকা
শবদেহে চড়ে
পৃথিবীতে কত অদৃশ্য বীজ ভেসে বেড়ায়,
অঙ্কুুরিত হয় আর অলক্ষ্যে বিনাশ হয়
কে তার হিসাব রাখে?
জলে ফসফরাস জ্বেলে
কত নদী, কত স্রোত বয়ে যায়
অন্ধকারে,
আমরা তার কতটুকু জানি?
শৈশবে দক্ষিণে আমি যে স্কুলে পড়তাম
তার সামনে একটা নদী ছিল।
জোয়ার ভাটায় সে নদীতে
সহস্র কাহিনি ভেসে যেত:
শ্মশানঘাটের পোড়া কাঠ,
ভাঙা ঘর-চাল, মাটির কলস।
ভাসমান মৃত পশুর শবদেহে বসে
ঠোকরাতে ঠোকরাতে যেত শুকুনেরা।
তখন সে দৃশ্য ছিল খুবই স্বাভাবিক,
পৃথিবী পরিক্রমায় সেসব বিলীন—
নীরব স্মৃতি হয়ে থেকে গেল আমার সাথে।
এখন সেসব ভিন্ন মাত্রা পায়:
মৃত্যু হয়ে ওঠে স্মৃতি
আর স্মৃতি হয়ে ওঠে আত্মা;
শবদেহে চড়ে শবকে ভোজ বানিয়ে ভেসে যাওয়া…
১৫/১১/২০২০
ঢাকা
তরমুজ
তোমার ভেতরে আছে আধখানা রাত আর আধখানা দিন। তুমি তাই এতটা স্বাধীন। ইচ্ছা হলে ঘর অন্ধকার করে আলো জ্বেলে দিতে পারো কিংবা আলো নিবিয়ে দিনের কাছে ফিরে যেতে পারো।
ইচ্ছে হলে গারো পাহাড়ের ধারে কুঁড়ে তুলে তরমুজ ক্ষেতে পাহারা বসাতে পারো। তখন হয়তো বন্ধ হবে শেয়ালের আনাগোনা। কিন্তু তুমি পড়ে রবে কুঁড়েঘরে!
তোমার ভেতরে যে আলো ছিল তা নিবে যাবে অন্ধকারে!
১৬/০৮/২০২০
ঢাকা
অন্ধকারে টর্চ নিয়ে চলার নিয়ম
পুরানো দিনে গ্রামের মানুষেরা রাতে পথ চলতো কুপি, হারিকেন অথবা টর্চ জ্বালিয়ে।
অন্ধকারে টর্চ নিয়ে চলার নিয়ম: কারোর মুখে সরাসরি আলো ফেলা চলবে না। তবে পায়ে আলো ফেলা যেতে পারে। কিন্তু সব হাঁটুরের পা তো একই রকম! তাই পা থেকে সামান্য ওপরে টর্চের আলোয় আগন্তুক দেখা হয়, এটাই নিয়ম।
১৩/০৯/২০২০
ঢাকা