ভিন্সেণ্টের বাড়ির গাড়ি বারান্দায় বোগেনভেলিয়া উবু হতে হতে মাথা ছুঁয়ে দেয়ার মত, বেশ বড় কম্পাউণ্ডের বাসা, জনশূন্য। বিস্ময়কর রকমের পরিচ্ছন্ন আর গোছানো (এক্সপ্যাট্রিয়েটদের বাসা এরকম থাকে- পরে জেনেছে নিধি)। শির শির করা হাত পা কোথায় রাখবে শুরুতে বুঝে উঠতে পারে না নিধি।
কুমকুম শাদা কাউচে পা তুলে আসন পেতে বসে পড়েছে। ভিন্সেন্ট ড্রিংকস তৈরী করছে।
-‘রেড হোয়াইট ওয়াইন আছে, কোনটা খাবি?’ বলে কুমকুম নিজেই আবার বলে –‘রেড এ আমার হ্যাং ওভার হয়, তোর তো একদম অভ্যাস নাই, বরং হোয়াইট নে’।
নিধির কিছু বলার থাকে না। কুমকুম তাকে সেভেন আপ দিয়ে জিন এর গ্লাস ধরিয়ে দিলো।
কখনো মদ্যপান করবে নিধি ভাবেনি। গ্লাস হাতে ধরে তার কোন বিকারও হলো না দেখে নিজের কাছে সামান্য অবাকও মানে। গ্লাস আকঁড়ে থাকা হাতের আঙ্গুলগুলি বেশ স্বাভাবিক লাগে তার।
সিডি প্লেয়ারে মৃদু ভলিয়্যুমে গান বাজছে, কন্ঠ মৃদু নয়, মনে হচ্ছে কারো বুকের কাছটা মুচড়ে কষ্ট নিংড়ে নিয়েছে কেউ, গানগুলি তারই উদ্দেশ্যে। নিধি বসেছে সিডি প্লেয়ারের কাছাকাছি, সিডির মোড়কটা হাতে তুলে নেয়- নিনা সিমোন। আবেদার মত দেখতে মেয়েটি। তেমনি পুরু ঠোঁট, ঝকঝকে চোখের তারা।
-‘আই লাভ জ্যাজ,’ ভিন্সেন্ট নিজের ড্রিংক নিয়ে বসে সোফায়। ‘ নিনা ইজ ওয়ান অব মাই অল টাইম ফেভারিটস। যখন ওকে প্রথমবারের মত শ্রবণ করিয়াছিলাম…সি হ্যাজ কিল্ড মি এন্ড মেইড মি ফল ইন লাভ!’
ভিন্সেন্ট তারপর এই কালো জ্যাজ গায়িকার প্রতিষ্ঠার পেছনের সংগ্রামী গল্প বলে। কালো হবার কারণে মিউজিক কলেজের বৃত্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে, এবং পরে আমেরিকার জ্যাজ সঙ্গীতের ইতিহাসে তার নাম কি রকম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে।
বিদেশী সঙ্গীতের প্রসঙ্গে নিধি বিশুদ্ধ শ্রোতা। এই গায়িকার প্রতি টান জন্মে তার। সিডি উলটে পালটে তার নামের বানান ভালো করে দেখে রাখে।
ড্রিংস গ্লাস, বোতল দেখার অনভ্যস্থতায়ও নিধি নতুন কিছু অনুভব করে না, বরং কিছুটা নিস্পৃহ হয়ে জিনের গ্লাসে চুমুক দেয়। কুমকুমের জোড়াজুড়িতে সেদিন প্রথম সিগারেটে টান দেয়াও হয়ে যায় তার।
মাত্র দু’পিস বিফ ষ্টেক ওয়াইন আর হার্বস এ ম্যারিনেট করে রেখে গিয়েছিল ভিন্সেন্ট। নিধি আসবে তার জানা ছিল না। সে ফ্রিজ খুলে সসেজ আর চীজ বের করে।
-‘তোমার খাবার দাবার আমরা শেষ করিয়া যাইব’- কুমকুম টিপ্পনি কাটে।
-‘কোন অসুবিধা নাই, ডিপ্লোম্যাটিক কনটেইনারে আমার লাগেজ আসিবে, উহাতে আমার সারা বছরের খাবার দাবার আনাইয়া লই। আর তাহা ছাড়া সুন্দরীরা চাইলে আমি সর্বস্ব দিতে প্রস্তুত’, ভিন্সেন্ট কথা বলে মৃদ্যু স্বরে, বৃষ্টি থেমে গেলে নিঃশব্দ খড়ের চাল থেকে পানির ফোটা পড়ার মত অনেকটা ।
-‘আইচ্ছা ভিন্সেন্ট, থাকেন আপনি আমাদের দেশে, আর খানা খাইদ্য সর্বদা আনাইয়া লন, এর মাজেজা কি? আমাদের খানা কি এতই খারাপ?’ – কুমকুম তার বিপরীতে ততটাই উচ্চকিত।
-‘না না। তোমাদের খাবার অতি উপাদেয়, আর পোলাউ, বিরিয়ানী অত্যন্ত আভিজাত্যময়। ওনলি প্রব্লেম উহাতে অতিরিক্ত তৈল মশলা। আর ভেজাল’ দেখোনা কাগজে মোবাইল কোর্ট কিভাবে ভেজাল ব্যবসায়ীদিগকে ধরিতেছে!’
ভিন্সেণ্টের হাসিমুখের সামনে নিধি কথা খুঁজে পায়না, কিন্তু কুমকুম বল্গাহীন-
-‘আমরা যে সারাক্ষণ ভেজাল খাইতেছি! তোমার পেটের দাম আমাদের চেয়ে বেশী তাই না ভিন্সেন্ট’,- কুমকুমের ছুরিতে মাখন লাগানো, ভিন্সেন্টের অগত্যা হাসিমুখ।
খেতে বসে ভিন্সেন্ট এক লোভনীয় প্রস্তাব দেয়।
একটা পার্ট টাইম প্রজেক্ট ওয়ার্কের জন্য তার এক বন্ধু দু’জন লোক খুঁজছে, নারীগোত্রীয় হলে ভালো হয়, কেননা কাজটা মহিলাদের সঙ্গে এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ক। তাদেরকে ময়নার হাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ গিয়ে প্রশ্নমালা পূরণের কাজ করতে হবে।
কুমকুম এর গলার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে, সে হাত তুলে সারেন্ডারের ভঙ্গিতে বলে-‘বৎস ভিন্সেন্ট, আমি আর আমার সখী নিধি আছি এই কর্মের জন্য। কবে, কোথায়, কখন যোগদান করিতে হইবে?’
ডাইনিং টেবিলে নিধি সন্তর্পণে সেদ্ধ সসেজে কাটাচামচ গাঁথে, আড়চোখে কুমকুমকে দেখে নেয়। একটা টিউশানি খুঁজছিল সে। এরকম কোন কাজ করতে পেলে তো ভালোই হয়!
ভিন্সেন্টের বাড়িতে হয়তো এটা গেষ্টরুম। ঘরের নিচু ছাদ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আওয়াজহীন আরামেও নিধির ঘুম আসে না। ওয়াইনে সেদ্ধ গরুর মাংস মনে হচ্ছে পেটের ভেতর থেকে নড়বে না। জীবনে প্রথম মদ্যপান, গা গুলিয়ে বমিভাব হচ্ছে তার। টেবিলে রাখা জগের সব পানি খেয়ে শেষ করে নিধি। দু’ একবার কুমকুমের হাসি, কুকুরের ডাক কানে আসে। অনেক রাত অব্ধি ঘুম আসে না তার।
রাতের বন্ধুবৎসল ভিন্সেণ্টের খোলস থেকে কেজো মানুষ বেরিয়ে সকালবেলার নাস্তার টেবিলে। কফি তিতকুটে স্বাদে নিধি ইচ্ছেমত দুধ মেশায়।
ঠিক হয় তারা এখান থেকে প্রজেক্টের কাজটির জন্য বারবারা’র সঙ্গে দেখা করতে যাবে।
গুলশানের শুনশান রাস্তায় সকালের রোদ চোখ ঠিকরে ধেয়ে আসে, কুমকুমের কাঁধে চটের থলে, একটা রিক্সা বা বেবী ট্যাক্সীর খোঁজে হাঁটতে থাকলে গতকাল সন্ধ্যা থেকে আজকের সকাল নিধির কাছে স্বপ্নের মত লাগে। এ স্বপ্ন তাকে সামনে কোথাও ঠেলে দিয়েছে মনে হয়। ভালো লাগতে থাকে কুমকুমকে, ওর ঠেস, টিপ্পনি আর সঙ্গ।
নাহার মনিকা
উৎকর্ষের দিকে মনযোগী লেখকদের তালিকায় নাহার মনিকা একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নাম। ঈদসংখ্যা ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’-য় কবিতা দিয়ে নাহার মনিকা’র লেখা প্রকাশের শুরু। তারপর দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন দেশের জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাস নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ছয়।
উপন্যাস— ‘মন্থকূপ’ (বৈভব প্রকাশন, ২০১৯), ‘বিসর্গ তান’ (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ২০১৬)।
গল্পগ্রন্থ—‘দখলের দৌড়; ( পুথিনিলয় ২০১৯), ‘জাঁকড়’ (দিব্যপ্রকাশ, ২০১৪), এবং ‘পৃষ্ঠাগুলি নিজের (দিব্যপ্রকাশ, ২০১১)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ চাঁদপুরে আমাদের বর্ষা ছিল’(বাংলামাটি প্রকাশন)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Health Policy, Planning & Financing এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। বর্তমানে ক্যানাডা’র ক্যুবেক প্রদেশে সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত আছেন।
লেখালেখি নাহার মনিকা’র কাছে অপার স্বাধীনতার জগৎ, যেখানে লেখক একমেবাদ্বিতীয়ম।